নতুন চওড়া রাস্তা বানাতে গেলে পুরনো বাড়ি ভাঙতে হবে, তার নোটিস দিতে হবে, মালিক বাড়ি না ছেড়ে আপিল করলে সেই আপিল নিয়ে মিটিং করতে হবে, নানা যুক্তি দেখিয়ে আপিল খারিজ করতে হবে, ক্ষতিপূরণ নির্ণয় করে মালিকের হাতে ধরাতে হবে, ইত্যাদি। এতসব ধাপ পেরিয়ে ট্রাস্ট কিন্তু বিশ শতকের প্রথম ভাগে বেশ কিছু কাজ করতে পেরেছিল, তার মধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য– এসপ্ল্যানেড থেকে শ্যামবাজার অবধি লম্বা সেন্ট্রাল এভিনিউ।
‘‘ওদিকে বউবাজার স্ট্রীট আর এদিকে সেন্ট্রাল এভিনিউ। মাঝখানের সর্পিল গলিটা এতদিন দুটো বড় রাস্তার যোগসূত্র হিসেবে কাজ চালিয়ে এসেছিল। কিন্তু আর বুঝি চললো না। বনমালী সরকার লেন বুঝি এবার বাতিল হয়ে গেল রাতারাতি। …আধখানা আগেই গিয়েছিল সেন্ট্রাল এভিনিউ তৈরির সময়ে, এবার বাকি আধখানাও শেষ।…
ভার পড়েছে ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্টের ওপর।…
গলিটাতে ঢুকে হঠাৎ মনে হবে বুঝি সামনের বাড়ির দেয়ালটা পর্যন্ত ওর দৈর্ঘ্য। কিন্তু বুকে সাহস নিয়ে এগিয়ে গেলে অনেক মজা মিলবে। নিচু নিচু বাড়িগুলোর রাস্তার ধারের ঘরগুলোতে জমজমাট দোকান-পত্তর। বাঁকের মুখে বেণী স্বর্ণকারের সোনা রূপোর দোকান। তারপর পাশের একতলা বাড়ির রোয়াকের ওপর ‘ইণ্ডিয়া টেলারিং হল্’। কিছুদূর গিয়ে বাঁ হাতি তিন রঙা ন্যাশন্যাল ফ্ল্যাগ আঁকা সাইনবোর্ড । প্রভাসবাবুর ‘পবিত্র খদ্দর ভাণ্ডার’। তারপরেও আছে গুরুপদ দে’র ‘স্বদেশী-বাজার’। যখন স্বদেশী জিনিস কিনতে খদ্দেরের ভিড় হয় তার জেরটা গিয়ে ঠেকে পাশের বাড়ির ‘সবুজ-সংঘে’র দরজা পর্যন্ত।…
নোটিশ দিয়েছে ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট যথাসময়।…
নোটিশের পেছন পেছন এল চেন, কম্পাস, শাবল, ছেনি, হাতুড়ি, কোদাল, গাইতি, ডিনামাইট– লোকলস্কর, কুলিকাবারি। আর এল ভূতনাথ। ওভারসিয়ার ভূতনাথ। ভূতনাথ চক্রবর্তী।”
ভূতনাথের গল্প এরপর বেশ খানিক পিছিয়ে যাবে, এক অন্য কলকাতার ছবি উঠে আসবে তাতে। আমরা সেদিকে যাব না। আমাদের নজর ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্টের ওপর। ১৯১১ সালে গঠিত হয় এই সংস্থা, বিশ্বব্যাপী বহু দেশের মতো। ভারতে প্রথম বম্বে শহরে শুরু হয় এ ধরনের ট্রাস্ট। ‘ক্যালকাটা ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্ট’ সরকারি কোনও বিভাগ ছিল না। বরং ব্রিটিশ সরকারের মনে হয়েছিল যে, ভারতীয় সদস্যে ভর্তি কলকাতা মিউনিসিপ্যালিটির আওতার বাইরে একটা স্বাধীন সংস্থা তৈরি করা প্রয়োজন কলকাতার উন্নয়নের জন্য। ট্রাস্টের মূল উদ্দেশ্য ছিল– শহরের নানা সমস্যা– রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, বাজারহাট– এসব কিছুকে আধুনিক নগর পরিকল্পনার নকশা অনুযায়ী সাজিয়ে নেওয়া।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আরও পড়ুন: ২৮ কোটির বিক্রি, কিন্তু বিক্রিত বইয়ের সংখ্যা কত? উত্তর দিকশূন্যপুরে
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
তবে তাতে বিস্তর সমস্যা। নতুন চওড়া রাস্তা বানাতে গেলে পুরনো বাড়ি ভাঙতে হবে, তার নোটিস দিতে হবে, মালিক বাড়ি না ছেড়ে আপিল করলে সেই আপিল নিয়ে মিটিং করতে হবে, নানা যুক্তি দেখিয়ে আপিল খারিজ করতে হবে, ক্ষতিপূরণ নির্ণয় করে মালিকের হাতে ধরাতে হবে, ইত্যাদি। এতসব ধাপ পেরিয়ে ট্রাস্ট কিন্তু বিশ শতকের প্রথম ভাগে বেশ কিছু কাজ করতে পেরেছিল, তার মধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য– এসপ্ল্যানেড থেকে শ্যামবাজার অবধি লম্বা সেন্ট্রাল এভিনিউ।
আধুনিক শহর তৈরির জন্মলগ্ন থেকেই জড়িয়ে রয়েছে উচ্ছেদের গল্প। আঠারো শতকের মাঝামাঝি নতুন কেল্লা তৈরি করার সময়ে কোম্পানি গোবিন্দপুর অঞ্চলের বাসিন্দাদের হটিয়ে দেয়। বিত্তশালীরা ক্ষতিপূরণ হিসেবে জমি পায় উত্তরে সুতানুটি এলাকায়। গরিব মানুষগুলি সরে যায় পূর্বে আজকের পার্ক স্ট্রিট অঞ্চলে। পরবর্তীকালে এই বস্তিগুলো আবার উচ্ছেদ করা হয়, সাহেবপাড়া সাফসুতরো রাখতে। উনিশ শতক জুড়ে কলকাতার বেড়ে ওঠার নানা পর্বের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে এই ভাঙা-গড়ার পালা।
এই একই গল্প আমরা দেখি বিশ শতকেও। এখন সেন্ট্রাল এভিনিউ কলকাতার অন্যতম ব্যস্ত ও গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা, কিন্তু এই রাস্তা তৈরি হওয়ার ফলে মধ্য কলকাতার সামাজিক মানচিত্র বেশ খানিক বদলে যায়। এই অঞ্চলে কিছু বনেদি হিন্দু বাঙালি পরিবার ও অনেক গরিব মুসলমান পরিবারের বাস ছিল। ট্রাস্টের নোটিসের গুঁতোয় তাদের পাততাড়ি গুটোতে হয়। নতুন রাস্তার ধারের জমি বা বাড়ি অনেক বেশি দামে বিক্রি হয়। তা কেনার সামর্থ্য বাঙালির আর তখন ছিল না। বড়বাজারের মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীরা চলে আসেন নতুন পাড়ায়।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
অঞ্চলের তথাকথিত ঘিঞ্জি চরিত্র বজায় রেখে, বেশি বাড়ি ঘরদোর না ভাঙচুর করে, অভিনব উপায়ে আলো-বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করা সম্ভব। তাঁর পদ্ধতিকে ‘কন্সার্ভেটিভ সার্জারি’ বলা হয়েছে। দুমদাম সবকিছু গুঁড়িয়ে না দিয়ে মানুষের বসতির ধরন-ধারণ মাথায় রেখে পরিবর্তন করার নানা পথ বাতলে ছিলেন তিনি। তাঁর মতে সফল নগর-পরিকল্পনা তখনই সম্ভব যখন মানুষের বসবাসের সঙ্গে তাঁদের কর্মক্ষেত্র এবং চারপাশের পরিবেশের একটা সামঞ্জস্যপূর্ণ সহাবস্থান গড়ে তোলা যাবে। এই চিন্তাভাবনা অনুসারেই তিনি বড়বাজার অঞ্চলের একটা রূপরেখা তৈরি করেছিলেন। যদিও ট্রাস্টের কর্তাদের সেই রিপোর্ট ‘অবাস্তব পরিকল্পনার এক নথি’ বলে মনে হয়েছিল।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
পুরনো কলকাতা বিশ শতকের গোড়ায় বদলাতে শুরু করে। সরু গলিকে ঘিরে একটা পাড়া গড়ে ওঠা কলকাতার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। উনিশ শতক থেকে এই ধরনের পাড়া কলকাতার নাগরিক জীবনের অঙ্গ হয়ে ওঠে। পাশাপাশি বাড়ি, রোয়াকের আড্ডা, হরেক কিসিমের দোকানঘর, ক্লাব, লাইব্রেরি, ভাব-ভালোবাসা, কূটকচালি– সব মিলিয়ে জমজমাট নাগরিক সমাজ! এই লেখার গোড়ায় উল্লেখ করা বিমল মিত্রের ‘সাহেব বিবি গোলাম’ উপন্যাসের শুরুর কয়েক লাইনে কলকাতার এই ছবিটা বেশ ফুটে উঠেছে।
ওদিকে উনিশ-বিশ শতকীয় নগর পরিকল্পনার মূল সুরটাই ছিল ঘিঞ্জি এলাকা ভেঙে সাফ-সুতরো ফাঁকা-ফাঁকা রাস্তাঘাট, বাড়িঘর বানানো। বলাই বাহুল্য, ভারতীয় তথা গরিব মানুষদের থাকার জায়গাগুলোই ঔপনিবেশিক সরকারের নজরে পড়ত সব কিছুর আগে। কিন্তু সরকারি নথিতে যা ঘিঞ্জি, অপরিচ্ছন্ন, অস্বাস্থ্যকর হিসেবে বর্ণিত হত সেইসব পাড়া ছিল বাঙালির বেড়ে ওঠার আঁতুড়ঘর।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আরও পড়ুন: সুকুমার রায় যে অর্থে শিশু-কিশোরদের মনোরঞ্জন করতে পারতেন, রবীন্দ্রনাথ তা পারেননি
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
তবে অন্য মতও ছিল। ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্টের প্রাথমিক পরিকল্পনার সমসময়ে স্কটিশ স্থপতি প্যাট্রিক গেডেস বড়বাজার নিয়ে তাঁর রিপোর্টে উল্লেখ করেছিলেন যে, কীভাবে সেই অঞ্চলের তথাকথিত ঘিঞ্জি চরিত্র বজায় রেখে, বেশি বাড়ি ঘরদোর না ভাঙচুর করে, অভিনব উপায়ে আলো-বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করা সম্ভব। তাঁর পদ্ধতিকে ‘কন্সার্ভেটিভ সার্জারি’ বলা হয়েছে। দুমদাম সবকিছু গুঁড়িয়ে না দিয়ে মানুষের বসতির ধরন-ধারণ মাথায় রেখে পরিবর্তন করার নানা পথ বাতলে ছিলেন তিনি। তাঁর মতে সফল নগর-পরিকল্পনা তখনই সম্ভব যখন মানুষের বসবাসের সঙ্গে তাঁদের কর্মক্ষেত্র এবং চারপাশের পরিবেশের একটা সামঞ্জস্যপূর্ণ সহাবস্থান গড়ে তোলা যাবে। এই চিন্তাভাবনা অনুসারেই তিনি বড়বাজার অঞ্চলের একটা রূপরেখা তৈরি করেছিলেন। যদিও ট্রাস্টের কর্তাদের সেই রিপোর্ট ‘অবাস্তব পরিকল্পনার এক নথি’ বলে মনে হয়েছিল।
বাতিল হয়ে যাওয়া এই রিপোর্ট আমাদের এক অন্য পথের কথা বলে। যেখানে মানুষের বসবাসের ধরন, তাদের জীবনযাত্রার চরিত্র, তাদের দৈনন্দিন চেনাজানা জগৎকে পুরোপুরি পালটে না ফেলে কীভাবে বদল আনা যায়, তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার অবকাশ থাকে। ভাবতে বাধ্য করে, উচ্ছেদ না করে উপযোগী নাগরিক পরিষেবা দিয়ে কী করে একটা এলাকার উন্নতি সম্ভব।
সময় বদলেছে, সরকার বদলেছে, আমাদের জ্ঞানের পরিধি বেড়েছে, তবে নগর পরিকল্পনার ক্ষেত্রে আমরা যেন আজও এই দুই মতের মধ্যে ঘোরাফেরা করে চলেছি।
ঋণস্বীকার: ঋতজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়, স্ট্রিটস ইন মোশন: দ্য মেকিং অফ ইনফ্রাস্ট্রাকচার, প্রপার্টি, অ্যান্ড পলিটিক্যাল কালচার ইন টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ক্যালকাটা (২০২২)
একজন অবতার-পুরুষ যুগকে কেন্দ্র করেই আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাই যুগের ব্যাধি, বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করতে কখনও ভুল করতে পারেন? আমরা এইবার কথামৃত পাঠ করব। ভগবানের কথা ব্যাখ্যা করার অধিকার আমাদের নেই। কিন্তু ভগবানের কথা স্মরণ ও ভাবার প্রয়োজন।
পশ্চিমবঙ্গের একশ্রেণির মানুষ বলতেন, ওঁরা তো ভোটে না জিতে নেতা হয়েছেন। হ্যাঁ, সীতারাম ইয়েচুরি কখনও ভোটে জিতে মন্ত্রী বিধায়ক হননি। তারপরও দলমত নির্বিশেষে যে গ্রহণযোগ্যতা ও মর্যাদা তিনি দেশের সীমা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অর্জন করেছিলেন, সেটা ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত।