এই রাস্তার ওপরই গাগারিন স্কোয়ারে ৪২ মিটার উঁচু উড়ন্ত-রকেট আকৃতির টাওয়ারের ওপর শূন্যে ডানা মেলার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবীর প্রথম মহাকাশচারী ইউরি গাগারিনের ৪২ মিটার উঁচু স্মৃতিমূর্তি। মাথা তুলে তাকিয়ে দেখলে ভয় করে। ভয়াল অথচ সমুন্নত। গ্রিক পুরাণের মহাশক্তিধর টাইটানের নামে যে টিটানিয়াম ধাতু, আগাগোড়া তাই দিয়ে গড়া, মহাকাশযানও এই ধাতুতে তৈরি, আবার সেই টাইটানের মতোই তো পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণকে অতিক্রম করেছিলেন গাগারিনও।
৩.
মস্কো (মস্ক্ভা/মস্ক্ওয়া) রাশিয়ার ইউরোপীয় অংশের কেন্দ্রস্থলে ওকা ও ভোল্গা নদীর দোয়াবে মস্ক্ভা নদীর উপকূলে অবস্থিত রাশিয়ার রাজধানী। এর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১১৪৭-এ। চতুর্দশ শতক থেকে মস্কো ‘মহা সামন্তরাজ্য’ নামে পরিচিত। পঞ্চদশ শতক থেকে অখণ্ড রুশ সাম্রাজ্যের রাজধানী। ১৭১২ খ্রিস্টাব্দে রাজধানী পেতের্বুর্গে স্থানান্তরিত হলেও দেশের দ্বিতীয় রাজধানীর মর্যাদা পেয়ে আসছিল মস্কো। বিপ্লবের পর রাজধানী পুনরায় মস্কোয় স্থানান্তরিত হয়। সেই থেকে আজও তা দেশের রাজধানী।
এই শহরের ইতিহাসের মধ্যস্থলে আছে পঞ্চদশ শতকের মস্ক্ভা নদীর তীরে নির্মিত দেশের প্রাচীনতম নগর-দুর্গ ক্রেমলিন, ক্রেমলিনের জমকালো প্রাসাদ ও অট্টালিকাগুলো, অপূর্ব কারুকার্য খচিত বিশাল বিশাল সমাবেশ কক্ষ, অভ্যর্থনা-কক্ষ, ভজনালয়, রঙ্গালয়, অস্ত্রাগার, মিউজিয়াম, সরকারি ভবন, ক্রেমলিন সংলগ্ন রেড স্কোয়ার, সেখানকার অপূর্ব স্থাপত্য সমাহার, পলান্ডু আকৃতির গম্বুজ-বিশিষ্ট বহু বর্ণ-বিচিত্র সন্ত ভাসিলি ভজনালয়, লেনিন স্মৃতিসৌধ, রাষ্ট্রীয় ইতিহাস মিউজিয়াম ও আলেক্সান্দ্র বাগিচা। এই চত্বরটি ঊনবিংশ শতকে প্রাথমিকভাবে অবশ্য বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবেই নির্মিত হয়েছিল। ক্রেমলিন নিছক মিউজিয়াম নয়, আজও সক্রিয় সরকারি কার্যালয়। ক্রেমলিন ও তৎসংলগ্ন রেড স্কোয়ার আজও মস্কো, তথা রাশিয়ার ঐশ্বর্য ও রাষ্ট্র শক্তির প্রতীক।
রাজধানীর অসংখ্য মিউজিয়াম, আর্ট গ্যালারি, শিল্প সংগ্রহশালা, স্মৃতিমূর্তি, স্থাপত্য ও ভাস্কর্য নিদর্শন ছাড়াও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তার মেট্রো স্টেশনগুলি। প্রথম মেট্রো স্টেশন তৈরি হয় ১৯৩৫-এ, আর্বাত অঞ্চলে। সেই থেকে প্রতি বছর একটা দুটো করে যোগ হতে হতে বর্তমানে সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২১৬-তে। আজও নির্মাণ কর্মের কামাই নেই, বৃহৎ থেকে বৃহত্তর মস্কো-কে তা ছুঁয়ে যাচ্ছে।
জারেরা তাঁদের নিজেদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য বিশাল বিশাল প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন, কিন্তু স্তালিন ভূগর্ভস্থ প্রতিটি স্টেশন এমন রাজকীয় ছাঁদে নির্মাণ করিয়েছিলেন, যাতে প্রতিটি শ্রমজীবী মানুষ এগুলিকে একেকটি ভূ-গর্ভ প্রসাদ ও অপূর্ব শিল্প সুষমামণ্ডিত মিউজিয়াম হিসেবে উপভোগ করতে পারে। স্ফটিকের ঝাড়লণ্ঠন, কাচের ওপর বর্ণবৈচিত্রময় অলংকরণ, ক্ল্যাসিকাল পেন্টিং, বিশাল বিশাল ব্রোঞ্জমূর্তি, সোনালি কারুকার্যখচিত খিলান, মোজাইকের কাজ, উঁচু সিলিং, মার্বেলের দেওয়াল, গ্রানিট পাথরের মেঝে, গ্রিসীয় ও রাজকীয় স্থাপত্যের সংমিশ্রণ– যাবতীয় অভ্যন্তরীণ সজ্জা ও অলংকরণ– সব মিলিয়ে এই স্টেশনগুলি পরম বিস্ময় উদ্রেককারী এক একটি ময়দানবের পুরী।
পাতালপুরী, ক্রেমলিন ও রেড স্কোয়ারের কথা ছেড়ে দিলেও ঐতিহাসিক স্মৃতি-বিজড়িত অসংখ্য দালানকোঠা ও স্মৃতিমূর্তিতেও এই শহর সমৃদ্ধ। মেত্রো অক্তিয়াবরস্কায়া থেকে বাইরে বের হলেই অক্টোবর স্কোয়ারে লেনিনের নামাঙ্কিত সরণির ওপর আছে লেনিনের মূর্তি। স্মরণীয় বিশেষত এই কারণে, ১৯৮৫-তে যে বছর এই মূর্তি স্থাপিত হয়, সেটা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার সূচনাকাল। এর ছয় বছরের মধ্যে চূর্ণ হয়ে যায় লেনিনের স্বপ্ন। কিন্তু তাঁর স্মৃতিমূর্তি আজও শহরের প্রাণকেন্দ্রে দৃপ্তভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। এই রাস্তার ওপরই গাগারিন স্কোয়ারে ৪২ মিটার উঁচু উড়ন্ত-রকেট আকৃতির টাওয়ারের ওপর শূন্যে ডানা মেলার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবীর প্রথম মহাকাশচারী ইউরি গাগারিনের ৪২ মিটার উঁচু স্মৃতিমূর্তি। মাথা তুলে তাকিয়ে দেখলে ভয় করে। ভয়াল অথচ সমুন্নত। গ্রিক পুরাণের মহাশক্তিধর টাইটানের নামে যে টিটানিয়াম ধাতু, আগাগোড়া তাই দিয়ে গড়া, মহাকাশযানও এই ধাতুতে তৈরি, আবার সেই টাইটানের মতোই তো পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণকে অতিক্রম করেছিলেন গাগারিনও।
ত্ভেরস্কায়া স্ট্রিটে আছে জাতীয় কবি আলেক্সান্দ্র পুশকিনের ভাবমগ্ন মূর্তি। মায়াকোভস্কির নামাঙ্কিত মেট্রো স্টেশনের বাইরে– বিপ্লবের কবি ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কির তেজোদৃপ্ত মূর্তি। তিয়াত্রাল্নায়া অথবা অখোতনি রিয়াদ্ মেট্রো স্টেশন থেকে বেরিয়ে কিছু দূর এগোলেই একদিকে আছে মঞ্চে ভাষণদানরত ভঙ্গিতে প্রলেতারিয়েতের মহান নেতা কার্ল মার্কসের গ্রানিট পাথরের আবক্ষমূর্তি– মঞ্চের গায়ে খোদিত আছে তাঁর সেই বিখ্যাত স্লোগান– ‘দুনিয়ার সর্বহারা এক হও!’ কিন্তু এই স্লোগান যে দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এবং শিল্পসংস্কৃতি বিকাশের অন্তরায় নয়, তার উজ্জ্বল নিদর্শনস্বরূপ মার্কসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে বিশ্ববিখ্যাত বলশয় থিয়েটারের ঐতিহ্যমণ্ডিত দালানটি, যার শীর্ষে আছে গ্রিক পুরাণে কথিত শিল্পসংস্কৃতির অধিষ্ঠাত্রী নয়জন দেবীর মূর্তি, শীর্ষদেশে শোভা পাচ্ছে ধাবমান অশ্বরথে সমারূঢ় সূর্যদেবতা অ্যাপোলোর মূর্তি। পাশের গলিতে আছে কেন্দ্রীয় বিপণন কেন্দ্র, যেমন রেড স্কোয়ারের একপাশে আছে সুপ্রাচীন রাষ্ট্রীয় বিপণন কেন্দ্র। কার্ল মার্কস ও তাঁর স্লোগান, দেশের ঐতিহ্য, তার শিল্প-সংস্কৃতি, মানুষের বিনোদন, বিপণন– কোনওটাই যে কোনওটার অন্তরায় না হয়ে বরং একে অপরের সম্পূরক হয়ে উঠতে পারে, এ যেন তারই প্রতীক।
পশ্চিম রাশিয়ার ভোল্গা নদীর তীরে অবস্থিত নিজনি নোভ্গরদ দেশের অন্যতম প্রাচীন ও সমৃদ্ধ জনপদ। ১২২১ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত। জনসংখ্যার হিসেবে রাশিয়ার পঞ্চম শহর। ষোড়শ শতকের নগরদুর্গ ক্রেমলিন, সপ্তদশ শতকের ক্যাথিড্রাল ও আর্ট মিউজিয়ামের জন্য বিখ্যাত। মাক্সিম গোর্কির জন্মস্থান। ১৯৩২ সালে গোর্কির মৃত্যুর পর থেকে ‘গোর্কি’ নামে পরিচিত। ১৯৯০ সালে তার পূর্বনাম নিজনি নোভ্গরদ ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
রাশিয়ার স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্র তাতারস্তানের সর্ববৃহৎ শহর ও রাজধানী, মস্কোর চেয়েও ১৫০ বছরের প্রাচীন শহর কাজান ভোল্গার ইস্তাম্বুল নামে পরিচিত। এখানেও একটি ক্রেমলিন আছে। নীল ও সোনালি গম্বুজবিশিষ্ট প্রাচীন ক্যাথিড্রাল এবং বর্ণাঢ্য কূল-শরিফ মসজিদের জন্য কাজান বিখ্যাত। কাজান বিশ্ববিদ্যালয়েরও খ্যাতি আছে। তলস্তোয় এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন অধ্যয়ন করেছিলেন, পরে ছেড়ে দেন। লেনিন ১৮৮৭ সালে কাজান বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনশাস্ত্র বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন, কিন্তু রাজনৈতিক কারণে বহিষ্কৃত হওয়ায় পাঠ শেষ করতে পারেননি, পরে ১৮৯১ সালে সাংকত পেতের্বুর্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে আইনশাস্ত্রে স্নাতক হন। গোর্কি এখানে পড়তে এসেও অর্থাভাবে ভর্তি হতে পারেননি।
রাশিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমে ভোল্গা তীরের সামারা দেশের ষষ্ঠ বৃহত্তম শহর, বিখ্যাত শিল্পাঞ্চল। ১৯৩৫ থেকে কুইবিশেভ্ নামে পরিচিত ছিল। ১৯৯১ সালে তার পূর্বনাম সামারা ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এখানে ১০টি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বেশ কয়েকটি থিয়েটার হল ও মিউজিয়াম আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দেশের রাজধানী থেকে প্রশাসন ও উৎপাদন ব্যবস্থার একটা বড় অংশ এখানে সরিয়ে আনা হয়। সেই সময় থেকে এখানে একটি ভূগর্ভস্থ আশ্রয়স্থল আছে, যা স্তালিনের বাঙ্কার নামে পরিচিত।
দক্ষিণ রাশিয়ার সর্ববৃহৎ শহর রস্তোভ্-অন-দন। ১৭৬৯ সালে এই শহরের প্রতিষ্ঠা। শহরের মাঝখান দিয়ে দন নদী প্রবাহিত। গত চার বছর ধরে পূর্ব উক্রাইনার রুশ অধ্যুষিত যে অঞ্চলে উক্রাইনার সঙ্গে স্থানীয় অধিবাসীদের সংঘাত চলছে, তার ঠিক ৬০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। তাই নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখানে খুবই আঁটসাঁট।
রুশ ফেডারেশনের ইউরোপীয় অংশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ভোল্গার পশ্চিম উপকূলবর্তী ভোলগোগ্রাদ রাশিয়ার অন্যতম প্রাচীন শহর। সম্ভবত ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত। তখন এর নাম ছিল ত্সারিৎসিন, কিন্তু স্তালিন ক্ষমতায় আসার পর ১৯২৫ সালে তাঁর সম্মানে স্তালিনগ্রাদ বা স্তালিনের শহর নাম রাখা হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রুশ বাহিনীর বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধের জন্য এই শহরের খ্যাতি। ১৯৪৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি এখানে নাৎসি জার্মান বাহিনীর শিরদাঁড়া ভেঙে যায়। যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। সেই যুগান্তকারী প্রতিরোধ ইতিহাসে স্তালিনগ্রাদের লড়াই নামে পরিচিত। কিন্তু এখানে এসেই ইতিহাসকে থতমত খেয়ে যেতে হয়। তাহলে ভোলগোগ্রাদ? ১৯৫৬ সালে খ্রুশ্শ্যোভের নিঃস্তালিনীকরণ নীতির ফলে স্তালিনগ্রাদ নামান্তরিত হল ভোল্গা তীরবর্তী শহর ভোলগোগ্রাদে। সেই থেকে ভোলগোগ্রাদই হয়ে আছে।
স্তালিনগ্রাদের রক্তঝরা সেই যুদ্ধের স্মৃতিতে সেখানকার রণক্ষেত্র মামায়েভ্ কুরগান টিলার ওপর ১৯৫৯ সালে এক স্মরণ-সৌধ নির্মিত হয়। সেই স্মরণ-সৌধের মাথা ছাড়িয়ে মুক্ত তরবারি উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ৮৫ মিটার উঁচু এক নারীমূর্তি– রণংদেহি জননী রাশিয়ার মূর্তি। স্তালিনগ্রাদের বিরল লড়াইয়ের মতোই বিরল সেই দৃশ্য।
উরাল পর্বতমালার পুবে রাশিয়ার চতুর্থ সর্ববৃহৎ শহর য়েকাতেরিনবুর্গ। মাঝখানে ১৯২৪ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত স্ভের্দলোভস্ক নামে পরিচিত ছিল। দেশের ইউরোপীয় অংশের এটাই সীমান্ত। তবে আজকের রাশিয়ার কেন, এমনকী, সেদিনের সোভিয়েত ইউনিয়নের তুলনায়ও এক কালের জার সাম্রাজ্যের আয়তন এতটাই বিশাল ছিল যে, ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ৭২ লক্ষ ডলারের বিনিময়ে তৎকালীন রুশ-সম্রাজ্ঞী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আলাস্কা বিক্রি করে দিতে কুণ্ঠিত হননি।
আবার পরবর্তী কালে, ১৯১৮ সালের ৩ মার্চ জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও রাশিয়ার মধ্যে যে ব্রেস্ত-লিটোভ্স্কের শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, তার ফলেও রাশিয়াকে রুশ সাম্রাজ্যের অনেকটাই উত্তরাধিকার ছাড়তে হয়। ফিনল্যান্ড, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া ও পোল্যান্ডও স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
(চলবে)
...রুশকথা–র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ২: যে দেশে সূর্য অস্ত যায় না– আজও যায় না
পর্ব ১: এক প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে রাশিয়ার খণ্ডচিত্র ও অতীতে উঁকিঝুঁকি