Robbar

লেখার অত্যাচার, লেখার বাঁচা-মরা

Published by: Robbar Digital
  • Posted:October 4, 2025 7:48 pm
  • Updated:October 4, 2025 7:51 pm  

লিখতে গিয়ে যখন বিরক্তি আসে, ঘুম পায়, মনে হয় কথাগুলো বলে হবেটা কী। আমার তো বলার সত্যিই কিছু নেই। ক্লান্ত, অবসন্ন লাগে কথা বলতে, লিখতে। ঠিক তখন এই বইগুলোর কথা উঠে আসে। লেখা, বলা আর নিঃশব্দের সমবায়ে যে জীবন আমরা কাটাচ্ছি, তাতে আপতকালের অনুভূতিটা থাকা চাই। তুমি একা দুঃস্থ নও, তোমার ঘরে শুধু নয় চতুর্ভিতেই বন্দিশালা। লেখা তাকে ভাঙতে পারে।

সুমন্ত মুখোপাধ্যায়

৬.

ঘোড়া দেখলেই সবার পায়ে বেমালুম বাত। কোনও কিছু লিখতে গেলে এই তেজি প্রাণীর চলাফেরা মনে আসে। সোজা গট গট করে কিছু যে বলে যাব, এমন কনফিডেন্স কস্মিনকালেও ছিল না। আড়ে আড়ে কোনাকুনি চলতে গিয়েও লজ্জায় মাথা কাটা যায়। তাই আড়াই চালে ভাবি। বাধা টপকে আদার ব্যাপারীও মোক্ষম ঘরটিতে গিয়ে বসতে পারে চোখের পলকে। কাটাকুটি– সে পরের কথা। তবে নিওলিথ স্তব্ধতায় না হোক মহীনের পোষা জীবটির আপন মনে ঘাস খাওয়ার দৃশ্য নিউটাউনেও দেখা যায়, সূর্যাস্তে, সন্ধ্যায়। স্যুররিয়াল। বিষাদ মন্থর। দিনশেষের লালচে আলোয় পিঠের ভাবনা-ক্ষতগুলো চিক চিক করে। কারও হাসি পায়, কারও চোখে জল আসে।

………………………….

পড়তে ভালো লাগে। নানারকম বই নিয়ে শব সাধনা। ছড়িয়ে থাকা বই, এটা টেনে নাও ওটার ক’-পাতা দেখো। মন বসে গেলে সারা দিনরাত পড়ো। সে আর আজকাল ফুরসতের অভাবে হয় না। সারাক্ষণই মনে নানা কথা জন্মাতে থাকে মরেও যায়, প্রতি মুহূর্তের সংঘাতেই কত কথা।  বললেই আবার উত্তর-প্রত্যুত্তর, অনেক লোককে রাস্তায় বা বাড়িতেও বিড়বিড় করে রিহার্সাল দিতে দেখেছি। এটা বলব, ও যেই ওটা বলবে অমনি ঘ্যাঁচ করে তাল ফেরতা ফেলব, বাছাধন যাবে কোথায়। এইমতো আমাদের অস্তিত্ব, সামাজিক-ই বলো সাংসারিক বলো আর রাজনৈতিক– এই আপন মনে বিড়বিড়ানি ছাড়া আর কিছু নয়। এমন একটা রিহার্সাল যা কোনও দিন স্টেজে উঠবে না। এই গোটা পৃথিবীটা যেখানে এসে পৌঁছেছে, তাতে যা হওয়ার তাকে অমোঘ বলে মনে হচ্ছে। এই নিয়তির মতো করে চারপাশটার একটা চেহারা দেওয়া, ইতিহাস জিনিসটার ভেতর মানুষের কর্মক্ষমতায় ঢেঁড়া কেটে দেওয়াই বোধহয় পণ্যবাদী ধনতন্ত্রের সফলতম চেহারা। যা হওয়ার তা হবে। আর তুমি কথায় কাটো কথার প্যাঁচ।

কথাগুলো কোথা থেকে এসে কোথায় যে যায়, হরিচরণবাবু জানতেন। লেখা তখন মনে হয় খানিক অত্যাচারের মতো। বাক্য, শব্দ, দাঁড়ি, কমা, কোট, প্যান্ট, সেমিকোলন– এত লেখা, এত শুভ, বুদ্ধি, বিশ্লেষণ, ঘৃণা, বিদ্বেষ, ব্যঙ্গ, বীরবাক্য– কী হয় এ দিয়ে? পৃথিবী জুড়ে  যে নির্লজ্জ দীর্ঘ গণহত্যাগুলো ধারাবাহিক চলেছে, তা কেউ শত লিখেও থামাতে পারছেন? এর মধ্যে একটা-দুটো প্যালেস্টাইনের বাচ্ছা যদি হাত ফসকে বেঁচেও যায়, আর জগতের দিকে আঙুল তোলে, তখন কী বলব? আমরা তো লিখছিলুম ভাই রে! অতদূরেই বা যেতে হবে কেন, দেশজোড়া পাজির পা-ঝাড়াগুলোর বাড়-বৃদ্ধি দেখে আমাদের বাচ্ছাগুলোই যদি একদিন তেড়ে ওঠে, তখন আমি যে বাতাসা খাচ্ছিলাম, মানে এখানে-ওখানে লিখছিলাম, এইটাই তো বুঝিয়ে বলতে হবে। এইসব সাত-পাঁচ মাথায় আসে লিখতে বসে। ফেসবুক, টুইটার, ইন্সটা, রিল– সোশাল মিডিয়ার ব্যবহারকে কীভাবে করেন, সেটা নিয়ে ভাবছি না। এটা তো ঠিকই, সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে এক বিপুল সাক্ষর-নিরক্ষর জনসংখ্যা খুব সহজেই নিজের মনের কথা আজ লিখে বা বলে জানাতে পারেন। হাতে একটা ফোন থাকলেই চলে। অনেক অন্যায় অবিচার, প্রতিবাদ, ব্যথা, হাসি, দুঃখ– এইসব প্ল্যাটফর্মে ভেসে থাকে। সেই লেখা পড়ে কেউ ‘সঙ্গে আছি’ বলে কেউ-বা ট্রোল করে, অনেকে শুধু দেখে– কিছুই বলে না। লাইক-ডিসলাইক-লাভ ইমোজি দিয়ে কাজ সেরে নিজের পোস্টে মন দেয়। তরুণদা– আমাদের  তরুণ পাইন বলেছিলেন, এত্ত বড় নার্সিসাস ফুলের ডোবা তুমি কোথাও পাবে না। কথাটা ঠিক। আবার রোজগারপাতিও হয় এ-লাইনে। কিছু গ্রুপ থাকে তারা সাহায্যের জন্য ছুটে আসে। কতগুলো ইনফরমেটিভ, নানা খবর পাওয়া যায়। খুব কাজের, খানিক বিজ্ঞাপনের লেখা। এ-সবের বাইরের ব্যাপার নিয়েই আদত ভাবনা। লেখা-পড়া-জানা– সব কিছুরই বোধহয় ক্ষেত্র বিশেষে মানে পাল্টে গেছে। আমার যদি কাউকেই কিছু বলার না-থাকে সেই সাদা ফাঁকা শূন্য মনটার আজ আর জায়গা নেই কোথাও। চুপ করে থাকার দিন গিয়েছে।

The Cell And The Soul A Prison Memoir

কিন্তু লেখা কখনও যদি বাঁচার একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়ায়? সেই লেখা লিখতে পড়তে ইচ্ছে হয়। ভালো-খারাপ নয়, সেখানে বেঁচে থাকার একটা ইমারজেন্সি টের পাওয়া যায়। যেটা আছে, অথচ সারাক্ষণই থাকে ধামাচাপা। এই যেমন এক্ষুনি সে-রকম লেখা পড়তে পেলাম।

আনন্দ তেল্টুম্বে। শিল্পী: দীপঙ্কর ভৌমিক

আনন্দ তেল্টুম্বে-র লেখা ‘দ্য সেল অ্যান্ড দ্য সোল: এ প্রিজন মেমোয়ার’  এই ক’দিন হল সদ্য প্রকাশ পেয়েছে। তেল্টুম্বের কথা আমরা কম বেশি শুনেছি কুখ্যাত এলগার পরিষদ বা ভীমা-কোরেগাঁও মামলার অন্যতম বাদী পক্ষ হিসেবে। যে মামলা এখনও চলছে, তা নিয়ে কোনও মন্তব্য না-করাই রেওয়াজ। কারণ সারাক্ষণই বাতাসে ভাসছে– আইন আইনের পথে চলবে। যদিও সে পথ গিয়েছে কোনখানে– এর সদুত্তর, ট্যাঁকের জোর না থাকলে পাওয়া মুশকিল। থাকলেও মুশকিল। বিখ্যাত বাবরি মসজিদ ধ্বংস আর অযোধ্যা মন্দির নির্মাণের রায় তো এই সেদিনের ঘটনারে বাপু! তবুও এলগার পরিষদ বা ভি কে মামলা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে কম কিছু লেখা হয়নি। দেশি-বিদেশি অনেক বিখ্যাত বিদ্যাজীবী, সাংবাদিক, আইনজীবী এর ভেতরকার ব্যাপার-স্যাপার স্পষ্ট করে দিয়েছেন। আল্পা শা আর আজাজ আশরফের দুটো বইতেও অনেক কিছু ফাঁস হয়েছে। এই কেসে অসংখ্য দরিদ্র দলিত মানুষের সঙ্গেই গ্রেফতার হয়েছিলেন ফাদার স্টান স্বামীর মতো সমাজকর্মী, গৌতম নওলাখা, হানিবাবু, সোমা সেন, জি এন সাইবাবার মতো বিদ্যাজীবী। ওয়ার ওয়ারা রাওয়ের মতো কবি এবং অবশ্যই তেলটুম্বে। অন্যদের কী দশা হয়েছে সেকথা এইখানে তুলব না। বেশিরভাগ জেলে পচছেন। ফাদার স্বামী জেলে মারা গিয়েছেন, সাইবাবা জামিন পেয়ে বাড়ি অবধি পৌঁছেছিলেন, যেখানে তাঁর আধখানা শরীরের বাকি ৯০ শতাংশ ভেঙে পড়ে, ১০ শতাংশ নিয়ে তিনি আমাদের একটা বই উপহার দিয়ে চলে গিয়েছেন। তেলটুম্বে বেঁচে। আর ওঁর জেলখানার স্মৃতিতে  বলছেন– তিনি এই লেখায় নির্ভর করেই এখনও খানিক টিকে আছেন। জেল নইলে খেয়ে ফেলত।

স্ট্যান স্বামী

এই ধরনের আপতকালীন লেখার কথাই ভাবছিলাম। উনি জেলখানায় কোভিড-১৯ কাটিয়েছেন, কোনও সাবধানতার বালাই সরকার যেখানে রাখেনি। অনেকেই ছিল সংক্রমিত, সোশ্যাল ডিসট্যান্সের কোনও বালাই ছিল না। জামিনের কোনও সম্ভাবনা নেই। একরকম করে মরার সমস্ত আয়োজন ছিল সম্পূর্ণ। এই গোটা সময়টার বর্ণনা আছে তেল্টুম্বের বইটার একটা অংশ জুড়ে। তিনি লিখছেন– ‘জেলখানা এমন একটা জায়গা, সময় যেখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। জীবনটাকে ল্যাংটো করে শুধুমাত্র যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুর সামনে খাড়া করা হয়। আর মানুষের বাঁচার ইচ্ছেটাকে শেষ সীমায় ঠেলে নিয়ে যায়, জেল।’ এই রকমই বাঁচা মরার সীমান্তবর্তী অবস্থানে লেখাটুকু আঁকড়ে ধরে দিন কাটিয়েছিলেন সাইবাবা-ও। সাইবাবা-র জেলে বসে লেখা টুকরো গুলো আরও করুণ। পরিকল্পনাহীন, আবেগভরা। কিছু কবিতা, কিছু গদ্য। যে-লেখাগুলোর কথা বলছি তাদের তত্ত্ব-গুণ বা সাহিত্যগুণ নিয়ে আদপেই ভাবছি না। শুধু এই অবস্থানটার কথা বুঝতে চাইছি। যেখানে কথা লেখা আর আমার বেঁচে থাকার মধ্যে এক সুতোর ভেদ থাকবে না। জেলের ভেতর এমন কত লেখাই তো আছে? গ্রামশির জেলখানার নোটবুক অন্য কোথাও বসে লেখা সম্ভব ছিল? জেলখানার নজরদারি এড়িয়ে লেখার জন্য রাজনৈতিক তত্ত্বের চালু পরিভাষাগুলো পাল্টে নিয়েছিলেন গ্রামশি। মার্ক্সের চিন্তার ভেতর থেকে শুধু নতুন শব্দের ব্যবহারেই নতুন রাস্তা বানিয়ে দিলেন তিনি । যে-পথে পরবর্তী সমাজচিন্তার নানাদিকের হদিশ পেলাম আমরা।

Selections from The Prison Notebooks of Antonio Gramsci : Gramsci, Antonio: Amazon.in: Books

তবে জেলের কথা বলতে গিয়ে মনে আসছে এই লাইনটাও– ‘যারা জেলে থাকেন, ভাইসাহেব ,শুধু তারাই বন্দী নয়’। লাইনটা ভাস্কর চক্রবর্তীর ‘স্বপ্ন দেখার মহড়া’য় আছে। যেমন রাণা রায়চোধুরীরলাল পিঁপড়ের বাসা’ বইয়ের উৎসর্গ কবিতায় ছিল ‘জেল খাটতে এসেছি, জেল খেটে চলে যাব’। এই হল জেলের বন্দিদশাটাকে লেখকের নিজস্ব অবস্থানের সঙ্গে মিলিয়ে ভাবা। আবার নাজিম হিকমেত-এর অসামান্য জে খানা থেকে লেখা চিঠি, কবিতা হিসেবে জেল থেকেই লেখা। যেমন মীনাক্ষী সেনের বই ‘জেলের ভেতর জেল’। ওদিকে সব দেশের মতোই এই দেশে জেলের ভেতর অন্য খেল-ও চলে , পয়সা বা ক্ষমতা থাকলে। ঠিক উল্টোদিকে খোলা আকাশের নীচে দেশের মানুষ একটা খোলা জেলের ভেতরেও থাকে, থাকতে পারে। ভারতের অনেক জায়গায় অনেক মানুষ তেমনভাবে হাড্ডাহাড্ডি বেঁচে আছেন। যেমন কাশ্মীর, মণিপুর, লাদাখ, আসাম কিংবা বস্তারে। যেমন হরিয়ানাতেই বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকরা।  ভারতেই বা কেন, বাইরে, গোটা পৃথিবীর যেদিকে যাও এরকমভাবে বন্দি থাকে লোকে। নইলে নিকানের পাররা ‘আমেরিকা’ শীর্ষক এক লাইনের কবিতায় লিখবেন কেন ‘যেখানে স্বাধীনতা একটা মূর্তি’। ‘স্ট্যাচু অফ লিবার্টি’র এমন অপরূপ  বিবরণ শুনে মুগ্ধ হয়ে আছি আজও। গত কয়েক বছরে গাজা খানিকটা খোলা বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে। অনেকেরই মনে পড়বে ইলান পাপ্পে-র ‘দ্য বিগেস্ট প্রিজন অন আর্থ’ বইটার কথা। ২০১৭ সালে প্রকাশিত এই বই গাজা ভূ-খণ্ডের মানুষের কথা বলে। আজ প্রায় ৮ বছর পরে সেখানকার মানুষের খোলা জেলখানার লেখা পড়তে পাওয়া যাচ্ছে এ-বছরই প্রকাশিত ‘লেটারস ফ্রম গাজা’ বইটার পাতায় পাতায়।

খান ইউনুস-এর ৩৫ বছর বয়সি গবেষক মোহাম্মদ আল-জাকজুক-এর লেখার নাম: ‘আমি লিখি, নইলে বর্বরতা গিলে খাবে’। আল-জাকজুক লিখছেন নিজের সঙ্গে নিজের কী মারাত্মক লড়াই চালিয়ে ১০৬ দিন চোখের সামনে দেখা ধ্বংস যজ্ঞে বসে , লিখতে শুরু করলেন তিনি– যখনই আমি তাকাই যারা চলে যাচ্ছে তাদের দিকে, গাড়ি কিংবা তাঁবুর ভেতর,সব মুখ মরছে। হচ্ছেটা কী? নিজেকেই বলে দেখি। মুখগুলো সব মরছে। হায় আল্লা! এ-সব মরা মুখ। রোদে খাওয়া, হতাশায় চাটা। সেলাই করা সব শরীর, যা হয়ে চলেছে তার ঘা-এ মুখগুলো ভয়ে কাঠ। কত যন্ত্রণা আর প্রশ্ন জমে আছে চামড়ার ভাঁজে ভাঁজে।

লাল চুলের মেয়ে বিসন নাতিল, বাচ্চাদের জন্য উপন্যাস লিখেছিল ‘পাগলা লুনা’, কোথায় সে এখন? জানা নেই। ‘কী ভাবে কাটাবে তুমি দিন’ লেখাটায় লিখে রেখেছে: কীভাবে মরব আমরা? এক টুকরো, দু-টুকরো… তিন? আমরা তবে কি শুধু টুকরো টুকরো দেহ হয়ে যাব?/ কোথায় ছলকাবে রক্ত আমাদের?/ মৃত্যুটাকে কেমন দেখাবে?

পরপর আসন্ন ইমেজগুলো লিখতে লিখতে বিসন প্রশ্ন করছেন, ‘কী ভাবে কাটাও তুমি দিন রাত?’ আর তারপরেই মোটা হরফে ‘উত্তর জবাব খুঁজে খুঁজে’।

খান ইউনুসের কবি হাশিম শালুলা-র কয়েকটা লাইন–

আমার অনেক দুঃখ,
তার মধ্যে সবচেয়ে গভীর হল আমি যে সান্ডুইচটা ওভেনে ভুলে এলাম
পুড়তে দেওয়া তাকে
সেদিনেই আমি ছোট একটা শেষকৃত্য করি
যেন সব দেশগুলো ভুলে যাওয়া অভিবাসী ব্যাগের ভেতরে।

এই কবিতার বা লেখার সবচেয়ে জোরের জায়গা হল এর লেখক আর অক্ষরের মধ্যে কোনও ভেদ নেই। শালুলা লিখেছেন–

টিকে থাকার সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা খুব আশ্চর্যজনক
ছুরির পেছন দিক আর পাখির গলার মতো
ফলাটা আমাদের দিকে নকল করে রাখা
আর গোটা একটা জীবন ভুল বুঝে কাটিয়ে দেওয়ার পর
তাড়া খেতে খেতে স্টেশনের জানলাটুকু আমরা ছুঁয়ে থাকি

Buy FOREST OF NOISE Book Online at Low Prices in India | FOREST OF NOISE Reviews & Ratings - Amazon.in

মোসাব-আবু তোহা, ইংরেজি-তে লেখেন। তাঁর বই ‘ফরেস্ট অফ নয়েজ’-এর একটা-দুটো লেখা এখানে মনে পড়ছে–

ধুলোর ভেতর দিয়ে গড়িয়ে আসছে ট্যাঙ্ক
বেগুন খেতের ভেতর দিয়ে।
বিছানা তোলা হয়নি, আকাশে ঝলকানি, ভাই-রে
জানলায় ঝাঁপ দিয়ে পড়া বোমারু বিমান দেখতে
ধোঁয়ার মেঘ
বোম মারার পর
যুদ্ধ-বিমান: ঈগলের পাল
ডাল খুঁজছে কোথায় ছোঁ মারা যায়
রেডিও লাগবে না
আমরাই খবর।

মোসাব-আবু তোহার সব কবিতাতেই ছোট ছোট জিনিস, খুঁটিনাটিগুলো জীবনটাকে জ্যান্ত করে তোলে। আবু বলছেন– সব কিছু শেষ হয়ে যায়, সিগারেট, চা, কফি, তখন বাজারে গিয়ে স্টক করে নিলেই চলে। তিনজন বন্ধু যুদ্ধে মরে গিয়েছে– ব্যাক্তিগত এই ক্ষতি তো আছেই কিন্তু ওঁর ভাঙা বাড়িটার নীচে যে ঠাকুমার একমাত্র ছবিটা চলে গেল সেটা একেবারে শেষ করে দিয়ে গেল। আমার ঠাকুমার দুটো ছবি ছিল। তিনটেও হতে পারে। তার বেশি নয়। সেই ছবিগুলো কোথায়?

লিখতে গিয়ে যখন বিরক্তি আসে, ঘুম পায়, মনে হয় কথাগুলো বলে হবেটা কী। আমার তো বলার সত্যিই কিছু নেই। ক্লান্ত, অবসন্ন লাগে কথা বলতে, লিখতে। ঠিক তখন যে বইগুলোর কথা বললাম তারা উঠে আসে। লেখা, বলা আর নিঃশব্দের সমবায়ে যে জীবন আমরা কাটাচ্ছি, তাতে আপতকালের অনুভূতিটা থাকা চাই। তুমি একা দুঃস্থ নও, তোমার ঘরে শুধু নয় চতুর্ভিতেই বন্দিশালা। লেখা তাকে ভাঙতে পারে। রনে শার, ফরাসি কবি, যুদ্ধের দিনগুলোয় রেসিস্টান্সে লড়েছিলেন যখন একতাড়া কাগজে লিখে রাখতেন নানা টুকরো কথা। সেসব কথায় ওই জোরের অক্ষর পড়া যায়। সামান্য একটা-দুটো শব্দের আকাশপাতাল বদলে বোঝা যায়, ভালো করে দেখছি না কিছুই। কবিদের নিয়ে রনে শার বলছেন, ‘কবিরা দীর্ঘদিন শব্দের স্ট্রাটোস্ফিয়র-এ থেকে যেতে পারেন না। নতুন চোখের জলে তাঁকে কুঁকড়ে যেতেই হবে, আর নিজেকে টেনে সোজা করে পৌঁছতে হবে নিজের এলাকায়।’

নতুন চোখের জল কে আর চায়? কিন্তু সিধে টানটান লেখার কাছে যেতে গেলে পৃথিবীর ইতিহাসের গুণে ওই পথে যাওয়া ছাড়া লেখার আর গত্যন্তর নেই।

 

এক, দুই, আড়াই-এর অন্যান্য পর্ব …

৫. বিশ্বকর্মা পুজোর সন্ধেবেলাটার মতো বিষাদ আর হয় না

৪. কথা শেষ হতে পারে, ‘শেষ কথা’ বলে কিছু হয় না

৩. দেখা হলে বলে দিও, আজও বেঁচে আছি

২. ফুলের রং শেষ পর্যন্ত মিশে যায় নন্দিনীর বুকের রক্তের ইমেজে

১. আমাদের বিস্মৃতিশক্তির কথা বলে গিয়েছেন ভাস্কর চক্রবর্তী

mosab abu toha