একজন অভিনেতা ঘুরে ঘুরে তাঁর জীবনটাকে দ্যাখেন, মুচকি হাসেন। আক্ষেপ করেন। কখনও কখনও গৌরান্বিত হন। কখনও কখনও নতুন করে ভাবেন যে ওই একটা তাল আমি এখনও ধরতে পারিনি, ওই তালটা, ওই ছন্দটায়, ওই লয়টায় আমাকে সাঁতার কাটতে হবে। ডুব দিতে হবে।
৩.
যারা অভিনয় করে না, তারাও প্রতিদিন নিজেকে যেভাবে সাজায়, নিজেকে যেভাবে জীবনের মধ্যে থাকতে শেখায়, এই যে সংসার করা, যদি তা একলাও হয়, সেই সংসার কিন্তু একলা করা যায় না। পাশের মানুষ থাকে, প্রতিবেশী থাকে। সেসব না হলেও কাজের জায়গা থাকে। কিছু না থাকুক, রাস্তা তো থাকেই। সেই রাস্তায় অনেক মানুষ। তারা কিন্তু আমাকে দেখে, আমাকে চিহ্নিত করে। আমাকে দেখে তারা বলে, তুমি ভাই এইরকম দেখতে, তুমি এরকম করে হাঁটো, তুমি এরকম করে চলো। নিজের চোখে তুমি দেখতে পাও না বলেই, আমি দেখিয়ে দিলাম তোমাকে। সেই আমি আমার ওপর নয়, নির্ভরশীল আরেক জনের ওপর, এর চেয়ে মহত্তর কথা বা অনুভব আর কী হতে পারে?
সারা জীবন আমার সব কাজের মধ্য দিয়ে বলছি যে, অন্যের জন্য বাঁচব, অন্যের জন্য কিছু করব। যদি না এটাকে অ্যাড্রেস করি, তাহলে মুশকিলে পড়ব। আমি সেই মুশকিলে পড়তে চাইনি। আমি আসলে নিজেকে মুশকিলে ফেলে রেখেছিলাম অনেকদিন। কিন্তু কবে আমি দেখলাম যে আমি দাঁড়িয়েছি এইরকম একটা ময়ূর পালকের মতো বিচিত্র আসরে? চালচিত্র দিয়ে ঘেরা চন্দ্রাতাপের নীচে, দর্শকের সামনে?
কিন্তু আমাদের তো সময়েরও দাবি থাকে। আমি যা শিখছি, আমি যা বলছি, যে যে আকাঙ্ক্ষা নতুন তৈরি হচ্ছে, তার মোকাবিলা আমি করতে পারিনি এবং আমি আবার নতুন আকাঙ্ক্ষায় জড়িয়েছি। সেই করতে গিয়ে আমার অনেক কিছু করতে ইচ্ছে করেছে। করেওছি অনেক কিছু জীবনে। মানে অন্যরকম কাজ বা অন্যরকম বেঁচে থাকার পরিবহণ জোগাড় করা যাকে বলে। তাতে চেপে বসেছি। কিন্তু বুঝতে পেরেছি যে এটা আমার গাড়ি নয়। এই গাড়ি থেকে আমাকে নেমে পড়তে হবে।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
বলা যেতে পারে এই ভাবেই দেবশঙ্কর হালদার এতদিনে অভিনেতা হিসাবে চিহ্নিত হয়েছেন সমাজে। মঞ্চের অভিনেতা হিসাবে মূলত তিনি নিজেকে নির্মাণ করতে চেষ্টা করেন এইভাবেই, কথা বলতে ভালোবাসেন, লিখতে ভালোবাসেন। বেঁচেটেচে থাকলে পনেরো বছর পরে প্রতিদিন খবরের কাগজের ‘রোববার.ইন’-এর এই বিশেষ কলামটির মধ্যে যদি আমি ঢুকি, হতে পারে যে আরও একটু অন্যরকমভাবে বলব, কিন্তু খুব বেশি আর অন্যরকম বলার সময় নেই আমার।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
এখানকার টিকিটও বোধহয় আমি ঠিকমতো কাটিনি। আদৌও কি আমি সেই গাড়িতে চড়ছি যে গাড়িতে টিকিট কেটে উঠতে হয়? এটা এমন একটা গাড়ি, যা আমি তৈরি করলাম, এমন একটা পরিবহণ, যা আমিই তৈরি করেছি এবং আমিই একলা সওয়ারি, কিন্তু আমি জানি ওই গাড়িতে আমি চাপিয়ে নিয়েছে এমন অনেক অনেক অজস্র মানুষকে, যারা শুধু টিকিট কেটে এই গাড়িতে ওঠে না, তারা ওঠে অন্য কোনও বাঁশির সুরে। সেই সুরের স্বরলিপি তৈরি করতে করতে যাওয়াই এখন আমার ভবিতব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। কখনও কখনও সুর কাটে, কখনও কখনও তালে, সুরে, নির্দিষ্ট ছন্দে এ গাড়ি চলতে পারে না, এলোমেলো হয়। কিন্তু তারপরে একটু থামে, একটু জিরোয়, একটু ভাবে। যখন সুর লাগেনি মনে হয়েছে, তখন সুরটাকে বদলে নিয়ে হয়। আবার চর্চা শুরু হয়, আবার মনে হয় পারব সা লাগাতে, তাই আবার এসে চালচিত্রের নিচে চন্দ্রাতাপের নীচে ময়ূর পালকের মতো বিচিত্র সব আসরে এসে দাঁড়ানো।
বলা যেতে পারে এই ভাবেই দেবশঙ্কর হালদার এতদিনে অভিনেতা হিসাবে চিহ্নিত হয়েছেন সমাজে। মঞ্চের অভিনেতা হিসাবে মূলত তিনি নিজেকে নির্মাণ করতে চেষ্টা করেন এইভাবেই, কথা বলতে ভালোবাসেন, লিখতে ভালোবাসেন। বেঁচেটেচে থাকলে পনেরো বছর পরে প্রতিদিন খবরের কাগজের ‘রোববার.ইন’-এর এই বিশেষ কলামটির মধ্যে যদি আমি ঢুকি, হতে পারে যে আরও একটু অন্যরকমভাবে বলব, কিন্তু খুব বেশি আর অন্যরকম বলার সময় নেই আমার। কিন্তু পিছন দিকে এইভাবে দেখতে পাওয়া– এইটার জন্যও একটা অবসর লাগে, মনের অবসর। আমি সবকিছু থামিয়ে দিয়ে বারান্দায় বসে ভাবনার মধ্যে ডুবে গিয়ে এইগুলিকে অতল থেকে তুলে আনার কথা বলছি না, আমার প্রতিদিনের কাজের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে একবার নিজেকে ফিরে দেখা। ঘুরে দেখা। এবং দেখতে দেখতে, কাজ করতে করতেই দেখা।
একজন অভিনেতা ঘুরে ঘুরে তাঁর জীবনটাকে দ্যাখেন, মুচকি হাসেন। আক্ষেপ করেন। কখনও কখনও গৌরান্বিত হন। কখনও কখনও নতুন করে ভাবেন যে ওই একটা তাল আমি এখনও ধরতে পারিনি, ওই তালটা, ওই ছন্দটায়, ওই লয়টায় আমাকে সাঁতার কাটতে হবে। ডুব দিতে হবে।
তাই এই পর্বে এইভাবে আমরা এই লেখাটির মধ্য দিয়ে এই জায়গাগুলোকেই একটু নেড়েঘেটে, ঝাঁকিয়ে দেখতে চাইব, যেমন আমার ছেলেবেলা, যেমন আমার মাঝবেলা, যেমন আমার মাঝের মাঝবেলা ইত্যাদি ইত্যাদি…। সেইগুলোকে একটুখানি দেখব আর দেখব যে আমি সাফল্য, ব্যর্থতা এইসবগুলোকে এড়িয়ে কীভাবে অনেক মানুষের চোখ দিয়ে নিজেকে আবিষ্কার করেছি। সেই আবিষ্কারে কী কী গল্প খুঁজে পাওয়া গেল, কী কী উপাদান খুঁজে পাওয়া গেল, কী কী গান খুঁজে পাওয়া গেল, যা আমি কখনও একলা ওই আয়নায় কোনও দিন দেখতে পারিনি।
…পড়ুন নাটুয়া-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ২। অন্যের চোখে দেখে নিজেকে রাঙিয়ে তোলা– এটাই তো পটুয়ার কাজ, তাকে নাটুয়াও বলা যেতে পারে
পর্ব ১। বাবা কি নিজের মুখের ওপর আঁকছেন, না কি সামনে ধরা আয়নাটায় ছবি আঁকছেন?