
কাঠের লাট্টুর ইতিহাসও বেশ প্রাচীন। ভারতবর্ষের ওড়িশা, বেনারস ও গোয়ায় কাঠনির্মিত লাট্টু পাওয়া যায়। কাঠ সহজলভ্য, তুলনায় হালকা। লাট্টুর মাধ্যমে শিশুরা কমবয়স থেকেই কৌণিক ভরবেগ, ঘূর্ণন জড়তা ও কেন্দ্রাতিগ বলের মতো বৈজ্ঞানিক ধারণা শেখে। বেশ কিছু ইতিহাসবিদ এ বিষয়ে একমত যে, লাট্টু ভারতীয়দের প্রাথমিক বিজ্ঞানচেতনার প্রতীক। ভারতীয় কাঠের লাট্টুর সঙ্গে ল্যাটিন আমেরিকান ট্রম্পোর অসাধারণ মিল রয়েছে। যদিও উৎপত্তিগতভাবে দুটোই আলাদা।
‘ওপেনটি বায়োস্কোপ, লাইনটানা টেলিস্কোপ’, ‘ইপ্টিপিন সিফটিপিন, খুকু খায় ভিটামিন’ কিংবা ‘আমপাতা জোড়া জোড়া, মারব চাবুক চড়বে ঘোড়া’ ছড়াগুলো মনে আছে? নিশ্চয়ই মনে থাকবে। আসলে এই কর্মব্যস্ততার ভিড়ে আমরা যেমন হারিয়েছি শৈশব, তেমনই হারিয়েছি বহু খেলাধুলোর মাধ্যমও। সংক্ষিপ্ত পরিসরে এমনই একটি মাধ্যম নিয়ে আলোচনা করা যাক!
যেমনটা লাট্টু খেলা। লাট্টু খেলেননি বা নাম শোনেননি এমন ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া বিরল। লাট্টুর ইংরেজি নাম স্পিনিং টপ। লাট্টু সর্বপ্রথম আবিষ্কৃত হয়েছিল সম্ভবত মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে, খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ সালে। আদিতে লাট্টু বলতে আমরা যে লাট্টু খেলি, সেই লাট্টু কিন্তু ছিল না। বরং তা ছিল পাথরের। এছাড়াও প্রাচীন গ্রিস ও রোমের শিশু ও অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা এই ধরনের স্পিনিং টপ দিয়ে খেলাধুলা করত। প্রত্নতাত্ত্বিকরা নানা সময়ব্যাপী দীর্ঘ খননকার্য দ্বারা ইরাকে, চিনে ও পরবর্তীকালে আমেরিকাতেও লাট্টু খেলার প্রমাণ পেয়েছেন। এমনকী ইউরোপের একাধিক অঞ্চলে হাড় নির্মিত লাট্টুও পাওয়া গিয়েছে।

নানা প্রদেশে লাট্টুর পৃথক পৃথক নাম আছে। লাটিম, পাম্বারাম (তামিল), ভারাগুড়ি (কন্নড়) ও বোঙ্গারাম (তেলেগু) নামেও পরিচিত আমাদের এই শৈশব ঘুঁটি। এটি বিশ্বের প্রাচীন খেলনাগুলির মধ্যে একটি। আমাদের ছেলেবেলায় কাঠের তৈরি লাট্টু কিনতে পাওয়া যেত। শুনেছি, তার আগে মাটি দিয়েও লাট্টু তৈরি হত।
কাঠের লাট্টুর ইতিহাসও বেশ প্রাচীন। ভারতবর্ষের ওড়িশা, বেনারস ও গোয়ায় কাঠনির্মিত লাট্টু পাওয়া যায়। কাঠ সহজলভ্য, তুলনায় হালকা। লাট্টুর মাধ্যমে শিশুরা কমবয়স থেকেই কৌণিক ভরবেগ, ঘূর্ণন জড়তা ও কেন্দ্রাতিগ বলের মতো বৈজ্ঞানিক ধারণা শেখে। বেশ কিছু ইতিহাসবিদ এ বিষয়ে একমত যে, লাট্টু ভারতীয়দের প্রাথমিক বিজ্ঞানচেতনার প্রতীক। ভারতীয় কাঠের লাট্টুর সঙ্গে ল্যাটিন আমেরিকান ট্রম্পোর অসাধারণ মিল রয়েছে। যদিও উৎপত্তিগতভাবে দুটোই আলাদা।

শুধু খেলাই নয়, আগে গ্রামে গ্রামে বিভিন্ন মেলাতে বা পার্বণে লাট্টু রাখা হত সৌজন্যের জন্যে। আগে মূলত ছুতোররাই শিশু-কিশোরদের লাট্টু বানিয়ে দিত। সেক্ষেত্রে পেয়ারা গাছ ও অন্যান্য গাছের ডাল কেটে তাঁরা লাট্টু বানাত। পাট থেকে তৈরি হতো সুতো। এই সুতোকে বলা হতো ‘লতি’। যদিও আমাদের সময়ে গেঞ্জির দড়ির সুতোও লাট্টুতে ব্যবহৃত হত। পরে প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে।
মাটিতে বৃত্ত একে খেলোয়াড়রা নিজেদের লাট্টু সেখানে ঘোরায়। বৃত্তে যার লাট্টু বেশিক্ষণ ঘুরবে, সে বিজয়ী হবে। আবার, বৃত্তের মধ্যে যদি একজনের লাট্টু অন্যের লাট্টুকে আঘাত করে, আঘাতকারী ব্যক্তি সেই লাট্টুরও মালিক হয়ে যায়। অনেক সময় একজনের লাট্টুর আঘাতে অন্যের লাট্টু ভেঙে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে। আবার শূন্যে ছুঁড়ে হাতের তালুতে লাট্টু নিয়ন্ত্রণে আনার কৌশলও জানেন অনেকে।

সিনেমায় লাট্টুর বহুল ব্যবহার দেখা গিয়েছে। শিশু-কিশোর মনের উপর নির্মিত বেশ কিছু বাংলা তথ্যচিত্রে লাট্টুর ভূমিকা পরিলক্ষিত। বিশ্ববন্দিত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় তাঁর ‘পথের পাঁচালী’ সিনেমায় লাট্টু খেলার দৃশ্য ব্যবহার করেছেন। পাশাপাশি হিন্দি সিনেমা ‘তারে জমিন পর’-এও স্কুলের মাঠে খেলাধুলার দৃশ্যে লাট্টু দেখা যায়। প্রধানত শৈশবের নিষ্পাপ আনন্দের প্রতীকরূপে। ঘুরন্ত লাট্টু– একদিকে সময়ের প্রবাহকে, আবার অন্যদিকে স্থিরতার মধ্যেও গতিশীলতাকে প্রকাশ করে।
বাংলায় হাওড়া, উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, নদিয়া ও হুগলিতে লাট্টু তৈরির কারখানা ছিল বলে জানা যায়। পরে বেশ কিছু কারখানা বন্ধ হয়ে যায় কর্মচারীর অভাবে। লাট্টুর পাশাপাশি একাধিক খেলাধুলার সরঞ্জাম আবিষ্কার হতে থাকে। মনে করা হয়, বেশ কিছু লাট্টু নির্মাণকর্মী উপযুক্ত বেতনের অভাবে কিংবা বিকল্প পেশার সন্ধানে এই কাজ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।

পাশাপাশি ক্রমেই গ্রাম থেকে ছেলেমেয়েরা শহরমুখী হয়ে পড়ল। খেলাধুলার অবসর সময় কমে এল। এভাবেই হারিয়ে গেল লাট্টু-সহ আরও নানা খেলাধুলা। জীবনে উন্নতির ইঁদুর-দৌড়ে শামিল হয়ে আমরা হারিয়ে ফেললাম আমাদের শিকড়, আমাদের চেনা-পরিচিত সেই শৈশবকে। যান্ত্রিকতা-সর্বস্ব হয়ে উঠল আমাদের জীবন। যদিও এখনও কিছু গ্রামে লাট্টু পাওয়া যায়। সেই ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখা একান্তই আমাদের কর্তব্য।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved