রবীন্দ্রনাথের ছবির প্রদর্শনীর আয়োজন হয়েছিল প্যারিসের বিখ্যাত গ্যালারি ‘পিগাল’-এ। রেস্তোরাঁ, হোটেল ও বার-সহ অত্যাধুনিক এই গ্যালারিতে আগে সেজান, সারডিন প্রমুখের মতো চিত্রীদের ছবি প্রদর্শিত হয়েছে। এ ছাড়াও হয়েছে আফ্রিকান আর্টের এক বিশিষ্ট একজিবিশন। কারপেলেসের চিঠি থেকে জানতে পারি, প্রদর্শনী উদ্বোধনের দিন রবীন্দ্রনাথ পরেছিলেন দুধসাদা রঙের জোব্বা। বিকেল থেকেই সেদিন গ্যালারিতে প্যারিস শহরের অভিজাত মানুষজনের ভিড়। কবির নতুন ভূমিকায় সকলে রীতিমত বিস্মিত।
৮.
প্যারিসে রবীন্দ্রনাথের ছবির এগজিবিশনের দিকে ফিরে তাকানো যাক। ঠিক কীভাবে গড়ে উঠেছিল সেই প্রদর্শনী? কবির ফরাসি শিল্পীবন্ধু আন্দ্রে কার্পেলেস ও তাঁর স্বামী ডাল হগম্যান অনেক চেষ্টা করেও সেবারে স্বল্প সময়ের মধ্যে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে উঠতে পারছেন না। রথী ঠাকুর ভেবেছিলেন এক, এখানে এসে দেখেন আর এক! শেষমেশ রবীন্দ্রনাথের কাতর আহ্বানে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো প্যারিসে পৌঁছে প্রদর্শনীর হাল ধরলেন। না এলে কী হত, বলা মুশকিল।
রবীন্দ্রনাথ এ প্রসঙ্গে প্রতিমাকে খোলাখুলি জানিয়েছেন, ‘ভিক্টোরিয়া যদি না থাকত তাহলে ছবি ভালই হোক মন্দই হোক কারও চোখ পড়ত না। একদিন রথী ভেবেছিল ঘর পেলেই ছবির প্রদর্শনী আপনিই ঘটে– অত্যন্ত ভুল। এর এত কাঠখড় আছে যে সে আমাদের পক্ষে অসাধ্য– আন্দ্রের পক্ষেও। খরচ কম হয়নি–তিন চারশো পাউণ্ড হবে। ভিক্টোরিয়া অবাধে টাকা ছড়াচ্ছে। এখানকার সমস্ত বড় বড় গুণিজ্ঞানীদের ও জানে– ডাক দিলেই তারা আসে’… ইত্যাদি।
রবিঠাকুর অন্যান্য নানা কারণেও চিন্তিত। তার অন্যতম, প্যারিসের নাকউঁচু দর্শক তথা শিল্প-রসিককুলের সামনে তাঁর ছবি দেখানোর বিষয়ে বেশ টেনশনে ছিলেন। শিল্পের পীঠস্থান কীভাবে নেবে এই নতুন ভূমিকা! সে দুশ্চিন্তা নেহাত অমূলক নয়। এই প্রথম ঘটা করে তাঁর ছবি দেখানো হচ্ছে। দেশের মানুষের ওপর অভিমান করে আগেই তাদের সামনে ছবির দরজা বন্ধ করেছেন। সংকল্প করেছিলেন, বিদেশের মাটিতে সরিয়ে দেবেন ছবির পর্দা। তারপর প্রায় চারশো ছবি তোরঙ্গে ভরে নিয়ে বিদেশে এসেছেন রবীন্দ্রনাথ।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘হিবারট লেকচার’ দেওয়া উপলক্ষে সেবারের বিদেশ পাড়ি ছিল ১৯৩০-এ মার্চের গোড়ায়। সেই ফাঁকে বিশ্বের কাছে আর্টিস্ট হিসেবে নিজেকে একবার যাচাই করে নেওয়ার প্রবল ইচ্ছে তাঁকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। আগেই বলেছি, প্যারিসের মতো শহরে হুট করে সে আয়োজন মোটে সহজ নয়, তবু অসাধ্যসাধন করলেন ভিক্টোরিয়া। প্যারিসের বিদগ্ধমহলকে জড়ো করলেন তিনিই। অন্যদিকে সুটকেস ভর্তি রবীন্দ্রনাথের সেই চারশো ছবি থেকে প্রদর্শনীর জন্যে একশো কুড়িটা বেছে দিলেন আন্দ্রে লোত, যিনি একাধারে শিল্পী ও শিল্পসমালোচক। তাঁর আরেক পরিচয়, ‘অ্যানালিটিকাল কিউবিজম’-এর অন্যতম ব্যাখ্যাতা হিসেবে। স্মরণীয়, কিছুকাল পরে আমাদের দেশের রামকুমার বা পরিতোষ সেন প্যারিসের ‘একোল দ্য বোজার’-এ ছবি আঁকার পাঠ নিতে গেলে লোত তাঁদেরও শিখিয়েছেন।
যাই হোক, প্রদর্শনীর জন্য রবিঠাকুরের আরও কিছু ছবি হয়তো নেওয়া যেত, এগজিবিশন হলের কথা ভেবে এই সংক্ষিপ্ত নির্বাচন। কারণ, দুটো ছবির মাঝে দৃষ্টির পরিসর যেন থাকে, সেই মতো সাজানোর পরিকল্পনা। এছাড়া আরও শ-খানেক ছবি আলাদা করে বেছে রাখা হল। রবিঠাকুরের মন অবশ্য খুঁতখুঁত করছিল, তিনি আরও কিছু ছবি দেখানোর পক্ষে ছিলেন। শেষপর্যন্ত আঁকিবুকিভরা পাণ্ডুলিপির একটা পৃষ্ঠা-সহ ১২৬টা ছবি দেখানোর ব্যবস্থা করা গেল। সেই ছবির মধ্যে ১৯২৮ সালে আঁকা ১৩টা, পরের বছর ১৯২৯ সালের আঁকা ১০১টা, আর বাকি ছবি সেই বছরের। তার মধ্যে প্যারিসে এসেও ছবি আঁকায় বিরাম নেই রবীন্দ্রনাথের, ছবি এঁকেই চলেছেন। প্রথমে ঠিক হয়েছিল, প্রদর্শনী ক্যাটালগের প্রিফেস লিখবেন ‘গীতাঞ্জলি’র ফরাসি অনুবাদক প্রখ্যাত লেখক আন্দ্রে জিদ, যিনি স্বয়ং ১৯৪৭ সালে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত। কিন্তু জার্মানি যাওয়ার তাড়ায় জিদের পক্ষে সে কাজ তখন সম্ভব হয়নি। অবশেষে ক্যাটালগের প্রিফেস লিখলেন কোঁতেস দ্য নোয়াই, এক ফরাসি কবি। আন্দ্রে কার্পেলেসের চিঠি থেকে কিছুটা আঁচ পেতে পারি, কী হয়েছিল প্যারিস-এগজিবিশনের প্রথম দিন।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘হিবারট লেকচার’ দেওয়া উপলক্ষে সেবারের বিদেশ পাড়ি ছিল ১৯৩০-এ মার্চের গোড়ায়। সেই ফাঁকে বিশ্বের কাছে আর্টিস্ট হিসেবে নিজেকে একবার যাচাই করে নেওয়ার প্রবল ইচ্ছে তাঁকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। আগেই বলেছি, প্যারিসের মতো শহরে হুট করে সে আয়োজন মোটে সহজ নয়, তবু অসাধ্যসাধন করলেন ভিক্টোরিয়া। প্যারিসের বিদগ্ধমহলকে জড়ো করলেন তিনিই।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
প্রদর্শনীর আয়োজন হয়েছিল প্যারিসের বিখ্যাত গ্যালারি ‘পিগাল’-এ। রেস্তোরাঁ, হোটেল ও বার-সহ অত্যাধুনিক এই গ্যালারিতে আগে সেজান, সারডিন প্রমুখের মতো চিত্রীর ছবি প্রদর্শিত হয়েছে। এ ছাড়াও হয়েছে আফ্রিকান আর্টের এক বিশিষ্ট এগজিবিশন। কার্পেলেসের চিঠি থেকে জানতে পারি, প্রদর্শনী উদ্বোধনের দিন রবীন্দ্রনাথ পরেছিলেন দুধসাদা রঙের জোব্বা। বিকেল থেকেই সেদিন গ্যালারিতে প্যারিস শহরের অভিজাত মানুষজনের ভিড়। কবির নতুন ভূমিকায় সকলে রীতিমতো বিস্মিত। কেউ কাছের থেকে কেউ বা দূর থেকে তাঁর ছবি নিরীক্ষণ করতে ব্যস্ত। রঙের টেক্সচার, ফর্মের অলংকারধর্মিতায় অনেকেই কৌতূহলী, কেউ বা ফ্রেস্কো-পেন্টিং-এর সঙ্গে সাদৃশ্য খুঁজে পাচ্ছিলেন।
এমন সময় একটু দেরিতে শুভ্র পোশাকে ‘ছবিঠাকুর’ সিঁড়ি দিয়ে নেমে সেই ঘরে প্রবেশ করলেন, তখনই ছবি থেকে ঘুরে সবার দৃষ্টি গেল তাঁর দিকে। অধিকাংশ দর্শকের মুখ থেকে একটা শব্দ যেন অজান্তেই বেরিয়ে এল ‘প্রোফেট’। উৎসাহী জনতা মুহূর্তে ঘিরে ধরল তাঁকে। ফোটোগ্রাফারদের কথা ভেবে কালো রঙের লং-স্কার্ট পরিহিতা কোঁতেস দ্য নোয়াই চকিতে গিয়ে দাঁড়ালেন শিল্পীর গা-ঘেঁষে। আর ব্যক্তিত্বময়ী ওকাম্পোর কথা আলাদা করে বলার দরকার নেই। ঘরের আনাচে-কানাচে তখন ফিসফাস আলোচনা ‘এ একেবারে নতুন ধরনের কাজ, বেঙ্গল-স্কুল বা অবনীন্দ্রনাথের ছবি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা’।
এসব কথা ছবিঠাকুরকে স্পর্শ করেছিল কি না জানি না। ঈষৎ ক্লান্ত রবীন্দ্রনাথ পাশের ঘরে গিয়ে বসলেন। সাদা জোব্বাপরিহিত ছবিঠাকুর তখন শুভ্র হিমালয়ের মতো স্থির, অচঞ্চল।
…পড়ুন ছবিঠাকুর-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৭: শেষ পর্যন্ত কি মনের মতো স্টুডিও গড়ে তুলতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ?
পর্ব ৬: রবীন্দ্র চিত্রকলার নেপথ্য কারিগর কি রানী চন্দ?
পর্ব ৫: ছবি আঁকার প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ পরলোকগত প্রিয়জনদের মতামত চেয়েছেন
পর্ব ৪: প্রথম ছবি পত্রিকায় প্রকাশ পাওয়ামাত্র শুরু হয়েছিল বিদ্রুপ
পর্ব ৩: ঠাকুরবাড়ির ‘হেঁয়ালি খাতা’য় রয়েছে রবিঠাকুরের প্রথম দিকের ছবির সম্ভাব্য হদিশ
পর্ব ২: রবীন্দ্রনাথের আঁকা প্রথম ছবিটি আমরা কি পেয়েছি?
পর্ব ১: অতি সাধারণ কাগজ আর লেখার কলমের ধাক্কাধাক্কিতে গড়ে উঠতে লাগল রবিঠাকুরের ছবি