গানের কথার দিকে খেয়াল করতে শিখছি কিছুটা পরে, তখন সুর আর কথাকে খানিক আলাদা করতেও পারছি। আর গান বেছে নিচ্ছি তখন, কী গাইতে চাই, কী গাইতে চাই না, সেই গ্রহণ-বর্জনে কথাকে আলাদা করে চিনছি, আর সেই প্রোসেসটা ধীরে ধীরে জরুরি হয়ে উঠছে। অন্যদিকে, সব কথা বুঝি না হয়তো, কিন্তু ভাবের টানেও গান বেছে নিই। বয়ঃসন্ধিকালে জগজিৎ সিং অমোঘ হয়ে ওঠেন। ‘বাত নিকলেগি তো ফির দূর তলক যায়েগি। লোগ বেওজহ’– কী করে জানব এই সব কথার মানে? শুনে শুনে গাই। কিন্তু ভাবটা ধরতে পারি। সুর আর কথা দিয়েই সেই ভাব তৈরি, তাও বুঝি। আর খুব আপন মনে হয়।
যতদূর স্মৃতি যায়, শুনতে পাই সুর আর কথার বুনন। আলাদা করতে পারি না তো। আমাদের পাহাড়ের বাড়ির টিনের চালে বৃষ্টি হত, তার একটা সুর ছিল, একটা ছন্দ। সেই বৃষ্টি কথা বলত যেন। সবটা মিলে একটা শব্দের জগৎ তৈরি হত। তারই মধ্যে মায়ের ডাক, রান্নাঘরে প্রেসার কুকারের হুইসল, রেডিওর খরখর শব্দ, অত দূর কলকাতা স্টেশনকে সহজে ধরা যায় না। বিকেলে হারমোনিয়াম বাজিয়ে রেওয়াজ করতে হয়, পাঁচ মিনিট মন্দ্র সপ্তকের ‘সা’, পাঁচ মিনিট ‘পা’, পাঁচ মিনিট তার সপ্তকের ‘সা’। রিপিট। আবার আবার আবার। তারপর একই জিনিস ‘আ আ আ আ’ করে। ভাল্লাগে না, ভাল্লাগে না, একেবারেই না। ঘড়ি টিকটিক করে, কিন্তু কাঁটা ঘোরেই না, আর সেই টিকটিক শব্দও রেওয়াজের সঙ্গে মিশে যায়। মাস্টারমশাই বকুলকাকু বা অবনীবাবু এলে তাঁদের গলার সঙ্গে গলা মেলাই, এক লাইন শুনি, সেই লাইন গাই। গানের কথা খাতায় লেখা থাকে, হারমোনিয়ামের ডালার ওপর খাতা খুলে রাখি। এইসব কথা, সুর, শব্দ, ছবি মিলে আছে একটা সময়ের ভিতরে, যখন কথা আর সুর আলাদা করার প্রয়োজন হত না। রেকর্ড প্লেয়ার চালিয়ে নিজে নিজেই গান শিখতাম। ঘুরে চলা ডিস্কের ওপর রেকর্ড চাপাই, বাজাই, থামাই, আবার বাজাই (প্লেয়ারের পিনের নিশ্চয়ই বারোটা বেজে যেতো!)। ‘মোর ঘুমঘোরে এলে মনোহর’। ফিরোজা বেগমের গলার সঙ্গে নিজের গলা মিশিয়ে গাওয়ার চেষ্টা করি। ‘শিয়রে বসি চুপি চুপি চুমিলে নয়ন’– কী গাইছি জানি না, কিন্তু দ্বিতীয়বার ‘শিয়রে বসি চুপি চুপি-ই-ই-ই-ই, চুমিলে-এ-এ -এ-এ-এ-এ-এ নয়ন’– এই সুরটা গলায় এসে যায় যখন, তখন, ব্যস! এবার আর একটা নতুন কিছু। ‘গগনভূষণ তুমি জনগনমনহারী’। এবার শিক্ষক সর্বাণী সেন।
গানের কথার দিকে খেয়াল করতে শিখছি কিছুটা পরে, তখন সুর আর কথাকে খানিক আলাদা করতেও পারছি। আর গান বেছে নিচ্ছি তখন, কী গাইতে চাই, কী গাইতে চাই না, সেই গ্রহণ-বর্জনে কথাকে আলাদা করে চিনছি, আর সেই প্রোসেসটা ধীরে ধীরে জরুরি হয়ে উঠছে। অন্যদিকে, সব কথা বুঝি না হয়তো, কিন্তু ভাবের টানেও গান বেছে নিই। বয়ঃসন্ধিকালে জগজিৎ সিং অমোঘ হয়ে ওঠেন। ‘বাত নিকলেগি তো ফির দূর তলক যায়েগি। লোগ বেওজহ’– কী করে জানব এই সব কথার মানে? শুনে শুনে গাই। কিন্তু ভাবটা ধরতে পারি। সুর আর কথা দিয়েই সেই ভাব তৈরি, তাও বুঝি। আর খুব আপন মনে হয়। ‘লোগ বেওজহ, উদাসী কা সবব পুঁছেঙ্গে’– এই যে ‘পুঁছেঙ্গে’ বলা, অস্ফুটে, সেখানে কথা আর সুর মিশে এক মায়া তৈরি হয়ে যায় মনের ভিতরে।
তারপর বহুকাল কেটে গিয়েছে। ক্রমে যে কথা বুঝেছি, তা হল, যা আমায় ঘিরে ছিল বরাবর আর আজও আছে, তা এক বহুস্তরীয় শব্দের জগৎ, আর আজীবন যা শেখার চেষ্টা করছি তা হল শ্রবণ। সমাজবিজ্ঞানী লেস ব্যাক বলেন, সমাজকে বোঝার জন্য, সময়কে বোঝার জন্য এবং সময়কে বদলানোর জন্য গভীরতম, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম শ্রবণের পাঠ নেওয়া প্রয়োজন। সেই পাঠ কোথা থেকে নেব? জীবন থেকে, যাপন থেকে।
প্রতুলদা, প্রতুল মুখোপাধ্যায়, সুর আর কথা দিয়ে আশ্চর্য এক শব্দের জগৎ তৈরি করতেন। যদি ভাবি ‘বাবরের প্রার্থনা’র কথা, সেখানে আজানের সুর মিশে যাচ্ছে শঙ্খ ঘোষের কথায়, সেই সুর কিছুটা ইলাস্ট্রেটিভ, কথাকে ফুটিয়ে তোলার কাজ করে সুর। তা যে আবেগের, অনুভবের জন্ম দেয়, তার একটা সর্বজনীনতা আছে। সন্তানের জন্য পিতার প্রার্থনা আমাদের অপেক্ষাকৃত সহজ ভাবে নাড়া দেয়। কিন্তু যদি ভাবি, চেক কবি মিরোস্লাভ হুলবের কবিতা অবলম্বনে ‘মৃত ভাষায় লেখা পাঠ্যপুস্তক’? সেখানে তো সুর এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে, দাঁড়িয়েই থাকে। কথাও একভাবে যেন এগতে পারে না, এগতে চায় না। কিন্তু কী একটা ঘন কালো ছায়া যে নেমে আসে পৃথিবীর ওপর, আমাদের অস্তিত্বের ওপর! আমাদের প্রত্যেককে গ্রাস করে নেয়। ‘একটি বালক/একটি বালিকা/ বালকটির একটি কুকুর আছে/ বালিকাটির একটি বিড়াল আছে/ কুকুরটির গায়ের রং কী?/বিড়ালটির গায়ের রং কী?/বালক-বালিকা একটি বল লইয়া খেলা করিতেছে/বলটি কোথায় গড়াইয়া যাইতেছে…’ এই এতক্ষণ স্রেফ দুটো নোটের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে সুর। ‘সা সা নি সা’। এই লাইন যা আমি একবার লিখছি, তা বারবার গাওয়া হয়। বারবার একই স্বর, কোনও ওঠানামা নেই। একজন বলছে, অনেকে বলছে। এই এক এবং অনেক সবই প্রতুলদা তাঁর কণ্ঠ দিয়ে ফুটিয়ে তোলেন। তিনি কণ্ঠ দিয়ে নানা নাটকীয় মুহূর্ত, সংলাপ তৈরি করতে পারতেন। এ কাজ যেমন আমার পক্ষে দুঃসাধ্য। আমার গানে, আমি যেমন মোনোক্রোম, আমার কথা সুরও তেমনই। সে যাই হোক, প্রতুলদার ‘মৃত ভাষায়’ এবার সুর এক ধাপ চড়ে। ‘বলটি কোথায় গড়াইয়া যাইতেছে?’ আবার নেমে আসে। ‘বলটি কোথায় গড়াইয়া যাইতেছে?’ ‘কোথায়? কোথায়? কোথায়?’ এখানে একটু সুর ওঠে নামে। প্রতুলদা এবার ‘উ উ উ উ উ’ করে একটা সুর ভাসিয়ে দেন বাতাসে। তীক্ষ্ণ সুর, যেন অশরীরী। আবার সেই ‘সা সা নি সা’-তে দাঁড়িয়ে প্রায় মৃতের গলায় জিজ্ঞেস করেন, ‘বালকটিকে কোথায় সমাধিস্থ করা হইল? বালিকাটিকে কোথায় সমাধিস্থ করা হইল?’ সমাধিস্থ? এই কথায় দারুণ আঘাত লাগে। তাহলে এদিকেই চলেছিল এই কথা আর সুর? এই মৃত্যুর দিকে? কেমন মৃত্যু? কেন মৃত্যু? বালক-বালিকার মৃত্যু? কেন? কেন? এবার আরও কঠিন প্রশ্নের পালা: ‘তোমরা নিজেরা কোথায় সমাধিস্থ আছো?’ এক ধাপ চড়ে একই প্রশ্ন, ‘তোমরা নিজেরা কোথায় সমাধিস্থ আছো?’ ‘কোথায় কোথায় কোথায়?’ তারপর আবার সেই অশরীরী ‘উ উ উ উ …’
এই মৃত সময়ে একটা গানের কথা মাঝে মাঝে মনে হয় আমার। খুলনার শিল্পী গুরুপদ গুপ্তের একটা গান ছিল, খুব জনপ্রিয় হয়েছিল এক সময়। ‘মানুষ, ও মানুষ, দুডো কান আর দুডো চোখ/ দেখবা আর শুনবা/ কিন্তু একটা মুখ তো! একটু কতা কম কবা। ’ সুরে বলা কথা, মজা করে বলা, আবার উচ্চারণে, সুরে, কথায় মজার আড়ালে অসহায়তা, অক্ষমতা আর শ্লেষ রাখা আছে। লেস ব্যাকের ভাষায় বলি, শব্দের আচ্ছাদন সরিয়ে শব্দের তলায় যে শব্দ তা শুনতে না পারলে, এই গানের শ্লেষ কানে ধরা পড়বে না। স্রেফ একটু মজা করা হবে আর কী, বাংলায় যাকে বলে ‘হ্যাভিং ফান’!
এমন সময়ে অতএব ক্লান্ত লাগে। একটা গান অনেক দিন আগে লিখেছিলাম, এখন বুঝি তা গাওয়ার সময় এসেছে। ‘অনেক হয়েছে কথা রাত্রিদিন নিদ্রাহীন/ অনেক হয়েছে গান ভুখমিছিল আকাশচিল/ অনেক হয়েছে চলা একলা পথ ভিন্ন মত/ অনেক হয়েছে মন/ আজকে তাই, থমকে যাই।’
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved