Robbar

মায়া ও সত্যের অপরূপ সম্মিলন

Published by: Robbar Digital
  • Posted:August 29, 2025 9:36 pm
  • Updated:August 29, 2025 9:39 pm  

আসলে ‘লুবলুর পৃথিবী’ আমাদের প্রত্যেকের দৃষ্টিভঙ্গিকে আতশকাচের তলায় ফেলতে চায়। বইয়ের পিছন-মলাটে লিখিত বিবরণে পাচ্ছি ‘দৃশ্যমান জগতের অস্তিত্ব অনুসন্ধান’… এককথায় এটাই লুবলুর মনোজগৎ। কাহিনির শুরুতেই আমরা প্রবেশ করি এই তরুণের স্বপ্নে। কিন্তু সেই স্বপ্ন ভেঙে যায় কিমের ফোনে। কিন্তু তথাকথিত ‘রিয়্যালিটি’তে কি আমরা পৌঁছই? পৌঁছলে কি বাঘচালিত মোটরভ্যানে উঠতে দেখতাম কিম-লুবলুকে! এ যেন একটা স্বপ্ন ভেঙে অন্য স্বপ্নে ঢুকে পড়া। নাকি তা নয়। আসলে এটাই বাস্তব!

বিশ্বদীপ দে

শব্দ ও ছবি। পাশাপাশি বসলে বহু দূরে চলে যেতে পারে। এ আমাদের কারও অজানা ‌নয়। বহু প্রাচীন কাল থেকেই মনের ভাব প্রকাশ করতে মানুষ ছবিও এঁকেছে। আবার লিখেছেও। কিন্তু আধুনিক পৃথিবীতে কমিক্স নামের এক শিল্পমাধ্যম এই দুইয়ের সমন্বয়ে দুনিয়া জয় করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে সিরিয়াসলি নিতে অনেকেই নারাজ। সুপারম্যান, ফ্যান্টম, স্পাইডারম্যানদের ‘শিশুতোষ’ বলে নাক সিঁটকানো লোকজনের সংখ্যা কম ‌নয়। অথচ আধুনিক পৃথিবীতে গ্রাফিক নভেলকে অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই আর। ক্রমশই দৃঢ় হচ্ছে তার অবস্থান।

নিল গাইম্যানের ‘স্যান্ডম্যান’ তো গত শতক থেকেই পাঠককে মাতিয়ে রেখেছে। ক’দিন আগেই কাফকার গল্পগুলির এক অনুপম মাঙ্গা চিত্ররূপ চোখে পড়েছিল। পড়তে পড়তে ভাবছিলাম, বাংলায় এমন কাজ কেন হচ্ছে না! অথচ সুকুমার রায় থেকে নারায়ণ দেবনাথ, ময়ূখ চৌধুরী হয়ে আজকের সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়– বাংলা কমিক্সেও অসামান্য সব শিল্পীরা এসেছেন। কিন্তু তাঁরা সংখ্যায় কম একথা মানতেই হবে। এহেন পরিস্থিতিতে হাতে এল ‘লুবলুর পৃথিবী’। বইয়ের ভিতরে থাকা বুকমার্কে লেখা ‘এমন কমিক্স বাংলায় আগে পড়েননি’। এই সদর্প উচ্চারণ প্রথম থেকেই পাঠক হিসেবে আমায় একটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে থাকে।

‘লুবলুর পৃথিবী’র মলাট নিশ্চিতভাবেই অভিনব। সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি। প্রথমে বলি, মলাট ওলটানোর পরে যে ছবি, সেটার কথা।

এক তরুণ ও তরুণী (পরে আমরা জানব এরা হল লুবলু ও তার বান্ধবী কিম) একটি মোটর চালিত ভ্যানরিকশা ধাঁচের গাড়িতে বসে রয়েছে। কিন্তু সেটাকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে একটি বাঘ! নিশ্চিতভাবেই এই ছবি পাঠককে প্রবলভাবে আকর্ষণ করবে। চার্বাক দীপ্ত শিল্পী হিসেবে কতটা অনবদ্য, সেটার প্রমাণ মলাটে রয়েছে। কিন্তু তা রয়েছে এই প্রথম পাতাতেও। এরপর যে ছবিটি নজরে আসে সেখানে উন্মুক্ত প্রান্তরে দাঁড়িয়ে রয়েছে লুবলু। আর তার সামনে আকাশে জ্বলজ্বল করছে সূর্যের মতো দীপ্যমান এক ঘড়ি। যার সময়বিন্দুগুলি এলোমেলো। ৩, ৬, ৯, ১২– সকলেই রয়েছে তাদের স্বাভাবিক অবস্থানের বিপ্রতীপে। এই দুই ছবি আমাদের বুঝিয়ে দেয় ‘লুবলুর পৃথিবী’ অন্যরকম কিছুই বলার চেষ্টা করছে।

কাহিনির ভিতরে প্রবেশ করলে সেটা আরও স্পষ্ট হয়ে যায়। লুবলু এক উদাসীন দার্শনিক। কিম তার বান্ধবী। দু’জনে মিলে চলেছে একটি ম্যাজিক শো দেখতে। পি. সি. সিংহ (জুনিয়র) নামক এক শ্মশ্রুগুম্ফময় জাদুকরের জাদু দেখতে চলেছে দু’জনে! পথে দেখা হল আরও দু’জনের সঙ্গে। একজন সিয়াম মাসি। অন্যজন কুনজুম গুলজামাল। প্রথমজন হিমালয়ের এক ছোট শহরের বাসিন্দা। কিন্তু একটি মোবাইল ভ্যানে করে মোমো বিক্রি করে বেড়ান নানা জায়গায়। তাঁর গাড়ির নাম ‘মোমো মিয়া’। গাড়ির গায়ে লেখা স্লোগান ‘মোমোস ক্যান চেঞ্জ দ্য ওয়ার্ল্ড’। আবার কুনজুম গুলজামাল হলেন এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। ভবঘুরে এই সেতার বাদক নাকি ভূত ধরে বেড়ান! তাঁর মুখ ঢেকে যায় চুলে। কাঁধে এসে বসে পোষা টিয়াপাখি। এগিয়ে চলে কাহিনি। কিন্তু তা আদপে কোনও রোমাঞ্চকর কাহিনিসূত্র ধরে এগয় না। সাধারণভাবে কমিক্স বা গ্রাফিক নভেলে ‘অ্যাকশন’ যেন প্রত্যাশিতই। সেই ধারণা নিয়ে এই বইয়ের পাতা ওলটালে আপনাকে হতাশ হতে হবে।

আসলে ‘লুবলুর পৃথিবী’ আমাদের প্রত্যেকের দৃষ্টিভঙ্গিকে আতশকাচের তলায় ফেলতে চায়। বইয়ের পিছন-মলাটে লিখিত বিবরণে পাচ্ছি ‘দৃশ্যমান জগতের অস্তিত্ব অনুসন্ধান’… এককথায় এটাই লুবলুর মনোজগৎ।

কাহিনির শুরুতেই আমরা প্রবেশ করি এই তরুণের স্বপ্নে। কিন্তু সেই স্বপ্ন ভেঙে যায় কিমের ফোনে। কিন্তু তথাকথিত ‘রিয়্যালিটি’তে কি আমরা পৌঁছই? পৌঁছলে কি বাঘচালিত মোটরভ্যানে উঠতে দেখতাম কিম-লুবলুকে! এ যেন একটা স্বপ্ন ভেঙে অন্য স্বপ্নে ঢুকে পড়া। নাকি তা নয়। আসলে এটাই বাস্তব! আমরাই দৈনন্দিনতার জাঁতাকলে পিষে গিয়ে অন্তর্দৃষ্টি হারিয়ে ফেলছি? লুবলুর চোখে আমরা নতুন করে এই চেনা জগৎকেই দেখি এক অচেনা বর্ণ-গন্ধ-স্পর্শের ভিতরে! প্রশ্নগুলি কাহিনির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পাশে চলতে থাকে।

সদ্য বাজারজাত এক ভি আর চশমা পরার পর লুবলু, কিম ও কুনজুমের চোখে চারপাশের জগৎ প্রত্যেকের চোখে আলাদা আলাদা ভাবে ফুটে উঠতে থাকে (সেই পাঁচ দৃষ্টিহীনের হাতি চেনার কাহিনি মনে পড়ে যায়, যা এই বইয়েও রয়েছে)। জাদুকর যে মায়ার কথা বলেন, সেই মায়াই যেন লুবলুদের চোখেও। বাস্তব-অবাস্তব, মায়া ও সত্যের এই অপরূপ সম্মিলন পাঠককে বশ করে ফেলে। আমরা দেখি, সেই অর্থে ঘটনার ঘনঘটা ছাড়াও একটি আখ্যান তৈরি হয়ে ওঠে। এবং পরিশেষে বোঝা যায়, এটি একটি সিরিজ হতে চলেছে। পরবর্তী সংখ্যায় ফের লুবলু-কিমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে আমাদের। তখন এই মায়াযাপন আরও নতুন থেকে নতুনতর পথে এগিয়ে চলবে।

চার্বাক দীপ্ত যে কাজ করেছেন তা সত্যিই অভিনব। একেকটি ফ্রেম যত্ন করে আঁকা। সেই ডিটেইলিং সময় নিয়ে না দেখলে পাঠকই ঠকবেন। যেমন একটি দৃশ্যে দেখি এক স্টেশনে ভিক্ষুককে ভিক্ষা দিতে দিতে সেলফি তুলে নিচ্ছে একজন। সামান্য দূরে এক জোকারের জাগলিং। এখানে কে অধিকতর বিদূষক, এই প্রশ্নই উঠে পড়ে। অথবা সেলফি তোলা মানুষটিরই প্রতিবিম্ব ওই জোকারের ইমেজ তৈরি করছে– এমনও হতে পারে। কেননা যে সেলফি তুলছে তার চেহারাটি কেবলই আউটলাইনে আঁকা! এমন উদাহরণ বইয়ের পাতায় পাতায়।

সংলাপেও রয়েছে দার্শনিকতার প্রবল উপস্থিতি। ‘ট্রেনেরা মানুষেরই মতো, না? শেষ গন্তব্যের দিকে যেতে যেতে নানা স্টেশনে দাঁড়ায়।’ লুবলুর এই কথার মতোই সিয়াম মাসিও বলেন, ‘প্রতি মুহূর্তের তুমি পরের মুহূর্তের তুমিকে জন্ম দিচ্ছে। তোমার মধ্যে তো সদ্যোজাত শিশুর উদ্দীপনা থাকা উচিত।’ স্টেশনের নাম কোথাও ‘কটাক্ষ’, কোথাও ‘প্যারাডক্স’ (এই স্টেশনেই ওই সেলফি তোলার দৃশ্য রয়েছে)। আর উদাহরণ দিচ্ছি না। বাকিটা পাঠকের জন্য তোলা থাক।

এবার মলাট। লুবলু তার অবিন্যস্ত ঘরের ভিতরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। জানলার বাইরে ময়ূর, আকাশে এরোপ্লেন, হিন্দিতে কী সব লেখা! ঘরের ভিতরে কোথাও গণেশের মূর্তি, কোথাও চে গেভারার ছবি, পাশে কাস্তে-হাতুড়ির পোস্টারও। দেওয়ালে নেপালি মুখোশ, বিচিত্র ঘড়ি (যার কথা আগেই বলেছি)। কম্পিউটার আছে, কিন্তু স্ক্রিনে ফুটে আছে ‘নো ইন্টারনেট’। লুবলুর হাতে ধরা অনেকগুলি বইয়ের মধ্যে একটিরই মলাট পড়া যাচ্ছে। সেখানে লেখা ‘প্যারাডক্স’। মেঝেতে রাখা ‘পলিটিক্স’ নামের বইটির ওপরে রাখা চায়ের কাপ (পলিটিক্স কি লুবলুর ‘কাপ অফ টি’?)। হারমোনিয়ামের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে অক্টোপাস-সদৃশ প্রাণী। এ কি অক্টোপাস নাকি এইচ পি লাভক্র্যাফট সৃষ্ট ‘খথুলু’ (এই মার্কিন সাহিত্যিকও আমাদের চেনা জগতের চৌহদ্দিকে চ্যালেঞ্জ করে কসমসের অনন্ত বিস্তারে গিয়ে পড়েছিলেন)! এমনই নানা এলোমেলো ইমেজারি পাঠককে চুপ করিয়ে বসিয়ে রাখে। বোঝা যায়, প্রতিটি খুঁটিনাটিকে সঙ্গে করেই চার্বাক নিজেকে তথা লুবলুকে পাঠকের সামনে তুলে ধরতে চাইছেন। প্রতিটিরই হয়তো রয়েছে নিজস্ব ব্যাখ্যা। কিংবা পাঠকও আলাদা করে ব্যাখ্যায় চলে যেতে পারেন। এমন প্রচ্ছদ আলাদা একটি লেখার দাবি জানায়।

টিনটিনের সাইজের একটি কমিক্স বই, যা সম্পূর্ণ রঙিন– তা ছাপতে আজকের বাজারে খরচ যে বিরাট, তা বুঝতে বইবাজারের সঙ্গে জড়িত না হলেও চলে। অথচ বইয়ের দাম সেই তুলনায় সামান্যই। দুর্দান্ত কাগজে ঝকঝকে ছাপা, ছাপার ভুলও চোখে পড়ল না। সব মিলিয়ে প্রকাশক ‘বুক ফার্ম’কে ধন্যবাদ দিতেই হয়। কিন্তু এত ভালোর মধ্যেও কি কিছু অন্য কথাও বলার নেই? আছে।

………………………….

ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার.ইন

………………………….

বইয়ের যে দার্শনিক সন্দর্ভ, তা কমবয়সি পাঠক-পাঠিকাদের কাছে অভিনব মনে হলেও একটু পোড় খাওয়া পাঠক কিন্তু কম বেশি এই দার্শনিকতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। পাঁচ হাতির গল্পের কথা আগেই বললাম। কিংবা একই নদীতে দু’বার স্নান না করতে পারার দার্শনিকতা। এমনও হতে পারে, প্রথম বই বলেই অপেক্ষাকৃত সহজ ও চেনা দর্শনের ভিতর দিয়ে গিয়েছেন চার্বাক দীপ্ত। পরের বইগুলিতে তিনি আরও গভীরে যাবেন, সহজতাকে উপেক্ষা না করেও কিঞ্চিৎ দুরূহ হবেন এই আশা রইল। তবে একথাটা মেনে নিতেই হয়, এমন কমিক্স (নাকি গ্রাফিক নভেল) আগে সত্যিই পড়িনি।

লুবলুর পৃথিবী
চার্বাক দীপ্ত
বুক ফার্ম
২৯৯ টাকা