গাজা এবং ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে যে শিশুরা বেঁচে থাকে ,তাদের আশৈশবের সঙ্গী হয় ট্রমা। তারা কুঁকড়ে থাকে ভয়ে। অথবা অস্বাভাবিক রকমের আগ্রাসী হয়ে ওঠে। ইমান ফারাজাল্লা বড় হয়েছেন প্যালেস্টাইনে। এখন থাকেন আমেরিকায়৷ উদ্বাস্তুদের নিয়ে কাজ করেন। তিনি বলছিলেন, ‘কী করে আমি বোঝাব একজন ইজরায়েলি সৈন্য যখন বন্দুক হাতে পাঁচিল টপকে বাড়িতে ঢুকে পড়ত, বেধড়ক পেটাতে শুরু করল আমার মা অথবা ভাইদের, মারতে মারতে নগ্ন করে দিত, তখন ঠিক কেমন লাগত আমার! বছরের পর বছর এমন সব দৃশ্যের সঙ্গে বেড়ে উঠেছি আমি। গভীর ট্রমা তৈরি হয়েছে। থেঁতলে গিয়েছে মন।’
আসিফ-আবু-মাজিন একজন ফুটবলার। বয়স ১১। গাজার আল জায়তুনে বাড়ি। বছর চারেক আগে আসিফ খেলতে শুরু করেছিল ডিফেন্ডার হিসাবে। কিন্তু টিমে গোলকিপারের বড্ড অভাব। তার ওপর চেহারাটাও লম্বা-চওড়া। তাই গত বছর থেকে গোলে খেলছিল।
আসিফ এখন শুয়ে আছে (তিনদিন আগেও ছিল, এখনও বেঁচে আছে কি না, জানি না) হাসপাতালে ফ্লোরে। এমন একটা হাসপাতাল, যেখানে থিকথিক করছে রোগী। মেঝে, করিডোর, সিঁড়ি– সর্বত্র হাজার হাজার রোগী। একজনের গায়ের ওপর আরেকজন, ঘেঁষাঘেঁষি। জল নেই। অধিকাংশ সময় বিদ্যুৎ নেই। অ্যানাস্থেসিয়া ছাড়াই অপারেশন চলছে। আসিফের দুটো পা ইজরায়েলি বোমা হামলায় নষ্ট হয়ে গেছে। সে আর কোনও দিন ফুটবল খেলতে পারবে না।
আসিফকে কি শিশু বলা যায়? না কি কিশোর? এত মৃত্যু, এত রক্তাক্ত দেহ, এত ঝলসে যাওয়া প্রিয়জনের লাশ দেখার পর মনের ভিতরের ফুটফুটে শৈশব বা ঝলমলে কৈশোরের ঠিক কতটুকু বেঁচে থাকে? আসিফ বলছিল, ‘আমাদের বাড়িটা ধুলো হয়ে গিয়েছে। আমার ফুটবল কিট ধ্বংসস্তূপে মিশে গিয়েছে। জুতো, মোজা কিচ্ছু নেই। ফুটবলটাও নেই। অবশ্য থেকেই বা কী হত! আমার তো পা দুটোই আর নেই!’ কথা বলতে বলতে আসিফ হাসতে থাকে। ১১ বছরের কিশোরের অপ্রকৃতিস্থ হাসি। নিস্পৃহ সাংবাদিকের পক্ষেও যে হাসি বেশিক্ষণ সহ্য করা মুশকিল।
২.
৮ বছরের আমিরা-আল-বাদায়ির মেরুদণ্ড ভেঙে গিয়েছে। আর কোনও দিন হাঁটতে পারবে না ঠিক করে। অবশ্য বেঁচে থাকলে তবে তো হাঁটার প্রশ্ন। বেঁচে থাকাটাই যেখানে লটারি পাওয়ার মতো, সেখানে আমিরা তো ভাগ্যবান! তার মা এবং ৭ ভাই ইতিমধ্যেই মৃত। ইজরায়েলি সেনা বলেছিল উত্তর গাজা খালি করে দিতে হবে। আমিরার বাবা আইয়াদ-আল-বাদায়ি স্ত্রী আর সন্তানদের তুলে দিয়েছিলেন একটা ছোট গাড়িতে। নিজে হাঁটছিলেন উত্তর গাজা থেকে দক্ষিণ গাজার দিকে। তাঁর মাথার ওপর পাক খাচ্ছিল যুদ্ধবিমান। চর্তুদিকে বিস্ফোরণ! নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পলাতক বেসামরিক মানুষের ওপর বোমা পড়ছিল। অথচ যে রাস্তায় ওঁরা হাঁটছিলেন, সেটিকে ‘নিরাপদ সড়ক’ হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল আগেই। বোমা এবং যুদ্ধবিমানের সঙ্গে লুকোচুরি খেলার ফাঁকে বাদায়ি জানতে পারেন, তাঁর স্ত্রী এবং সন্তানরা আহত। এক এক করে ৭টি সন্তানের মৃত্যুর খবর আসে তাঁর কাছে।
চুপ করে বসে খানিকক্ষণ ভাবলে চারপাশ কেমন আবছা হয়ে যায়। সদ্য সন্তানহারা বাবার মাথার ওপর যুদ্ধবিমান উড়ছে। মুঠোফোনে খবর আসছে আরও এক সন্তানের মৃত্যুর, তারপর আরও একজন। তিনি শুনতে শুনতে হাঁটছেন। একটু নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। বাঁচতে চেয়ে।
কত নাম লিখব! লন্ডনে যুদ্ধবিরোধী মিছিলে মানুষের হাতে হাতে মৃত পরিজনদের ছবি। কারও নাম আয়াত ফেরওয়ানা। বয়স ১ মাস। বাড়ি ছিল গাজার আলরিমালে। কারও নাম মিশক জৌদা। ৩ বছর বয়স। থাকত গাজার আল নুসিরাতে। আহমেদ আল নাওক বলে এক ভদ্রলোকের তোলা সেলফি দেখলে খানিকক্ষণ থমকে যেতে হয়। পরিবারের একঝাঁক কচিকাঁচার সঙ্গে সেলফি তুলেছিলেন তিনি। অলিভ গাছের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। এক ফ্রেমে জনা দশেক কচিকাঁচা। সক্কলে মারা গিয়েছে। সক্কলে। কেউ বেঁচে নেই। ফ্রেমভর্তি শূন্যতা। উত্তর গাজায় সাঁতার শেখাতেন আমজেদ তানতেস। কোনওমতে প্রাণ নিয়ে আসতে পেরেছেন দক্ষিণ গাজায়। একের পর এক ছাত্রের মৃত্যুসংবাদ পাচ্ছেন। কারও বয়স ৬, কারও ১০, কারও ১২। সম্ভাবনাময় সাঁতারু তারা। স্বপ্ন ছিল সমুদ্র পাড়ি দেবে। আমজেদ বলছিলেন, এত যন্ত্রণা বুকে চেপে বাঁচা যায় না। একটা বোমা তাঁকে খুঁজে নিক। শান্তি পাবেন।
৩.
নেহাদ আবু জাফরের কথা বলি। দেড় দশকের ওপর বিয়ে হয়েছে ভদ্রমহিলার, কিছুতেই মা হতে পারছিলেন না। ডাক্তারবদ্যি কম করেননি। কাজ হচ্ছিল না কিছুতেই। ১৪ বছরের চেষ্টার পর সম্প্রতি জন্মেছে তাঁর মেয়ে– ফতিমা। অক্টোবরের ১৭ তারিখ বিমান হামলায় একরত্তি মেয়েটির দুটো পা কেটে বাদ দিতে হয়েছে। সে-ও আর কোনও দিন হাঁটতে পারবে না। নেহাদের অসীম সৌভাগ্য কোনওমতে অপারেশনটুকু করাতে পেরেছেন। তারপর থেকে সব চিকিৎসা বন্ধ। খাবার নেই। জল নেই৷ অসহ্য যন্ত্রণায় গোঙাচ্ছে ছোট্ট ফতিমা। মা আর কী করবেন! মেয়েকে একের পর এক পেইনকিলার খাওয়াচ্ছেন।
নেহাদ বলছিলেন, ‘আমার মেয়েটা কী অপরাধ করেছিল? আমরা তো হামাস নই। ওরা কেন সিভিলিয়ানদের ওপর বোমা মারছে? সাড়ে ৪ হাজার শিশুকে ওরা কেন হত্যা করল?’ ভিডিও কলের উল্টোদিকে বসে থাকি চুপ করে, উত্তর থাকে না।
‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র প্রধান বলেছেন, গাজায় প্রতি ১০ মিনিটে একজন শিশু খুন হচ্ছে ইজরায়েলের সেনাবাহিনীর আক্রমণে। এক ঘণ্টায় মরছে ৬ জন শিশু। একবেলায় ৭২ জন। একদিনে ১৪৪ জন। সহজ অঙ্ক। মুখে মুখে হিসাব করা যায়। নিউজ ফিড জুড়ে ছড়িয়ে থাকে ফুটফুটে লাশবহর।
লন্ডন হয়ে উঠেছে গোটা দুনিয়ার যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। কাজ করছি প্যালেস্টাইন সংহতি মঞ্চের সঙ্গে। প্রতিদিন ফোনে, ভিডিও কলে কথা বলতে হয় নরককুণ্ডে পরিণত হওয়া গাজা এবং অবরুদ্ধ ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে আটকে পড়া মানুষের সঙ্গে। কথা বলতে হয় হাসপাতালের চিকিৎসকদের সঙ্গে। কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন তাঁরা। সেই কান্না লিখে রাখি। লিখে রাখি, একটু একটু করে ফুয়েল শেষ হয়ে যাওয়ার ভয়। লিখে রাখি, মর্গে জায়গা নেই। আইসক্রিমের ফ্রিজারে রাখা হচ্ছে লাশ। বোমায় ঝলসে যাওয়া শিশুদের ক্ষতস্থান পরিষ্কার করার মতো জল নেই, লিখে রাখি। লিখে রাখি হাসপাতালে বোমা পড়ছে, উদ্বাস্তু শিবিরে বোমা পড়ছে। আল শিফা হাসপাতালের ৩৭ জন প্রিম্যাচিওর বেবি মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। ইতিমধ্যেই ২ জন মারা গিয়েছে। তারা সকলেই Neonatal ICU -তে ছিল৷ বিদ্যুৎ ফুরিয়ে যাওয়ার পর তাদের বের করে আনা হয়েছে। ছোট ছোট দেহ। ফুটফুটে। তুলতুলে। মানুষের সন্তান। অমৃতের পুত্রকন্যারা। একটু একটু করে মরে যাচ্ছে। গাজায়। এখন।
এই সব মৃত্যু, অসহায়তা, কান্না, আর্তনাদের ডকুমেন্টশন করা, রিপোর্ট তৈরি কাজ। প্রতিদিন নিয়ম করে রিপোর্ট লিখি। পাঠাই। জানি না আজ যাঁর সঙ্গে কথা বললাম, আগামিকাল তিনি বেঁচে থাকবেন কি না। লিখতে লিখতে অক্ষর ঝাপসা হয়ে আসে। স্ক্রিন ঘোলাটে। এত অসহায় এই বেঁচে থাকা! এত অসহায় মনুষ্যজন্ম!
৪.
রাষ্ট্রসংঘের মহাসচিব বলেছেন, গাজা এখন শিশুদের গোরস্থান। গণহত্যার বিবরণ শুনতে শুনতে ভাবি, যে ছেলেটি শুয়ে ছিল সমুদ্রের ধারে, নীল প্যান্ট লাল জামা পরা, সেই আয়লান কুর্দি বুঝি আজ বেঁচে উঠেছে গাজায়। হাতের নিজের নাম লিখে ঘুমোতে যাচ্ছে। পরের দিন সকালে বেওয়ারিশ লাশ হতে না হয় যেন। হাতে লেখা নাম যেন বলে দেয় নতুন করে কে আবার সন্তানহারা হলেন।
কত শিশু থাকে গাজায়? ইউনিসেফ বলেছে, গাজার মোট জনসংখ্যার ৪৭ শতাংশই শিশু এবং নাবালক। ১৪০ স্কোয়্যার মাইলের গাজায় ২.৩ মিলিয়ন মানুষের বাস। এই মানুষগুলির কেউ নিরাপদ নন। একজনও না। রাষ্ট্রসংঘের কর্মীরা নিরাপদ নন। ঝাঁকে ঝাঁকে মরছেন তাঁরা। সাংবাদিকরা মরছেন। রোগী নিয়ে ছুটে যাওয়া অ্যাম্বুলেন্সে বোমা পড়ছে। প্রায় আড়াইশো স্কুলে বোমা পড়েছে। এই মৃত্যুর উৎসবে কেমন করে বাঁচবে শিশুরা?
৫.
বেঁচে থেকে করবেই বা কী? গাজা এবং ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে যে শিশুরা বেঁচে থাকে ,তাদের আশৈশবের সঙ্গী হয় ট্রমা। তারা কুঁকড়ে থাকে ভয়ে। অথবা অস্বাভাবিক রকমের আগ্রাসী হয়ে ওঠে। ইমান ফারাজাল্লা বড় হয়েছেন প্যালেস্টাইনে। এখন থাকেন আমেরিকায়৷ উদ্বাস্তুদের নিয়ে কাজ করেন। তিনি বলছিলেন, ‘কী করে আমি বোঝাব একজন ইজরায়েলি সৈন্য যখন বন্দুক হাতে পাঁচিল টপকে বাড়িতে ঢুকে পড়ত, বেধড়ক পেটাতে শুরু করল আমার মা অথবা ভাইদের, মারতে মারতে নগ্ন করে দিত, তখন ঠিক কেমন লাগত আমার! বছরের পর বছর এমন সব দৃশ্যের সঙ্গে বেড়ে উঠেছি আমি। গভীর ট্রমা তৈরি হয়েছে। থেঁতলে গিয়েছে মন।’ ইমান তাই বারবার ফিরে গিয়েছেন গাজায়। সেখানকার শিশুদের ট্রমার ডকুমেন্টেশন করেছেন। তাঁর ছোটবেলার দৃশ্যগুলি আরও অনেক বেশি বীভৎসতার সঙ্গে অভিনীত হচ্ছে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে। সেখানে কোনও হামাস নেই। যুদ্ধ নেই। সেখানে পিএলও পরিচালিত প্যালেস্তাইন অথরিটির সরকার৷ অথচ সেখানেও পাখির মতো মানুষ মারছে ইজরায়েল। বাড়ি বাড়ি ঢুকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে শিশুদের। ইতিমধ্যেই ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের শিশুমৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ৫০।
গাজা এবং ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের শিশুদের অধিকাংশই ভোগে গভীর মানসিক ব্যাধিতে। প্রায় ৭০ শতাংশ শিশু ভোগে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গাজার এক তৃতীয়াংশ শিশুর অবিলম্বে মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসা প্রয়োজন। প্রতি ৫ জন শিশুর মধ্যে ৪ জন ডিপ্রেশনের শিকার। ৫৫ শতাংশ ফিলিস্তিনি শিশু কোনও না কোনও পরিচিতের মৃত্যু দেখেছে রাজনৈতিক হিংসায়৷ দশকের পর দশক ধরে ‘মুক্ত কারাগার’ হয়ে থাকা ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক এবং গাজা গত একমাসে পরিণত হয়েছে ‘মুক্ত কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’-এ। বিশেষত গাজায় যা চলছে, তা হলোকাস্টের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। বলছেন জায়নবাদ বিরোধী ইহুদিরা। হাজারের হাজারে তাঁরা পথে নামছেন ইজরায়েলি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। তাঁদের হাতে ব্যানার, ‘নট ইন আওয়ার নেম’।
এই যুদ্ধ গত ৭ অক্টোবর শুরু হয়নি। শুরু হয়েছে ১৯৬৭ সালে, যখন বেদখল হয় ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক এবং গাজা৷ অথবা বলা যায় এই যুদ্ধের শুরু তারও প্রায় দু’দশক আগে। আরবদের মতামতের তোয়াক্কা না করে পশ্চিমের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে যখন তৈরি হল ইজরায়েল। লক্ষ লক্ষ আরব ছিটকে পড়লেন ভিটেমাটি থেকে৷ তাঁদের গ্রাস করল ‘নকবা’-র আতঙ্ক। তখন থেকে শিশুরা থেঁতলে যাচ্ছে গোটা প্যালেস্তাইন জুড়ে। তাঁদের মনোজগৎ জুড়ে থাকছে সেই অন্ধকার ছায়া।
২০১৪ সালে ইজরায়েল অপারেশন প্রোটেক্টিভ এজ শুরু করে। একটানা ৫১ দিন ধরে লাগাতার আক্রমণ চলে। ২২৫১ জন ফিলিস্তিনি খুন হন। তাঁদের মধ্যে ৫৫১ জন শিশু৷ এর কিছুদিন পরে গাজার খান ইউনিসের একঝাঁক শিশুর আঁকা ছবি এক সাংবাদিকদের হাতে আসে। একদম সাধারণ ছবি, যেমন সব বাচ্চারাই আঁকে– মাঠ, ঘাট, বাড়ি, ঘর, রাস্তা। পার্থক্য হল, প্রতিটি ছবিতেই কিছু না কিছু যুদ্ধের উপাদান। হাসিখুশি মানুষের মাথার উপরে যুদ্ধ বিমান, শান্ত পথের ধারে ট্যাংক। হতবাক হয়ে যান ওই সাংবাদিক। শিশুমনের একদম গভীরে ছাপ ফেলেছে সম্বচ্ছরের যুদ্ধপরিস্থিতিক। তাই তো হওয়ার কথা। কয়েক বছর নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিল বলেছিল, যেহেতু গাজার শিশুরা পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারে ভোগে, তাই তাদের মনে যুদ্ধ এবং হামলার স্মৃতি গাঢ় অন্ধকারের মতো জমে থাকে। মৃত্যু তাদের মুক্তি দেয় এক অর্থে। সুদীর্ঘ ট্রমা থেকে মুক্তি। ২০২১ সালে ইজরায়েলের হামলায় যে ৬০ জন শিশু মারা যায়, তাদের ১২ জনের গভীর মানসিক অসুস্থতার চিকিৎসা চলছিল।
২০০০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ইজরায়েলের হামলায় গাজায় খুন হয়েছেন ৭,৭৫৯ জন ফিলিস্তিনি৷ তার মধ্যে ১,৭৪১ জন শিশু, ৫৭২ জন নারী। হাজার হাজার শিশুকে গ্রেফতার করা হয়েছে পাথর ছোড়ার অপরাধে। ২০১৪ সালের জুলাই মাসে ইজরায়েলের মানবাধিকার সংস্থা বি’টাসেল একটি ৫ বছরের ফিলিস্তিনি শিশুর আটক হওয়ার ভিডিও প্রকাশ করেছিল৷ সে-ও নাকি পাথর ছুড়ছিল।
কেন ঝাঁকে ঝাঁকে শিশুদের খুন করে ইজরায়েলের জায়নবাদী সরকার? উত্তর খুঁজতে গিয়ে মনে পড়ে যায় নাৎসি ডেথ স্কোয়াড আইনজাৎগ্রুপেনের নেতা অটো ওলেনডর্ফের কথা। ন্যুরেমবার্গে তিনি স্বীকার করেছিলেন, ইউক্রেনে কোনও কারণ ছাড়াই ৯০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল৷ জাস্ট এমনিই। শিশুদের খুন করা হয়েছিল খানিকটা বাধ্য হয়েই৷ যাতে তারা বড় হয়ে প্রতিশোধ নিতে না পারে।
ইজরায়েলও কি নাৎসি জার্মানির থেকে খুব আলাদা? ২০১৪ সালের জুলাই মাসে ইজরায়েলের গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদ আয়েলেত শাকেদ বলেছিলেন, ফিলিস্তিনের শিশু এবং কিশোররা হল ‘সাপ’। তাদের হত্যা না করে উপায় নেই। সেই সঙ্গে দরকার সাপগুলির মায়েদের মেরে ফেলা৷ ওই ফিলিস্তিনি মায়েরাই ফুল ও চুমু দিয়ে শিশু, কিশোরদের লড়তে পাঠায়। হিসাব তাই সহজ। সাপেদের মায়েদের বাঁচিয়ে রাখলে আরও সাপ জন্মাবে। হাজার হাজার সাপ৷ লক্ষ লক্ষ সাপ। তাই দাওয়াই একটাই- গণহত্যা। সেই ট্র্যাডিশন বজায় আছে সগৌরবে। গত মাসের ১০ তারিখে ইজরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছেন, তাঁরা পশুদের মোকাবিলা করছেন। গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য৷ সুচিন্তিত এবং কৌশলী। কে না জানে পশু বনাম মানুষের যুদ্ধে মানবাধিকারের কথা উঠবে না। পশুদের শিশুরাও পশু বই তো নয়! সাড়ে ৪ হাজার হোক বা আরও বেশি! তাদের প্রাণ তো সস্তা। মরলে মরুক।
৬.
ফিলিস্তিনি শিল্পী আলা-আল-লাগতার একটি ছবি দেখছিলাম৷ ছবির বিষয়, একজন ফিলিস্তিনি মা দু’বার তাঁর সন্তানকে বহন করেন। একবার গর্ভে, আরেকবার তার লাশ নিয়ে কবরে যাওয়ার সময়৷ এর চেয়ে বড় সত্যি আর হয় না।
গোটা গাজা এখন শিশুদের গোরস্থান। একদিন যুদ্ধ শেষ হবে। তারপর আরও দশকের পর দশক ধরে তাদের কবরগুলি অপেক্ষা করবে একদিন স্বাধীনতার ফুলে ফুলে ঢেকে উঠবে বলে।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved