Robbar

বেশিক্ষণ চেপে রাখতে পারি না!

Published by: Robbar Digital
  • Posted:September 10, 2025 7:49 pm
  • Updated:September 10, 2025 7:49 pm  

প্রকাশ্যে মূত্রত্যাগ করার মধ্যে প্রশাসনের সঙ্গে একরকমের লুকোচুরি খেলার ব্যাপার আছে। ছোটবেলায় শেখা খেলা তো বড়বেলাতেও থেকে যায় মনের গভীরে। জানি অপরাধ করছি। তার সঙ্গে এটাও জানি, এই খেলায় জিতব আমিই। নিয়ামকের বিরুদ্ধে নিজের তৈরি করা খেলায় নিজেই জিতে এক অদ্ভুত ধরনের আনন্দ পাই আমরা।

অম্লানকুসুম চক্রবর্তী

লালমোহনবাবুকে যদি বাসস্ট্যান্ডে বসিয়ে রাখা যেত ঘণ্টাখানেক, রাস্তার ৫০ শতাংশ লোককে দেখেই হয়তো বলে উঠতেন, ‘হাইলি সাসপিশাস!’ জীবনের এই স্বল্প সময়ে কাকে ছেড়ে যে কাকে কালটিভেট করা উচিত, তা বুঝে উঠতে পারতেন না।

উত্তর কলকাতার ব্যস্ত রেলওয়ে স্টেশন লাগোয়া অতিব্যস্ত রোল কর্নার। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামতেই ওই দোকানের কাউন্টারে মহাষ্টমীর ঠাকুর দেখার লাইন। সারা বছরে এর কোনও ব্যতিক্রম নেই। দোকানের উল্টোদিকেই বাসস্ট্যান্ড। বসে ছিলাম। মনোযোগ ছিনিয়ে নিয়েছিল একজন।

বুঝতে পারলাম, ছেলেটি কাজ করে দুনিয়াখ্যাত তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায়। গলায় আইডি কার্ড দোল খাচ্ছিল। আর ছেলেটি পরমানন্দে রোল খাচ্ছিল। ওই দোকানে রোলের দাম ৪০ টাকা। এগরোলের গায়ে জড়িয়ে থাকা কাগজগুলো উড়িয়ে দিচ্ছিল হাওয়ায়। রোল শেষ হওয়ার পরে অর্ডার করা হল এক প্লেট চাউমিনের। বলল, ‘চিলি মারো বেশি করে।’ ৫৫ টাকা!

খাওয়া শেষ হলেই ছেলেটি চলে গেল দোকান থেকে কয়েক ফুট বাঁ-হাতে, আরও অনেক রোলযাত্রীর সঙ্গে। একটি বহু পুরনো, জীর্ণ বাড়ির হতভাগ্য দেওয়াল জেগে থাকে সেখানে। দাঁড়িয়ে পড়ল ছেলেটি। পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল আরও কয়েকজন, রোবটের মতো। প্রস্রাব করল চারদিকের তোয়াক্কা না করেই। বাসস্ট্যান্ড থেকে দৌড়ে গিয়ে ছেলেটিকে পাকড়াও করেছিলাম। গলার আওয়াজ যতটা উঁচু করতে পারি বলে জানতাম, তার থেকেও তেজি করে বললাম, ‘লজ্জা করে না?’

ছেলেটির হাবভাবে কোনও আড়ষ্টতা ছিল না। পাশের লোকগুলোরও না। প্রশ্ন করেছিলাম ছেলেটিকেই। কিন্তু কোনও অজানা নীতিগত কারণে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা অনেক মানুষের কাছ থেকেই উত্তর পেলাম। প্রসঙ্গত জানাই, এর ফুট ২০ দূরত্বের মধ্যেই ছিল একটি সুলভ শৌচালয়। উত্তরগুলির নির্বাচিত কয়েকটি সাজিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে।

–প্রকৃতির জিনিস, প্রকৃতির কোলে দিয়ে দেওয়াই ভালো। আরও সহজে মাটির কাছাকাছি চলে যাবে।
–আপনি কি সমাজ সংস্কারক? এই বিরাট দেশে ক’টা বাড়িতে বাথরুম আছে, জানেন? বাথরুম থাকলেও ক’টা বাড়িতে তা ব্যবহার করা হয় জানেন?
–আপনার বাড়ির দরজার সামনে করেছি না কি? কীসের এত মাথাব্যথা? ফুটুন তো মশাই!
–সুলভ শৌচালয়ে শুধু শুধু দু’-টাকা সরকারকে দিতে যাব কেন? রোজগার করতে ঘাম ছুটে যায়।
–এই টাকা যে সরকার পাবে তার গ্যারান্টি কই? সরকার পাচ্ছে জানলে ওখানেই করতাম।
–আমি সুগারের রোগী। বেশিক্ষণ চেপে রাখতে পারি না। হঠাৎ কিছু হয়ে গেলে আপনি দায়িত্ব নেবেন?
–সব মোহ মায়া হ্যায়। পোশাক পরে আসিনি এ পৃথিবীতে। পোশাক পরে যাবও না। দুনিয়ার মঞ্চে কয়েক দশকের এই সামান্য অভিনয়ে কীসের এত লজ্জা, কেন এই সংকোচ? মুক্ত করো হে!
–সুলভ শৌচালয়ে যে লোকটা টাকা নেয়, সেও কিন্তু এখানেই করে। হি, হি!

আরও অনেককিছু ধেয়ে আসছিল আমার দিকে। পরাজিত চিত্তে বাসস্ট্যান্ডের ওই চেয়ারে এসে বসে পড়েছিলাম ফের। রোল কর্নারে তখন লাইনের ভার আরও বেশি। জীর্ণ দেওয়ালের পাশেও লোক বাড়ছিল ক্রমশ।

জনপ্রতিনিধিদের ভোটমুখী বক্তৃতায় নানা বিষয়ের সঙ্গে উল্লেখ করা থাকে তাঁর অঞ্চলগুলিতে সুলভ শৌচালয় বাড়ানোর প্রসঙ্গও। প্রতি বছর শহর মফস্‌সলে উদ্বোধন করা হয় সুলভ শৌচালয়ের। কিন্তু এগুলো কত লোক ব্যবহার করছেন, তা সম্পর্কে কোনও পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না, অন্তত প্রকাশ্যে। বহু সুলভ শৌচালয় ঘটা করে উদ্বোধনের মাসখানেকের মধ্যে দরজায় তালার মুখ দেখে। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, নবনির্মিত শৌচালয়ের বাইরের দেওয়ালের আনাচ-কানাচ-ই হয়ে ওঠে মূত্রত্যাগ করার নয়া জায়গা। দৃশ্যদূষণ কমানোর জন্য যার নির্মাণ করা হয়েছিল, সেটিই ক্রমশ পরিণত হয় দূষিত করার নতুন উপকরণে। কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়।

এক মনোবিদ বন্ধুর সঙ্গে এ-প্রসঙ্গে সম্প্রতি আলোচনা করেছিলাম অনেকক্ষণ। ওঁর কথায়, ‘প্রকাশ্যে মূত্রত্যাগ করার মধ্যে প্রশাসনের সঙ্গে একরকমের লুকোচুরি খেলার ব্যাপার আছে। ছোটবেলায় শেখা খেলা তো বড়বেলাতেও থেকে যায় মনের গভীরে। জানি অপরাধ করছি। তার সঙ্গে এটাও জানি, এই খেলায় জিতব আমিই। নিয়ামকের বিরুদ্ধে নিজের তৈরি করা খেলায় নিজেই জিতে এক অদ্ভুত ধরনের আনন্দ পাই আমরা। কিছুটা স্যাডিস্টিক প্লেজারও মিশে থাকে এর মধ্যে। এভাবে মূত্রত্যাগের মধ্যে এক সম্মিলিত আনন্দ আছে। যে কর্ম করার সময় আড়াল থাকাই শ্রেয় এবং বাঞ্ছনীয়, বাস্তবে হয় ঠিক তার উল্টোটা। একজন শুরু করলেই তার পাশে দাঁড়িয়ে পড়েন আরও একজন। তার পাশে আরও। আরও, আরও। ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে, যৌথভাবে আইন ভাঙলে অমান্যকারীদের শক্তি বাড়ে। মনের রহস্যময় সুড়ঙ্গে হয়তো খেলা করে এই বোধও। পুলিশ ধরলে একসঙ্গে কতজনকে ধরবে?’

এক আশ্চর্য সমাজে বাস করি আমরা। এক্ষেত্রে জনতার সঙ্গে নিয়ম ভাঙেন আইনের রক্ষকরাও। রাস্তার ধারে বাইক রেখে করে উন্মুক্ত স্থানে আমআদমির পাশে মূত্রত্যাগ করছেন পুলিশ এবং ট্রাফিক সার্জেন্ট– এমন দৃশ্যও দেখেছি বহুবার। এক ট্রাফিক সার্জেন্টকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘এ কি স্যর, আপনিও?’ উনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘কেন? আমরা কি মানুষ নই নাকি?’ ফের বলেছিলাম, ‘সুলভ শৌচালয়ে তো যেতে পারতেন স্যর।’ উনি বলেছিলেন, ‘চোপ্। কেস দিয়ে দেব? দেখবি?’ আমি মুখে সেলোটেপ লাগিয়ে স্থান ত্যাগ করেছিলাম।

এদিক-ওদিক খবর নিয়ে অবশ্য জানতে পারলাম, উন্মুক্ত স্থানে এই অপরাধ করার জন্য শাস্তি কে দেবে, সেটা নিয়েই প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা আতান্তরে। জরিমানার অঙ্কও বড় রহস্যময়। এই মহানগরীর জায়গায় জায়গায় লাগিয়ে রাখা প্ল্যাকার্ডে বিবিধ জরিমানার অঙ্ক দেখেছি। লেখাগুলো সাধারণত এমন হয়ে থাকে, ‘এখানে প্রস্রাব করিবেন না। করিলে এত টাকা জরিমানা।’ এই ‘এত’-র অঙ্ক যেমন ৫০ দেখেছি, দেখেছি ১৫০০-ও। এক জায়গায় এক বিরাট কাঁচির চিহ্ন দেখেছিলাম। আর বিশদে নাই বা গেলাম!

জনতার অবশ্য এই অঙ্কের বহরে আগেও যায় আসেনি, ভবিষ্যতেও কিছু যাবে আসবে না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাংলায় যে শব্দটির বানান নিয়ে সবচেয়ে বেশি পারমুটেশন ও কম্বিনেশন করা হয়েছে, তার নাম প্রস্রাব। তিন অক্ষরের এই শব্দের কত ধরনের বানান আজ অবধি চোখে পড়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। আর ‘এখানে প্রস্রাব করিবেন না’ সাবধানবাণীর শেষ শব্দ ‘না’-টি সম্ভবত কর্পূর দিয়ে তৈরি। কিছুদিন পরেই সেটি গায়েব হয়ে যায়। অথবা লাফিয়ে এসে জুড়ে যায় পরের লাইনের প্রথমে। পরিবর্তিত প্ল্যাকার্ড বলে, ‘এখানে প্রস্রাব করিবেন। না করিলে এত টাকা জরিমানা।’ এই বিঘ্ন না দেখলেই আমাদের আজকাল অস্বস্তি হয় বেশি!

এদিক-ওদিক কিছু প্রশাসনিক লোকের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, এমন অপরাধে কে যে জরিমানা করবেন, তার কোনও ঠিকঠাক নির্দেশিকাই নেই। পুলিশ বলে, এই দায়িত্ব পুরসভার। আর পুরসভার আধিকারিক বলেন, এর ভার নেবে কলকাতা পুলিশ। অন্যদিকে, কলকাতা পুলিশের বক্তব্য, কাজ কিছু কম নেই আমাদের। জরিমানা করবে ট্রাফিক পুলিশ। পাড়ার দাদারা বলেন, দায়িত্বটা শুধু আমাদের ঘাড়ে ছেড়ে দিন একবার। তারপরে দেখুন। এই হট্টগোলের জেরে শুধু দৃশ্যদূষণ বাড়ে। কাজ হয় না কিছুই।

লন্ডনে জন্ম ও বড় হওয়া আমার এক পিসতুতো ভাই বছরখানেক আগে কলকাতা এসেছিল। ওকে নিয়ে ঘুরেছিলাম শহরের নানা বিখ্যাত স্থল। একটি লজেন্স মুখে পুরে দেওয়ার পর তার মোড়কটি ও প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে রেখেছিল বাড়ি না ফিরে আসা অবধি, রাস্তায় ফেলে দেওয়া উচিত নয় বলে। বিভিন্ন হেরিটেজ বিল্ডিং লাগোয়া স্থানে ‘প্লিজ ডু নট ইউরিনেট হিয়ার প্ল্যাকার্ড’ দেখে ও অবাক হয়ে তাকিয়েছিল আমার দিকে। জিজ্ঞেস করল, ‘এগুলো এখানে কেন লাগিয়েছে?’ বললাম, ‘হঠাৎ লোকে যদি কিছু করে দেয়, তাই!’ ওর চোখের মণিগুলো পরিণত হয়েছিল বিস্ময়গোলকে। ফের বলল, ‘দুমদাম করে লোকজন কেন এমন কাজ করবে? এগুলো তো পাবলিক প্লেস।’ ট্রেন বেলাইন হয়ে যাওয়ার মতো প্রসঙ্গ ঘুরিয়েছিলাম সেদিন। ও বিড়বিড় করে বলে চলেছিল, ‘কিন্তু এমন প্ল্যাকার্ড লাগাতে হবে কেন?’

সার্বিকভাবে শুভবোধের উদয় না হলে এই সমস্যার কোনও সমাধান নেই, আপাতত। এক পরিচিত সমাজতাত্ত্বিক সেদিন এক অভিনব উপায়ের সন্ধান দিলেন। বললেন, ‘এখন তো শুধু ওটিপি আর এই পরিচয়পত্রের সঙ্গে ওই পরিচয়পত্রের লিংকিংয়ের যুগ। ড্রাইভিং লাইসেন্সের নম্বর ফেললেই উঠে আসে কেস খেয়েছ কতবার। প্যান নম্বর দিলেই জানতে পারা যায় ঠিক সময়ে ক্রেডিট কার্ডের বিল মেটাওনি কতবার। সিবিল স্কোর যদি হতে পারে, সামাজিক ভদ্রতার কোনও স্কোর হবে না কেন? জরিমানার পরিকাঠামো যদি ঠিকঠাক করা যায় আর তা যদি জুড়ে দেওয়া যেতে পারে আধার কার্ডের সঙ্গে, একটা ভয়ংকর সুন্দর ব্যাপার হতে পারে। এই ডেটার অ্যাকসেস দিতে হবে সবাইকে।’ আমি জুলজুল করে তাকিয়ে ছিলাম ভদ্রলোকের দিকে। একটু তির্যকভাবে হেসে উনি জুড়ে দিলেন, ‘ধরো তুমি চাকরির কোনও ইন্টারভিউয়ে গিয়েছ। বড় পোস্টের মোটা বেতন। প্রশ্নকর্তা খানিক পরেই বললেন, ছ্যা, ছ্যা! বাহারি বায়োডাটা কী সব কথা বলে? আপনি তো দেখছি শহর নোংরা করেছেন ২৭ বার। শেষবারেরটা তো গত সপ্তাহে। এরপরে কি এই অফিসের পিছনেও?’ কতকিছুই তো সত্যি হত যদি, বইত বেগে ইচ্ছেভরা নদী!

পাড়ারই এক দাদার কথা বলে শেষ করি।

একটি নামী মিউচুয়াল ফান্ড সংস্থার এজেন্ট। শহরের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত ঘুরে বেড়ান সারাদিন। নতুন ফান্ড বিক্রি করেন। চেক আদায় করেন। বলছিলেন, ‘দিনে তিনবার প্রকৃতির কাজটা এদিক-ওদিক টুক করে সেরে দিয়ে যদি ছ’টাকা বাঁচাই, তাহলে বছরে বাঁচে ২,১৯০ টাকা। টানা ২০ বছর যদি এটা চালিয়ে যেতে পারি, তাহলে বাঁচছে ৬৫,৭০০ টাকা। ভালো এসআইপি-তে বছরে রিটার্ন কম করে ১৮ শতাংশ। এবারে কম্পাউন্ড ইন্টারেস্টের ম্যাজিক ফর্মুলাটা লাগাই। শোন্। শুনতে থাক। কত হচ্ছে বলত? কি রে, শুনছিস?’

……………………………..

রোববার.ইন-এ পড়ুন অম্লানকুসুম চক্রবর্তী-র অন্যান্য লেখা

……………………………..