খাদ্যে কেবল রসনার কথা ভাবলে চলে না। খাদ্যের প্রকৃতিকেও বুঝতে হবে। তাই গুরুপাক খেয়ে কাহিল হওয়া নয়। কেননা তা শরীরটাকে সাধনার পরিপন্থী করে তোলে। বরং এমন খাবার খেতে হবে যা শরীরকে করে তুলবে সুস্থির, শান্ত। যুগ যুগ ধরে এই বিশ্বাসকে সঙ্গে করেই পথ চলেন সাধকরা। চর্যাপদ থেকে মঙ্গলকাব্য, চৈতন্যযুগ হয়ে একেবারে হাল আমলের সাধুসন্তদের, অর্থাৎ এককথায় আবহমান বাংলার সাধকজীবনের ধারায় খাদ্য ও পথ্যের ধারা নিয়ে একটি ধারাবাহিক চলনের কথা বলে এই গ্রন্থ।
‘জেনো, বাসনার সেরা বাসা রসনায়।’ রবীন্দ্রনাথের ‘নিমন্ত্রণ’ আমরা ছেলেবেলাতেই পড়েছি। দামোদর শেঠরা অল্পে খুশি হন না, তাও জানা। অথবা সুকুমারের ‘খাই খাই’। কিন্তু এসবই আমাদের চারপাশের চেনা মানুষজনের ভোজনবিলাস ও উদরপূর্তির কথা। যাঁরা নিজেদের বাসনার নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করে সাধনার উচ্চমার্গে যেতে চাইছেন সেই সাধুগুরুরা? তাঁরা কী খান? তাঁদের খাবার দাবার, রান্নার প্রণালী থেকে শুরু করে পথ্যাপথ্য– সেসব সাধারণ মানুষদের নাগালের বাইরে। সোমব্রত সরকারের ‘সাধুর হেঁশেল’ হাতে নিলেই একথা ফের মনে পড়ে যায়। সত্যিই এমন একটা বই কি আমরা সকলেই খুঁজিনি?
খাদ্য নিয়ে কী বলেন সাধুরা? তাঁরা বলেন, ‘… বেশি অম্ল-ঝাল আত্মসাৎ করে শরীরটাকে কখনও বোঝা কোরো না। মনের ভারে হাঁটতে থাকো বাপ, দেখবা অনেকটা পথ চলবার পারবা।’ আসলে খাদ্যে কেবল রসনার কথা ভাবলে চলে না। খাদ্যের প্রকৃতিকেও বুঝতে হবে। তাই গুরুপাক খেয়ে কাহিল হওয়া নয়। কেননা তা শরীরটাকে সাধনার পরিপন্থী করে তোলে। বরং এমন খাবার খেতে হবে যা শরীরকে করে তুলবে সুস্থির, শান্ত। যুগ যুগ ধরে এই বিশ্বাসকে সঙ্গে করেই পথ চলেন সাধকরা। তাঁদের আধ্যাত্মিকতা, ধ্যানজপের উপযোগী করে গড়ে তোলেন শরীর। চর্যাপদ থেকে মঙ্গলকাব্য, চৈতন্যযুগ হয়ে একেবারে হাল আমলের সাধুসন্তদের, অর্থাৎ এককথায় আবহমান বাংলার সাধকজীবনের ধারায় খাদ্য ও পথ্যের ধারা নিয়ে একটি ধারাবাহিক চলনের কথা বলে এই গ্রন্থ। নিঃসন্দেহে সেই জীবনের একেবারে বিপ্রতীপে থাকা ভোগী মানুষেরা এমন বই পড়ে এক অদেখা জগৎকে চিনতে পারেন। যে জগৎ অথচ রয়েছে আমাদের চিরচেনা দুনিয়ার সঙ্গেই, একেবারে জড়িয়ে মড়িয়ে।
সোমব্রত লিখছেন, ‘সাধুর আখড়ায় খাওয়া মানে হল সেবা। তাঁরা সব বলেন, দেহটাকে সন্তুষ্ট রাখতে আমরা খাবার খাই, শুধুমাত্র রুচির জন্য খাই না। খাদ্য হল দেহের ঔষধ। এজন্যই এমন সব খাবার দাবার গ্রহণ করা উচিত যা দেহকে ঠান্ডা রাখে।’ কীভাবে তা রাখা যায়? বইয়ের আরেক স্থানে পাচ্ছি তার হদিশ— ‘সাধু দেহগঠনে খাদ্যবস্তুর ভূমিকার কথা বলতে থাকেন। বলেন, দিনের খাদ্য হবে প্রধানত নিরামিষ ও তিতা। এতে দেহ ঠান্ডা থাকবে।’ পাশাপাশি আরেক নিদানও রয়েছে অন্য এক স্থানে। ‘সাধু বললেন, সকালে অভ্যাসগত চা খাও ঠিক আছে। কিন্তু তারপর লুচি, পরোটা, পাঁউরুটি এসব নয় আর, ফলার করতে শেখো।’ আসলে ‘দীর্ঘ আয়ু ও লাবণ্যপূর্ণ দেহ খাদ্যবস্তুর সুষম গুণ থেকে উঠে আসে। বুঝে শুনে তাই খাবার দাবার খেতে হয়।’
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: বাঙালির প্রেম, শরীর, বন্ধুতা: এক অন্য অনুসন্ধান
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
মনে হতে পারে এত সাবধানতায় কি আহারের বাহারে ফাঁকি থেকে যায় না? আমরা যে চর্বচোষ্যলেহ্যে তোয়াজ করেছি জিভকে, সেই আনন্দ থেকে কি সম্পূর্ণ দূরবর্তী সাধুসন্ন্যাসীর জীবন? এমনটা ভাবলে নেহাতই ভুল ভাবা হবে। বইয়ের পাতায় যে রকমারি খাদ্য আয়োজনের কথা রয়েছে, তা পড়তে পড়তে বোঝা যায় সামান্যেও অসামান্য হয়ে ওঠার কারুকাজ জানেন সাধকেরা। আর তাই কাঠের জ্বালে, শিলে বাটা মশলায়, দেশীয় ঘানিতে ভাঙানো সরষের তেলের সুস্বাদু রান্না কেবল গুরুপাকের বিপদ থেকে শরীরকে দূরে রাখে না। রসনাতৃপ্তির পরিপাটি আয়োজনও করে। কেমন সে আয়োজন? ‘মা-গুরু ব্যস্ত সাধুসেবায়। কুসুম কুসুম গরম জলে রান্নাবাড়ির চালে ছাওয়া লাউ গাছের কচি পাতা এনে তিনি ভাপাতে দিয়েছেন। এমনভাবে ভাপাতে হবে লাউয়ের পাতা, যাতে সবুজ রং সরে না যায়। ভাপানোর পর তিনি অগ্রহায়ণে তোলা আতপ অন্নের হাঁড়ি বসিয়ে দিয়েছেন কাঠের জ্বালে।… লাউ পাতা বাটা ভরা বাটিতে শেষমেশ ছড়িয়ে রাখলেন কাঁচা সরিষার তেল। গরম ভাতপাতে এর স্বাদ অনুপম।’ মহাপ্রভুর ভোগে আমের মোরব্বা, তেঁতুলের সরবত, দুধমানের পাতা বাটা, শুক্ত, ঘন্টের মতো বিপুল খাদ্য আয়োজনের কথা পড়তে পড়তেও বোঝা যায় আয়োজনে কোথাও কোনও দায়সারা ভাব নেই।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: পুরুলিয়া বলেছিল: হামদের ভাষাট্ কী?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এরই সঙ্গে রয়েছে ওষধির কথা। মাথাব্যথার উপশমে গজানো ধুতুরার বন থেকে পাতা ছিঁড়ে তাতে পুরনো ঘি-কর্পূর গুঁড়ো মাখিয়ে সেই প্রলেপ কপালে লাগানোর কথা পড়তে পড়তে বোঝা যায় প্রকৃতির সান্নিধ্য আধুনিক মানুষ কত হেলায় হারিয়েছে! অথচ সাধুসন্তরা সেই জীবনকে আঁকড়ে রেখেছেন আজও। ইতিহাসের কথা বলেছেন লেখক। শ্রীক্ষেত্রে বাসুদেব সার্বভৌমের বাড়িতে চৈতন্য মহাপ্রভু গেলে তাঁকে অন্নের সঙ্গে আর কী দেওয়া হয়েছিল সেই প্রসঙ্গ এসেছে। নিমাই যে লাউয়ের পায়েস অসম্ভব ভালোবাসতেন রয়েছেন সেকথাও। ‘যখন নীলাচলে চৈতন্যদেব, পানিহাটির রাঘব পণ্ডিত ছুটছেন তাঁকে শুণ্ঠখণ্ড নাড়ু খাওয়াবেন বলে।’ কিন্তু এরই পাশাপাশি লেখকের নিজস্ব অভিজ্ঞতালব্ধ সাধুগুরুর আখড়াবাসের জীবন থেকে উঠে আসা দৈনন্দিনতা বইটিকে কেবলমাত্র তথ্যভারে ভারাক্রান্ত হওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছে। ‘সাধুর হেঁশেল’, ‘ঋতুচর্যা’, ‘লোকখাদ্য’, ‘বৈষ্ণব হোটেল’ এই চারটি মূল অধ্যায়ে বিভক্ত বইটি। সেখানে মিলেমিশে রয়েছে ইতিহাস ও সমকাল। আমাদের চিরচেনা বঙ্গদেশ। কেবল তো খাদ্য আর পথ্য নয়, রয়েছে সাধুর জীবনদর্শনের খণ্ড অথচ পূর্ণ দর্শনের স্পর্শ। ‘সাধু বলেন, পৃথিবীর খাদ্যচক্রে আমরা সক্কলে একে অন্যের খাবার।’ এমন বহু পঙক্তি এই বইয়ের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়েছে। প্রচ্ছদ থেকে ভিতরের অলঙ্করণ, ছাপা, কাগজ সবই চোখকে শান্তি দেয়। কেবল একটা বিষয়ই মনকে বিষণ্ণ করে তোলে। এমন অভিনব ভাবনার একটি বইয়ের সম্পাদনা কি আরও যত্নশীল হতে পারত না? কোথাও কোথাও দীর্ঘ বাক্যের অমসৃণতা চোখকে পীড়া দেয়। ‘জিনিষ’, ‘উচিৎ’, ‘ঠাণ্ডা’, ‘পরিস্কার’ এই ধরনের ভুল একেবারেই কাম্য ছিল না। আশা, পরের সংস্করণে এই সব প্রমাদ থেকে উত্তীর্ণ হয়ে উঠবে ‘সাধুর হেঁশেল’।
সাধুর হেঁশেল
সোমব্রত সরকার
মান্দাস। ৪০০ টাকা
প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশের সময় সম্পাদকের বক্তব্য ছিল কিঞ্চিৎ দ্বিধাজড়িত। একটি পৃথক গ্রন্থ হিসাবেই সংখ্যাটিকে ভাবছিলেন তাঁরা। সম্পাদকের নিবেদনে সেই সংশয় স্পষ্ট– ‘আগামীবারে এই বই আরও বিরাট আকারে বাহির করিবার ইচ্ছা রহিল।... তবে এর সাফল্যের সবটাই নির্ভর করিতেছে চিত্র-প্রিয়দের সহানুভূতির উপর।...’