মানুষ মাংস খাচ্ছে প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে। মাংস যতই সুস্বাদু হোক, চারপেয়ে বা দুই পেয়ে যারই মাংস দিনের শেষে খেতে বসুক, মাংসের হাড় তো থাকবেই! মাংস খাওয়াটা যেন মাংস খাওয়াই হয়, এই খাওয়ার পথে মাংসের হাড় যেন বিব্রত বা বাধা সৃষ্টি না করে– মাংস খাওয়াকে আরও আরামদায়ক করতেই কোফতার জন্ম।
২৩.
গোটা পৌষ মাস নিরামিষ খাবারের গপ্প বলে অনেক পুণ্য সঞ্চয় আর গালাগালি– দুটোই সঞ্চয় করে ফেলেছি। শীত সেকেন্ড ইনিংস খেলতে এসেছে– এখনই আমিষে ফেরত না গেলে সব পুণ্য পাপে কনভার্ট হয়ে যাবে বলে পুরনো শীত জাঁকিয়ে পড়েছে– খাবার ঠাকুর স্বপ্নে এসে হুমকি দিয়ে গিয়েছেন।
সব ধর্মেই বলেছে, খেতে বসে তাড়াহুড়ো না করতে, সময় নিয়ে আরাম করে খেতে– খাওয়ার সময় চিন্তামুক্ত থাকতে। এই ‘আরাম’ শব্দটা সেই যে খাবারের সঙ্গে আদ্যিকালে যোগ হল, দু’জনে ‘ইয়ে দোস্তি হাম নেহি তোড়েঙ্গে’ গাইতে গাইতে ইতিহাসের পথ দিয়ে যাত্রা শুরু করে দিল। মানুষ মাংস খাচ্ছে প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে। মাংস যতই সুস্বাদু হোক, চারপেয়ে বা দুই পেয়ে যারই মাংস দিনের শেষে খেতে বসুক, মাংসের হাড় তো থাকবেই! মাংস খাওয়াটা যেন মাংস খাওয়াই হয়, এই খাওয়ার পথে মাংসের হাড় যেন বিব্রত বা বাধা সৃষ্টি না করে– মাংস খাওয়াকে আরও আরামদায়ক করতেই কোফতার জন্ম।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
মাংস নষ্ট না করে বাসি মাংস দিয়ে কোফতা বানিয়ে ফেললে মধ্যবিত্তের সাশ্রয় হত। আরেকটা কারণও ছিল– মাংসের মণ্ডের সঙ্গে সবজি আর মশলার ব্যবহার মাংসের পরিমাণটাকে বেশ ওজনদার দেখাত, সব মিলিয়ে কোফতা গেরস্ত হেঁশেলে এক নিয়মিত খাবার হয়ে দাঁড়াল।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
গুগল জেঠু বলেছে, কোফতা হচ্ছে ভেড়া বা গরুর মাংসের কিমা দিয়ে তৈরি মধ্যপ্রাচ্য আর ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম এক অন্যতম জনপ্রিয় খাবার। কিন্তু জেঠুর হিসেব নেই– কোফতার মণ্ড যে ভেড়া-শুয়োর, গো-মাংস বা কোনও চারপেয়ের মাংস ছাড়া বানানো যায় না, এই মতামত তৈরি হওয়ার অনেক আগে থেকেই কোফতা রান্না হচ্ছে বিশ্বের নানা প্রান্তে আর ‘কোফতা’ নামটা সৃষ্টির অনেক আগে থেকেই এই পদ বিশ্বের নানা প্রান্তে রান্নাঘরে চার-ছয় মেরেছে। ২৫ খ্রিস্টাব্দে মার্কাস গাভিয়াস আপিকাসের রোমান ভাষায় লেখা প্রাচীন রেসিপি বইয়ে কোফতার মতো পদের যে রান্নার বিবরণ আছে, সেটা কিন্তু ময়ূরের মাংস দিয়ে তৈরি, কারণ সেই যুগে এই বিশেষ রান্নার জন্য সেরা মাংস ধরা হত ময়ূরের মাংসকে। তার পরের পছন্দের বাছাই ছিল পায়রা, খরগোশ আর মুরগির মাংস। পর্ক বা শুয়োরের মাংসের স্থান ছিল তারও পরে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কোফতা রান্নায় রেড-মিট প্রায় আবশ্যক হয়ে যায়, কারণ, উদ্বৃত্ত মাংস নষ্ট না করে বাসি মাংস দিয়ে কোফতা বানিয়ে ফেললে মধ্যবিত্তের সাশ্রয় হত। আরেকটা কারণও ছিল– মাংসের মণ্ডের সঙ্গে সবজি আর মশলার ব্যবহার মাংসের পরিমাণটাকে বেশ ওজনদার দেখাত, সব মিলিয়ে কোফতা গেরস্ত হেঁশেলে এক নিয়মিত খাবার হয়ে দাঁড়াল।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: শীতে চর্বির পিঠে গত কয়েক মরশুমেই ছক্কার পর ছক্কা মারছে
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
রোমান সাম্রাজ্য পতনের পর এক হাজার বছরের অন্ধকার যুগে স্পেনে যখন চার্চ আর রাজশক্তির মিলিত প্রয়াসে খ্রিস্টমতাবলম্বীদের সংখ্যা তরোয়ালের জোরে বাড়ানো হচ্ছে আর ধর্মান্তরিত না হলে মাথার ওপর নেমে আসছে কঠিন শাস্তি, ইহুদিরা প্রবল চেষ্টা করত নিজেদের ধর্ম গোপন করে ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানদের দলে মিশে গিয়ে গা ঢাকা দেওয়ার। কোফতা সেই সময় স্পেনের রাজন্যবর্গ আর ধর্মগুরুদের কাছে এক ধরনের ‘লাই-ডিটেক্টর’ হয়ে উঠেছিল। স্পেনের রাজা মাঝে মাঝেই প্রজাদের জন্য ভোজনসভার ব্যবস্থা করতেন আর সেই ভোজনসভায় আমন্ত্রিত প্রজাদের উপস্থিতি আবশ্যক ছিল। বিভিন্ন পদের সঙ্গে সেখানে শুয়োরের মাংস দিয়ে বানানো কোফতাও পরিবেশন করা হত। খাওয়ার শেষে আমন্ত্রিতদের ধন্যবাদ জানানোর সঙ্গে সঙ্গে যে পদগুলো পরিবেশন করা হয়েছে, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করা হত। কোফতা বানানোর বিশদ বর্ণনা আরও বিশদ হত, যেমন দেহের কোথাকার মাংস, কীভাবে শিকার করা হয়েছে, শুয়োরটা মৃত্যুর আগে কী করছিল ইত্যাদি। ইহুদিরা স্বাভাবিকভাবেই তাদের ধর্মের নিষিদ্ধ মাংসের ওরকম বিবরণ শুনে ওয়াক্-ওয়াক্ করে বমি করতে দৌড়ত– নিদেনপক্ষে তাদের চোখেমুখে ঘৃণা আর আতঙ্ক ফুটে উঠত। চার্চের লোকেরা পাশ থেকে কড়া নজর রাখত এই প্রজাদের ওপরে। এই বিবরণ চলাকালীন বেচাল কিছু দেখলে তখনই গ্রেপ্তার করে কঠিন শাস্তির সামনে ফেলা হত। এই শনাক্তকরণ পদ্ধতি এড়াতে যারা এই ভোজসভায় যেত না, তারা স্পেনীয় রাজন্যবর্গের কাজ আরও সহজ করে দিত, কারণ রাজার আদেশ ছিল এই ভোজে যারা আসবে না, তাদের ‘ইহুদি’ বলে শনাক্ত করা হবে।
ডার্ক এজ থেকে রেনেসাঁ, যুগ বদলাল– কিন্তু কোফতার জনপ্রিয়তা বেড়েই চলল। সুইডেনে কোফতার কথা প্রথম পাওয়া যায় ১৭৫৪ সালে কাজ্সা অয়ার্গ-এর লেখা রান্নার বইতে, যেখানে তিনি কোফতার সঙ্গে মাখন-সিক্ত নুডল্স পরিবেশন করার কথা লিখেছিলেন। এই রান্নার বইটা এতটা জনপ্রিয় হয়েছিল যে, ওই দেশে কোফতা অন্যতম জনপ্রিয় এক পদ আর কোফতার সঙ্গে মাখন মাখা নুডলস খাওয়া আজ প্রায় আবশ্যক। মধ্যপ্রাচ্যে কোফতা এতই জনপ্রিয় যে শুধু তুর্কিতেই ২৯১ রকমের কোফতা পাওয়া যায়। ‘কোপ্তা’ বা ‘কোফতা’ শব্দটার উৎসই পারস্য শব্দ ‘কোফতে’ থেকে, মানে মাংসের কিমার মণ্ড বা গোলা।
ঢাকার সুস্মিতাকে যখন বলেছিলাম বাঙালির কোফতা কাঁচকলা দিয়ে হয়, সে রেগে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল চিতলের মুইঠা আদপে কী! পরে বুঝলাম তার রাগ অমূলক নয়। মাংসের কোফতার চেয়ে অনেক বেশি জনপ্রিয় সেখানে মাছের কোফতা– বরিশাল আর চাঁদপুরে ইলিশের কোফতা, খুলনাতে নারকেল দুধে চিংড়ির কোফতা, চট্টগ্রামে লটেমাছ আর শুঁটকির কোফতা, ঢাকায় ফলুই আর পাবদার কোফতা খেয়েছি সুস্মিতার রাগের কল্যাণে। রুই, কাতলা, তেলাপিয়া আর আড় মাছের কোফতা সব জায়গাতেই পাওয়া যায়।
ভারতীয় হেঁশেল, সে যতই আমিষ-বিমুখ হোক, কোফতা বিমুখ কিন্তু এক্কেবারেই না। যার জন্যে শুধু এই দেশেই পনির থেকে শুরু করে সবজি সবকিছুরই কোফতা হয়! সেটা স্বাদের জন্যেই হোক বা মিতব্যায়িতা– যে কারণেই হোক না কেন! আজকের গপ্প শেষ করব এক অভিজ্ঞতা বলে। কলকাতার এক নামী হোটেলে আমি তখন ট্রেইনি। সেই হোটেলের এক পুরনো রেস্তরাঁয় রোজ বুফে লাঞ্চ থাকত, আর প্রত্যেক পদের সামনে তার নাম শোভা পেত। বুফেতে ‘সারপ্রাইজ কোফতা’ নাম দেখে এক কাস্টমার কোফতায় কী আছে, জানতে চায়। জানতাম শেফ বেঁচে যাওয়া সবজি দিয়ে কোফতা করে, তাই বেগতিক দেখে এক ওয়েটারকে ডেকে দিয়েছিলাম। সেই ওয়েটার কাস্টমারের সামনে দাঁড়িয়ে বিজ্ঞের হাসি হেসে বলেছিল, ‘সেটাই তো সারপ্রাইজ স্যর!’
…ভাজারদুয়ারি-র অন্যান্য পর্ব…
ভাজারদুয়ারি পর্ব ২২: শীতে চর্বির পিঠে গত কয়েক মরশুমেই ছক্কার পর ছক্কা মারছে
ভাজারদুয়ারি পর্ব ২১: যে ভারতীয় খাবারের রেসিপি জোগাড় করতে না পারায় প্রাণ দিয়েছিলেন সাহেব
ভাজারদুয়ারি পর্ব ২০: নর্স ভাষায় ‘কাকা’ নামে এক ধরনের রুটি ছিল, যা আজকের কেকের পূর্বপুরুষ
ভাজারদুয়ারি পর্ব ১৯: গোস্ত কা হালুয়া, বলেন কী!
ভাজারদুয়ারি পর্ব ১৮: আরে, এ তো লিট্টির বৈমাত্রেয় ভাই!
ভাজারদুয়ারি পর্ব ১৭: ল্যাদের সঙ্গে খিচুড়ির অবৈধ সম্পর্ক
ভাজারদুয়ারি পর্ব ১৬: আগুন যখন পবিত্র, ঝলসানো মাংসই সুপারহিট
ভাজারদুয়ারি পর্ব ১৫: শ্রমের বিনিময়ে খাদ্য– এভাবেই তৈরি হয়েছিল বিরিয়ানি
ভাজারদুয়ারি পর্ব ১৪: যে সুস্বাদু জিলিপি আর ফাফরার জন্যে দুরন্ত ষাঁড়ের পিছনেও ছোটা যায়
ভাজারদুয়ারি পর্ব ১৩: শ্রীকৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনামকে টেক্কা দেবে ভাতের বিবিধ নাম
ভাজারদুয়ারি পর্ব ১২: জুয়া-লগ্নে যে খাবারের জন্ম, এখন তা ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে
ভাজারদুয়ারি পর্ব ১১: নারকোলের বিদেশযাত্রা
ভাজারদুয়ারি পর্ব ১০: সন্দেশের ব্যাপারে একটি জরুরি সন্দেশ
ভাজারদুয়ারি পর্ব ৯: আলু গোল বলে আলুর চপকেও গোল হতে হবে নাকি?
ভাজারদুয়ারি পর্ব ৮: পা দিয়ে ময়দা মেখে রুটি বানানো হয় বলে নাম পাউরুটি, এ এক্কেবারেই ভুল কথা!
ভাজারদুয়ারি পর্ব ৭: যুদ্ধক্ষেত্রে রুটির ওপরে চিজ আর খেজুরই আজকের পিৎজা
ভাজারদুয়ারি পর্ব ৬: পান্তা ভাতে টাটকা বেগুনপোড়া
ভাজারদুয়ারি পর্ব ৫: ইউরোপের ক্রেপ-কে গোলারুটির চ্যালেঞ্জ
ভাজারদুয়ারি পর্ব ৪: ২০০ পরোটা কোন রাক্ষসে খায়!
ভাজারদুয়ারি পর্ব ৩: হাজার বছর পার করেও বাসি হয়নি শিঙাড়ার যাত্রা
ভাজারদুয়ারি পর্ব ২: পাড়ার মোড়ের দোকানের চপ-তেলেভাজা হচ্ছে টিভি সিরিয়াল
ভাজারদুয়ারি পর্ব ১: বাঙালি তেলে ভাজবে না ঘি-এ ভাজবে?