Robbar

পাগলি তোমার সঙ্গে জেমিনাই জীবন কাটাব

Published by: Robbar Digital
  • Posted:October 3, 2025 5:45 am
  • Updated:October 3, 2025 5:45 am  

আমরা স্মৃতিকে অনুবাদ করেছি এআই প্রম্পটে। ঘুম ভেঙে দেখেছি, মাথার কাছে বসে আছে আমারই বছর বারো। আমাদের গিয়েছে যেদিন, একেবারে যায়নি। তাই স্মৃতির অলিগলি রিভিশন দিতে গিয়ে মনে হচ্ছে, এ-সবই তো আমার জানা। এক্ষুনি দেখেছি ল্যাপটপের স্ক্রিনে। জীবন থেকে রোমাঞ্চ ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে। মৃত ঠাকুমার ছবি নিউজফিডে লাভ রিয়্যাকশানে ছয়লাপ। মধুবালার মতো বৃষ্টিতে ভিজছে কেউ। মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে ডিনার করছেন কেউ। এক টেবিলে বসে। আর একটা শূকর, নিউজফিডে এসে নিজের মধ্যমা তাক করছে সভ্যতার দিকে। কী দারুণ ভিস্যুয়ালি ডিসটর্ডেট একটা পৃথিবী। এক প্রম্পটে জীবিত আর মৃতের ধারণা কেমন গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। এরপরে কি আমরা আরও জীবনমুখী হয়ে পড়ব? কারণ জীবন মানে জল, জি-বাংলা আর জেমিনাই…

রোদ্দুর মিত্র

স্যর পড়াচ্ছিলেন, জীবন মানে জল। আমরা শুনছিলাম, জীবন মানে জি-বাংলা। জীবন অগাধ হওয়ার পথে গোঁত্তা খেয়ে গেল তখনই। ফুলটু এন্টারটেনমেন্টে ভাসতে ভাসতে কবে যে জীবন মানে ‘জেমিনাই’ হয়ে গিয়েছে মশাই, টের পাইনি। মাইরি বলছি। একদিন সকালে উঠে দেখলাম, সকলের গায়ে লাল শিফনের শাড়ি। খোঁপায় গোলাপ ফুল। অথবা চুল-দাড়ি কামিয়ে, একটা পারফেক্ট শার্ট। মুখের ওপর বিকেলের মরা আলো।

গ্রেগর সামসার মতো আমরা পোকা হইনি অথবা আখেরে হয়েছি– আশ্চর্য আর অমোঘ সেই মেটামরফোসিস, যার একেকটা মেটা ইমেজ হাসছে, গাইছে, চুমু খাচ্ছে আর গোল্লাপাক দিচ্ছে খেয়ালে। দেওয়ালে। কল্পনার তো কোনও ডাইমেনশন নেই, সে অ্যাবস্ট্রাক্ট, তাই আমরা জেমিনাইয়ের কাছে গিয়ে লিখছি, হাগ মাই ইয়ঙ্গার সেলফ! এক প্রম্পটে দশ বছরের ‘আমি’ এসে দাঁড়িয়েছে। আমারই পাশে। জড়িয়ে ধরতে চাইছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলছি, আহা! ওই ইনোসেন্স যদি ফিরে পেতাম! আসলে আমরা যা নই, তা হয়ে উঠতে চাওয়ার সাধ আমৃত্যু মোছে না। সেই থেকেই জন্ম নেয় আশাবাদ। আমাদের তাড়া করে বেড়ায়। তাই যা ছিল অগোছালো, বেয়াড়া, অসম– এক প্রম্পটে এ দেহ আর মন থেকে ক্রপ করেছি। স্লিম অ্যান্ড সেক্সি। সকলকেই দেখতে এক। সকলেরই পছন্দ এক। ইমাজিনেশনও এক। সকলেই তাই এক ছাতার তলায় হাজির। ভরা লকডাউনের অখণ্ড অবসরে, যেমন লিখেছিলেন, পিডিএফ দিও! এখন, প্রম্পট দিও।

কারণ, এই প্রম্পট যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হত? পাটুলি থেকে পেনসিলভানিয়া। বাগনান থেকে ব্লুমসবেরি। প্রেমিকার হাত ধরে মিনিটে মিনিটে ছবি। একটা কাল্পনিক প্রি-ওয়েডিং শুট। টিউলিপ গার্ডেন। কিঞ্চিৎ বেহালা। পাগলি তোমার সঙ্গে জেমিনাই জীবন কাটাব। কিংবা ওয়ামিকা গাব্বির কাঁধে মাথা রেখে একটা সেলফি। এই যে এত ছবি, এত প্রম্পট, এত লাইক প্রাণ পায় কী থেকে? একটা দুর্বার ইচ্ছে। একটা স্বপ্ন। একটা ইটারনাল দুঃখ। সেইসব কি তবে ফুরিয়ে যাবে? বহু আকাঙ্ক্ষিত সুদিন কি দুয়োরে? সেই লাল-নীল সংসার তৈরি করে দিয়েছে জেমিনাই। আমরা এইবার বাঁচব। একসঙ্গে। মেটা-পৃথিবীতে। তাহলে রিয়েলিটি? ডোপামিন আর সেরোটোনিনের মায়াবী খেলাধুলো। বেঁচে থাকতে বোধহয় ওটুকুই কাফি। সঙ্গে পরোটা। বিরিয়ানি। ইন্সটাগ্রাম রিল।

এ যদি বাঁচা হয়, সমস্যা কী? শৈশব থেকে মায়ের কোল পায়নি যে ছেলেটা, জেমিনাই এক প্রম্পটে খুঁজে দিয়েছে সেই অতিলৌকিক কোল। আমার মনে পড়ে অক্ষয় মালবেরি। মণীন্দ্র গুপ্ত বলছেন, যখন তাঁর দশ মাস বয়স, মা মারা গেলেন। তারপর থেকে কেউ বলেছে, জন্মাইয়াই মায়রে খাইছ? কেউ-বা সকরুণ বলেছে, ওর মা নেই। এ-লেখায় আমি যে বিষয়ে ফোকাস করতে চাইছি, তা শুধুমাত্র মা অথবা বাবা অথবা আত্মজনে সীমাবদ্ধ নয়। মণীন্দ্র গুপ্ত লিখছেন: “…ক্রমাগত শুনতে শুনতে শেষে, যে নেই তার না থাকার জন্য একটা আবছা কুয়াশাভরা অপরাধ ভিতরে ছায়া ঘনিয়ে আনত। মনে হত, কোনো দুর্গম কারণে সংসারে আমি অস্বাভাবিক, এবং একা।”

লক্ষ করে দেখুন মশাই, ‘নেই’ বলে একুশ শতকে কিচ্ছুটি আর নেই। দুর্দান্ত কোনও মাসিহা হয়ে রোয়াব নিচ্ছি যেন পৃথিবীতে। ঘরে ঘরে যেন উত্তর আধুনিক ফ্যাঙ্কেনস্টাইন। ভার্চুয়ালি মানুষ আর নিসর্গ তৈরি করে দেয়। সুতরাং, যাবতীয় ‘নেই’ থেকে উদ্ভূত দুঃখ, ‘নেই’-এর প্রতি যে অনিবার্য টান, সন্ধে নামার আগে ভীষণ একা হয়ে যাওয়া– সেগুলো ফিকে। ফিকে হতে হতে একদিন নিঃস্ব হয়ে গেলে, আর কী আশ্বাসে বেঁচে থাকে মানুষ? তাকে চারিয়ে নিয়ে যাবে কে? স্বপ্নহীন, বিষাদহীন, জ্ঞানহীন, শুধুমাত্র ৩০ সেকেন্ডের এন্টারটেনমেন্টে ভেসে যাওয়া একটা ক্রিচারের মতো থামব কোথায় শেষে?

জেমিনি এআই-এর নিজেকে নিয়ে বানানো কার্টুন

আমরা স্মৃতিকে অনুবাদ করেছি এআই প্রম্পটে। ঘুম ভেঙে দেখেছি, মাথার কাছে বসে আছে আমারই বছর বারো। আমাদের গিয়েছে যেদিন, একেবারে যায়নি। তাই স্মৃতির অলিগলি রিভিশন দিতে গিয়ে মনে হচ্ছে, এ-সবই তো আমার জানা। এক্ষুনি দেখেছি ল্যাপটপের স্ক্রিনে। জীবন থেকে রোমাঞ্চ ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে। মৃত ঠাকুমার ছবি নিউজফিডে লাভ রিয়্যাকশানে ছয়লাপ। মধুবালার মতো বৃষ্টিতে ভিজছে কেউ। মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে ডিনার করছেন কেউ। এক টেবিলে বসে। আর একটা শূকর, নিউজফিডে এসে নিজের মধ্যমা তাক করছে সভ্যতার দিকে। কী দারুণ ভিস্যুয়ালি ডিসটর্ডেট একটা পৃথিবী। এক প্রম্পটে জীবিত আর মৃতের ধারণা কেমন গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। এরপরে কি আমরা আরও জীবনমুখী হয়ে পড়ব? কারণ জীবন মানে জল, জি-বাংলা আর জেমিনাই…

জেমিনি এআই-এর নিজেকে নিয়ে বানানো কার্টুন

যে মন একা, জলের মতো ঘুরে ঘুরে কথা কয়, নিরালা পুকুরঘাটে বসে বারবার ভেবেছিল জলফড়িং হয়ে যাবে, সন্ধে নামার আগে অকারণেই যে মনগুলো খারাপ হয়ে যায়– সেইসব মনের ওপরেই বোধ করি অভিঘাত ভীষণ। কেন? যেহেতু আমাদের আর কোনও আবডাল নেই। আপনি ঘরের পর্দা বদলেছেন, আমরা জানি। আপনি বাজারে গিয়ে ভোলা মাছ কিনেছেন, সেটাও আমরা জানি। অর্থ হয়, জেমিনাইয়ের এহেন ছবির বিস্ফোরণে আমরা প্রত্যেকেই বুঝে নিয়েছি, সকলেই প্রত্যেকে সুন্দর। নিখুঁত। লাবণ্যে ভরপুর। এক ছাতার তলায় নিয়ে আসা হয়েছে। রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে সুবিধে হবে। জেমিনাইয়ের কাছে গিয়ে বলি, মেক প্যালেস্তাইন ফ্রি এগেইন! বাফার করতে শুরু করে। একটা অনন্ত বাফারিংয়ের ভেতর বসে চিৎকার করি। লাথি মারি। উন্মাদ হয়ে যাই। কিন্তু বাস্তবে ফিরতে পারি না। জেমিনাই দারুণ একটা ছবি বানিয়ে দিয়েছে আমার। চুলদাড়ি কামানো, ফ্লোরাল শার্ট…