উঠোনে, বারান্দায় বা এমনকী, ছাদেও মেয়েদের অন্তর্বাস শুকোতে দেওয়ার সময় প্যান্টিকে যেন লুকিয়ে রাখা হত, সায়া বা সেমিজের আড়ালে। ফার্স্ট ইয়ারে প্যান্টি নিয়ে আমার অবশেসন সম্পূর্ণ ভেঙে যায় এক ব্যাচমেটের কল্যাণে। লিখছেন অনুব্রত চক্রবর্তী।
১
আমি পঞ্চাশোর্ধ্ব, পুরুষ। ছোটবেলায়, মধ্যবিত্ত যাপনের ঘেরাটোপে ‘প্যান্টি’ শব্দটি পুরুষদের সামনে উচ্চারিত হতে শুনিনি কখনও। মা, আত্মীয়া বা প্রতিবেশী দিদি-মাসি-কাকিমারা অবলীলায় পুরুষের অন্তর্বাস কিনে আনতেন দোকান থেকে, নিজেদের সায়া-ব্লাউজের সঙ্গে। অথচ বাবা-দাদা, কাকা-জ্যাঠা-মামা-মেসোরা কোনও দিন মেয়েদের অন্তর্বাস কিনেছেন বলে অন্তত আমার জানা নেই। মহিলারা তাঁদের ব্যক্তিগত আলাপচারিতাতেও ‘প্যান্টি’ শব্দটি এড়িয়ে চলতেন, তাঁদের লবজ– ‘এবার একটা প্যান্ট কিনতে হবে।’ আমি শিশু, তাই তাঁদের একান্ত আলোচনায় বসে থাকা যেত বিন্দাস। কিছু শব্দ কানে লেগে থাকত। সেই প্যান্ট যে আসলে প্যান্টি, অনেক পরে বুঝেছি। উঠোনে, বারান্দায় বা এমনকী, ছাদেও মেয়েদের অন্তর্বাস শুকোতে দেওয়ার সময় প্যান্টিকে যেন লুকিয়ে রাখা হত, সায়া বা সেমিজের আড়ালে। ব্রা-এর জ্যামিতিক গঠনের জন্য ফাঁকফোকর দিয়ে সে নিজেকে জানান দিলেও প্যান্টি নিজেকে আড়াল করে রাখতে সক্ষম, কারণ সে ত্রিভুজাকৃতি– বদ্বীপ। এদিকে আমার পুরুষকেতন সগর্বে দোল খায় আংটায় বাঁধা দড়ি থেকে। প্রকাশ্যে রোদ-হাওয়া খায় হাভাতের মতো। অথচ প্যান্টি যেন লাজুকলতা, অথবা সে ভয় পায়? এই নিয়ে অসীম কৌতূহল জন্মায় নিজেকে আবিষ্কারের সময়কালে। মনে হত, একটা সামান্য কাপড়ের টুকরোর জন্য যদি এত গোপনীয়তা, তাহলে না জানি সেই বদ্বীপে কি রত্নভাণ্ডার লুকনো থাকে। প্যান্টি শব্দটি তাই শৈশব থেকে বাল্যকালে উত্তরণের ফ্যান্টাসি নিয়ন্ত্রণ করে।
আরও পড়ুন: কালীঘাট মানেই পুরনো কলকাতার স্বাদ-গন্ধ
কৈশোর আসে তার অমোঘ আকর্ষণ নিয়ে। ছেলেদের স্কুলে দশ বছর কাটিয়ে হঠাৎ কো-এড কলেজে। তখন কলেজেও হায়ার সেকেন্ডারি চালু ছিল। ছিল হালকা র্যাগিং। মূলত ডিগ্রি কোর্সের ছাত্ররা কচি-কাঁচাদের (ছেলেদের) পাকানোর দায়িত্ব নিত। অনেকটা কার্বাইডে ফল পাকানোর মতো। আমরা অ্যাসেম্বলি হলে বা সিঁড়িতে স্কার্ট বা শাড়ি পরে বসে থাকা মেয়েদের সামনে ইচ্ছে করে পকেট থেকে পয়সা ফেলে হামাগুড়ি দিয়ে সেগুলো তুলতাম। দৃষ্টি অবশ্যই খুচরো পয়সার দিকে থাকত না। আমাদের চোখ তখন অর্জুনের মতো ফোকাস্ড। এরপর, কোন বদ্বীপের কী রং, সেই নিয়ে চায়ের দোকানে পুরুষালি খিল্লি হত। হাত দিয়ে চোখ ঢাকলে দড়িতে ক্লিপ আটকানো কামনার মিছিল দেখতে পেতাম। ভাবতাম বড় হয়ে গিয়েছি। অথচ, মেয়েদের চোখের দিকে তাকানোর সাহস জন্মায়নি তখনও। ডিগ্রি কোর্সে ঢুকে আমাদেরও এই খেলা শেখানোর দায়িত্ব নিতে হল। পকেট থেকে ঝনাৎ করে পয়সা ফেলে গরিব হয়ে যাওয়া, তার পরমুহূর্তেই বদ্বীপের মালিক। এই খেলাটি যে মেয়েদের কাছে চূড়ান্ত অসম্মানজনক হতে পারে, তারা যে স্কার্ট ছেড়ে সালোয়ার-কামিজের আশ্রয় নিতে বাধ্য হতে পারে, সে খেয়াল কখনও মাথায় আসেনি।
ফার্স্ট ইয়ারে প্যান্টি নিয়ে আমার অবশেসন সম্পূর্ণ ভেঙে যায় আমাদেরই এক ব্যাচমেটের কল্যাণে। মফস্সলের ছেলে। আমার বাড়ির ঢিলছোঁড়া দূরত্বে বয়েজ হোস্টেল। বড়দের চোখ এড়িয়ে সিগারেট এবং মদ খাওয়ার আদর্শ জায়গা। এক সান্ধ্যকালীন ঠেকে, ঈষৎ টিপসি অবস্থায়, ছেলেটি জানাল যে, প্যান্টি নিয়ে আমাদের এই ছ্যাবলামো তার অসহ্য লাগে, কারণ সে নিজে প্যান্টিই পরে। কারণ তার কাপড় নাকি জাঙ্গিয়ার থেকে অনেক নরম। আমরা তৎক্ষণাৎ নস্যাৎ করে দিই এই দাবি। ‘হ্যা হ্যা’ রবে তার পাজামার দড়ি ধরে টান মারতে শুরু করি। পরদিন সে আমাদের মানিকতলার মোড়ে এক হোশিয়ারি দোকানে নিয়ে যায়–
–‘প্যান্টি দেখান।’
–‘কোন সাইজ?’
–‘আমার সাইজ।’
বিব্রত পুরুষ দোকানদার মাপ আন্দাজ করে খান দুয়েক প্যান্টি বের করেন ফিতে বাঁধা বাক্স থেকে।
একদিন দুপুরে, প্রখর গ্রীষ্ম, হস্টেলে গিয়েছি। ছেলেটি একটু অসুস্থ হওয়ায় ছুটিতে বাড়ি যেতে পারেনি। খাঁ খাঁ তিনতলায় পৌঁছে দেখি খালি গায়ে, শুধুমাত্র প্যান্টি পরে সে দাঁড়িয়ে আছে। রেলিংয়ে ভর দিয়ে বিড়ি ফুঁকছে। আমায় দেখে হাত দিয়ে ধোঁয়া তাড়িয়ে এক গাল হাসে– ‘সেইটা! কেমন লাগছে?’ আমি বলি, ‘খুব সুন্দর।’ বিড়ি শেষ হলে ওর ঘরে যাই। নড়বড়ে চৌকি, তোশক-বালিশ, আধভাঙ্গা চেয়ার-টেবিল। পলেস্তারা খসা দেওয়ালে কোনও আয়না ছিল না।