Robbar

পুজোমণ্ডপে রূপান্তরকামীদের প্রতি ইনফ্লুয়েন্সারদের কটূক্তি উৎসবকে ম্রিয়মাণ করে না?

Published by: Robbar Digital
  • Posted:October 7, 2025 8:13 pm
  • Updated:October 7, 2025 8:13 pm  

সম্প্রতি দক্ষিণ কলকাতার একটি পূজামণ্ডপে সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের উপস্থিতি নিয়ে কিছু বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। বিতর্ক তৈরি করেছেন সমাজ মাধ্যমের এক তথাকথিত ‘ইনফ্লুয়েন্সার’ এবং দাবানলের মতো তা চারিদিক ছড়িয়ে পড়ে এটাই প্রমাণ করছে যে, এখনও আমাদের সমাজে সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের জায়গা এতটুকু স্বস্তির নয়। ওই মণ্ডপ দেখে নাকি সকলের ‘থ্যাইল্যান্ড’ মনে হচ্ছে! কেন?

ভাস্কর মজুমদার

শ্রাবণের কালো যে মেঘ
তারে যদি নাম দাও চণ্ডাল
তা ব’লে কি জাত ঘুচিবে তার,
অশুচি হবে কি তার জল

শুধু একটি গণ্ডুষ জল বৌদ্ধ ভিক্ষু আনন্দকে দান করেছিল চণ্ডালিকা। নাম তার ‘প্রকৃতি’। তার মা চারণের বউ। সে তন্ত্র-মন্ত্র জানে। আনন্দ প্রকৃতিকে বলেছিলেন, সব মানুষ সমান। তিনি যে-মানুষ, চণ্ডালের মেয়ে প্রকৃতিও তাই। এই সাহচর্যের, সাম্যের স্পর্শ প্রকৃতির মনে প্রেমের উন্মেষ ঘটিয়েছিল। সে চেয়েছিল আনন্দ তার হোক। কিন্তু আনন্দ যে সংসারত্যাগী ভিক্ষুক! প্রকৃতি ভেবেছিল এমনিতে না হোক তার মা যদি তন্ত্র-মন্ত্রের জোরে আনন্দকে মেয়ের কাছে নিয়ে আসে, তাহলে তাই যেন হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটাও হয়নি রবীন্দ্রনাথ বিরচিত ‘চণ্ডালিকা’ নৃত্যনাট্যে। সমাজে সব মানুষের সহাবস্থান যে সহজ নয় এবং তার জন্য মানবতার অপার্থিব শক্তি লাগে, তা আমাদের উপলব্ধি করিয়াছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।
Chandalika (Bengali) | Exotic India Art
সম্প্রতি দক্ষিণ কলকাতার একটি বিশেষ পূজামণ্ডপে সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের উপস্থিতি নিয়ে কিছু বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। দুর্গাপুজো শেষ হয়ে গেল। পুজোর চার-পাঁচটি দিন কলকাতায় বহু মানুষের ঢল নামে। ঠাকুর দেখার ভিড়ে দিন আর রাত একাকার হয়ে যায়। এই ক’টা দিনের এই আনন্দ-উত্তেজনার জন্য কেবল বাঙালি নয়– জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও লিঙ্গ নির্বিশেষে কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার সব মানুষ সারা বছর অপেক্ষা করে। বাংলার সকল মানুষের এই উৎসবে অংশগ্রহণের ইচ্ছে থাকে। কিন্তু পুজোর আনন্দে সকলের সমান অধিকার অনেক সময় থাকে না। বিতর্কটা তৈরি করেছেন সমাজ মাধ্যমের এক তথাকথিত ‘ইনফ্লুয়েন্সার’ এবং দাবানলের মতো তা চারিদিক ছড়িয়ে পড়ে এটাই প্রমাণ করছে যে, এখনও আমাদের সমাজে সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের জায়গা এতটুকু স্বস্তির নয়। ওই মণ্ডপ দেখে নাকি সকলের ‘থ্যাইল্যান্ড’ মনে হচ্ছে! কেন?

থাইল্যান্ডের রাস্তার প্রাইড মান্থ সেলিব্রেশন আসলে থ্যাইল্যান্ডের অনুষঙ্গ এখানে এ-জন্য এসেছে, যাতে ওদেশে যে রূপান্তকামী মানুষদের রমরমা কিংবা বহু রূপান্তকামী দেহব্যবসায়ীর দেখা মেলে– তার সঙ্গে কলকাতার সেই মণ্ডপের তুলনা করা যায়। অবাক কাণ্ড, ‘থ্যাইল্যান্ড’ দেশটার যে কেবল রূপান্তরকামী মানুষদের দেহব্যবসা দিয়ে পরিচয় তা এইসব ইনফ্লুয়েন্সার না-থাকলে জানা হত না। ‘ভাইরাল’ হতে পারা ইনফ্লুয়েন্সারদের সর্বতো আকাঙ্ক্ষা আমরা জানি কিন্তু একটি দুর্বল গোষ্ঠীর মানুষদের যতরকম ভাবে পারা যায় অনলাইন-হেনস্তা করে সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা তো আদতে একটা অপরাধ। অনেকে বলবেন– সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষরা দুর্বল কোথায়, এই তো হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে, যেমন খুশি সাজতে পারছে, সব জায়গায় তাদের উপস্থিতি কিন্তু তথাকথিত বিসমকামী, বিসমতান্ত্রিক সমাজের মানুষদের যখনই পছন্দ হচ্ছে না বলে বারবার খাঁড়ার ঘা যে নেমে আসছে, তাতেই তো তাদের জায়গা কত শক্তিশালী, সেটা টের পাওয়া যাচ্ছে। তা নয়তো রূপান্তরকামীরা কী পোশাক পরবে, কী ব্যবহার করবে, তাদের পক্ষে কোনটা শালীন আর কোনটা অশালীন– তা অন্য কেউ ঠিক করে দেবে কেন? এ তো যেন তোমাকে ততক্ষণ চড়তে দেব যতক্ষণ তুমি আমার তাঁবে, বেগড়বাঁই করেছ কি সটান দেব ভাগিয়ে! যার জন্য অনেকে আবার বলছে ‘এরা খুব বেড়ে গিয়েছে, আগে এত ছিল না!’ আর এই উক্তি হিংসায় উসকানিমূলক সাংঘাতিক একটি মন্তব্য।
কলকাতার দুর্গাপুজোয় অর্ধনারীশ্বর মূর্তি
সমাজে যখনই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সংখ্যালঘুর ওপর অত্যাচার আরম্ভ করে সে সবসময় সংখ্যালঘুর পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে বলেই প্রথম আক্রমণটা শুরু করে। ভারতে সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষরা যৌনসংখ্যালঘু গোষ্ঠী। তাদের লিঙ্গযৌনপরিচয়ের জন্য তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ বিসমকামী শ্রেণির কোনও সামাজিক-রাজনৈতিক অধিকারের ধারে-কাছে নেই। সমাজে তাদের উপস্থিতি যতটুকু, পুরোটাই দীর্ঘদিনের যুদ্ধ ও প্রাত্যহিক সংগ্রামের ফলাফল। অস্বস্তিটা আসলে রূপান্তরকামীদের দৃশ্যমান তাতে তারা আর পরিচয় গোপন করছে না, বদ্ধ ঘরে না থেকে এবার জগৎ দেখতে শুরু করেছে, নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে এবং তথাকথিত বিসমকামী মানুষদের পুজোয়, মণ্ডপে, ভিড়ে, ঘোরাঘুরিতে, উৎসবে-উদ্দীপনায় নিজেদের স্থান দাবি করছে– গাত্রদাহ সেখানেই!
শিলিগুড়ির এক পুজো প্যান্ডেলে উপস্থিত ছিলেন ট্রান্সজেন্ডাররা
আবার এও দেখা যাচ্ছে– ওইসব ইনফ্লুয়েন্সারের সমর্থনে রূপান্তরকামী মানুষদের নিন্দা করছে কিছু রূপান্তরকামী মানুষই! তাদের বক্তব্য হল সংখ্যাগরিষ্ঠ বিসমকামী মানুষরা এখন সমকামী-রূপান্তরকামীদের মেনে নিচ্ছে, ‘সহ্য’ করছে, আগের থেকে তাদের জীবনযাত্রা অনেক সহজ হয়েছে যখন, তবে কেন বিসমতান্ত্রিক সমাজ যেমন চাইবে সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষরা সেরকমই চলাফেরা করবে না! বিসমকামী সমাজ ও রাষ্ট্রকে তদ্বির করা এইসব সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষ ভুলে গিয়েছেন এ-সমাজে এককণা অধিকার বিসমতান্ত্রিক সমাজের কোনও মানুষ তাদের দেয়নি। তারা কোনও দিন দিত না, পরবর্তীকালেও দেবে না। সমস্ত অধিকার অর্জিত হয়েছে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই– যা প্রত্যেকটি হিজড়ে পেশার মানুষকে বাধাই-খাজড়ার সময় করতে হয়, যা রোদ-জল-ঝড়ে ট্রাফিক সিগন্যালে ভিক্ষা চাওয়ার মধ্যে দিয়ে একটি রূপান্তরকামী মানুষকে করতে হয়, যার জন্য এইসব মানুষকে মার খেতে হয়, খুন হতে হয়, পরিবার থেকে বিতাড়িত হতে হয়, মানুষের ঘৃণা ও অস্পৃশ্যতার শিকার হতে হয়! ভারতের সংবিধান জাতি-ধর্ম-বর্ণ ও লিঙ্গ নির্বিশেষে সমস্ত মানুষকে সমাজের সকল ব্যাপারে সমান অধিকার দিয়েছে। রাস্তা হোক আর পুজো মণ্ডপ– যে-কেউ যে-কোনও ভাবে উপস্থিত থাকতে পারবে যখন খুশি। আইনবিরুদ্ধ কোনও কাজ হলে তার জন্য প্রশাসন আছে। কিন্তু সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের বিরূদ্ধে ঘৃণাবর্ষণ করে যারা ‘একঘরে’ করতে চায় শাস্তি তাদেরও প্রাপ্য, এটা ভুললে চলবে না।