
আমি পশ্চিমবঙ্গের লোক যখন এই গান গাইব তখন কি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে গাইব? না। আমি আমার বাংলাকে নিয়েই গাইব। হ্যাঁ, আমি যদি বাংলাদেশে যাই এবং এই গানটি শুরু হয় তাহলে অবশ্যই আমি উঠে দাঁড়াব। জাতীয় সংগীতকে সম্মান জানানোর যতগুলি পথ খোলা আছে, আমি সেই পথগুলি নেব, রীতিগুলি পালন করব। কিন্তু এদেশে তো এই গানটা ‘জাতীয় সংগীত’ নয়। কিন্তু এই গান আমার, আমাদেরও।
‘আমার সোনার বাংলা’– এই গান, এই ভারতে গাওয়া যাবে না! একথা কেউ বলতে পারে, ভাবিনি! তবু এ ঘটনা সত্যি। কারণ যে-দল কেন্দ্রে বসে আছে, তারা প্রায়শই এরকম সব উদ্ভট ফতোয়া জারি করে। তারা এ দেশকে ‘অসভ্য দেশ’ বানিয়ে ছেড়েছে। যদিও এ দেশ এখনও, পুরোপুরি অসভ্য দেশ হয়ে যায়নি। কারণ কেন্দ্রের কথা মানে না সকলে। মনে আছে, প্রয়াত জ্যোতি বসু একবার ওই রাজনৈতিক দলটিকে বলেছিলেন, ওরা ‘বর্বর’। কিন্তু বর্বরদেরও তো একটা রীতি থাকে। যে পথে বর্বররা চলবেন, তারও একটা মানানসই, চলনসই ব্যাপার থাকে। কিন্তু এরকম নিপাট, নির্জলা, নির্বুদ্ধিতা, অশিক্ষা বর্বরদেরও ছিল না। হয়তো তাঁরা হিংসার আশ্রয় নিতেন, কারণ কোনও সংবিধান বা আইনের শাসন তাঁদের মধ্যে ছিল না। এখন যে এই আধুনিক বর্বর– সেখানে রয়েছে ডিকটেটরশিপ, রয়েছে ফ্যাসিজম।
ভেবে দেখুন, একটি গান, যা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা, এদেশের জাতীয় সংগীত যাঁর লেখা, তাঁরই আরেকটি গান– ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’, যা বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। কিন্তু বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত– সেটাই তো একমাত্র বিচার্য বিষয় নয়। আমি পশ্চিমবঙ্গের লোক, আমি তো বাংলাদেশের লোক নই। আমি ছোটবেলা থেকেই ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গেয়েছি।

আমার বাবা প্রয়াত হয়েছেন ১৯৯৩ সালে। আমার বাবা সুধীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, তাঁর যৌবনকালে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি রেকর্ড করেছিলেন শৈলজারঞ্জন মজুমদারের ট্রেনিংয়ে। সেই গান খুব এলিয়ে গাওয়া গান নয়, তার মধ্যে গতির চলন ছিল, স্পিরিট ছিল। তখন সম্ভবত ব্রিটিশ ভারতের জমানা শেষ হয়েছে। ভারত স্বাধীন হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ চলে গিয়েছেন, বেশিদিন হয়নি। রবীন্দ্রনাথ শৈলজারঞ্জনকে শিখিয়েছিলেন, শৈলজারঞ্জন শিখিয়েছিলেন বাবাকে। চলচ্চিত্রের নেপথ্যসংগীত হিসেবে তা প্রয়োগও করা হয়েছিল। এই যে ঘটনা– এ তো আমাদের দেশেরই। তখন তো শৈলজারঞ্জন মজুমদার বা সুধীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় কঙ্গো বা নাইজেরিয়ার নাগরিক ছিলেন না। সেসময় বাংলাদেশ তৈরিই হয়নি, ফলে সে প্রসঙ্গে আসছিই না। ফলে এ গান ঐতিহাসিক। আমি কিংবা পশ্চিমবঙ্গের লোক যখন এই গান গাইব তখন কি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে গাইব? না। আমি আমার বাংলাকে নিয়েই গাইব। হ্যাঁ, আমি যদি বাংলাদেশে যাই এবং এই গানটি শুরু হয় তাহলে অবশ্যই আমি উঠে দাঁড়াব। জাতীয় সংগীতকে সম্মান জানানোর যতগুলি পথ খোলা আছে, আমি সেই পথগুলি নেব, রীতিগুলি পালন করব। কিন্তু এদেশে তো এই গানটা ‘জাতীয় সংগীত’ নয়। কিন্তু এই গান আমার, আমাদেরও। ক’দিন আগে আসামে কংগ্রেস দলের এক নেতা, বাঙালি-অধ্যুষিত এক জেলায় সম্ভবত এই গান গেয়েছিলেন বাংলায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে। তাই নিয়ে না কি বাকবিতণ্ডা চলছে! এর মানে কী!
এই সমস্ত কিছুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চালিয়ে যেতে হবে। বেশ কিছুকাল ধরেই দেখছি যে, বাঙালিদের ওপরে আক্রমণ করা হচ্ছে। উত্তরপ্রদেশ-ওড়িশায়, ছিন্নবিচ্ছিন্ন ভাবে এখানে-ওখানে। সে আক্রমণ, বলাই বাহুল্য, বাংলা ভাষার ওপর আক্রমণও। বাংলা ভাষায় কথা বললে তাঁকে সরাসরি বলা হচ্ছে, তিনি ‘বাংলাদেশের লোক’। তাঁর এখানে থাকার অধিকার নেই। আমি তো বাঙালি। আমি বাংলায় কথা বলি, আমার এদেশে থাকার অধিকার নেই! এর উত্তর কীভাবে দেব আমরা? আমাদের মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। এটা একটা চ্যালেঞ্জ! যদিও মাথা ঠান্ডা থাকে না। আমার অন্তত থাকে না। অথচ ৭৭ বছর বয়স আমার, জীবন ফুরিয়ে এল। তবুও মাথা ঠান্ডা থাকছে না ছাই!

সরাসরি গণজাগরণের সময় এসে গিয়েছে। আমি নিজে খুব একটা জাতীয়তাবাদী লোক নই। ছিলামও না কোনও দিন। আমি জগৎবাদী লোক। কিন্তু এখন আমি সম্পূর্ণভাবে জাতীয়তাবাদী বাঙালি। প্রায়ই টেলিফোন আসে, উল্টোদিকের মানুষটা হিন্দিতে কথা বলে। আমি যতই বলি, ‘এটা পশ্চিমবঙ্গ, বাংলায় কথা বলুন’, বলে না। ট্যাক্সি কিংবা আজকালকার অ্যাপ-ক্যাবের চালক– বেশিরভাগই স্বচ্ছন্দে হিন্দি বলে যাচ্ছে। মুশকিল হল, আমরাও তার সঙ্গে তাল দিয়ে যাই। হিন্দির প্রত্যুত্তরে হিন্দি বলি। এই সবকিছুই কিন্তু আজকের ‘সোনার বাংলা’ গাইতে না বলার তীব্র সাহসের সঙ্গে জড়িয়ে। বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ফলে গানটিকে কেন্দ্র করে যে নির্বুদ্ধিতার ষণ্ডামি এবং একবগ্গা ফ্যাসিজমের পরাকাষ্ঠা আমরা দেখলাম বা আরও দেখব– তার বিরুদ্ধে গণআন্দোলন জরুরি। যে যেখানে আছে, সেখান থেকেই। জরুরি– এই গানটি গাওয়াও। আমরা গাইব।
এই বুড়ো বয়সে আর কী-বা করার আছে। আমাদের এত বড় দেশ, তার এত ঐতিহ্য– সে দেশের কেন্দ্রীয় দলের নেতারা এরকম আচরণ করবেন, ভাবলে কষ্টই হয়। মনে পড়ে, আমি আর আমার বড় ভাই, পাঁচের দশকে, ওই ’৫৭-’৫৮ সালে, অনুরোধের আসর শুনতাম ‘আকাশবাণী কলকাতা’য়। আর আধ মিলিমিটার গেলেই রেডিওতে ধরা পড়ত ঢাকার চ্যানেল। ওই সময়, কলকাতায় অনুরোধের আসর শেষ হলেই ঢাকার অনুরোধের আসর শুরু হত। সেখানে কিন্তু ভারতের গানগুলোই বাজত। শেষ হত ‘রেডিও পাকিস্তান, ঢাকার অনুষ্ঠান আজকের মতো এখানেই শেষ। খোদা হাফিজ, পাকিস্তান জিন্দাবাদ।’ আমি আর দাদা এরপরও অপেক্ষা করতাম, কারণ একেবারে শেষে, পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত বাজত। আমি উর্দু জানি না, কিন্তু গাইতেই পারি পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত। সুরটা তো জানি। সেই গান গাইলে কি আমাকে ফাঁসি দেওয়া হবে? আমি রাষ্ট্রদ্রোহী? বেশ করেছি গেয়েছি। গান তো গান। এবার গান গাইতে গাইতে যদি কেউ ঠেঙায়, আমার প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের– তখন সেই গানের বিরোধিতা করব, কিন্তু তা যখন হচ্ছে না, গানকে গান হিসেবে গ্রহণ করতে বাধাটা কোথায়?
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved