প্রভিডেন্সের এক ছোট আদালতের এই ভিডিওগুলো রেকর্ড করা হয়েছিল স্থানীয় কেবল চ্যানেলের জন্য। পরে ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়ল– ‘Caught in Providence’ নামে। কয়েক কোটি মানুষ এই কোর্টরুমের দৃশ্য দেখল। একদিনে যে জিনিসগুলো ঘটে যায়, সেগুলো হয়ে উঠল বৈশ্বিক নৈতিক পাঠ। ক্যাপ্রিওর ইউটিউব ভিডিওয় একজন মা কাঁদছেন– ৫০০ ডলারের ফাইন মেটাতে গেলে তাঁর কাছে খাবার কেনার টাকাও থাকবে না। ক্যাপ্রিও সেই জরিমানা নামালেন, শেষে পুরোটা মুকুব করলেন। তিনি বললেন, ‘আমি আপনাকে মাত্র পাঁচ ডলার হাতে রেখে বাড়ি পাঠাতে পারি না।’ এই এক মুহূর্তেই বোঝা যায়, বিচার তাঁর কাছে ক্ষমতার প্রদর্শন নয়, মানবতা রক্ষা।
তিনি কোনও সাংবিধানিক বেঞ্চে বসেননি। কোনও দেশের ভাগ্যও নির্ধারণ করেননি। আমেরিকার রোড আইল্যান্ডের প্রভিডেন্স শহরের এক কোণে বসা সবচেয়ে সাধারণ আদালত– মিউনিসিপ্যাল কোর্ট ছিল তাঁর ক্ষেত্র। পার্কিং টিকিট, স্পিডিং, সিগনাল ভাঙা– মামলাগুলো ছিল তুচ্ছাতিতুচ্ছ। কিন্তু এমন মামলার ভিড়েই তিনি গড়ে তুলেছিলেন এমন এক নৈতিক জগৎ, যা ইউটিউবের সূত্রে ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা বিশ্বে।
২০২৫ সালের ২০ আগস্ট প্যানক্রিয়াটিক ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই শেষে চলে গেলেন ফ্রাঙ্ক ক্যাপ্রিও। বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। তাঁর রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার কোনও সুপ্রিম কোর্টের ভলিউমের চেয়ে বড়: আইনকে করুণার সঙ্গে, কর্তৃত্বকে নম্রতার সঙ্গে মিশিয়ে তিনি আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছিলেন– বিচারের মূল জোর ক্ষমতা নয়, ন্যায়পরায়ণতা।
অভিবাসীর সন্তান থেকে বিচারক
ফ্রাঙ্ক ক্যাপ্রিওর গল্প শুরু হয় রোড আইল্যান্ডের প্রভিডেন্স শহরে, ১৯৩৬ সালে। তাঁর বাবা আন্তোনিও ক্যাপ্রিও ছিলেন এক ইতালীয় অভিবাসী, দুধ বিক্রি করে সংসার চালাতেন। মা ছিলেন গৃহিণী। দারিদ্র আর বঞ্চনা ছিল শৈশবের পাঠশালা। তবু সেখানেই জন্ম নিয়েছিল সহানুভূতির শিকড়। ক্যাপ্রিও জানাতে ভোলেননি– ‘আমার বাবা সবসময় বলতেন, যেখানেই পারবে, মানুষকে সাহায্য করবে। নিজেকে তাদের জায়গায় ভেবে দেখো।’ এই সহজ মন্ত্রই পরিণত হয়েছিল তাঁর বিচার-দর্শনের ভিত।
তাঁর জীবন কোনও অভিজাত পথ ধরে এগোয়নি। স্থানীয় স্কুল, পরে নাইট স্কুলে পড়াশোনা– সেখান থেকে আইনজীবী, তারপর রাজনীতিতে ছোটখাটো পদ, শেষে বিচারপতি। একেবারে সাধারণ মানুষ, যিনি বসতেন একেবারে ছোট আদালতে– Providence Municipal Court। মামলাও তুচ্ছ: পার্কিং টিকিট, স্পিডিং, হেডলাইট নষ্ট, ট্রাফিক রুল ভঙ্গ। কিন্তু এখানেই তিনি দেখিয়েছিলেন, আইনের মর্যাদা কখনও মামলার আকারে নির্ভর করে না, নির্ভর করে বিচারকের নৈতিকতায়।
মামলার ভেতর মানুষ
প্রভিডেন্সের আদালত সাধারণ আমেরিকানের কাছে কোনও আলোচিত জায়গা ছিল না। কিন্তু ফ্রাঙ্ক ক্যাপ্রিও সেটিকে বানালেন মানুষের আস্থার জায়গা। ১৯৮৫ থেকে ২০২৩– প্রায় চার দশক তিনি বসেছিলেন বিচারকের আসনে।
এক বৃদ্ধ ভেটেরান, যিনি সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে গিয়েছিলেন, পড়লেন পার্কিং জরিমানায়। ক্যাপ্রিও জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কোথায় যাচ্ছিলেন?’ শুনলেন বৃদ্ধ আসছিলেন হাসপাতাল থেকে। ক্যাপ্রিও বললেন, ‘আপনাকে জরিমানা করা মানে আপনার সেবাকে অগ্রাহ্য করা।’ জরিমানা মুকুব।
এক কিশোর ছাত্র, যিনি সিগন্যাল ভেঙেছিলেন, তাঁকে শাস্তি দিলেন না। বললেন, ‘শর্ত একটাই, কলেজে ভর্তি হবে।’ জরিমানা মাফ করলেন।
৯৬ বছরের বৃদ্ধ, যিনি তাঁর অক্ষম ছেলেকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তাঁকে ‘স্পিডিং’ মামলায় ধরা হয়েছিল। ক্যাপ্রিও হাসলেন– ‘আপনি আমার নায়ক। এই মামলা খারিজ।’
এমন অসংখ্য ঘটনা আছে। এগুলো নিছক আবেগতাড়িত উদাহরণ নয়। এগুলো ছিল এক দার্শনিক ঘোষণা: আইন যদি কেবল কঠোরতার যন্ত্র হয়, তবে তা অন্যায়কে ন্যায়ের ছদ্মবেশে টিকিয়ে রাখে। আর যদি করুণার সঙ্গে মেশে, তখনই তা ন্যায় হয়ে ওঠে।
কোর্টরুম থেকে বৈশ্বিক পাঠ
প্রভিডেন্সের এক ছোট আদালতের এই ভিডিওগুলো রেকর্ড করা হয়েছিল স্থানীয় কেবল চ্যানেলের জন্য। পরে ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়ল– ‘Caught in Providence’ নামে। কয়েক কোটি মানুষ এই কোর্টরুমের দৃশ্য দেখল। একদিনে যে জিনিসগুলো ঘটে যায়, সেগুলো হয়ে উঠল বৈশ্বিক নৈতিক পাঠ।
ক্যাপ্রিওর ইউটিউব ভিডিওয় একজন মা কাঁদছেন– ৫০০ ডলারের ফাইন মেটাতে গেলে তাঁর কাছে খাবার কেনার টাকাও থাকবে না। ক্যাপ্রিও সেই জরিমানা নামালেন, শেষে পুরোটা মুকুব করলেন। তিনি বললেন, ‘আমি আপনাকে মাত্র পাঁচ ডলার হাতে রেখে বাড়ি পাঠাতে পারি না।’ এই এক মুহূর্তেই বোঝা যায়, বিচার তাঁর কাছে ক্ষমতার প্রদর্শন নয়, মানবতা রক্ষা।
এই ভিডিওগুলো বিশ্বে এত জনপ্রিয় হল কারণ, এগুলো দেখাল– আইনের ভয়ংকর দুনিয়াতেও মানবিকতার জায়গা আছে। যেখানে আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট বা কংগ্রেস অচলাবস্থায় আটকে থাকে, সেখানে প্রভিডেন্সের এক সাধারণ কোর্ট বিশ্বকে শিখিয়ে দেয় ন্যায়ের সহজতম পাঠ।
ভারতের আয়নায় ফ্রাঙ্ক
ক্যাপ্রিওর আদালতের এই দৃশ্য ভারতের আদালতের সঙ্গে তুললে ফারাকটা প্রকট। এখানে বিচার-প্রক্রিয়া আড়ম্বরপূর্ণ, জটিল এবং প্রায়শই নিষ্ঠুর। কোটি কোটি মামলা ঝুলে আছে। বিচার ছাড়াই মানুষ দশকের পর দশক জেলে কাটাচ্ছে। মামলার খরচে পরিবারগুলো দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে। আদালতের ভেতরে প্রক্রিয়া এতটাই জটিল যে নাগরিকের কাছে বিচার হয়ে উঠছে আতঙ্ক।
ক্যাপ্রিও যেখানে জরিমানার উদ্দেশ্যকে মানবিকতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখেছিলেন, ভারতীয় আদালত সেখানে প্রক্রিয়াগত কঠোরতাকেই ‘নিরপেক্ষতা’ বলে চালিয়ে দিচ্ছে। ফলে তৈরি হচ্ছে গভীর বিশ্বাস-সংকট।
গৌতম ভাটিয়া তাঁর ‘The Transformative Constitution’ এবং সাম্প্রতিক প্রবন্ধগুলোতে দেখিয়েছেন, ভারতীয় বিচারব্যবস্থা কেবল অবকাঠামোর সমস্যায় জর্জরিত নয়, এর মধ্যে আছে নৈতিক দুর্বলতা। আদালত প্রায়ই মৌলিক অধিকারের ভাষায় মহৎ রায় দেয়– গোপনীয়তা, সমতা, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা নিয়ে– কিন্তু বাস্তবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সামনে নতি স্বীকার করে। কাশ্মীরে ইন্টারনেট বন্ধ থাকুক বা প্রতিরোধমূলক আটক, আদালতের প্রতিক্রিয়া হয় দেরিতে, হয় নীরব। ভাটিয়ার মতে, আদালত অনেক সময় হয়ে দাঁড়ায় রাষ্ট্রের ‘stenographer’– ক্ষমতাসীনদের ভাষাকে আইনের ভাষায় অনুবাদ করার যন্ত্র।
এই দ্বিচারিতাই আমাদের সবচেয়ে অস্বস্তিকর সত্য। নাগরিকরা আদালতে প্রবেশ করে ভয় নিয়ে, আস্থা নিয়ে নয়। বিচার তাঁদের কাছে সুরক্ষা নয়, ক্ষমতার প্রতীক হয়ে ওঠে।
অদৃশ্য নাগরিক, দৃশ্যমান আদালত
ভারতীয় আদালতের কাঠামো এখনও ঔপনিবেশিক মর্যাদার ভঙ্গিতে চলে। উঁচু আসনে বসা বিচারক, সাবেক পোশাক, ইংরেজি ভাষার প্রাচীর– সবই নাগরিককে মনে করায় আইন তাঁর জন্য নয়, তাঁর ওপরে। ক্যাপ্রিও এই কাঠামোকে উল্টে দিয়েছিলেন। মামলাকারীকে তিনি সমান ভাবে বসাতেন, সহজ ভাবে বলতেন– ‘আমি আপনাদের জন্য কাজ করি।’ এই বাক্য আজও আমাদের কল্পনাতেও আসে না।
ভারতীয় আইনের শাস্তিমূলক চরিত্র কাঠামোগত। জামিনের টাকা না থাকায় মানুষ বছরের পর বছর জেলে পচে। ছোটখাটো অপরাধে জরিমানা পুরো জীবিকা ধ্বংস করে দেয়। আদালত ফলাফলের বদলে প্রক্রিয়া দেখে। অথচ ক্যাপ্রিওর আদালতে প্রশ্ন ছিল– ‘এই শাস্তি মর্যাদা ফিরিয়ে দিচ্ছে, নাকি আরও ভাঙছে?’ বিচার তাঁর চোখে দায়বদ্ধতা আর করুণার মিশ্রণ।
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট প্রায়ই নিজেকে জাতির বিবেক বলে প্রচার করে। টিভিতে শুনানি, বিশাল রায়, আনুষ্ঠানিক বক্তৃতা– সবই আছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের আদালতে দেরি, অস্বচ্ছতা, অপমান প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা। প্রতাপ ভানু মেহতা লিখেছেন– প্রতিষ্ঠান ব্যর্থ হয় ক্ষমতার অভাবে নয়, নৈতিক স্পষ্টতার অভাবে। ক্যাপ্রিওর আদালত ছিল ছোট, কিন্তু মানুষকে শোনার অভিজ্ঞতা দিত। আমাদের আদালত বিশাল, কিন্তু সেখানে প্রায় অদৃশ্য নাগরিকই।
ভুলে যাওয়া পাঠ
ক্যাপ্রিওর উত্তরাধিকারের কেন্দ্রে আছে নম্রতা। তিনি বারবার বলতেন– ‘আমি আপনাদের জন্য কাজ করি।’ ভারতীয় বিচার-ব্যবস্থায় এই বাক্য অকল্পনীয়। বিচারপতিরা খুব কমই ভুল স্বীকার করেন, ভুল কারাবাসের জন্য ক্ষমা চান না। অথচ গণতন্ত্রে ক্ষমতা মানে সেবা, মহিমা নয়।
ফ্রাঙ্ক ক্যাপ্রিওর মৃত্যু আমাদের মনে করিয়ে দিল, করুণা ছাড়া আইন নিছক নিষ্ঠুরতার সমান। তাঁর ছোট আদালত দেখিয়েছে– সহানুভূতি, নম্রতা, পুনরুদ্ধার বিচারকে কীভাবে মর্যাদা দেয়। ভারতীয় বিচার-ব্যবস্থা, সাংবিধানিক মহিমা সত্ত্বেও, এই পাঠ বহুবার ভুলেছে।
ভারতের দরকার আর একটি চমকদার রায় নয়। দরকার এমন বিচারকদের, যারা মনে রাখবেন– পোশাক পবিত্র করে না, ক্ষমতা ফাঁপা যদি তা নম্রতার সঙ্গে না মেলে।
ফ্রাঙ্ক ক্যাপ্রিওর উত্তরাধিকার আমাদের জন্য এক আয়না। আর সেই আয়নায় ভেসে ওঠে আমাদের অস্বস্তিকর সত্য: আমরা আজ কী, তা নয়– আমরা কী হতে ভুলে গেছি।
………………………….
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার.ইন
………………………….
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved