স্বপ্ন দেখি, একদিন হয়তো অনেক দূরের ভবিষ্যতে, যখন এই শহর বদলে যাবে, তখনও কোনও রাস্তার মোড়ে হয়তো কেউ গাইবে– ‘আমি বাংলায় গান গাই, আমি বাংলার গান গাই।’ আর চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ হঠাৎই কোরাসে পরিণত হবে। সেই মুহূর্তেই প্রতুল আবার জন্ম নেবেন। প্রতুল মুখোপাধ্যায় ছিলেন একক ছিলেন না। ছিলেন জনতার কণ্ঠস্বর, ইতিহাসের সাক্ষী, বিদ্রোহের ঢাক, প্রেমের ফিসফিস। তাঁর গান আজও বাঁচিয়ে রেখেছে হাজার মানুষের ভেতরের আলো।
একটি একক কণ্ঠ কখনও কোরাস হয়ে ওঠে– যখন সেই কণ্ঠের ভেতরেই লুকিয়ে থাকে অসংখ্য মানুষের হাহাকার, প্রেম, দুঃখ, সংগ্রাম, ভবিষ্যতের স্বপ্ন। প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের স্বর ছিল সেই অমোঘ কণ্ঠ– অননুকরণীয়, পেলব অথচ তীব্র। শুনলেই মনে হত কোথাও এক বিশাল অর্কেস্ট্রা বাজছে– কিন্তু সেই অর্কেস্ট্রার যন্ত্র আর সুর সবই তাঁর শরীরের ভেতর থেকে উঠছে।
তিনি ছিলেন গায়ক, কবি, বিপ্লবী, পথিক, আর সবচেয়ে বড় কথা– মানুষ। এমন এক মানুষ, যিনি রবীন্দ্রনাথকে বুকের মধ্যে ধারণ করে রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলেন, আর সেখান থেকেই উচ্চারণ করেছিলেন তাঁর গান।
আমি একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, প্রতুলদা, এত গান কীভাবে সম্ভব? এগুলো তো গান নয়, যেন শ্লোগান। শুনলেই আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে।
তিনি তখন মৃদু হেসে বলেছিলেন, ‘গান কতটা হয়েছে জানি না দেবজ্যোতি, তবে এ আমার মনের কথা। যা বলতে চাই, গানে বলি।’
এই উত্তরে লুকিয়ে ছিল তাঁর সমগ্র জীবনদর্শন। গান তাঁর কাছে কেবল সুর আর ছন্দের খেলা নয়– এ ছিল আত্মার উচ্চারণ।
মাইক্রোফোনের প্রয়োজন তাঁর ছিল না। খোলা স্টেজ, রাস্তার মোড়, ছাত্রসমাবেশ, কারখানার গেট– যেখানেই হোক, একাই দাঁড়িয়ে গাইতেন– ‘বাংলা আমার তৃষ্ণার জল, তৃপ্ত শেষ চুমুক। আমি একবার দেখি, বারবার দেখি, দেখি বাংলার মুখ।’
তারপরই আশ্চর্যজনক ভাবে চারপাশের মানুষ এক এক করে জড়ো হতে শুরু করত। যেন অদৃশ্য কোনও জাদু তাদের টেনে আনছে। একসময় কয়েকজন মিলেমিশে এক বিশাল সমুদ্র হয়ে যেত। কণ্ঠে কণ্ঠ মিশে যেত, একলা গায়ক হঠাৎই এক মহাকোরাসে রূপ নিতেন।
এ দৃশ্যকে কি শুধুই গান বলা যায়? নাকি এটি ইতিহাসের মধ্যেই লুকনো এক বিপ্লবের দৃশ্য?
আমি প্রায়ই স্মরণ করি– ‘আমি বাংলায় গান গাই’। কোনও সভা-সমাবেশে, কোনও ছাত্রাবাসে, কোনও অডিটোরিয়ামে– যখনই এই গান শুরু হয়েছে, তখনই দেখেছি মানুষ দাঁড়িয়ে সমস্বরে গেয়ে উঠছে। কোথাও ভেদ নেই, কণ্ঠে কণ্ঠ মিশে যাচ্ছে। যেন গান নয়, বরং এক মন্ত্রোচ্চারণ।
এই গান দেশ-কালের সীমা পার হয়ে গিয়েছে বহু আগেই। আজও যখন কেউ গাইতে শুরু করে, তখনই চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে সেই একই আবেগ।
কলেজ চত্বরে, কফি হাউসের কোণে, মঞ্চের আলোয়– প্রতিবার এই গান নতুন হয়ে ফিরে আসে। গানটির ভেতরেই রয়েছে বিদ্রোহ, বিপ্লব, প্রেমের উচ্চারণ। একদিকে এটি দুঃসাহসের ডাক, অন্যদিকে এটি শান্তির স্বর। এই অস্থির সময়েও গানটি যেন কোথাও প্রশান্তি এনে দেয়।
প্রতুলদার গান বললেই ‘আমি বাংলায় গান গাই’ মনে পড়ে, কিন্তু শুধু তা নয়, আরও অনেক সাহসী এবং সোচ্চার গান রেখে গিয়েছেন তিনি। যেমন অমিত দাসের কথায় প্রতুলদা নিজের সুরেই গেয়েছেন–
‘সাপের মাথায় পা দিয়ে সে নাচে,
কান্না কেন, কান্না কেন তোর?
বন্যা, খরা, মড়ক বুকে বাঁচে
ভাবনা কেন, ভাবনা কেন তোর?
তুই কি ভাবিস তার ঘুমে সেই স্বপ্ন নেই? আছে।
সাপের মাথায় পা দিয়ে সে নাচে॥’
প্রতুলদার আরেকটি গান মনে পড়ে, ‘জন্মিলে মরিতে হবে।’ কিন্তু তাঁর কথায়, ‘মরণে মরণে অনেক ফারাক আছে ভাই রে।’ কত সহজে বললেন সবচেয়ে কঠিন কথা। মানুষ প্রতিদিনই অল্প অল্প করে মরে– ক্ষয়ে যায়, নষ্ট হয়, হতাশ হয়। কিন্তু কিছু মৃত্যু এমনও আছে, যা হয়ে ওঠে হাজার মানুষের বেঁচে থাকার প্রেরণা। এই উপলব্ধিই প্রতুলকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যায়।
এ যেন আলোর গান, প্রেরণার গান, মানুষের মেরুদণ্ড সোজা রাখার গান। ক্লান্ত শহরের ভিড়ে হাঁটতে হাঁটতে, বৃষ্টির ফোঁটায় ভিজতে ভিজতে যখন কানে আসে তাঁর কণ্ঠ, তখন মনে হয় শহরটিই জেগে উঠছে।
কিংবা এই গানটা যদি দেখা যায়–
‘আলু বেচো, ছোলা বেচো, বেচো বাখরখানি
বেচো না বেচো না বন্ধু, তোমার চোখের মণি।
কলা বেচো, কয়লা বেচো, বেচো মার্জনা
বুকের জ্বালা বুকেই জ্বলুক, কান্না বেচো না।
ঝড়ে বেচো পাঁচ সিকেতে,হাজার টাকায় সোনা
বন্ধু তোমার লাল টুকটুক স্বপ্ন বেচো না।’
তিনি যেন সতর্ক করলেন– ভয়ংকর বাজার-সভ্যতা, লোভ, প্রতারণার সামনে স্বপ্নকে বিক্রি করো না।
মার্কেস যেমন তাঁর উপন্যাসে ম্যাজিক রিয়ালিজমের মধ্য দিয়ে বাস্তবের মধ্যে কল্পনার রেখা টেনে দিতেন, প্রতুলদার গানও তেমনই। এগুলো বাস্তব, কারণ এগুলো মানুষের যন্ত্রণার ভাষা। আবার কল্পনাও, কারণ এই গান শুনলেই মনে হয়– রাস্তার মোড় থেকে ভেসে আসছে এক অদৃশ্য অর্কেস্ট্রা, আকাশ জুড়ে বাজছে ভায়োলিন, ড্রামের তালে মিলেছে ভিড়ের করতালি। কোনও এক রাতে, বেহালার দিকে এক সভা ছিল। মঞ্চ খুব ছোট। প্রতুলদা দাঁড়িয়ে গান ধরলেন। প্রথমে কয়েকজন বসেছিল। গান গাইতে গাইতে তিনি যেন মন্ত্র জপতে শুরু করলেন। গান শেষে তাকিয়ে দেখি– রাস্তা ভরে গিয়েছে। অগণিত মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, চুপচাপ শুনছে। যেন সময় থেমে গিয়েছে।
এই থেমে যাওয়া সময়ই তাঁর আসল জাদু…
আমি ভাবি, প্রতুলদা আসলে কি একক মানুষ ছিলেন? নাকি তিনি ছিলেন এক বহুরূপী সত্তা, যিনি প্রতিটি মানুষের কণ্ঠ ধার করে গান গাইতেন? তাঁর গানের ভেতর যে সুরগুলি ছিল, সেগুলো কোনও যন্ত্রে বাজানো যেত না। এগুলো ছিল হৃদয়ের তারে বাঁধা। তিনি বলতেন, ‘গান মানে কেবল সুর নয়, গান মানে মানুষের মনের কথা।’ এখনও দেখি, তাঁর গান বাজলেই নতুন প্রজন্ম শোনে, গায়, আবার আবিষ্কার করে। গানটি বয়স্ক মানুষের কাছে স্মৃতির, তরুণদের কাছে নতুন আবিষ্কারের। এ এক বিস্ময়– যেন প্রতিবার শোনার সঙ্গে সঙ্গে গানটি জন্ম নিচ্ছে নতুন করে।
একটি শহর কেবল তার রাস্তাঘাট, ভবন, আলো নয়। শহর আসলে তার গান। কলকাতার গলিতে গলিতে আজও প্রতুলের গান ভেসে বেড়ায়। কখনও অটো-চালকের মুখে, কখনও কলেজ-ছাত্রীর গলায়, কখনও বৃষ্টিভেজা ট্রামের ভেতর। গানগুলো যেন অদৃশ্য সঙ্গী হয়ে আছে।
কিন্তু প্রতুলদা নিজে কখনও ভাবেননি তিনি ইতিহাস লিখছেন। তিনি শুধু গাইতেন। গাইতে গাইতে বলতেন, ‘এ আমার মনের কথা।’ আর সেই কথাগুলোই একসময় রূপ নিল জনগণের উচ্চারণে।
এটাই প্রতুলের মহিমা।
যখন তিনি বলেন, ‘ভয় পাস না ছেলে’– তখন সেটা কেবল এক মায়ের সান্ত্বনা নয়, বরং সমগ্র জাতির আত্মবিশ্বাসের ডাক। যখন তিনি বলেন– ‘আমাদের যেতে হবে’– তখন সেটা কেবল এক যাত্রার ঘোষণা নয়, বরং ইতিহাসের রথচক্রের ডাক।
এই দ্বৈততা, এই বহুমাত্রিকতা তাঁকে গড়ে তোলে এক অনন্য শিল্পীতে।
প্রতুলদার গান শোনার সময় মনে হয়, শব্দের ভেতর আলো লুকিয়ে আছে। প্রতিটি শব্দ যেন অগ্নিকণা। আবার সেই আগুনই আলোকিত করে, জ্বালিয়ে দেয় মনের আঁধার।
মার্কেস যেমন লিখেছিলেন, ‘জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল মানুষের স্মৃতি।’ প্রতুলের গানও তেমনি। এগুলো শুধু গান নয়, এগুলো আমাদের স্মৃতি, আমাদের সংগ্রাম, আমাদের ভালোবাসা, আমাদের ইতিহাস। লং মার্চের সেই গানটা ধরা যাক–
‘কীসের ভয় সাহসী মন লালফৌজের?
লাফিয়ে হই পার
থাক না হাজার অযুত বাধা
দীর্ঘ দূর যাত্রার
কীসের ভয়?’
কিংবা, এই গান, যেখানে বলছেন,
‘তুমি এখন বাংলাদেশি, আমারে কও ইন্ডিয়ান!
দুঃখ কিছু ছিল মনে
দুঃখরে কই যাওরে ভাই
সাঁঝ বেলায় আদরের ডাক
কেমনে বলে মুখ ফিরাই?
…দুইজনেই বাঙালি বন্ধু
বাংলা দু’জনেরই জান
দুয়ের মুখেই বাংলা কথা,
দুয়ের গলায় বাংলা গান।’
এই গানের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই!
স্বপ্ন দেখি, একদিন হয়তো অনেক দূরের ভবিষ্যতে, যখন এই শহর বদলে যাবে, তখনও কোনও রাস্তার মোড়ে হয়তো কেউ গাইবে–
‘আমি বাংলায় গান গাই, আমি বাংলার গান গাই।’
আর চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ হঠাৎই কোরাসে পরিণত হবে। সেই মুহূর্তেই প্রতুল আবার জন্ম নেবেন।
প্রতুল মুখোপাধ্যায় ছিলেন, একক ছিলেন না। ছিলেন জনতার কণ্ঠস্বর, ইতিহাসের সাক্ষী, বিদ্রোহের ঢাক, প্রেমের ফিসফিস। তাঁর গান আজও বাঁচিয়ে রেখেছে হাজার মানুষের ভেতরের আলো।
একটি কণ্ঠ যখন কোরাসে রূপ নেয়, তখন সেটি আর একক থাকে না– হয়ে ওঠে জাতির, ইতিহাসের, ভবিষ্যতের। প্রতুলদার গান সেই চিরন্তন কোরাস।
………………………..
পড়ুন পুজোর রোববার-এর অন্যান্য লেখা রোববার.ইন-এ
………………………..
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved