মধ্যযুগে খ্রিস্টধর্ম পেঁচাকে করে তুলল পাক্কা ভিলেন। খ্রিস্ট ছিলেন আলো আর সত্য। পেঁচা ছিল অন্ধকার আর মিথ্যা। পাদ্রীদের প্রচারে পেঁচা হয়ে উঠল আধ্যাত্মিক অন্ধত্বের টোটেম। ইউরোপের লোককথায় পেঁচা শয়তানের রূপ। বিশ্বাস করা হত, ডাইনিরা পেঁচা হয়ে উড়ে বেড়ায়, শিশুদের রক্ত চুষে খায়। জানালায় বসে পেঁচা ডাকলে ধরে নেওয়া হত, ডাইনি নজরে রেখেছে। তাই ডাইনি পুড়িয়ে মারার সময় পেঁচাদেরও ঝলসে মারা হত আগুনে। তবে মারা নিয়ে দ্বিমত না থাকলেও পোড়ানোর ব্যাপারটায় দ্বন্দ্ব ছিল। সেটা অবশ্য পশুপাখি প্রেমের জন্যে নয়, মানুষের নিজের স্বার্থে। ইংল্যান্ডে মানুষ মৃত পেঁচাকে পেরেক দিয়ে গোয়ালঘরের দরজায় ঝুলিয়ে রাখত বজ্রপাত বা অশুভ শক্তির প্রকোপ থেকে মুক্ত হতে।
২০.
অন্ধকার যখন প্রায় সবকিছু গিলে ফেলেছে তখন পিন ড্রপ সায়েলেন্সের বুক চিরে হঠাৎ একটা অদ্ভুত শব্দ হল। শ্মশানের হাড় হিম করা নিশির ডাকের মতো। যাঁরা ডাকটা চেনেন তাঁরা হলফ করে বলতে পারবেন কাছাকাছি নিশ্চয়ই কোথাও একটা পেঁচা বসে আছে। জ্বলে ওঠা দুটো চোখ দিয়ে অন্ধকার জরিপ করতে করতে সে মিলনের সন্দেশ পাঠাচ্ছে সঙ্গীকে, বলছে এই সেই অমোঘ ক্ষণ, কাছে এসো। অথবা হয়তো খোঁজ নিচ্ছে চোখের আড়াল হওয়া সন্তানের। কিংবা আর্ত চিৎকারে সজাগ করছে বাকিদের, আসন্ন বিপদ সম্পর্কে। কারও কাছে সে শুধু রাতের শিকারি পাখি, কিন্তু কারও কারও কাছে পেঁচা ভয়ংকরের বার্তাবাহকও। স্বয়ং মৃত্যুর দূত!
হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে পেঁচা বসে আছে অশুভের প্রতীক হয়ে মানুষের কল্পনায়। আকাশের কালো ক্যানভাসে তার নীরব উড়ান আর রাত্রির বুক চিরে আসা ছমছমে ডাক, তাকে বানিয়েছে অপয়ার প্রতীক। পৃথিবীর কুসংস্কারের কাহিনিতে পেঁচা তাই আজও রয়েছে জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে।
কিন্তু ঠিক কোথা থেকে আমদানি হল এই ভয়ের? কেন পৃথিবীর এতগুলো সভ্যতার কাছে অশুভ হয়ে উঠল নিরীহ একটা রাতপাখি? উত্তর বোধহয় রয়েছে অতীতের গভীরে, সভ্যতার আদি অধ্যায়ে। তখন বিজ্ঞান ছিল না, আলো ছিল না, শহর ছিল না। রাত মানে শুধু ছিল জন্তু, ভয় আর আতঙ্কের দুনিয়া। বেচারা পেঁচার এর মধ্যে দোষ ছিল একটাই। অন্ধকারে তাঁকে স্পষ্ট দেখা না গেলেও সে নিজে দেখতে পেত সব কিছু। তাই গুহাচিত্রে, প্রাচীন আচার-অনুষ্ঠানে, পেঁচা রয়ে গেল পাতালপুরীর প্রহরী আর মৃত্যুর দূত হয়ে। নিশাচর বলে মানুষ তাকে ভেবেছিল সে নশ্বর দুনিয়ার কেউ নয়, নেহাতই অন্য জগতের। তার অদ্ভুত চ্যাপ্টা মুখ, আগুনের মতো চোখ, আর নিঃশব্দ উড়ান মানুষকে দিয়েছিল অস্বস্তি। সৌন্দর্যের চালু সজ্ঞায় কোনও দিন বাঁধা যায়নি তাকে।
প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় পেঁচা ছিল মৃত্যুর দেবতাদের সঙ্গী। মিশরে সমাধির কাছে ছিল তাদের স্থান। রোমানরাও প্রায় পাগল ছিল তাদের ভয়ে। প্রখ্যাত রোমান প্রকৃতিবিদ প্লিনি দ্য এল্ডার তাঁর ‘ন্যাচারাল হিস্টরি’ গ্রন্থে পেঁচাকে বলেছেন– ‘রাতের দানব’। তাদের বিশ্বাস ছিল, কোনও ঘরের ছাদে বসে পেঁচা ডাকলে সেই বাড়িতে মৃত্যু আসন্ন। তাই মৃত পেঁচাদেরই উল্টে পেরেক দিয়ে টাঙিয়ে রাখা হত দরজায় অশুভকে দূর করার তাগিদে। রোমান সম্রাটরাও রক্ষা পাননি এর থেকে। গল্পে আছে, জুলিয়াস সিজারের হত্যার আগে রোমে হঠাৎ কোনও একদিন দুপুরে একটা পেঁচা ডেকে উঠেছিল। অগাস্টাসের মৃত্যুর পূর্বলক্ষণও নাকি ছিল একই, সেই পেঁচা।
মেক্সিকোর তেওতিহুয়াকান সভ্যতায় পেঁচা ছিল ঝড়, বজ্রপাত, আর বলিদানের দেবতার সঙ্গী। তারাও ছিল মৃত্যুর দূত। চিনের তাং রাজবংশেও প্রচলিত ছিল এই ভয়ংকর বিশ্বাস, পেঁচারা নিজেদের মাকে খেয়ে ফেলে! এই ভয়ংকর ধারণা কনফুসীয় সমাজে স্বাভাবিকভাবেই পেঁচাকে করেছিল ‘পাখি পাপি মাকে খায়’-এর মতো গোলমেলে। যুক্তিও ছিল খুব পরিষ্কার। সন্তান যদি মাকে খেয়েই ফেলে, তবে তো সে নির্ঘাত নরকের প্রাণী। আমেরিকার প্রেইরি অঞ্চলে, নাভাহো ও অ্যাপাচি উপজাতিদের মধ্যে পেঁচা হল নির্ভেজাল মৃত্যুর আত্মা। কথিত আছে, দুষ্ট শামানরা রূপ বদলে পেঁচা হয়ে আসে মানুষের ক্ষতি করতে। তাদের ডাকে শোনা যায় মৃত্যুর বার্তা।
আফ্রিকায় পেঁচা মানে জাদুবিদ্যার সঙ্গী। ডানা মেলে তারা যখন নিঃশব্দে উড়ে যেত, মানুষ দৃষ্টি আড়াল করত তাদের প্রেতাত্মা ভেবে। বাড়ির ছাদে পেঁচা বসলে মনে করা হত, রোগ, অমঙ্গল বা মৃত্যু ঠেকাতে পারবে না কেউ। ক্রমেই মানুষ যখন পৃথিবী জুড়ে ভ্রমণ করল, যুদ্ধ করল, বাণিজ্য করল, এই বিশ্বাস ছড়িয়ে পড়ল আরও বেশি।
…………………………………..
মেক্সিকোর তেওতিহুয়াকান সভ্যতায় পেঁচা ছিল ঝড়, বজ্রপাত, আর বলিদানের দেবতার সঙ্গী। তারাও ছিল মৃত্যুর দূত। চিনের তাং রাজবংশেও প্রচলিত ছিল এই ভয়ংকর বিশ্বাস, পেঁচারা নিজেদের মাকে খেয়ে ফেলে! এই ভয়ঙ্কর ধারণা কনফুসীয় সমাজে স্বাভাবিকভাবেই পেঁচাকে করেছিল ‘পাখি পাপি মাকে খায়’-এর মতো গোলমেলে। যুক্তিও ছিল খুব পরিষ্কার। সন্তান যদি মাকে খেয়েই ফেলে, তবে তো সে নির্ঘাত নরকের প্রাণী। আমেরিকার প্রেইরি অঞ্চলে, নাভাহো ও অ্যাপাচি উপজাতিদের মধ্যে পেঁচা হল নির্ভেজাল মৃত্যুর আত্মা। কথিত আছে, দুষ্ট শামানরা রূপ বদলে পেঁচা হয়ে আসে মানুষের ক্ষতি করতে। তাদের ডাকে শোনা যায় মৃত্যুর বার্তা।
…………………………………..
মধ্যযুগে খ্রিস্টধর্ম পেঁচাকে করে তুলল পাক্কা ভিলেন। খ্রিস্ট ছিলেন আলো আর সত্য। পেঁচা ছিল অন্ধকার আর মিথ্যা। পাদ্রীদের প্রচারে পেঁচা হয়ে উঠল আধ্যাত্মিক অন্ধত্বের টোটেম। ইউরোপের লোককথায় পেঁচা শয়তানের রূপ। বিশ্বাস করা হত, ডাইনিরা পেঁচা হয়ে উড়ে বেড়ায়, শিশুদের রক্ত চুষে খায়। জানালায় বসে পেঁচা ডাকলে ধরে নেওয়া হত, ডাইনি নজরে রেখেছে। তাই ডাইনি পুড়িয়ে মারার সময় পেঁচাদেরও ঝলসে মারা হত আগুনে। তবে মারা নিয়ে দ্বিমত না থাকলেও পোড়ানোর ব্যাপারটায় দ্বন্দ্ব ছিল। সেটা অবশ্য পশুপাখি প্রেমের জন্যে নয়, মানুষের নিজের স্বার্থে। ইংল্যান্ডে মানুষ মৃত পেঁচাকে পেরেক দিয়ে গোয়ালঘরের দরজায় ঝুলিয়ে রাখত বজ্রপাত বা অশুভ শক্তির প্রকোপ থেকে মুক্ত হতে।
সাহিত্যর প্রসারে এই কুসংস্কার আরও পাকাপোক্ত হল। বাইবেলে ধ্বংসস্তূপের সঙ্গে পেঁচাদের উল্লেখ করা হয়েছে, যেন তারা সর্বনাশের সাথী। ‘ম্যাকবেথ’-এ ডানকানের হত্যার রাতে শোনা যায় পেঁচার ভয়াবহ ডাক। জুলিয়াস সিজার-এ দিনের বেলায় পেঁচা ডাকে, আর তার পরেই ঘটে হত্যাকাণ্ড। ইংরেজ দর্শক আসলে জানত, পেঁচা ডাকছে মানেই মৃত্যু আসছে। রেনেসাঁ আর এনলাইটেনমেন্টের যুগেও বিজ্ঞানের বাড়বাড়ন্ত হওয়া সত্ত্বেও কুসংস্কার গেল না। ভিক্টোরিয়ান যুগে গোয়াল ঘরে ঝোলানো ট্যাক্সিডার্মি করা পেঁচা এতটাই জনপ্রিয় হল যে, ইউরোপীয় ভয় মিশে গেল আফ্রিকান আর আমেরিকান বিশ্বাসের সঙ্গে।
জাপানেও পেঁচা মানে বিপদ। তাদের ডাকে শোনা যেত মানুষের কান্না। মধ্যপ্রাচ্যে পেঁচা বাইবেলের মতোই ভগ্নপ্রায় ধ্বংসস্তূপে বসে থাকা মৃত্যু। তবে সব জায়গায় তাকে দাগিয়ে দেওয়া যায়নি ‘অপয়া’ বলে। গ্রিক দেবী এথেনার সঙ্গী হিসেবে তার প্রাচীন ইতিবাচক রূপের কথাও ভুলে গেলে চলবে কেন। ভারতবর্ষে মা লক্ষ্মীর বাহন হিসেবেও সে পূজিত।
সমাজে পেঁচা-কুসংস্কার দিয়েছে আরেকটি বোঝা– নারীদের ওপর অত্যাচার। ডাইনির সঙ্গে পেঁচার নাম জুড়ে দিয়ে নারীদের সহজেই বানানো হয়েছে শত্রু। দারিদ্র পীড়িত দেশে পেঁচা হয়েছে বলির পাঁঠা। শিশু মারা গেলে, ফসল নষ্ট হলে, রোগ ছড়ালে– যদি পেঁচা দেখা যায়, তারাই শেষমেশ দোষী। হাজার বছরের পুরনো এই বিশ্বাস কিন্তু আজও বহু জায়গায় টিকে আছে। কারণ, হয়তো আমরা মৃত্যুকে, অন্ধকারকে, অজানাকে আজও ভয় পাই। পেঁচা সেই ভয়ের প্রতীকই হয়ে রয়ে গেছে। তার ডাক আজও মানুষকে মনে করিয়ে দেয়, আমরা ক্ষণস্থায়ী। কে জানে কেন আজও গভীর রাতে পেঁচার ডাক শুনলে অনেকেরই বুকের ভেতরে নড়ে ওঠে কিছু একটা। হয়তো কৌতূহল। হয়তো আতঙ্ক। হয়তো পূর্বপুরুষদের সেই প্রাচীন স্মৃতি, যখন তারা আঁধারে বসে ভেবেছিল– ছায়ার ভেতরেও পাখিটা শিকার করছে কীভাবে।
…………………………..
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার.ইন
…………………………..
তাই পেঁচা এখনও সেই গল্পই বলছে। অর্ধেক বাস্তব, অর্ধেক অলীক। একদিকে জ্ঞানের প্রতীক, অন্যদিকে মৃত্যুর দূত। তার ডানা হয়তো নিঃশব্দ কিন্তু তার কিংবদন্তি গর্জন করছে আজও। মনে করিয়ে দিচ্ছে, প্রকৃতি আর অলৌকিকের মাঝের সীমানা খুব সূক্ষ্ম। আর সেই সীমানা পেরিয়ে যেতে লাগে শুধু একটা জিনিস– অন্ধবিশ্বাস।
……………..অপয়ার ছন্দ অন্যান্য পর্ব……………..
পর্ব ১৯। রাতে, ঝাঁটা নিয়ো না হাতে
পর্ব ১৮। তিল থেকে তাল
পর্ব ১৭। অন্ধবিশ্বাস মাথাচাড়া দিলে ‘অপয়া’ হয় মাথায় হাত
পর্ব ১৬। চুল তার কবেকার অন্ধকার অপয়ার নিশান
পর্ব ১৫। যে আত্মীয়তার ডাককে অপয়া বলে বিকৃত করেছে মানুষ
পর্ব ১৪। অকারণে খোলা ছাতায় ভেঙে পড়েছে পাবলিক প্লেসে চুমু না-খাওয়ার অলিখিত আইন
পর্ব ১৩। দলবদলু নেতার মতো ধূমকেতু ছুটে চলে অনবরত
পর্ব ১২। কখনও ভয়ংকর, কখনও পবিত্র: দাঁড়কাক নিয়ে দোদুল্যমান চিন্তা!
পর্ব ১১। শুধু একটা হ্যাঁচ্চো– বলে দেবে কীভাবে বাঁচছ
পর্ব ১০। অপয়ার ছেলে কাঁচকলা পেলে
পর্ব ৯। চোখের নাচন– কখনও কমেডি, কখনও ট্র্যাজেডি!
পর্ব ৮। জুতো উল্টো অবস্থায় আবিষ্কার হলে অনেক বাড়িতেই রক্ষে নেই!
পর্ব ৭। জগৎ-সংসার অন্ধ করা ভালোবাসার ম্যাজিক অপয়া কেন হবে!
পর্ব ৬। প্রেম সেই ম্যাজিক, যেখানে পিছুডাক অপয়া নয়
পর্ব ৫। ডানা ভাঙা একটি শালিখ হৃদয়ের দাবি রাখো
পর্ব ৪। জন্মগত দুর্দশা যাদের নিত্যসঙ্গী, ভাঙা আয়নায় ভাগ্যবদল তাদের কাছে বিলাসিতা
পর্ব ৩। পশ্চিম যা বলে বলুক, আমাদের দেশে ১৩ কিন্তু মৃত্যু নয়, বরং জীবনের কথা বলে
পর্ব ২। শনি ঠাকুর কি মেহনতি জনতার দেবতা?
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved