
তথাকথিত অতিশিক্ষিত যুক্তিবাদী অভিভাবকদের থেকে কয়েক ধাপ উঁচুতে উঠে গিয়েছেন রিচার বাবা-মা। এমন বহু পরিবার দেখেছি যেখানে বাইরের লোক নয়, তারাই মেয়েদের পছন্দের কাজটি অঙ্কুরেই বিনাশ করে দেয়। যে নাচ শিখতে চায় তাকে গান শিখতে বলে, যে যুযুৎসু ক্যারাটে শিখতে চায়, তাকে যোগাসনে পাঠায়।
রিচা ঘোষের কথা আমার লেখার কথাই নয়, কারণ ২২ বছরের মেয়েটির ২২ গজের জীবনের সঙ্গে আমার তেমন পরিচয় নেই। তাই লেখার কথা শুনে শুরুতেই খানিক গাঁইগুঁই করলাম। সবজান্তার অনধিকার চর্চায় আমার কোনওদিন আগ্রহ নেই। তারপরও কেন লিখছি? লিখছি এই কারণে, স্বীকার করি বা না-করি, জয় ছাড়া আপামর জনসাধারণের কাছে গুণের স্বীকৃতি নেই। সে লেখনীর সাহায্যে পাঠকের হৃদয় জিতে নেওয়াই হোক বা বিপক্ষের উড়ন্ত পাখি-বল মুঠোবন্দি করাই হোক। আর এই জয় যখন ভারতের ক্রিকেট খেলা মেয়েদের, তার তাৎপর্য বহুদূর প্রসারিত। রিচাদের প্রজন্মের কাছে এই মেয়ে হওয়ার প্রতিবন্ধকতা অনেকটাই কম, কিন্তু আমরা যারা বর্ষীয়ান ক্লাবের সদস্য হতে চলেছি, তাদের কাছে এ এক আকাশছোঁয়া উদযাপন।

আমার বাসস্থান থেকে ২০-২২টা বাড়ি বাদেই রিচাদের বাবা, কাকা, আত্মীয়দের গায়ে গা-লাগা পরপর বাড়ি। আমাদেরই মতো ওরাও এলাকার পুরনো বাসিন্দা। চার-পাঁচ বছর বয়স থেকেই ওর বাড়ির পাশের প্রাচীন ও সুবিখ্যাত বাঘাযতীন ক্লাবে খেলা শিখতে যাওয়া। ওদের বাড়ির সামনে যে এটিএম থেকে আমাদের টাকা তুলতে যেতে হয়, মাঝেমধ্যেই ওখানে দাঁড়িয়ে ভাবি, এই এলাকা থেকেই এত বড় এক প্রতিভার উত্থান! স্বাভাবিকভাবেই রিচার কাছে সেটা পারফরমেন্স ভিত্তিক প্রতিষ্ঠা, আমার কাছে সে অতীতের বহু মেয়েদের ধারাবাহিক লড়াইয়ের ফসল।
……………………………
পড়ুন: মেয়েরা বিশ্বকাপ জিতল, কিন্তু হারল কারা?
……………………………

সুভাষপল্লি, হাতি মোড়, কলেজ পাড়া থেকে একটি অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়ের এমন স্বপ্নের উড়ানে কত কিছুই না ঘটে গেল! উত্তরের এই প্রান্তিক শহরকে সে বিশ্ব মানচিত্রে স্থান দিল। যেমন বলা হত– রাঁচি মানে মহেন্দ্র সিং ধোনি, তেমনই এখন, শিলিগুড়ি মানে রিচা ঘোষ। তবে এই প্রসঙ্গে আরও কয়েকটি বিষয় বলার। সোশ্যাল মিডিয়ায় কয়েক জায়গায় দেখছি, ‘শিলিগুড়ির মতো একটা শহর, যেখানে মেয়েদের খেলার কথা ভাবা যায় না’– এসব কথাগুলো লেখার সময় একটু খবর নিয়ে লিখতে হয়। এই সেদিন এই শহরের মেয়ে টেবিল টেনিসের মান্তু ঘোষকে কে না চিনতেন? কিন্তু তারও বহু আগে আমার শৈশবে শিলিগুড়ি থেকে এক তারকার উত্থান হয়। আপনাদের অনেকেরই হয়তো মনে আছে মধুমিতা গোস্বামীর (পরে বিস্ত) কথা। ঘটনাচক্রে ওঁর মা ছিলেন আমার মায়ের নিকট আত্মীয়। বাবা বিমল গোস্বামী ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য-সংস্কৃতি বিভাগের চাকুরে শিল্পী। রামকিঙ্কর মঞ্চ তৈরি হলে তার ভিতরে রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি তাঁরই তৈরি করা ছিল। জানি না, এই শিল্পীর পদটি ওই বিভাগে এখনও আছে কি না। ছোটবেলায় দেখতাম প্রায়ই বিমলদা (সম্পর্কে দাদা) বাবার কাছে নানা কাজে আসতেন। আমরাও পোস্ট অফিসের উল্টো দিকে তাঁদের সাদামাটা ফ্ল্যাট কোয়ার্টারে যেতাম।

বিমলদার সমস্ত জগৎ জুড়ে ছিল তাঁর কন্যা মধুমিতা। কন্যাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি প্রায় সর্বস্ব ত্যাগ করেছিলেন। এখনই নেই, তখন তো শিলিগুড়িতে বিশ্বমানের একজন ব্যাডমিন্টন প্লেয়ার তৈরি করার মতো পরিকাঠামো থাকার প্রশ্নই নেই। কলকাতায় যাওয়ার ট্রেন বলতে একটা-দুটো। বিমলদাকে সারাক্ষণ মেয়েকে নিয়ে কলকাতায় যাতায়াত করতে হত। যতদূর মনে পড়ছে, বিমলদা গোপাদির একটি পুত্র সন্তানও ছিল। তাঁদের আত্মীয়স্বজন, পরিজন বিমলদার এই মেয়ের জন্য ‘অবশেসন’ নিয়ে আড়ালে হাসাহাসি করত। আমাদের বাড়িতে যখন আসতেন, বাবার সঙ্গে কথা হত, সেই মেয়ের পারফরমেন্স এবং প্র্যাকটিস সংক্রান্ত কথা। স্বাভাবিকভাবেই মধুমিতা গোস্বামী যত তারকা হয়ে উঠলেন, ততই তাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ কমে গেল। পরবর্তীকালে মা প্রায়শই অনেককে বলতেন, এমন বাবা পেলে বহু মেয়ের জীবনের কাজ সহজ হয়ে যায়।
……………………………
পড়ুন: স্টাম্প মাইক এখন মাঠে ঢুকে পড়ার আশ্চর্য জানলা
……………………………

এ কথাটার অর্থ এই নয়, এতে মধুমিতার কৃতিত্ব থেকে নম্বর কেটে নেওয়া হচ্ছে। অধিকাংশ বাঙালি বাবারা দীর্ঘদিন ধরেই ব্যতিক্রম। দীর্ঘকাল ধরেই বাঙালি বাবারা কন্যাসন্তান হলে আনন্দিত হন, তাকে উপযুক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করেন। একসময় এটি স্বাভাবিক মনে হত। সারা ভারতের, বিশেষ করে উত্তর ভারতের নিরিখে এখন এটি আশ্চর্যই মনে হয়। এর নেপথ্যে কলকাতার উপনিবেশিক রাজধানী হওয়া এবং শিক্ষার সুযোগ পাওয়া, কারণ হতে পারে কি না, ভেবে দেখা যেতে পারে।

রিচার বয়স মাত্র ২৩। ওর বাবা মানবেন্দ্রবাবুরও সে অর্থে বয়স বেশি হওয়ার কথা নয়। আম্পায়ার বাবা ওকে নিয়ে বাঘাযতীন ক্লাবে কোনও একটা খেলায় ভর্তি করতে নিয়ে গিয়েছেন– এটা আমাদের কাছে তাই আশ্চর্যের কোনও বিষয় নয়। ব্যতিক্রম অন্য জায়গায়। বাঘাযতীন ক্লাবে মেয়েরা টেবিল টেনিস ও ব্যাডমিন্টন খেলতেই বেশি যায়। সেখানে ছোট্ট রিচার পছন্দ হল তুলনামূলক শারীরিক সামর্থ্যে পাল্লা ভারী ক্রিকেটকে। স্বাভাবিকভাবেই অতগুলি মেয়ে-সঙ্গী না পাওয়ায় তাকে ছেলেদের সঙ্গে খেলতে হল। একসময়ের ক্রিকেটার এবং আম্পায়ার হলেও তার বাবা যে এই আঘাত লাগার সম্ভাবনাযুক্ত খেলায় তাকে থাকতে দিলেন এটাই বড় কথা। মানবেন্দ্রবাবু ভাবলেন না, মধ্যবিত্ত বাড়ির কন্যাসন্তান, এ খেলায় গায়ে-হাতে-পায়ে চোট পাওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা। রিচার সাহসী মা পাশে থাকলেন। এতেই লড়াইটা অর্ধেক জিতে যাওয়া যায়। ঠিক এই জায়গায় তথাকথিত অতিশিক্ষিত যুক্তিবাদী অভিভাবকদের থেকে কয়েক ধাপ উঁচুতে উঠে গিয়েছেন রিচার বাবা-মা। এমন বহু পরিবার দেখেছি যেখানে বাইরের লোক নয়, তারাই মেয়েদের পছন্দের কাজটি অঙ্কুরেই বিনাশ করে দেয়। যে নাচ শিখতে চায় তাকে গান শিখতে বলে, যে যুযুৎসু ক্যারাটে শিখতে চায়, তাকে যোগাসনে পাঠায়।
……………………………..
এমন বহু পরিবার দেখেছি যেখানে বাইরের লোক নয়, তারাই মেয়েদের পছন্দের কাজটি অঙ্কুরেই বিনাশ করে দেয়। যে নাচ শিখতে চায় তাকে গান শিখতে বলে, যে যুযুৎসু ক্যারাটে শিখতে চায়, তাকে যোগাসনে পাঠায়।
…………………………….

আমার কর্মস্থলে বার্ষিক ক্রিকেট প্রতিযোগিতা হয়। সেখানে দু’-একবার মানবেন্দ্রবাবু আম্পায়ার হয়ে এসেছেন। আমাদের সুইমিং কোচ সুবিমল স্যরের দাদা হিসেবে তাঁকে দেখেছি। গম্ভীর মানুষটিকে স্কুল ক্রিকেটের ছোট পরিসরেও অত্যন্ত তন্নিষ্ঠ, খুঁতখুঁতে হতে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। এমন ভঙ্গিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আম্পায়ারিং করছেন যেন বড়সড় টি-টোয়েন্টি চলছে! সুবিমল স্যরের কাছে শুনেছিলাম, উনি প্রশিক্ষিত এবং সিএবি অনুমোদিত আম্পায়ার। খুব ছোট ছোট বিষয়ে মানুষ চেনা যায়। যে একাগ্রতা তিনি সারা জীবন বহন করেছেন, নিজের জীবনে প্রস্ফুটিত করতে পারেননি, কন্যার মধ্যে সেই আগুনে ইচ্ছা প্রবিষ্ট করাতে পেরেছেন। প্রতিপক্ষের দিকে যে আগ্রাসী খুনি চোখে তাকিয়ে থাকতে পারে রিচা, তাকে যিনি এমনভাবে তৈরি করেছেন, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার জানানোর জন্যও এ লেখা।

যে ক’দিন মনে মনে না হেঁটে কলেজের মাঠে আর তার চারপাশে হাঁটতে যাই, ভাবি, এই মাঠেই তো রিচা খেলেছে। আর এখানেই আমি সারাজীবন হেঁটে পাঁচ কিলো কমাতে পারছি না! এক পাক মেরেই, ‘যথেষ্ট হয়েছে’ বলে হাই তুলে বাড়ি ফিরছি। ফলে ভালো বাবা-মা বা সুযোগ পাওয়াই সব নয়, রিচা হয়ে ওঠা শুধু রিচার পক্ষেই সম্ভব। কোটিতে সে একখানিই হয়। সেখানে আমরা পাড়াতুতো প্রতিবেশী হিসেবে ওর ১০-২০ হাতের মধ্যে থাকলেও আসলে লক্ষ-যোজন দূরে।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved