নারকোল নাড়ু কি আমাদের বাংলার একার? একেবারেই নয়, নাড়ুর আপন ভাই ‘কোকোদা’ দক্ষিণ আমেরিকার কলোম্বিয়ার প্রিয় মিষ্টি, থুড়ি দেজার্ত। ১৮১১ সালে কলোম্বিয়ার ইতিহাসে ‘লা পাত্রিয়া বোবা’ পর্বে সিভিল ওয়ার চলাকালীন সেদেশের প্রিয় খাবার পাইনের বাদাম পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে, তাই নারকোলের ওপর মনোনিবেশ করে আর কোকোদা বানিয়ে ফেলে। পাটিসাপটার আপন ভাইও লাতিন আমেরিকায় থাকে– আর্জেন্টিনার ‘প্যান্কেকে দ্য দল্থে দ্য লেশে’, যা সাধারণ মানুষের কাছে ‘ক্যাজেতা ক্রেপ্স’ বলে পরিচিত।
মা দুর্গার সঙ্গে নারকোলের এক অঙ্গাঙ্গী যোগ খুঁজে পাই আমি। মায়ের আরতির সময় ঢাকের আর কাঁসর ঘণ্টার আওয়াজ, মণ্ডপের মধ্যের ধুনোর ধোঁয়া আর বাইরের ছাতিম ফুলের গন্ধ মিলেমিশে এক হয়ে যাওয়া আর তার মধ্যে প্রতিমার সামনে ভোগে গুড় আর নারকোল দিয়ে তৈরি নাড়ুর পাহাড়ের শীর্ষে কিছু চিনি দিয়ে তৈরি নাড়ু। লোলুপ দৃষ্টিতে সাদা নাড়ুর দিকে তাকিয়ে থাকতাম, যদিও জানতাম সেটা দিওয়ান-ই-খাসের, আমার মতো পাবলিক গুড়ের নাড়ু পাবে ভোগের প্রসাদে। পৌনে তিনশো বছরের তিন-পুতুলের দুর্গাঠাকুর সাঁওতালদের কাঁধে চেপে মশালের আলোয় বিসর্জন যেতেন। তিনি জলে পড়লে চণ্ডীমণ্ডপে শান্তির জল, আর তারপর খই, মুড়কি, নাড়ু মেশানো দিয়ে খানিক মিষ্টিমুখ আর তার সঙ্গে সিদ্ধির শরবত, যাতে সিদ্ধি নামমাত্র, শুধু নিয়মের খাতিরে। সেই সন্ধের বাতাসে ধুনোর গন্ধ থাকত না, কিন্তু ছাতিম ফুলের গন্ধটা থেকে যেত। সেই গন্ধ নাকে মেখে তিনপুতুলের বিভিন্ন তরফে বিজয়া করতে যাওয়া, যেখানে জুটত গুড়ের নাড়ু, চন্দ্রপুলি, নারকোলের ছাবা বা নারকোলের চিড়ে।
নারকোলের সঙ্গে আত্মীয়তা দুর্গা পুজোয় শেষ হয়ে যেত না। পৌষ মাস অসম্পূর্ণ থাকত গোকুলপিঠে আর পাটিসাপটা ছাড়া, আর এই দুটোতেই নারকোলের ছাঁচ অপরিহার্য। ময়দা আর চালের গুড়োর মণ্ড দিয়ে তৈরি লেচিতে নারকোল আর ক্ষিরের পাক পুর দিয়ে পাটি বানিয়ে ঘিতে ভাজা চিনির রসে ডুবনো পাটিসাপটার সঙ্গে বাংলার সম্পর্ক অনেক পুরনো আর গভীর। ষোড়শ শতাব্দীতে কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর লেখা চণ্ডীকাব্য থেকে বিভূতিভূষণের ‘পুঁইমাচা’– সবেতেই পাটিসাপটা পাওয়া যায়।
নারকোল নাড়ু কি আমাদের বাংলার একার? একেবারেই নয়, নাড়ুর আপন ভাই ‘কোকোদা’ দক্ষিণ আমেরিকার কলোম্বিয়ার প্রিয় মিষ্টি, থুড়ি দেজার্ত। ১৮১১ সালে কলোম্বিয়ার ইতিহাসে ‘লা পাত্রিয়া বোবা’ পর্বে সিভিল ওয়ার চলাকালীন সেদেশের প্রিয় খাবার পাইনের বাদাম পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে, তাই সাধারণ মানুষ শেষ পাতের মিষ্টির জন্যে নারকোলের ওপর মনোনিবেশ করে আর কোকোদা বানিয়ে ফেলে। বানানোর প্রক্রিয়া প্রায় আমাদের চিনির নাড়ুর মতোই, শুধু সেদেশে তো আর নারকোল কুড়ুনি নেই, অগত্যা আমাদের নারকোলের চিড়ের মতো করে নারকোল কেটে কোকোদা বানায়, নারকোলের জল অবধি বাদ দেয় না বানানোর সময়। একদম আমাদের নারকোল নাড়ুর স্বাদের এই কোকোদা কলোম্বিয়াতে এতই জনপ্রিয় যে, সেখান থেকে অন্য লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে।
পাটিসাপটার আপন ভাইও লাতিন আমেরিকায় থাকে– আর্জেন্টিনার ‘প্যান্কেকে দ্য দল্থে দ্য লেশে’ যা সাধারণ মানুষের কাছে ‘ক্যাজেতা ক্রেপ্স’ বলে পরিচিত, আর সেখানে পৌঁছেছিল ১৮২৯ সালে এক মজাদার দুর্ঘটনার মাধ্যমে। এখানেও যুদ্ধ জন্ম দিয়েছিল দেজার্তের। পনেরো বছর ধরে চলা সেই দেশের সিভিল ওয়ারে বিপর্যস্ত সাধারণ মানুষের কথা ভেবে যুযুধান দুই রাজনৈতিক আর সামরিক পক্ষের নেতা জুয়ান ম্যানুয়েল দি রোসাস্ আর জুয়ান লাভালে মনস্থ করেন যে তাঁরা আলোচনায় বসবেন, একটা সন্ধির কথা ভাববেন। সেইমতো রোসাস্ লাভালে-কে ক্যানুয়েলাস চুক্তি সইয়ের জন্য লা ক্যালেদনিয়ার পাহাড়ি উপত্যকায় তাঁর প্রধান কার্যালয়ে আমন্ত্রণ জানান। দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে লাভালে সাক্ষাৎকারের নির্ধারিত সময়ের আগেই পৌঁছে যান, পরিশ্রান্ত হাভালে এক ফাঁকা তাঁবুতে ঢুকে বিছানায় শুয়ে ঘুমে তলিয়ে যান। ঘটনাক্রমে সেই তাবু ছিল রোসাস্-এর জন্য নির্দিষ্ট। সেই সময় রোসাস্-এর এক পরিচারিকা রোসাস্কে অন্যান্য দিনের মতো কাফিন পুষ্ট বনজ পানীয় ‘মাতে’ পরিবেশন করতে যায়, যাওয়ার সময় উনুনে লেচাদা (গরম দুধে চিনি দিয়ে বানানো হয়) চাপিয়ে যায়, কারণ রোসাস্ মাতে-র পরেই লেচাদা খেতেন। সেই পরিচারিকা ঘরে ঢুকে দেখে মনিবের বিছানায় লাভালে শুয়ে। আতঙ্কিত হয়ে সে বাইরে এসে তক্ষুনি সামরিক বাহিনীকে জানায় মনিবের ঘরে শত্রু ঢুকে গিয়েছে। চারদিকে হইচই শুরু হয়ে যায়, কারণ এই মিটিংয়ের কথা রোসাস্ গুপ্ত রেখেছিলেন। রোসাস্ খবর পেয়ে পরিস্থিতি যতক্ষণে ঠান্ডা করলেন, তার মধ্যে উনুনে চাপিয়ে রাখা দুধ চিনির মিশ্রণে এক থকথকে পদার্থে পরিণত হয়েছে। সেই পরিচারিকার কাছে আর দুধ নেই লেচাদা বানানোর। ভয়ে একটু চেখে দেখে, দুধ জমে যে ক্ষির তৈরি হয়েছে, তা অতি সুস্বাদু। মিটিংয়ের পরে ডিনারে এই ক্ষিরের সঙ্গে নারকোল মিশিয়ে প্যানকেকের মধ্যে পুরে পরিবেশন করল সেই পরিচারিকা। এই খাবারের জয়জয়কার পড়ে গেল, আর সৃষ্টি হল আর্জেন্টিনার বিখ্যাত ক্যাজেতা ক্রেপ্সের।
তিনপুতুল এখন ইতিহাস, তাদের বাড়িগুলো বিক্রি হয়ে গিয়েছে। বাড়ির পুজো এখন বাইরের লোকে করে। পাটিসাপটা এখন দোকান থেকে কিনে খেতে হয়। কিন্তু তিনপুতুল আছে, ছাতিম ফুলের গন্ধ আছে, ভোগে আর বিজয়ায় নাড়ু আছে, কিছু গৃহস্থের বাড়িতে এখনও পাটিসাপটা হয়, যেমন আছে অনেক সাগর দূরে এদের ভাই কোকোদা আর ক্যাজেতা ক্রেপ্স।