উচ্চকিত, নীরব, অন্তঃস্থিত শরীরবাসনার বিচিত্র সব নকশা ডিঙিয়ে যেতে যেতে পাঠক কখনও এসে দাঁড়ান একা মানুষের সামনে। একা মানুষও তো কতরকম। পার্ক রোডের নির্জন, নিরিবিলি বাড়িতে প্রকৃতপক্ষেই নিঃসঙ্গ চন্দনাকে দেখলে বোঝা যায় শূন্যের ভিতরে কত ঢেউ। অপেক্ষার, অতৃপ্তির একেকটি দীর্ঘ রাত্রি তার কেটে যায় কুল-কাঁটার যন্ত্রণা বুকে নিয়ে। ঠিক যেমন শরীরসঙ্গিনীর অভাবে মৃতদার নীলকণ্ঠের লিবিডো চাগাড় দিয়ে ওঠে কুসুমের আলো-আন্ধারি শরীরের মোহে। একা একা কিছুদূর যাওয়ার পর ক্লান্তির অনিবার্য ছিদ্র দিয়ে কামনার সাপ এসে ঢোকে।
‘…ভগবান পাখির গায়ে পাকা রঙ দেবার আগে আমাদের ইন্দ্রিয়ে কাঁচা মালমশলা ঢেলেছে।’
এ হল আদি কথার একটি। আলোর চেয়েও দ্রুত উপ্ত হয়ে কামনা রক্তের প্রবাহে মিশে যায়। রিপুতাড়িত নিরুপায় মানুষ সভ্যতার ছাঁকনিতে সেই স্রোতকে পরিশীলিত এবং গোপনীয় করে নেবে ভাবে; অথচ আমাদের ‘ইন্দ্রিয় তার রসনা লালায়িত করে এই সংসারে পাখিঅলা’ সাজার ব্যর্থ চেষ্টায় ময়ূরপুচ্ছধারী বায়সের মতো এক্সপোজড হয়ে যায় কখনও-সখনও। মোটা দাগের লোভ-লালসাময় স্থূলমতি জীবন আমাদের। সতত সতর্ক থেকেও ভয়াবহভাবে জলে পড়ে যাওয়াই যেন নিয়তি। নকল সাজ খসে পড়লে রং-করা পাখির আসল চেহারা যখন বেরিয়ে আসে, ত্রিলোচন নন্দীর কাছে ধরা পড়ে যায় মুরারী (‘ত্রিলোচন নন্দীর নামে ছড়া’)। নীলকণ্ঠ ভট্টাচার্যের ‘আসঙ্গ জ্বালা’র খবর ছেলে ললিতের কাছে আর অজ্ঞাত থাকে না (‘যযাতি’)। বটানির প্রফেসর পূর্ণেন্দুবিকাশ ভরা চাঁদের আলোয় উদ্ভিদের মতো তাঁর নীরব কামনার উত্থিত প্রশাখাসমেত প্রকাশিত হয়ে পড়েন– ‘সুষমাময়ী চন্দ্রমার নয়ান ক্ষমাহীন’ (‘উদ্ভিদ’)। দুর্বলতম মুহূর্তের এমন সব উন্মোচন ছাড়াও আরও কত রং আছে, আরও কত স্তর– কামনার ক্যালাইডোস্কোপ। আদিম প্রবৃত্তির এইসব সুতো নিয়ে নাড়াচাড়া করে বিমল কর একেকটি বিভঙ্গে খুলে ধরেন মানুষের অন্তর্গত রক্তের খেলা, প্রকৃত জীবনসত্য।
উচ্চকিত, নীরব, অন্তঃস্থিত শরীরবাসনার বিচিত্র সব নকশা ডিঙিয়ে যেতে যেতে পাঠক কখনও এসে দাঁড়ান একা মানুষের সামনে। একা মানুষও তো কতরকম। পার্ক রোডের নির্জন, নিরিবিলি বাড়িতে প্রকৃতপক্ষেই নিঃসঙ্গ চন্দনাকে দেখলে বোঝা যায় শূন্যের ভিতরে কত ঢেউ। অপেক্ষার, অতৃপ্তির একেকটি দীর্ঘ রাত্রি তার কেটে যায় কুল-কাঁটার যন্ত্রণা বুকে নিয়ে। ঠিক যেমন শরীরসঙ্গিনীর অভাবে মৃতদার নীলকণ্ঠের লিবিডো চাগাড় দিয়ে ওঠে কুসুমের আলো-আন্ধারি শরীরের মোহে। একা একা কিছুদূর যাওয়ার পর ক্লান্তির অনিবার্য ছিদ্র দিয়ে কামনার সাপ এসে ঢোকে।
জীবনের নিত্য কোলাহলে, কর্তব্যের কঠিন প্রহরা ডিঙিয়ে নিজের মুখোমুখি বসতে ভুলে যাওয়া মানুষ সংসারের ভিতর ভালোবাসার মুখটিকে অবসরের নিটোল চোখে তাকিয়ে দেখার ফুরসত পায় না। দেখে না এই দীর্ঘপথে, কোথাও লেগেছে কি না বাদামি ক্ষয়ের দাগ। নতুবা ভরা-সংসারে বধূ আছে, শিশুটিও আছে– তবুও রক্তপলাশের মাঠে একান্ত মুহূর্তে উমার টলটলে বড় চোখ, গলার তিল আর আলতা-লালরঙা উজ্জ্বল ব্লাউজ দেখে বিনুর স্বামী ‘রতিকান্তর ঘোর লাগে’ কেন? কামরাঙা গাছটির নাম উমাকে বলতে তাঁর বাধা কীসের? এ তো নিছকই শ্যালিকা-জামাইবাবুসুলভ চটুল খুনসুটির উপাদান হতে পারত, পারত, তবুও অদ্ভুত অস্বস্তি হয় তার। তবে কি কোনও অন্তর্গত শূন্যতা ছিল এতদিন, মোক্ষম আশকারা পেয়ে যেখানে লতিয়ে উঠেছে বাসনার লতা-গুল্মগুলি। প্রকৃতি এখানে অনুঘটকের মতো। আশকারা দেয়। বিমল কর মানেন, গল্পের যে লজিক তা পরিবেশের ভিতর ‘কাজ করে যায়’। নির্জন মধ্যাহ্নের মায়া, পলাশের লাল, ম্রিয়মাণ বিকেলের বিষণ্ণ ছায়াঘেরা পুকুর উমাকে, রতিকান্তকে দিয়েছে কামনার ঘোর। দিয়েছে গহীন হৃদয়ের দিকে তাকানোর অবকাশ। অথচ শরীরবৃত্তের বাইরে বেরিয়ে আসে ‘পলাশ’ গল্পটা। কামনার পথ ধরে ভালোবাসার বারান্দাতে এসে দাঁড়ায়। নতুন শরীরের মোহে জড়িয়ে পড়েও রতিকান্ত অবশেষে ভালোবাসার আশ্চর্য প্রহেলিকায় পথ খোঁজে। নিজের স্ত্রী, সন্তানকে ভালোবাসার পরেও কেন উমাকে ভালোবাসা যাবে না?– এই ক্রাইসিস নিছক পরকীয়ার ধারণায় গিয়ে মেশে না। রতিকান্ত ভাবে, ‘ভালোবাসাটা একটা গুণ। গুণ। কোয়ালিটি।’ কিন্তু মনের ইচ্ছে হলেও ‘অন্যে’র নিষেধ রয়েছে। দীর্ঘকালের একটা সামাজিক প্র্যাকটিসের আগল মানতে না চাওয়া ডেসপারেট রতিকান্ত সেই ‘অন্যে’র উদ্দেশে জানায়– ‘কিন্তু ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে উমাকে– এই ইচ্ছেকে নষ্ট করে দিতে চাও। পারবে? পারবে না।’ তবুও বৈধ-অবৈধের চিরাচরিত ব্যূহের ভিতর নিরস্ত্র রতিকান্ত বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েও হেরে যায় শেষমেশ। কামনা-পলাশের লাল রং পাংশু হয়ে পড়ে। বারান্দা থেকে তারা দু’জন ভালোবাসার ঘনিষ্ঠ ঘরে এসে ঢুকতে পারে না। এই না-পারার কারণে বিমল করকে কি আমরা ‘চোখের বালি’র রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এক পঙ্ক্তিতে বসাব? এইরকম স্থূল প্রশ্নে দাঁড়াব না; বরং তাকাব ভালোবাসা নামক জন্ম-মৃত্যুহীন সেই অনন্ত প্রবাহের দিকে, কামনার অনিবার্য বালি-পাথর যার সঙ্গে চলে, যাবতীয় নিগড়ের শৈবাল যাকে আটকাতে পারে না।
গোপন কামনা-বাসনার খবরাখবর মেলে ধরা গেলে সেই সূত্র গোটা মানুষের কাছে নিয়ে যায়, প্রকৃত অবস্থান বোঝা যায় তাঁর। বিমল কর নিহিত সেই পাতালের মুখ– কখনও যা সামাজিক ঔচিত্যের বিধানে নাড়া দেয়– অকপটে খুলে ধরেন, কিন্তু আখেরে পৌঁছে দিতে চান কামনার স্থূল অন্ধিসন্ধি পেরিয়ে ভালোবাসার ব্যাপ্ত চরাচরে। সেইখানে জ্যোৎস্নার নিচে সুধাময়ের বাড়ি। রাজেশ্বরীর মোহিনী শরীরের মায়া যাকে ভোলাতে পারেনি, হৈমন্তীর উজ্জ্বল অস্তিত্বের ভিতর বেড়ে ওঠা বিশুদ্ধ ভালোবাসার মোহ যাকে বিভোর করেছে। তবুও শরীর-মনের নিরবচ্ছিন্ন সম্পর্কের রহস্য তাকে ঘুরিয়েছে চিরকাল। শরীরসংলগ্ন ভালোবাসার কামনাতীত বিশুদ্ধ অনুভবের দিকেই চলে বিমল করের গল্প। সেই পথ দ্বন্দ্বসংকুল। ভুবন সেখানে একা, গল্পের নামেই তো তার ইঙ্গিত– ‘আমরা তিন প্রেমিক ও ভুবন’। তবুও সে পেয়ে গিয়েছে ভালোবাসার অমূল্য সুধা। তিন প্রেমিক কেবল ভোগ করল শিবানীকে, তাকে নকল বিশ্বাসের আলেয়ায় ঘুরিয়ে ফায়দা লুটে নিল একজন। তারপর শিবানীর চিতা যখন জ্বলছে শ্মশানে তিন প্রেমিক আশ্চর্য হয়ে ভাবল, ‘আমরা তিনজনে– তিন প্রেমিক শিবানীর নিষ্পাপতা, কৌমার্য, নির্ভরতা তো হরণ করে নিয়েছিলাম। নিয়ে তাকে প্রত্যাখান করেছি। কিন্তু তারপরও আর কি অবশিষ্ট ছিল শিবানীর, যা ভুবন পেয়েছে!’ সেই অবশিষ্টের দিকেই বিমল কর নিয়ে যান আমাদের। সেখানে নিবিড় জ্যোৎস্নায়– সুধাময়ের জন্মদিনে যেমন ছিল ফিনকি-কাটা জ্যোৎস্না– ভুবনের ‘চারপাশে নিবিড় ও নীলাভ, স্তব্ধ, মগ্ন যে চরাচর তা ক্রমশই যেন ব্যাপ্ত ও বিস্তৃত হয়ে এক অলৌকিক বিষণ্ণ ভুবন সৃষ্টি করছিল।’ অলৌকিক কেননা তা শরীরবাসনার স্থূল লৌকিকের ঊর্ধ্বে। এবং বিষণ্ণতারও সহাবস্থান, কারণ চলে গেল শিবানীর শরীর, যেমন রক্তমাংসের হৈমন্তীও ছেড়ে গিয়েছিল সুধাময়কে। তুষারের কোমল তুলোর মতো প্রসাধনে, পরিচ্ছন্নতায় পরিপাটি শরীর আছে বলেই যে তাদের সংসারে সুখ উজাড় হয়ে আছে– মৃণালের এই বিভ্রম কেটে যায় একদিন উদাত্ত ঝড়ের রাতে (‘পালকের পা’)। ‘এ জগতে হায়, সেই বেশি চায়, আছে যার ভুরি ভুরি!’ তুষারের রাজহংসীর মতো শুভ্র সৌন্দর্যে সকলে বিভোর অথচ তার স্বামী ‘দাম দিতে পারে না, দেবার ক্ষমতা নেই। ভাবে… চামড়া আর মাংসগুলো আরো, আরো সুন্দর হলে ও পারবে।’ এই অন্তঃসারশূন্য, নিরাবরণ দেহবলয়ের ভিতর অনিঃশেষ আকাঙ্ক্ষার খেলায় আটকে পড়তে চায়নি মৃণাল, তাই গল্পের শেষবাক্যে জিতে যায় সে– ‘…একটা আবরণ থাকলেও এখন ওর পাশে পাতায় ঢাকা পদ্মকুঁড়ির মতন একটি হৃদপিণ্ড ধুকধুক করছে।’
চিরকালীন ভালোবাসার বাঘ– অরণ্যের আদিমে যে ঘোরে, বিমল কর সেই বাঘের গল্পই লেখেন আদতে। স্পষ্ট করে জানান: ‘…ভগবান পাখির গায়ে পাকা রঙ দেবার আগে আমাদের ইন্দ্রিয়ে কাঁচা মালমশলা ঢেলেছে।’ আর কামনার কাঁচা ভিত ধ্বসে যায়, ভালোবাসার অক্ষয় রং নিয়ে হৃদয়পুরের দিকে উড়ে যায় পাখি।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved