সব মিলিয়ে, ভাদু গান, ভাদুর কিংবদন্তিকে বড় ভালোবেসে জড়িয়ে রাখে রহস্য। যে গান, যে উৎসবের গড়ন, রীতি রাজপরিবারের দরবার ছাড়িয়ে নেমে এসেছে মাটিতে। ঔপনিবেশিক সময়ের এক রাজকন্যার গল্প কীভাবে এমন একটি লোকউৎসবের জন্ম দেয়– তা নিয়ে বিশদে তর্ক চলতে পারে। কেউ কেউ বলেন, ভাদুর গল্প আসলে আরও সুপ্রাচীন। এই গল্পে পঞ্চকোট বা হেতমপুরের রাজপরিবারের ইতিহাস যুক্ত হয়েছে পরে। যেভাবে, লোকগান ভাদুকে দরবারি আঙ্গিকে জুড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন পঞ্চকোট রাজারা। কেউ বলেন অন্য কথা। ভাদু গানের সুরের মতোই ভাদুকে ঘিরে থাকা ইতিহাস, লোকশ্রুতি, প্রথারা ভেসে ভেসে যায় দূর-দূরান্তরে।
ঢেউ-খেলানো লালমাটির দেশ পুরুলিয়া। তার একদিকে রয়েছে সাঁওতালদের ‘অযোধিয়া বুরু’। মাঝে সমতলভূমি। বয়ে গিয়েছে কাঁসাই। নদীর দু’-পাশের পলিভরা মাটিকে সবুজ করে তুলেছে সেখানের জনজীবন। এই লালমাটি, জঙ্গল আর পাহাড়ের দেশ পুরুলিয়ার বাতাসে ভেসে বেড়ায় ভাদু গান। তবে শুধু পুরুলিয়া নয়, পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া, বীরভূম, পশ্চিম মেদিনীপুর, পশ্চিম বর্ধমান থেকে ঝাড়খণ্ডের রাঁচি-হাজারিবাগ– সবখানেই সাদামাটা জীবনযাপনে অভ্যস্ত মানুষ যেসব লোকউৎসব পালন করেন, সেখানে প্রাচুর্য ও বিলাসিতার ডঙ্কা-নিনাদ শোনা যায় না। সেগুলি যেন প্রাণের স্পন্দনের সঙ্গে এক সুতোয় বাঁধা। তেমনই এক প্রাণের উৎসব হল ‘ভাদু পুজো’। বাংলার শিকড়ে লেপটে থাকা এই পরব এখনও গ্রামীণ হৃদয়ের অমূল্য সম্পদ। পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমাঞ্চলে এমন কোনও গ্রাম পাওয়া মুশকিল, যেখানে ভাদ্র সংক্রান্তির সন্ধ্যার আকাশ-বাতাস ভাদুগানের সুরে মুখরিত হয়ে ওঠে না। এই পুজো ও ভাদুগানের জন্মের সঙ্গে মিশে রয়েছে ইতিহাস আর কিংবদন্তির অপরূপকথারা।
ভাদুপুজোর উৎসের সন্ধানে সবচেয়ে বেশি শোনা যায় এই কিংবদন্তি। ভাদুর আড়ালে রাজকুমারী ভদ্রাবতীর করুণ গল্প। এই কাহিনিও অবশ্য একরৈখিক নয়। এক মুখ থেকে অন্য মুখে বদলাতে থেকেছে এই লোককাহিনি নদীর বহমান স্রোতের মতো। এই কাহিনিতেও মিশেছে নানা রং, পাঠান্তর। কিন্তু, এই কাহিনি কোনও গল্পকথা নয়, কারণ, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক সময়, ঐতিহাসিক চরিত্ররা। ভাদুর জন্ম তাই কল্পনা আর ইতিহাস মিশ্রিত এক আখ্যান।
আজ থেকে প্রায় দুশো বছর আগে, ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি, পুরুলিয়ার কাশীপুরের পঞ্চকোট রাজবংশের সিংহাসন আরোহণ করেন রাজা শ্রী নীলমণি সিংদেও। কথিত আছে, রাজা নীলমণির এক কন্যার নাম ছিল ভদ্রেশ্বরী বা ভদ্রাবতী। ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার, পুরুলিয়া’ বই থেকে জানা যায়, বিয়ে করতে আসার পথে ডাকাতদের আক্রমণে ভদ্রেশ্বরীর স্বামী প্রাণ হারান। সেই বিরহ সহ্য করতে না পেরে ভদ্রাবতীও চিতার আগুনে প্রাণ বিসর্জন দেন। ভদ্রাবতীর মৃত্যুর পরে তাঁর প্রেমের আকুতিকে স্মরণীয় করে রাখতে নীলমণি সিংদেওই প্রচলন করেন ভাদু গান। আবার শোনা যায়, ভাদু কোনও ব্যাধির কারণে মৃত্যুবরণ করেন। সেই কন্যার অকালমৃত্যুতে রাজা তাঁর স্মৃতিরক্ষায় চালু করেন ভাদুপুজো। নৃতাত্ত্বিক রিজলের লেখা থেকে জানা যায়, ভাদ্র মাসের শেষ দিনে মানভূম ও বাঁকুড়া জেলায় বাগদি ও বাউরিরা ভাদু নামে এক দেবীর মূর্তি নিয়ে শোভাযাত্রা করেন। মূর্তিটি পঞ্চকোট রাজার প্রিয় কন্যা বলে কথিত। উৎসবটি সেই কন্যার স্মৃতিরক্ষা করেছিল বলে তিনি অনুমান করেছিলেন।
ইতিহাস এই তথ্য নিয়ে সন্দিহান। কারণ ইতিহাসে রাজা নীলমণি সিংহদেও বাহাদুরের কোনও কন্যাসন্তানের উল্লেখ নেই। কিন্তু ভাদু তো আদতে লোকজীবনের সঙ্গে লেপটে থাকা মেয়েদের গান। অথচ, তার প্রতিষ্ঠা হল রাজপরিবারের হাত ধরে। কারণ ইতিহাস বলছে, পঞ্চকোট রাজপরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় সত্যিই গাওয়া হত ভাদু গান– ‘কাশীপুরের মহারাজা/ সে করে ভাদুপূজা/ হাতেতে মা জিলপি খাজা/ পায়েতে ফুল বাতাসা।’ কিন্তু, সেই ভাদুতে লোকশিকড়ের ছাপ নেই। বরং হারমোনিয়াম, পাখোয়াজ, তবলা, সানাই সহযোগে এক উচ্চাঙ্গ মার্গসংগীতের ঢঙে গাওয়া হত দরবারি ভাদু। যে ঘরানার প্রবর্তকরা প্রত্যেকে রাজপরিবারের মানুষ– ধ্রুবেশ্বরলাল সিংদেও, প্রকৃতীশ্বরলাল সিংদেও এবং রাজেন্দ্রনারায়ণ সিংদেও। ভদ্রাবতীকে নিয়ে আরেকটি গল্পে হয়তো রয়েছে এর ইঙ্গিত।
লাড়া গ্রামের মোড়ল এক ভাদ্রমাসে ধানখেতের আলের পাশ থেকে কুড়িয়ে পেলেন ফুটফুটে এক সদ্যোজাত কন্যাসন্তানকে। কে জানে, হয়তো সীতার মতোই এই উর্বরা ভূমি জন্ম দিয়েছে এই কন্যার। মোড়ল শিশুটিকে নিয়ে এলেন ঘরে। সেই ভাদ্র ছিল রোদে পোড়া, শুষ্ক। কিন্তু, এই মেয়ে ঘরে আসতেই বৃষ্টি এল ঝেঁপে। ধান হল খুব। সবাই বলল, এ মেয়ে ভারী লক্ষ্মীমন্ত। মোড়ল-দম্পতি মেয়ের নাম দিলেন ভদ্রাবতী। ডাকনাম ভাদু। ভাদু হল রূপবতী। চাষির ঘরে এমন রূপ মানায় না। রাজা নীলমণি সিংদেওর কানে গেল ভাদুর কথা। মন্ত্রী ধ্রুবচাঁদকে রাজা বললেন, ওই মেয়েকে তিনি দত্তক নেবেন। রাজপরিবারই ওর যোগ্য স্থান। কিন্তু, ভাদু কিছুতেই যেতে চাইল না বাবা-মাকে ছেড়ে। তখন রাজা গ্রামে-গ্রামে ঢেঁড়া পিটিয়ে বলে দিলেন, রাজপ্রাসাদে না থাকলেও ভদ্রাবতী রাজকন্যেই।
ভাদু তখন ষোড়শী। তার কানে উজিয়ে আসে বাঁশির সুর। বংশীবাদক অঞ্জন। গ্রামের কবিরাজের ছেলে। মন দেওয়া-নেওয়া হয়। সাল ১৮৫৭। পঞ্চকোটেও এসে পড়ে সিপাহি বিদ্রোহের আগুন। বিদ্রোহে মদত দেওয়ার অভিযোগে ইংরেজদের হাতে বন্দি হন রাজা নীলমণি সিংদেও। রাজা মুক্তি পেতেই মন্ত্রী ধ্রুবচাঁদ জানায় রাজকন্যা প্রেমে পড়েছে কবিরাজপুত্র অঞ্জনের। ক্রুদ্ধ রাজা বন্দি করেন তাঁকে।
অঞ্জনের কয়েদের খবরে ছুটে আসে ভদ্রাবতী। তার করুণ আকুতিতেও মন গলে না রাজার। তখন ভাদু, দিনের পর দিন হৃদয় নিংড়ানো করুণ গান গেয়ে ঘুরতে থাকে জেলখানার চারপাশে। সেই গানে রাজার মন নরম হল। অঞ্জনকে মুক্তি দিলেন তিনি। কিন্তু, ভাদুর খোঁজ আর মেলে না। কেউ বলল, ভাদু শোকে আত্মঘাতী হয়েছে নদীর জলে। কেউ বলল, ভাদু ভেসে গিয়েছে নদীর কান্নার সঙ্গে। বাকিরা বলল, আকাশ থেকে মাটিতে নেমেছিল ভাদু, আবার ফিরে গেছে আকাশেই। সেই থেকে ভাদুর গান ভাসতে ভাসতে ছড়িয়ে পড়ল বাংলাদেশের নানা কোণে।
আরেকটি হল বিজয়োৎসবের কিংবদন্তি। ছাতনা রাজার সঙ্গে পাঁচেতের রাজার যুদ্ধ হয়েছিল ভাদ্র মাসে। জয়ী হয়েছিলেন পাঁচেতের রাজা। কেউ কেউ মনে করেন ভাদু উৎসব এই বিজয়ের স্মৃতিবহ। আবার অনেকের মতে ভাদু উৎসব আসলে আউশ ধানের নবান্ন উৎসব। সাধারণত, রোহিণী নক্ষত্রের উদয়কালই ছিল ধানের বীজ বপনের নির্দিষ্ট তিথি। প্রথা মেনে পুরুলিয়া-বাঁকুড়ায় প্রচলিত লোকউৎসব ‘রোহিণ’ উপলক্ষে বীজ বপন করে কৃষিকার্য চলত ভাদ্রের শুরু পর্যন্ত। ভাদ্রের সারা মাস ধরে কাটা হয় ধান। ঝাড়াই মাড়াই ও ধান ভেনে ঘরে তোলার জন্য ডাক পড়ে মেয়েদের। অক্লান্ত পরিশ্রমের কাজটিকে তাঁরা গানে গানে আনন্দময় করে তোলেন। দৈনন্দিন জীবনের আশা আকাঙ্ক্ষা, সুখ- দুঃখ, স্বপ্ন ও বঞ্চনার সবরকম তরঙ্গ প্রতিধ্বনিত হয় সুরে সুরে। আর কিছুদিন পরে সোনার ফসল ঘরে তোলার পালা। সারা বছর অনটনে কাটানোর পরে খুশির দিন আগতপ্রায়। আর সেই খুশির শুভ সূচনার দিন হল ভাদু পুজো।
ইতিহাস হয়তো নির্লিপ্ত থেকেছে, কিন্তু গ্রামীণ স্মৃতিতে নানা কাহিনি রূপ নিয়েছে ভাদুর। উৎপত্তির কারণ যা-ই হয়ে থাকুক, ভাদু সম্পূর্ণভাবে যে কোনও ধর্মীয় আড়ম্বর, মন্ত্রপাঠ, পুরোহিত বর্জিত এক প্রাণের পুজো। উপাচার, আয়োজন সামান্যই। যে পুজোর মূল মন্ত্র হল গান। ভাদু উৎসবের প্রাণ হল গান। কিন্তু এক রাজকন্যেকে নিয়ে গানই যে কীভাবে মাটির এত কাছের গান হয়ে উঠল, ভাবতে অবাক লাগে। আরও অবাক লাগে, ভাদু গানের সঙ্গে জড়ানো রীতিকে দেখলে। পয়লা ভাদ্র কুমারী মেয়েরা ঘরে ভাদু প্রতিষ্ঠা করে। কোথাও ভাদ্র সংক্রান্তির দিন পাড়ার মহিলারা কারও ঘরে একটি স্থান নির্দিষ্ট করে, সেখানে তক্তপোশ দিয়ে একটি ম্যারাপ বা মঞ্চ প্রস্তুত করেন। রংবেরঙের শাড়ি এবং নানা ঘরোয়া জিনিস দিয়ে সেই মঞ্চকে করেন সুসজ্জিত। মৃৎশিল্পীর গড়া এক সুন্দর নারী প্রতিমা এনে সেটিকে ওই মঞ্চে একটি বেদিতে স্থাপন করা হয়। সাজসজ্জা আরও আকর্ষণীয় করতে ব্যবহৃত হয় শালুক ফুল। সন্ধ্যাবেলা সুসজ্জিত হয়ে হাতে মিষ্টি, চিঁড়ে, খাজা, ঘরে তৈরি গুড়-পিঠে, ফল প্রভৃতিতে পরিপূর্ণ থালা নিয়ে, ভাদু মূর্তির চারপাশে সেই থালা সাজিয়ে মহিলারা মাদুর পেতে সমবেত কণ্ঠে শুরু করেন ভাদু গান–
‘আমার ঘরকে ভাদু এলেন
কুথাকে বসাব।
পিয়াল গাছের তলায় আসন পাতব না না
আমার সোনার ভাদুকে কোলে তুলে লিব।।
ভাদু খাবেক কড়কড়া
মোতির দাঁতে আওয়াজ দিবে
কুটুর মুটুর মড়মড়া।।’
ভাদু এখানে কন্যা, সোনার বরণ ভাদুকে কোলে তুলে আদর করা যায়, দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখের অংশীদার করে অতি তুচ্ছ ঘরোয়া উপকরণ কড়কড়া খেতে দেওয়া যায়। আসলে গ্রামীণ নারীদের কণ্ঠে ভাদু গানে ধরা আছে নিখাদ নারী সমাজের মনের কথা, গৃহস্থ জীবনের হাসি-কান্না, আছে মহাভারত-রামায়ণের গল্প, বারোমাস্যার সুর। নানা ছড়ায় উঠে আসে সমাজের ব্যঙ্গ, গ্রামের আড্ডা, জীবনের রং।
কখনও আবার দলবেঁধে মহিলারা অন্যের ভাদু দেখতে যান। যান অন্যের ভাদু গানের বিষয়বস্তু শুনতে বা তাদের পাড়ায় গান করতে। অন্য দল বা পাড়ার মেয়েরা ভাদু দেখতে বা গান গাইতে এলে তাঁদের অভ্যর্থনা জানানোর রীতিটিও বেশ আকর্ষণীয়। অভ্যর্থনা জানানো হয় গানের মাধ্যমেই– ‘ভাদু বৈলতে আলি তোরা/ বৈসলো তোরা ছাঁচকোলে/ পাৎনা ভৈরে মাড় রাখ্যেছি/ খা লো তোরা প্যাট ভৈরে।’ ভাদু দেখতে এসে বা গান গাইতে এসে অন্যের ভাদুর কোনও খুঁত দেখলে সমালোচনা করতেও ছাড়েন না কেউ– ‘এই ভাদুটি কে গৈড়েছে/ নীলু ছুতার মিস্তিরি/ গড়নে গৈড়েছে ভালো/ গলায় দেয় নাই চাপকলি।’ যাঁদের ভাদুর সমালোচনা করা হয়, তাঁরাই বা ছাড়বেন কেন! তাঁরাও গেয়ে ওঠে, ‘তোদের ভাদু পৈরতে খুঁজে/ নূতন ছকের কাল্লাফুল/ হাতে নাই পুরাণ সিকি/ এত কিসের সাধ লো তুর।’ এভাবে গানের প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়েই কেটে যায় ‘ভাদু জাগরণের’ রাত। সারা রাত জেগে থাকে গ্রাম। পরের সকালে সমবেত ভাবেই মাথায় নিয়ে কোনও জলাশয়ে বিসর্জন দেওয়া হয় ভাদুকে।
এক সময় ভাদুর জাগরণ– বিসর্জনে হরেকরকম মিষ্টান্নতে ম-ম করত পঞ্চকোট। পঞ্চকোটের রাজসভায় ভাদু উৎসবে ২৫ কেজির লাড্ডু তৈরি হত। ভাদুকে দেওয়া হত একান্ন রকমের মিষ্টি। ভাদু পরবের মিষ্টি বানানোকে ঘিরে কম তোড়জোড় ছিল না এই ভাদুভূমে। জানা যায়, ভাদু-র সময় ছোটোলাটের কাছে মিষ্টি পাঠানো হত। দু’কেজি ওজনের লাড্ডু, থালার মতো জিলিপি দোকানে সুতোয় বেঁধে ঝোলানো থাকত। এমনকী, লাড্ডু–জিলিপির নিলাম হত। সারা ভাদ্র মাস জুড়ে তৈরি হত হরেক রকমের মিষ্টি। এখন সেসব শুধুই স্মৃতি। বাঁকুড়ার কেঞ্জাকুড়ায় ভাদুর স্পেশাল মিষ্টি ছিল আঁকরা মিঠাই। হাঁড়ি, গ্লাসের মতো আকৃতির এই মিষ্টি বিক্রি হত। তবে সেই আঁকরা মিঠাই না থাকলেও ভাদু-র জিলিপিতে এখনও পাক দেয় এই সাবেক মানভূম। শস্যের দেবী ভাদুর আরাধনায় এই গ্রামে শুরু হয়ে যায় জিলিপি উৎসব। দু’কেজি, আড়াই কেজি, তিন কেজি ওজনের একেকটা জিলিপি।
বীরভূমে পা রাখলে দেখা যাবে ভদ্রাবতী নাকি পুরুলিয়ার নন, হেতমপুরের রাজকন্যা। বর্ধমানের রাজপুত্রকে মন দিয়েছিল সে। ইলামবাজারের কাছে চৌপারির শালবনে ডাকাতদের হাতে রাজপুত্র মারা যায়, তখন তার সঙ্গেই সহমরণে গেছিল ভদ্রাবতী। সেই যন্ত্রণার ইতিহাসই নাকি বোনা ভাদু গানে। বীরভূমে ভাদু উৎসব আরও বৈচিত্রময়। এখানে পয়লা ভাদ্র একজন ছেলেকে মেয়ে সাজিয়ে তার কোলে ভাদু মূর্তি বসিয়ে পুরুষদের দল নাচ গান করে বাড়ি বাড়ি অর্থ সংগ্রহ করে। সংক্রান্তির রাতে হয় জাগরণ, আর ভোরবেলায় বাদ্যের তালে মূর্তি বিসর্জন। মহিলারা এই উৎসবে অংশ নেন না– এ যেন ভিন্ন সুরে বাঁধা এক ভাদু। ভাদুর মূর্তি নাকি ছিল না আগে। ফুল রেখে বা গোবরে ধান দিয়ে মূর্তি কল্পনা করা হত। কিন্তু, এখন মূর্তি এসেছে। সেই মূর্তিরও নানা রূপ। কোথাও ভাদু হংসে উপবিষ্টা, কোথাও বা ব্রাহ্মণ্য ঘরানার মূর্তির ঘেরাটোপে ক্রমশ জড়িয়ে পড়ছে লোক-কল্পনার ভাদু।
সব মিলিয়ে, ভাদু গান, ভাদুর কিংবদন্তিকে বড় ভালোবেসে জড়িয়ে রাখে রহস্য। যে গান, যে উৎসবের গড়ন, রীতি রাজপরিবারের দরবার ছাড়িয়ে নেমে এসেছে মাটিতে। ঔপনিবেশিক সময়ের এক রাজকন্যার গল্প কীভাবে এমন একটি লোকউৎসবের জন্ম দেয়– তা নিয়ে বিশদে তর্ক চলতে পারে। কেউ কেউ বলেন, ভাদুর গল্প আসলে আরও সুপ্রাচীন। এই গল্পে পঞ্চকোট বা হেতমপুরের রাজপরিবারের ইতিহাস যুক্ত হয়েছে পরে। যেভাবে, লোকগান ভাদুকে দরবারি আঙ্গিকে জুড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন পঞ্চকোট রাজারা। কেউ বলেন অন্য কথা। ভাদু গানের সুরের মতোই ভাদুকে ঘিরে থাকা ইতিহাস, লোকশ্রুতি, প্রথারা ভেসে ভেসে যায় দূর-দূরান্তরে। ভদ্রাবতীর অশ্রুর কাহিনি, মাটির প্রতিমার হাসি, নারীকণ্ঠের সুর– সব মিলিয়ে ভাদু হয়ে উঠেছে বাংলার অমূল্য লোকঐতিহ্য। ভাদু মানে দুঃখের সঙ্গে লড়াই, ভাদু মানে গান দিয়ে জীবনকে সাজিয়ে তোলা।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved