কেউ কেউ বলে শ্মশানের থেকে পবিত্র জায়গা আর হয় না। কিন্তু পোড়া কাঠ, ভাঙা মাটির হাঁড়ি, ছেঁড়া কাপড় মিলিয়ে যে আবহ তৈরি হয় তাকে কখনও আমার ‘পবিত্র’ বলে মনে হয়নি। গা-শিরশির কমেনি। বরং মনে হয়েছে ওখানে হয়তো খারাপ হাওয়া ঘুরে বেড়ায়। একটু বড় হয়ে সাইকেল চালাতে শিখে যখন একটু একটু ডানা গজালো, ছোট্ট এক জোড়ের (খুব ছোট নদী) পাশে সুন্দর আড্ডা মারার জায়গা আবিষ্কার করলাম। আরও অনেক পরে জেনেছিলাম ওটা শ্মশান ছিল। আড্ডা মেরে এসে বাড়িতে কখনও বলিনি। খারাপ হওয়া গায়ে মেখে হারিকেনের আলোয় পড়তে বসে গিয়েছি।
আষাঢ়ের পয়লা নাকি ভোরে উঠতে নেই। উঠলেও বাইরে বেরতে নেই। পাছে মা মনসার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। ১৯৮৪-র পয়লা আষাঢ় আমার ঠাকু’মা ভোরে উঠেছিলেন। পাঁচ হাত লম্বা কালো খরিসের দেখাও পেয়েছিলেন। ১৯৮৪-র আরেক বর্ষণমুখর ভোরবেলায় বাড়ির সবাই যখন পুকুর ঘাটে গিয়েছে আমার ঠাকু’মা সজনে গাছের তলায় কাঁচা নর্দমায় মুখ গুঁজে পড়েছিলেন। স্ট্রোক। পূজার ফুল তুলতে এসে ঠাকুমাকে আবিষ্কার করেন আমার পিসি। হয়তো ততক্ষণে সব শেষ হয়ে গিয়েছে। তবুও দু’কূল ছাপানো দ্বারকেশ্বর বাঁশের ভেলায় চেপে শেষবারের মতো পার করে বুড়ি চললেন হাসপাতাল। আমার দু’বছরের দিদি আছাড়ি-পিছাড়ি দিয়ে কাঁদতে থাকে ‘‘আমার ঠাকু’মাকে বেনে নিয়ে চলে গেল গো’’। হাসপাতাল থেকে আর বাড়ি ফেরা হয়নি। সোজা শ্মশান। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে কয়েক লক্ষ বার এই বিবরণ মায়ের মুখে শুনে শুনে আমি চোখের সামনে দেখতে পাই ১৯৮৪-র সেই আলোআঁধারি ভোর, মধুমালতীর ঝোপ, তাঁত চলার খটাস খটাস আওয়াজ। ঠাকু’মার মরণযাত্রা। আমি তখনও পৃথিবীর আলো দেখিনি।
যে সময় থেকে সব কিছু স্পষ্ট ভাবে মনে পড়ে সেই সময়ের ঘটনা। নব্বইয়ের শুরুর দিকে। মেয়েটির নাম তোফা। হিন্দি সিনেমা দেখে মা-বাবা শখ করে নাম রেখেছিল। কান ফুটো করতে গিয়ে ইনফেকশন হয়ে কিশোরীর মৃত্যু হয়। একই দিনে মারা যায় অন্যপাড়ার আরেকটি ছেলে। কেউ কাউকে চেনে না। কোন অদৃশ্য মায়াডোরে ওপারে বাঁধা পড়ল দু’জনে। সরস্বতী পূজা ছিল সেদিন। ঘরে ঘরে অলিখিত শোক। পড়ে রইল বইয়ের পুঁটুলি, ফাগের পোঁটলা, শুকনো বনফুল, কাতলার পেটি, গোটা সিদ্ধর বেগুন। মেয়েদের শ্মশানে যাওয়া নিষেধ। তাও অনেক মেয়ে বউ পিছু পিছু অনেক দূর অবধি গেল। জ্ঞান হওয়ার পর সেই বোধহয় প্রথমবার মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখা।
তারপর কখনও বাড়ির উল্টোদিকের সরি-খড়িদের ঠাকুমা, কখনো জেঠিমাদের বাড়ির রান্নার ঠাকুমা, কখনো ভুবন, কখনও লুদু। চলে গিয়েছে অনেকে। সবার নাম মনেও নেই। দূরের অনাত্মীয় অপরিচিতদের চলে যাওয়া ফুরিয়ে গেলে এক সময় নিজের বাড়ির পালা আসে। এক এক করে চলে গেছে জেঠু, জেঠিমা, মামা, মামি, মাসি, মেসো। খুব খারাপ শোনালেও এই চলে যাওয়াগুলো মেনে নিতে কোনও অসুবিধা হয়নি। প্রথম অসুবিধে হল যখন কাউকে কিছু না-বলে ঘনিষ্ঠ বন্ধু স্বেচ্ছায় চলে গেল। সেই কান্না আজও কোথাও চাপা আছে। শরীরে। মনে।
এত চলে যাওয়া দেখেছি কিন্তু স্বার্থপরের মতো কখনও কারও শেষ যাত্রায় শামিল হয়নি। জানি না এক অদ্ভুত অস্বস্তি নাকি ভয় কাজ করত শ্মশান নামটা শুনলেই।
বাঁকুড়া শহরেরই অংশ আমার রাজগ্রাম। প্রাচীন জনপদ। ‘শ্মশান’ বলতে দ্বারকেশ্বরের ব্রিজের তলা বা পুলের তলা। কয়েক বছর আগে যখন শ্মশানের শেড বানানো হল তার আগে অবধি নদীর বুকেই চলতো দাহকাজ। ছোটবেলায় ওই ব্রিজটার উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে জয়েন্টের ফাঁক দিয়ে নিচের শ্মশানটা দেখতে পেতাম। গা শিরশির করে উঠত। তার মধ্যে যদি কখনও মরা পোড়ানো অবস্থায় দেখতে পেতাম ভয়টা আরও দ্বিগুণ হয়ে যেত। নতুন ব্রিজের পাশে তখনও পুরনো ভাঙা ব্রিজের অর্ধেকটা ঝুলে ছিল। ভাঙা ব্রিজের গায়ে লিখে দেওয়া হতো মৃতদের নাম। ঁলতিকা রানী চন্দ। ঁগোরাচাঁদ হেঁস। ঁঅনিলবরণ লক্ষণ। চন্দ্রবিন্দু লাগানো নাম গায়ে গায়ে লেগে অদ্ভুত এক অপ্রাকৃতিক গ্রাফিটি তৈরি হয়েছে। ভাঙা ব্রিজ পুরোপুরি ভেঙে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মৃতদের ভিড় ভেসে গিয়েছে দ্বারকেশ্বরের জলে।
কেউ কেউ বলে শ্মশানের থেকে পবিত্র জায়গা আর হয় না। কিন্তু পোড়া কাঠ, ভাঙা মাটির হাঁড়ি, ছেঁড়া কাপড় মিলিয়ে যে আবহ তৈরি হয় তাকে কখনও আমার ‘পবিত্র’ বলে মনে হয়নি। গা-শিরশির কমেনি। বরং মনে হয়েছে ওখানে হয়তো খারাপ হাওয়া ঘুরে বেড়ায়। একটু বড় হয়ে সাইকেল চালাতে শিখে যখন একটু একটু ডানা গজালো, ছোট্ট এক জোড়ের (খুব ছোট নদী) পাশে সুন্দর আড্ডা মারার জায়গা আবিষ্কার করলাম। আরও অনেক পরে জেনেছিলাম ওটা শ্মশান ছিল। আড্ডা মেরে এসে বাড়িতে কখনও বলিনি। খারাপ হওয়া গায়ে মেখে হারিকেনের আলোয় পড়তে বসে গিয়েছি।
খারাপ হাওয়া উড়িয়ে নিয়ে যায় অস্থিমজ্জার ছাই। আত্মা। প্রেতাত্মা। পাশ দিয়ে খোলা চুলে যাওয়া মানা। খারাপ হাওয়া গা-গঞ্জে ঢুকে না পড়ে। তাই এক প্রান্তে পুকুর, নদী, জোড়– যেখানেই জল আছে সেখানেই শেষ আশ্রয়। কোথাও কোথাও শ্মশানের পাশে বানিয়ে দিয়েছে ছোট ছোট মন্দিরের মতো মঠ। কোথাও কোথাও সমৃদ্ধ পরিবারে বাগানের এক কোনায় নিজেদের ব্যক্তিগত দাহ কাজের জায়গা। উঁচু জাতির শ্মশান আলাদা। নিচু জাতির শ্মশান আলাদা। মরেও শান্তি নেই!
অদ্ভুত দেশ আমাদের। শ্মশানও দেখতে যাওয়ার জায়গা। হ্যাঁ, কাশীর কথাই বলছি। মৃত্যু যেখানে ট্যুরিজম। মণিকর্ণিকা ঘাট। কথায় আছে, সেখানে নাকি কখনও চিতা নেভে না। আজ থেকে বছর পনের আগে প্রথমবার যখন বিশ্বনাথ গলি, কচৌড়ি গলি পায়ে হেঁটে পার করে মণিকর্ণিকা ঘাটে পা রাখলাম, চিতা দেখে ভয় পাইনি। গা ছমছম করে উঠেছিল থরে থরে সাজানো কাঠের স্তূপ দেখে। চিতার আগুনের ধোঁয়ায় যেন অঙ্গারের পাহাড়। ফাইনাল পরীক্ষার আগে লাস্ট মিনিট সাজেশন-এর মতো যেন মৃত্যুর অবশ্যম্ভাবী প্রস্তুতি।
বেনারসের ভোল বদলে যাওয়ার পর এখনও আছে কি না জানি না। তবে আজ থেকে ১৫ বছর আগে মণিকর্ণিকা ঘাটের পাশে মৃত্যুর আরেকটি আয়োজন দেখেছিলাম। একটি দোতলা বা তিনতলা বাড়ি, ঠিক মনে নেই। উপরের তলায় বিরাট বড় হল। তিনদিক প্রায় খোলা। আলাদা করে কোনও ঘর নেই। চিতার আগুনের ধোঁয়ায় সমস্ত দেওয়াল কালো। সেখানে বসবাস করে সমাজ পরিত্যক্ত বা স্বেচ্ছায় সমাজকে ত্যাগ করা মানুষেরা। জীবনের শেষপ্রান্তে এসে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা। সামান্য একটু শোয়ার বিছানা আর খাবার থালা। এটুকুই সম্বল। চোখের সামনে এতগুলি মানুষকে একসঙ্গে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে দেখে কী অনুভূতি হয়েছিল, বলে বোঝাতে পারবো না। মানুষগুলির থেকেও আশ্চর্য ওই বাড়ির কালো দেওয়ালের গায়ে থাকা আঁকাজোকা। কোথাও রয়েছে ফিজিক্সের ফরমুলা। কোথাও কবিতা। কোথাও গুপ্তধনের সংকেত। হিন্দি-ইংরেজি-ফ্রেঞ্চ-স্প্যানিশ। ঠিক যেন চলে যাওয়ার আগে রেখে যাওয়া দাগ।
মৃত্যু-শ্মশান-বেনারস একসঙ্গে বললেই অবশ্যম্ভাবীভাবে চলে আসে নীরজ ঘাওয়ানের ‘মাসান’ ছবিটির কথা। ‘ইয়ে দুখ কাহে খতাম নেহি হোতা’। দীপকের বুকফাটা আর্তনাদ এখন দশ বছর পরেও সমান আলোচিত। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমি ‘মাসান’-এর থেকেও যে ছবিটির সাথে বেশি একাত্ম হতে পারি তা হল তুলনায় কম পরিচিত ‘মুক্তি ভবন’। এক সন্তানের পিতার মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা। মুক্তি ভবন হোটেলে বেশ কিছুদিন থাকার পরেও পিতার মৃত্যু হয় না। পুত্র সন্তান কাজে ফিরে যায়। এবং তারপরেই পিতার মৃত্যু হয়। কাশীতে মৃত্যু হলে সরাসরি স্বর্গ লাভ হয় কি না, তা তর্কের বিষয় কিন্তু কাশীতে মৃত্যুর উদযাপন একবার দর্শন করলে হয়তো মেনে নেওয়া যায় যে, সবচেয়ে বড় সত্যি মৃত্যু।
তবুও যত বড়ই সত্যি হোক, তাকে সহজভাবে মেনে নেওয়া সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। স্বপ্নে বারবার ফিরে আসে চলে যাওয়া আত্মীয়, বন্ধু। এমনকী, কুকুর, বেড়ালও। কত সহজভাবে। কত স্বাভাবিকভাবে। ঘুম ভাঙলে ঘোর কাটে। ঘোর কাটলেও অবচেতনে কোথাও হয়তো স্বপ্নটা রয়ে যায়। মনে হয় যেন এটাই সত্যি। নইলে কোন আশায় এই হেমন্তে স্বর্গবাতি জ্বালাই? আমার জন্মের আগে চলে যাওয়া আমার ঠাকুরমা হয়তো আকাশপথে ঘুরে বেড়ানোর সময স্বর্গবাতির আলো দেখে একবার টুপ করে নেমে পড়বেন। বুড়ি হয়তো দেখে খুশি হবেন, তাঁর ঠিক করা নামই আমাকে দেওয়া হয়েছে। ১৯৮৪-র বর্ষার ভোরবেলায় বুড়ি হয়তো ভাবেননি তাঁকে নিয়ে তাঁর নাতি দু’কলম লিখবে।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved