Robbar

এক উল্কার পৃথিবীতে ফেরা অথবা এক বিদ্রোহিনীর আত্মকথা

Published by: Robbar Digital
  • Posted:September 14, 2025 8:42 pm
  • Updated:September 14, 2025 8:42 pm  

এই বইটি পড়তে বসে আমরা পাই একজন মেয়েকে, যে কেবল স্নেহবঞ্চিত শৈশব কাটায়নি, ঘর বা পরিবারের কোনও অস্তিত্বই যার কাছে ছিল না। এই যে স্থানহীনতা, তা অরুন্ধতীকে অনুসরণ করে ফিরেছে জীবনের একটা বড় অংশ। নিজেকে তিনি বলেছিলেন, ‘আ মোবাইল রিপাবলিক’।  বাইরে যে সংগ্রামী ভাবমূর্তি, তার বিপরীতে একটি ভঙ্গুর, অনিশ্চিত ব‍্যক্তিহৃদয়ের ছবিকে জনসমক্ষে আনা খুব সহজ কাজ ছিল না। ভাঙা পরিবার, নিষ্ঠুর বাবা-মার চালচিত্র নিয়ে অনেক সন্তান বড় হয়, কিন্তু অমানবিক, কারণহীন নির্মমতার যে দৃষ্টান্ত মেরী রায় স্থাপন করেছেন, তার কোনও তুলনা নেই। মদ‍্যপ স্বামীর কাছ থেকে পাওয়া বঞ্চনা, প্রথম জীবনের দারিদ্র, অনিশ্চিত আশ্রয়, হাঁপানির জন‍্য শারীরিক কষ্ট– এসবই সত‍্যি। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে যেভাবে নির্দয় আচরণ ও চাপের শিকার করে তুলেছেন দুই সন্তানকে, তার কোনও ব‍্যাখ‍্যা নেই।

অনিতা অগ্নিহোত্রী

মহাকাশ থেকে উল্কা যখন পৃথিবীর দিকে ছুটে আসতে থাকে, সে দেখে নীচের পৃথিবী তার সব সবুজ-খয়েরি-হলুদে মোড়া স্থল ও জলের মায়া নিয়ে মহা বেগে উঠে আসছে তার দিকে, তখন সে কেবল চায় তার কক্ষচ‍্যুতির বেদনা নিয়ে কখন পৃথিবীর বুকে মুখ গুঁজে দিতে পারবে। সে আকিঞ্চন সর্বদা সুখের হয় না, উল্কার প্রত‍্যাগমন উৎক্ষিপ্ত করে মাটি, পাথর, বালি; তৈরি হয় গহ্বর, কখনও বা উল্কাহ্রদ জন্ম নেয়, যাকে বর্ষার জল ভরে রাখে অবলুপ্ত স্মৃতির গহনতায়। ২২ শে সেপ্টেম্বর ২০২২, মা মেরী রায়ের মৃত‍্যুর পর অরুন্ধতী রায় ফিরে গেছেন তাঁর মায়ের সঙ্গে জড়ানো স্মৃতির কাছে, কিন্তু সে প্রত‍্যাবর্তন  কেবল শোকজনিত নয়।

Mother Mary Comes to Me

‘Mother Mary comes to Me’ বইটি অরুন্ধতীর আত্মজীবনীই বলা যায়, যেখানে তিনি মায়ের সঙ্গে নিজের সম্পর্কের কাছে নিজের জীবনকেই দেখেছেন। বিপন্ন শৈশব। দুই ভাইবোন। মদ‍্যপ, অপদার্থ বাঙালি স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক শেষ করে মা মেরী ফিরে আসছেন কলকাতা হয়ে তামিলনাড়ুর উটিতে। উপার্জনহীন, দরিদ্র পরিবার আশ্রয় নিচ্ছে পৈতৃক এককামরার বাসায়, যার অন‍্যদিকে থাকে মেরীর মায়ের ভাড়াটেরা। ইংরেজ আমলের পতঙ্গ বিশারদ দাদুর জিনিসপত্র দিয়ে ঠাসা ঘর। তিন বছরের অরুন্ধতী মায়ের নিষ্ঠুর আচরণ সইতে অভ‍্যস্ত হয়ে যাচ্ছে, অ‍্যাজমার শ্বাসকষ্ট মাকে আরও নির্মম করে তোলে। সেই ঘর থেকেও তাকে উচ্ছেদ করতে আসে মেরীর মা ও ভাই। সিরিয়ান ক্রিশ্চান পরিবারে মেয়েরা সম্পত্তির অধিকার পায় না। কেরলে না পেলেও তামিলনাড়ুতে পায়, উকিলের এই পরামর্শ নিয়ে সে যাত্রা উচ্ছেদ থেকে রক্ষা পায় তারা। কিন্তু স্বাস্থ‍্যের কারণে, অভাবে মেরীকে ফিরতে হয় পিত্রালয় কেরলে। সেখানে কোট্টায়ামে রোটারি ক্লাবের ঘর নিয়ে মেরী আরম্ভ করেন তাঁর স্কুল। অরুন্ধতী আর তার থেকে বয়সে সামান্য বড় ভাই মায়ের হাতে নিগৃহীত, তিরষ্কৃত, অপমানিত হতে হতে নীরব, পলায়নপর হয়ে যায়। ভাইয়ের মনে আসামের চা বাগানের, বাবা রয়ের কিছু স্মৃতি আছে। তিন বছরের অরুন্ধতীর নেই। মা মেরীই তার পৃথিবী। মাকে সে নিজের সর্বস্ব দিয়ে অসহায়ভাবে ভালোবাসে। হাঁপানির টান উঠলে মেয়ে মায়ের ফুসফুস হয়ে নিশ্বাস নিতে থাকে, যেন কেবল মায়ের মেয়ে নয় সে, মায়ের অঙ্গও বটে।

Mary, quite contrary | A review of Arundhati Roy's memoir - The Hindu

অনবদ‍্য সুন্দর গদ‍্যে, হাস‍্যরস-খচিত আত্ম-করুণা-শূন‍্য চরণসম্পাতে অরুন্ধতী নিজের জীবনের, ফিল্ম তৈরির, লেখার, প্রতিবাদের দীর্ঘ ইতিহাস লিখেছেন। লিখেছেন কেমন করে নিজেকে রক্ষা করার জন‍্য তিনি মায়ের কাছ থেকে পালান। ১৬ বছর বয়সে দিল্লিতে স্কুল অফ আর্কিটেকচারে ঢোকার পর সাত বছর মায়ের সঙ্গে দেখা করেননি। মাও খবর নেননি মেয়ের। ভাইও অরুন্ধতীকে খুঁজে পাননি, যতদিন না ‘ইন্ডিয়া টুডে’-তে তাঁর প্রবন্ধের উল্লেখ দেখে ফোন নম্বর জোগাড় করতে পেরেছেন। আমাদের দেশে পরিবারের ভিতর বাবা-মায়ের হাতে সন্তানের নিগ্রহ খুব বিরল ঘটনা নয়। পরিবার যখন আশ্রয়ের আড়ালে অত‍্যাচারের কারাগার হয়ে ওঠে, পালানো ছাড়া সন্তানের উপায় থাকে না, কিন্তু সহায় সম্বল অর্থ ছাড়া ক’জন সে সিদ্ধান্ত নিতে পারে? একটি সাক্ষাৎকারে অরুন্ধতী বলেছেন, আমি কেবল মাকে ‘আনমাদার’ বা ‘অমাতৃয়িত’ করিনি, নিজেকেও ‘আনডটার’ বা ‘অকন‍্যায়িত’ করেছি। ভিতরের কথাটা হল, মেরীও মা নন, অরুন্ধতীও মায়ের কন‍্যা নন, কারণ মা হওয়ার কোনও প্রস্তুতি বা আগ্রহই মেরীর মধ‍্যে ছিল না। মেরীর পিতা মদ খেয়ে অত‍্যাচার করতেন, তাঁর নির্যাতনে মেরী ঠিক করেন প্রথম যে বিবাহপ্রস্তাব দেবে, তাকেই বিয়ে করবেন। বিয়ে করে দেখলেন, স্বামী আপাদমস্তক মদ‍্যপ। কিছু না করা একজন মানুষ, যে মদ খাওয়া ছাড়া আর কিছুই করে না। তা সত্ত্বেও দু’টি সন্তান হওয়া ঠেকানো যায়নি। মা হয়ে ওঠার জন‍্য যা তিনি করতে পারতেন, তা না করলেও যে নির্মমতা তিনি দুই নাবালক সন্তানের প্রতি দেখিয়েছেন, তাঁর কারণ অবোধ‍্য। অরুন্ধতী নিজের শর্তে বাঁচা একজন মানুষ, মনে হয় না পরিবারের কোনও ভূমিকা তাঁর বেড়ে ওঠার মধ‍্যে আছে।

Arundhati Roy: 'The damage to Indian democracy is not reversible' | CNN

অরুন্ধতীর প্রথম উপন্যাস ‘গড অফ স্মল থিংস’ তাঁকে ৩৬ বছর বয়সে এনে দিয়েছিল বিপুল অর্থ ও বুকার পুরস্কার। কিন্তু তার আগে বারো বছর তাঁর জীবন কেমনভাবে কেটেছিল, অনেকেই জানেন না। বুকার পরবর্তী কালে সমাজকর্মী অরুন্ধতীর নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনে জড়িয়ে পড়া, সেই সময় লেখা প্রবন্ধ ‘দ‍্য গ্রেটার কমন গুড’, তারপর বস্তারে মাওবাদীদের সঙ্গে তাঁর অভিযাত্রা, পরবর্তী সময়ে কাশ্মীরের ঘটনাবলি নিয়ে তাঁর লেখা– এইসব থেকে একজন স্পষ্টবাদী, তেজস্বিনী, প্রতিবাদী মহিলার ছবি মনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু এই বইটি পড়তে বসে আমরা পাই একজন মেয়েকে, যে কেবল স্নেহবঞ্চিত শৈশব কাটায়নি, ঘর বা পরিবারের কোনও অস্তিত্বই যার কাছে ছিল না। এই যে স্থানহীনতা, তা অরুন্ধতীকে অনুসরণ করে ফিরেছে জীবনের একটা বড় অংশ। নিজেকে তিনি বলেছিলেন, ‘আ মোবাইল রিপাবলিক’।  বাইরে যে সংগ্রামী ভাবমূর্তি, তার বিপরীতে একটি ভঙ্গুর, অনিশ্চিত ব‍্যক্তিহৃদয়ের ছবিকে জনসমক্ষে আনা খুব সহজ কাজ ছিল না। ভাঙা পরিবার, নিষ্ঠুর বাবা-মার চালচিত্র নিয়ে অনেক সন্তান বড় হয়, কিন্তু অমানবিক, কারণহীন নির্মমতার যে দৃষ্টান্ত মেরী রায় স্থাপন করেছেন, তার কোনও তুলনা নেই। মদ‍্যপ স্বামীর কাছ থেকে পাওয়া বঞ্চনা, প্রথম জীবনের দারিদ্র, অনিশ্চিত আশ্রয়, হাঁপানির জন‍্য শারীরিক কষ্ট– এসবই সত‍্যি। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে যেভাবে নির্দয় আচরণ ও চাপের শিকার করে তুলেছেন দুই সন্তানকে, তার কোনও ব‍্যাখ‍্যা নেই; অরুন্ধতী মেরীকে ‘গ‍্যাংস্টার, মাই স্টর্ম’ ইত‍্যাদি বিশেষণে আচ্ছাদিত করেও তার ওপর কোনও পালিশ দিতে পারেননি।

Arundhati Roy's early work – Parmanu

মেয়েকে অবশ‍্য শেক্সপিয়রের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন মেরী রায়, কিপলিং-এর সঙ্গে, পল রোবসন গাইতেন, প্রতি তিন মাসে মাদ্রাজের এক লাইব্রেরি থেকে বইয়ের পার্সেল আসত, পড়ে ফেরানোর জন‍্য। সে এক তুমুল উত্তেজনা ছিল বালিকা অরুন্ধতীর জন‍্য, পার্সেল আসার দিন ব‍্যথায় পেট মোচড় দিয়ে উঠত বারবার। কম‍িউনিজমে বিশ্বাস ছিল মেরীর। মেয়েকে তিনি ভিয়েতকং কন‍্যার পোশাকে সাজিয়ে দিয়েছিলেন যেখানে অরুন্ধতী পড়তেন নীলগিরির সেই মিলিটারি হস্টেলে এসে। কিন্তু এসব যেন অন‍্যদের দেখানোর জন‍্য বাইরের সাজ।

mary roy: Arundhati Roy's mother Mary Roy passes away - The Economic Times

মেরী রায়ের বিরাট ক্রোধ ছিল পুরুষ জাতির প্রতি। নিজের স্বামী, বাবা, ভাই– কারও কাছে তিনি ভালোবাসা দূরে থাক, ন‍্যূনতম সুবিচারটুকু পাননি। তাই বলে নিজের শিশু সন্তানকে যে কোন ভুলের জন‍্য ‘মেল শভিনিস্ট পিগ’ বলা যায়? অরুন্ধতীর মতো তার ভাই মায়ের কাছ থেকে পালাতে পারেনি বলে যাবতীয় নির্মমতা ও অবদমনের শিকার হয়েছে। অরুন্ধতী তাঁর স্বভাবসিদ্ধ হাস‍্যরসে লিখেছেন, পুত্র-উপাসক ভারতবর্ষে মেরী রায় একটিমাত্র পুরুষকে হাতের কাছে পেয়ে যাবতীয় অন‍্যায়ের শোধ তুলতে পেরেছিলেন। সে তার নিজের বালক সন্তান। বইয়ের আরম্ভেই অরুন্ধতী লিখছেন, ‘‘মাকে ভালোবাসতাম না বলে ছেড়ে যাইনি, যাতে ভালোবেসে যেতে পারি, সেই জন‍্যই ছেড়ে গিয়েছিলাম।—একবার চলে গিয়ে বহু দিন মায়ের সঙ্গে কথা বলিনি। মাও আমার খোঁজ করেননি। আমরা দু’জনেই মিথ‍্যের আশ্রয় নিয়েছিলাম।’’ প্রথম উপন্যাস ‘গড অফ স্মল থিংস’-এর আরম্ভে মায়ের সম্বন্ধে এই কথাটি আছে, যথেষ্ট ভালোবাসতেন বলেই মা আমাকে ছেড়ে দিতে পেরেছিলেন। অরুন্ধতীর ভাইয়ের মতে, সেটিই বইয়ের শ্রেষ্ঠতম কল্পনাশ্রয়ী বাক‍্য।

Booker Prize winner Arundhati Roy's iconic mother Mary Roy dies

পুত্র সন্তানের বয়স যখন ন’মাস, তখন আবার গর্ভে সন্তান আসায় গর্ভপাতের নানা পরিকল্পনা করেছিলেন মেরী। অনেক মা-ই এমন করেন, কিন্তু সন্তানকে বলেন না খুব অস্বাভাবিক পরিস্থিতি না হলে। অরুন্ধতী যখন হস্টেলে, তখন তার প্রিয় কুকুরটিকে গুলি করে মেরে ফেলা, সে পেডিগ্রিহীন অন‍্য কুকুরের সঙ্গে মিলিত হয়েছিল বলে। এ তো রীতিমতো অপরাধ প্রবণতা। দুই নাবালক সন্তান ভীত সন্ত্রস্ত, নিজের বলতে পিত্রালয়েরও কেউ নেই। ফলে এই মনোবিকারের যেমন চিকিৎসা দরকার ছিল, তা করা সম্ভব হয়নি।

A personal encounter with Mary Roy – over 30 years ago

তিন বছর বয়সে বালিকা মেয়েটি প্রথমবার মায়ের মৃত‍্যুর সম্ভাবনা প্রত্যক্ষ করে হাঁপানির কষ্টে মৃতপ্রায় মেরীকে দেখে। তারপর বহুবার এই ভয়ের মুখোমুখি হয়েছে সে, ৮৯ বছর বয়সে মায়ের মৃত্যুর দিন পর্যন্ত। প্রতিটি অসুস্থতার জন‍্য যে সন্তানদের আচরণ দায়ী, তাও মনের মধ‍্যে ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন মেরী। বারবার নিজের জীবনের নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ‍্যও অরুন্ধতী কেরল ছুটে এসেছেন, কখনও মায়ের চিকিৎসার জন‍্য, কখনও স্কুলের কাজে মাকে সাহায‍্য করতে। মৃত‍্যুর পর নিজের দীর্ঘ তীব্র শোক মাকে (মায়ের ভস্মাবশেষ) রক্ষা করার জন‍্য সম্পূর্ণ ব‍্যবস্থা করার দায়িত্ব নিয়েছেন। তুলনামূলকভাবে অরুন্ধতীর ভাই ছিলেন শান্ত, দীর্ঘকাল মায়ের নিপীড়ন ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থার মধ‍্য দিয়ে গিয়ে শোকের কোনও বহিঃপ্রকাশ তার মধ্যে আর অবশিষ্ট ছিল না। কিন্তু অসহায়ভাবে মাকে ভালোবাসা শিশুকন‍্যার হৃদয়স্থল থেকে অরুন্ধতী আর বেরতে পারেননি। মায়ের যে মূর্তি অরুন্ধতী নির্মাণ করতে চেয়েছেন, তা সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। তাহলে এই বইটি লেখার পিছনে কারণ কী ছিল? মায়ের প্রতি নিজের অসহায় ভালোবাসার উদযাপন? জীবনে ঝড়, গ‍্যাংস্টার হয়ে যিনি ছিলেন, তাঁর জন‍্য শোককে অমরত্ব দেওয়া?

Noted social worker and Arundhati Roy's mother Mary Roy passes away

মেরী রায় একেবারে গোড়া থেকে পূর্ণ বিকশিত করেছিলেন একটি স্কুল, যা কোট্টায়ামে শ্রেষ্ঠ এক শিক্ষায়তন, লরি বেকারের অ-গতানুগতিক স্থাপত্যের নিদর্শন তৈরি করেছিলেন নতুন স্কুলের বাড়িতে। কিন্তু এটা এমন বিরাট কোনও অবদান নয়, যার বিপরীতে তাঁর সব নিষ্ঠুরতাকে দাঁড় করানো যায়। তিনি নারীবাদী ছিলেন, অন‍্য মায়েদের মতো পুত্র উপাসক ছিলেন না, কিন্তু তাঁর সব মতাদর্শ ধুয়ে গেছে নিজের সন্তানেদের ওপর অকারণ নির্বিচার নির্যাতনে। তিনি সিরিয়ান ক্রিশ্চিয়ান নারীর উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠার জন‍্য সুপ্রিম কোর্টে কেস করে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত পেয়েছেন, কিন্তু যেভাবে মা ও ভাইকে নিজে উপস্থিত থেকে পুলিশের সাহায‍্য নিয়ে গৃহচ‍্যুত করেছেন, তাও যথেষ্ট অমানবিক। একইভাবে স্কুলকে জমি বিক্রি করতে রাজি না হওয়া চাষিকে যেভাবে তিনি উৎখাত করেছেন, তাতে তাঁকে ঠান্ডা মাথার এক ধনতন্ত্রী বলেই মনে হয়।

হয়তো অরুন্ধতী তাঁর শিকড় থেকে উৎক্ষিপ্ত ছিন্নভিন্ন জীবনের যাবতীয় ব‍্যক্তিগত হাহাকারকে একটি কাহিনির রূপ দিয়ে পুরোপুরি মুক্ত হতে চেয়েছিলেন, যা তাঁর মায়ের মৃত‍্যুর আগে সম্ভব ছিল না। বইটির মধ‍্যে আমরা পাই অরুন্ধতীর সাহিত‍্য ও জীবনের এক অপরূপ বেণীবন্ধন, যা পাঠকের জন‍্য এক দুর্লভ অভিজ্ঞতা। ১৯৯৬ তে ‘দ‍্য গড অফ স্মল থিংস’ আর ২০১৭-তে দ্বিতীয় উপন‍্যাস ‘দ‍্য মিনিস্ট্রি অফ আটমোস্ট হ‍্যাপিনেস’-এর মধ‍্যে অরুন্ধতীর ন’টি প্রবন্ধ বই প্রকাশিত হয়েছে। এই পর্বে অরুন্ধতী নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন থেকে নানা ধরনের জনআন্দোলনে সমাজকর্মীর ভূমিকা পালন করেছেন। বস্তারে মাওবাদীদের সঙ্গে অভিযাত্রা, আফজল গুরুর ফাঁসি, কাশ্মীর– ইত‍্যাদি নানা প্রশ্নে তাঁর স্পষ্ট ভাষণ কঠিনভাবে সমালোচিত হয়, আদালত অবমাননার দায়ে তিনি কারারুদ্ধ হন, একই সঙ্গে বাবরি মসজিদ ভাঙার পরবর্তী পর্বে বিজেপির ক্রমবিস্তার স্বাধীন মতামত প্রকাশের পক্ষে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। দিল্লির স্কুল অফ আর্কিটেকচার ছাড়ার পর থেকেই অরুন্ধতীর নিজের শর্তে জীবনযাপন আরম্ভ হয়, তিনটি ছবির কাজে তিনি জড়িয়েছেন প্রিয় পরিচালক প্রদীপের সঙ্গে, জীবনে আর্থিক স্থায়িত্ব আসার পর ছেড়েও চলে আসেন প্রদীপ ও তাঁর সন্তানদের সঙ্গে গড়ে তোলা সুখের ঘর, দিল্লির উচ্চবিত্ত এলাকায় ‘বাড়িওয়ালি’ বনে যেতে চান না বলে। কোথায় যেন সুখ ও স্থায়িত্বের সঙ্গে তাঁর চিরন্তন বিরোধ। জীবনের নানা সিদ্ধান্তকে সমালোচনা করা যায়, কিন্তু অরুন্ধতী নিজের শর্তে জীবন যাপন করেছেন সর্বদা, বাকস্বাধীনতা কোনও কারণেই ক্ষুণ্ণ হতে দেননি। মেরী রায়ের কাছে ততটা তাঁর ঋণ ছিল না, যতটা তিনি প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন, বরং নিজের অর্জিত স্বাধীনতাই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় সম্পদ।

তবে, আমরা জীবনে যা করি সবকিছুর ব‍্যাখ‍্যা সম্ভব হয় না। শৈশব-কৈশোর-যৌবন পর্বে একনায়কতন্ত্রী মায়ের হাতে প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে হতে বেঁচে যাওয়া আমিও কি শ্মশানে বসে অশ্রু বিসর্জন করিনি? অরুন্ধতী রায়ের অসামান্য মেধা ও যুক্তি পরায়ণতার বাসরঘরেও কোনও ছিদ্রপথে ঢুকে আসতে পারে উপায়হীন ভালোবাসার কালসাপ। কে জানে! তবে তাতে পাঠকেরই লাভ হয়েছে। আমরা পেয়েছি অসামান্য গদ‍্য, চকিত কল্পনায় আঁকা ছবি খচিত এক বিদ্রোহিনীর জীবনকাহিনি।

মাদার মেরি কামস টু মি: অরুন্ধতী রায়

পেঙ্গুইন

মূল্য ৮৯৯