’৪৭ সালের দেশভাগের সময় আমিনুল ইসলাম খানের দাদা বেলায়েত হোসেন খান বর্ধমানের বাড়ির সঙ্গে রাজানগরের রায় বাহাদুর নন্দমোহন কুমার বসুর বাড়ি অদলবদল করেন। পূর্ববঙ্গের মানুষ পশ্চিমবঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ পূর্ববঙ্গ। এই অদলবদলের পেছনে রয়েছে ধর্মীয় পরিচয়! মানুষ নয়। হায় দেশভাগ। মানুষ চেয়েছিল স্বাধীনতা। দেশভাগে হয়েছে পরাধীন। রাষ্ট্র ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়েছে। নিজ বাড়ি ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছে বসু ও খানদের। এই বাড়ির বাসিন্দারা লেখক সমরেশ বসুকে চিনতে পারলেন। কিন্তু বলতে পারলেন না ঠিক কোন ভিটায় ছিল সমরেশ বসুদের ঘর। তবে ধারণা করা যায়, এই বসুপাড়ায় ছিল সমরেশ বসুদের বাড়ি।
১৯.
ঢাকায় সমরেশ বসু! মার্চ ১৯৭২। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দর নামলেন সমরেশ। মাটিতে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমরেশ বসুর চোখ আপনা থেকেই ঝাপসা হয়ে উঠল। বিমানের সহযাত্রীদের দিকে না তাকিয়ে, মাটিতে হাত ঠেকিয়ে কপালে স্পর্শ করলেন। এবং স্পষ্টই অনুভব করলেন একটা আবেগের কলকলানি সমরেশের ভেতরে ছলছল করছে।
ব্রিটিশ আমলে যে শহর ছেড়ে গেলেন। এরপর পাকিস্তান পর্বের ২৪ বছরে ঢাকায় ফেরা হয়নি। ফিরলেন স্বাধীন বাংলাদেশে। ১৩ বছর বয়সে ১৯৩৭ সালে ঢাকা ছেড়ে যান পশ্চিমবঙ্গের নৈহাটিতে। দীর্ঘ ৩৫ বছর পর জন্মভূমিতে ফিরলেন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক, গল্পকার সমরেশ বসু। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় অস্ত্র হাতে যুদ্ধে যোগদান করতে পারেননি। কিন্তু কলম হাতে মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে থেকেছেন। বাংলাদেশের জন্মক্ষণে, জন্মভূমির পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লিখেছেন গল্প। দেশভাগের বেদনা নিয়ে লিখেছেন ‘নিমাইয়ের দেশত্যাগ’ ও ‘সুঁচাদের স্বদেশযাত্রা’ উপন্যাস।
সমরেশ বসু ঢাকা শহর ঘুরে দেখছেন। যে শহরের পুরোটাই তাঁর চেনা। এত বছর পর সেই শহরের অনেককিছুই অচেনা লাগছে। তবুও এই শহর সমরেশের শহর। সমরেশ বসুর শৈশবের শহর। স্মৃতির রেখা ধরে ভিক্টোরিয়া পার্ক পেছনে রেখে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালেন লক্ষ্মীবাজার গিরীশ মাস্টারের পাঠশালার সামনে। সেখান থেকে জিয়স সাহেবের গলি দিয়ে হেঁটে গেলেন একরামপুরের ২৫ নম্বর বাড়ির সামনে। একা একাই পায়ে হেঁটে ঘুরছেন পুরনো ঢাকা।
হাজার স্মৃতির দরজা যেন খুলে গিয়েছে এক ঝটকায়। দক্ষিণের জানালা দিয়ে ঘরে হাওয়া ঢোকার মতো হু হু করে অতীত ঢুকে পড়েছে সমরেশের মনের ঘরে। সমরেশও ফিরে গিয়েছেন অতীত ঢাকার সূত্রাপুরে। একটা দৃশ্য দেখতে পেলেন– শহরের দু’-একটি গাড়ির শব্দ বাদে আর কোনও চঞ্চলতা নেই। এরমধ্যে ঘোড়ার গাড়িতে করে ফুলবাড়িয়া রেললাইন পেরিয়ে মায়ের সঙ্গে সুরথনাথ যাচ্ছেন রমনার কালীবাড়ির দিকে। সমরেশ বসু ’৭২ সালে ঢাকা শহর ঘুরে গিয়ে পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৭৩ সালে ‘মোক্তারদাদুর কেতুবধ’ নামে আত্মজীবনীমূলক একটি কিশোর উপন্যাস লেখেন। এই উপন্যাসে সমরেশের ঢাকার শৈশবজীবনের অনেকটাই ছবির মতো পাওয়া যায়।
সমরেশ বসুর জন্ম ১৯২৪ সালের ১১ ডিসেম্বর। বাংলার আদি রাজধানী বিক্রমপুরের রাজানগর গ্রামে তাঁর পৈত্রিক বাড়ির ঢেঁকিঘরে। জন্মগ্রাম– ‘রাজানগর’, বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান উপজেলার একটি ইউনিয়ন। বাবা মোহিনীমোহন বসু, মা শৈবলিনী বসু। রাজানগর বাড়িতে মা শৈবলিনী বসু ঢেঁকিতে পাড় দিচ্ছিলেন। সেই সময়ে সমরেশের জন্ম হয়। নির্ধারিত সময়ের আগেই জন্ম এবং পৃথিবী দেখার তর সইছিল না বলেই সমরেশের ডাক নাম হয় ‘তরবৈরা’। জন্মনাম সুরথনাথ বসু। লেখক জীবনের নাম, সমরেশ। আর ছদ্মনাম ‘কালকূট’ ও ‘ভ্রমর’।
‘কোথায় পাবো তারে’ কালকূটের লেখা উপন্যাসের শুরুতেই সমরেশ বসুর শৈশবকে খুঁজে পাওয়া যায়– “দরবেশের পাশে পাশে, ইছামতীর ধারের গাঁয়ে হাঁটতে হাঁটতে, আমার চমকের চিকুরে দেখলাম, ছোট ছেলে, পাঠশালার পড়ো, বছর দশ বয়স। ওপার বাঙলার ঢাকা শহরের একরামপুর দিয়ে হেঁটে চলেছে। জিয়সের গলিতে সে দৌড় দিয়ে বাড়ি ঢোকে। মায়ের পায়ের কাছে বই সেলেট নামিয়ে দিয়ে দে ছুট। মায়ের মুখের দোষ দিয়ো না, হাঁক দিয়ে বলল, ‘ওরে মুখপোড়া কোথা যাস?’
ছেলের গলায় উত্তেজনা, রুদ্ধশ্বাস, ‘খেলতে।’
‘খেয়ে যা রে।’
ছেলে তখন আবার একরামপুরের বড় রাস্তায়। চোখে তার পড়ন্ত বেলার রোদ। ইস, ছোট বেলা, চলে যায়। খালি পা, গায়ে একটি পাতলা জামা, ডুরি পরানো প্যান্ট। জামার পকেটে তার হাত ঢোকানো। সেখানে হাতের মুঠোয়, ষষ্ঠ জর্জের মাথা ছাপানো দুটি নতুন তামার পয়সা। যার গন্ধ স্বাদ ওর জানা। হাতের ঘামে যা চটচটিয়ে উঠেছে। পকেটের মধ্যে। এই পয়সা দিয়ে ও যাবে যাবে যাবেই। পাঠশালার জেলখানা থেকে পালাতে পারেনি, হেড পড়োটা, ইঁদুর ধরা বেড়ালের মতো তাকিয়েছিল। নইলে আগেই যেত। এই পয়সা দিয়ে দুটো জিভে গজা কেনা যেত। দুটো অমৃতি বা দুটো লুচি আর মোহনভোগ। জিভের সব লালা ও ঢোক গিলে খেয়েছে।
এ দু’-পয়সা তো রোজের পয়সা নয়। দুটো পয়সা, এ যে মেলে কালে-ভদ্রে। এই পয়সা দিয়ে কিছু কিনে খাওয়া যায় না। তার চেয়ে অনেক বিরাট স্বপ্ন সফল করতে হয়। ও যাবে, আজ যাবেই যাবে।
কদমতলা পার হয়ে ওর পাগলা ছোটা নারিন্দার পুলের দিকে। পিছন থেকে আসে ঘোড়ার গাড়ি, সামনে থেকে আসে ঘোড়ার গাড়ি। জোড়া ঘোড়ায় টানা, যাকে বলে পালকি গাড়ি, ঢাকা শহরের সেই আমলের সর্বকালের একমাত্র যানবাহন। তাদের চাবুকে বাজে শিস। ছোট ছেলেটার ডাইন-বাঁয় জ্ঞান নেই, দেখে হাঁক দেয়, ‘আরে মাখন, সরকাইয়া যা।’
ওরে মাখন, সরে যা। ছেলেটার নাম মাখন নয়, গাড়োয়ানের আদরের ডাক। ননী মাখনের থেকে, আদর করে আর বেশি কী-ই বা বলা যায়।…”
মুন্সিগঞ্জের ইছামতী নদীর পাড়ে রাজানগর বাজারের কেন্দ্রে রয়েছে একটি প্রবীণ বটবৃক্ষ। বটগাছের আশেপাশের কয়েকটি দোকানে জিজ্ঞেস করলাম লেখক সমরেশ বসুর বাড়ি কোন দিকে? একজন দোকানদার বললেন, ‘এই বটগাছের গোড়া থেকেই বসুপাড়ার সীমানা শুরু। ঠিক কোন বাড়িটি তাগো, তা জানি না। ১০০ বছর আগের বাড়িঘরের চিহ্ন এখন খুইজ্যা পাওয়া মুশকিল। তবে এই বাজার থেইক্যা পশ্চিমে দুই কিলোমিটার পর্যন্ত বসুপাড়া। প্রথমে রাজানগর ইউনিয়ন পরিষদ, রাজানগর পোস্ট অফিস, ভূমি অফিস, রাজানগর হাইস্কুল– এই সবই শরৎ বসুর জমির ওপরে উঠেছে। শরৎ বসুর পরিবার দেশভাগের বছরে এই দ্যাশ থেইক্যা চইল্যা যায়। সেই বছর শরৎ বসুও খুন হন ওই বাজারের পথেই।’
রাজানগর বসুপাড়ায় একটি পরিত্যক্ত বাড়ি পেলাম। যে বাড়ির বয়স আনুমানিক ২০০ বছর। এই বাড়িতে বর্তমানে বসবাস করেন আমিনুল ইসলাম খান। এই বাড়ির আদি বাসিন্দারা এসেছেন বর্ধমান থেকে। ’৪৭ সালের দেশভাগের সময় আমিনুল ইসলাম খানের দাদা বেলায়েত হোসেন খান বর্ধমানের বাড়ির সঙ্গে রাজানগরের রায় বাহাদুর নন্দমোহন কুমার বসুর বাড়ি অদলবদল করেন। পূর্ববঙ্গের মানুষ পশ্চিমবঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ পূর্ববঙ্গ। এই অদলবদলের পেছনে রয়েছে ধর্মীয় পরিচয়! মানুষ নয়। হায় দেশভাগ। মানুষ চেয়েছিল স্বাধীনতা। দেশভাগে হয়েছে পরাধীন। রাষ্ট্র ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়েছে। নিজ বাড়ি ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছে বসু ও খানদের। এই বাড়ির বাসিন্দারা লেখক সমরেশ বসুকে চিনতে পারলেন। কিন্তু বলতে পারলেন না ঠিক কোন ভিটায় ছিল সমরেশ বসুদের ঘর। তবে ধারণা করা যায়, এই বসুপাড়ায় ছিল সমরেশ বসুদের বাড়ি।
সমরেশ বসু বাবার কর্মসূত্রে ছোটবেলা কাটে ঢাকা শহরের সূত্রাপুরের একরামপুর এলাকায়। পিতা মোহিনীমোহন বসু ছিলেন ঢাকার ফরাশগঞ্জ রূপলাল দাশ এস্টেটের রোকর্ড কিপার। কালের সাক্ষী হিসেবে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে রূপলাল হাউসটি এখনও টিকে আছে। কিন্তু বাড়ি হেরিটেজ হিসেবে সনাক্ত হয়নি ব্যবহৃত হচ্ছে পিয়াজ রসুনের গুদামঘর হিসেবে!
সমরেশ বসুর পড়াশোনা শুরু লক্ষ্মীবাজার গিরীশ মাস্টারের পাঠশালায়। এরপর ভর্তি হোন গেন্ডারিয়ার গ্র্যাজুয়েট স্কুলে। গিরীশ মাস্টারের পাঠশালাটি এখন হয়েছে ‘একরামপুর বালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’। আর গেন্ডারিয়ার গ্র্যাজুয়েট স্কুলটির নামকরণ হয়েছে ‘গেন্ডারিয়া হাই স্কুল’।
সমরেশ বসুর স্কুলের লেখাপড়া ভালো লাগত না। স্কুল থেকে পালিয়ে যেতেই ছিল আনন্দ। ঘর থেকে বইখাতা নিয়ে বের হতেন। স্কুলে না গিয়ে চলে যেতেন পোস্তগোলা শ্মশানে। বুড়িগঙ্গা নদীতে। ঢাকার শহরের বুকের ভেতরের একমাত্র দুলাই নদীতে। যা বর্তমানে ধোলাইখাল নামে পরিচিত। শহর থেকে দূরে ধানমণ্ডাইয়ের মাঠে। যা বর্তমানে ঢাকা শহরের অভিজাত এলাকা ধানমন্ডি।
সুরথনাথ বসু থেকে লেখক হিসেবে সমরেশ বসু আত্মপ্রকাশ করেন ‘আদাব’ গল্প দিয়ে। এই গল্পের চরিত্ররা ঢাকা শহরের, পটভূমি ঢাকা শহরের হিন্দু মুসলমানের দাঙ্গা। গল্পের শেষ হয় হিন্দু-মুসলমানের বন্ধুত্ব দিয়ে। এই গল্পে মানুষের ভালোবাসার জয় হয়। পরাজিত হয় ধর্মান্ধতা। পরাজিত হয় ব্যবস্থা-নিয়ন্ত্রিত সন্ত্রাসের।
সমরেশ বসুর দ্যাশের বাড়ির খোঁজে ঢাকা শহরের বাড়ি ও বিক্রমপুরের বাড়ির ভিটা খুঁজে পাওয়া যায়নি। খুঁজে পাওয়া গেছে তাঁর শৈশবের শহরকে। শৈশবের গ্রাম ও নদীকে। আসলে সমরেশ বসুর দ্যাশের বাড়ি রয়েছে তাঁর সৃষ্টিতে। সমরেশের গল্পে, উপন্যাসে।
ছবি: কামরুল হাসান মিথুন
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved