বিজ্ঞান ও ইংরেজি শিক্ষা চাপানো ঔপনিবেশিক ভাবনাকে ভেঙে লীলা মজুমদার বারবার আনছেন উত্তর-ঔপনিবেশিক ভাবনা। ঝগড়ুদের গল্পগুলো, অতিলৌকিক অলৌকিক অতিকথা থেকে কি আমরা আসলে চলে যাচ্ছি না সাবঅলটার্নের কণ্ঠস্বরের কাছাকাছি? স্বপ্নকল্পনা বার বার জিতে যাচ্ছে না কি, রূঢ় বাস্তবের সঙ্গে?
১০.
বাতাসবাড়ির নিরবু, শামু, পদম, পম্পা, কাঞ্চিরা গরিব শিশু। সম্পূর্ণ সহায়হীনদের লীলা মজুমদার তুলে এনেছেন সযত্নে, তাঁর শিশু-কিশোর সাহিত্যে বারবার। এখানেও তাই। সঙ্গে আছে পরিবেশ সচেতনতার কথা, ব্যাখ্যা করা আছে খেলাচ্ছলে পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখের কথা। ‘বাতাসবাড়ি’ একটি মহাকাশযান। এই মহাকাশযান শুধু ধনীর পুত্র-কন্যাদের জন্য নয়, বঞ্চিত সাধারণ মানুষের জন্যও নিজেদের দ্বার উন্মুক্ত করে। বড় লামা তাদের নিয়ে বাতাসবাড়িতে তুলবেন। ‘ঊনপঞ্চাশ’ নামের রোবট, ‘ধিঙ্গিপদ’ নামের রোবট যুক্ত মানুষ কর্মী মিলে লাটফর্ম-এ তুলে বাতাসবাড়িতে ট্রান্সফার করবেন। সেখানে সূর্যশক্তির কল বসানো।
শেষ হচ্ছে একটা ফিউচারিস্টিক বার্তায়। ‘‘দুলে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে, নোটবই খুলে তার পাতায় খচখচ করে বিশ্রী হাতের লেখায় লিখে, পৃথিবীর সব মানুষকে সাহস দিয়ে রাখল, ‘পৃথিবীতে যখন মানুষ থাকবার জায়গা কুলোবে না, কয়লা ফুরুবে, তেল ফুরুবে, তখনও যেন কেউ ভয় না পায়। এই আমি রেখে গেলাম আরও ভালো বাতাস বাড়ির নকশা; এই রইল সূর্য-কলের নিয়মকানুন; খিদের বড়ির রন্ধনপ্রণালী: কাপড় ছেঁড়ে না বা পোড়ে না, গায়ের সঙ্গে বাড়ে কমে, রোজ যার রং বদলায়, তার গোপন তথ্য। পৃথিবীর দুঃখ ঘুচে যাক, সবাই সুখী হোক। ইতি—
পু: মনে থাকে যেন, সেই সুখের দিন আসবার আগে সমুদ্রের নীচে প্রচুর খাদ্যদ্রব্য পাওয়া যাবে। এবং বহু লোক ভেলা ভাসিয়ে জলের উপরে বাস করবে।’’
‘হলদে পাখির পালক’-এর বোগি রুমু আবার ঝগড়ু ঝমরুর গল্পের জগতে হারাচ্ছে। বিজ্ঞান ও ইংরেজি শিক্ষা চাপানো ঔপনিবেশিক ভাবনাকে ভেঙে লীলা মজুমদার বারবার আনছেন উত্তর-ঔপনিবেশিক ভাবনা। ঝগড়ুদের গল্পগুলো, অতিলৌকিক অলৌকিক অতিকথা থেকে কি আমরা আসলে চলে যাচ্ছি না সাবঅলটার্নের কণ্ঠস্বরের কাছাকাছি? স্বপ্নকল্পনা বার বার জিতে যাচ্ছে না কি, রূঢ় বাস্তবের সঙ্গে?
লীলা মজুমদার বহুপ্রজ। শিশু-কিশোর সাহিত্যের সম্রাজ্ঞীও বলা চলে। জন্ম ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯০৮, প্রয়াণ ৫ এপ্রিল ২০০৭। ৯৯ বছর বেঁচেছিলেন ২০০-র ওপর বইয়ের এই লেখক, অনুবাদক ও ‘সন্দেশ’ সম্পাদক হিসেবেও যিনি অগ্রগণ্য, স্মৃতিধার্য। সুবিখ্যাত রায় পরিবারের প্রমদারঞ্জন রায় ও সুরমাদেবীর সন্তান (বিবাহপূর্ব নাম লীলা রায়)। জন্ম রায় পরিবারের গড়পার রোডের বাড়িতে। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী (যাঁর পৈতৃক নাম ছিল কামদারঞ্জন রায়) ছিলেন প্রমদারঞ্জনের দাদা এবং লীলার জ্যাঠামশাই। সেইসূত্রে লীলা হলেন সুকুমার রায়ের খুড়তুতো বোন এবং সত্যজিৎ রায়ের পিসিমা। অর্থাৎ, নবজাগরণের যাবতীয় আলো এসেছিল এই পরিবারে। আর বিশ শতকের মেম ইশকুলের ইংরেজি শিক্ষা, তারপর বিশ্বভারতীতে রবীন্দ্রসান্নিধ্য, লীলার মনোজগতের এক অভূতপূর্ব জলসেচন হয়েছিল বলেই, মেধামননের ফলিয়ে ও লতিয়ে ওঠাটি সম্ভব হয়েছিল বলে মনে হয়।
আজগুবি লেখক হলেও, লীলা আসলেই যুক্তিবাদী মননের বিকাশের ভেতরে বড় হওয়া মানুষ।
আমরা জানি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব বিকাশের পর, বিশ শতকটিই হয়ে ওঠে কল্পবিজ্ঞানের আঁতুড়। ১৯২৬ সালে মার্কিন মুলুকে হিউগো গার্ন্সব্যাক ‘অ্যামেজিং স্টোরিস’ নামে প্রথম সায়েন্স ফিকশন পত্রিকা প্রকাশ করতে শুরু করেন। সায়েন্স ফিকশন শব্দবন্ধটির জনক তিনি কি না জানা নেই, তবে এই শৈলীর প্রথম পত্রিকাটি প্রকাশ করে তিনি যে এর জনপ্রিয়তাকে রূপ দেন– সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
এরপর পশ্চিমে অনেক জল গড়িয়ে গিয়েছে কল্পবিজ্ঞান নিয়ে। এবং আদর্শ কল্পবিজ্ঞান যে বস্তুত সাহিত্য, বিজ্ঞানের কচকচি নয়, সেকথাও বারবার আলোচিত হয়েছে। ফ্যান্টাসি বা কল্পনার এতে যতখানি অবদান, প্রায় ততখানিই বিজ্ঞানের, এবং দুয়ের মেলবন্ধনে যথার্থ সাহিত্য হতে হবে একে। এই নিয়ে বিতর্ক শেষ না হলেও, পাঠকপ্রিয়তার বিচার দিয়ে দেখলে বোঝাই যায় যে, বিজ্ঞান যত কম থাকুক না কেন, এইচ. জি. ওয়েলস থেকে জুল ভের্ন এই বিষয়ের সবচেয়ে মান্য দুই নাম। এর পর আসেন রে. ব্রাডবেরি বা আর্থার সি ক্লার্ক আইজাক অ্যাসিমভ, ফিলিপ কে ডিকরা। ব্র্যাডবেরি লিখছেন– ‘What if’ is the operative term for many of these stories’– ‘যদি’ হল এই গল্পগুলোর অনেকখানি মূলমন্ত্র। তিনি ভবিষ্যৎ কল্পনা করতে গিয়ে একটা ‘যদি’র সন্ধান করেছেন, তারপর তার পরিপ্রেক্ষিতে রচনা করেছেন কাহিনি।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
নারীরা সাহিত্যিক হিসেবে একেই বাংলা সাহিত্যে খুব অল্প জায়গাই দখল করতে পেরেছেন। তার ওপরে বিজ্ঞান আর নারীকে মানসিকভাবে মেলাতেই পারেন না অনেক পাঠক। মেয়েরা অঙ্ক পারে না– এই পুরনো কথনটি রয়েছে বহুদিন যাবৎ, একদা মেয়েরাও এটা বিশ্বাস করতেন। খুব সাহসী ও প্রথাভাঙা কয়েকজন মেয়ে ছাড়া। মেয়েরা অঙ্ক পারে না এই কথা কোনও যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা ছাড়াই বলা হয়েছিল, কারণ তার বদলে তাদের ‘হোম সায়েন্স’ বা ‘ডোমেস্টিক সায়েন্স’ পড়ার বিধান দিতে হবে শিক্ষাব্রতীদের।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
ইদানীং নতুন করে বলা হচ্ছে, ভারতীয় আর পাশ্চাত্য– দুই ধারার তফাতের কথা। কল্পবিজ্ঞান আর সায়েন্স ফিকশনের মধ্যে তফাতটা গভীর। ‘কল্পবিজ্ঞান’ শব্দটা সায়েন্স ফিকশনের দেশি বিকল্প হিসাবে অদ্রীশ বর্ধন কয়েন করেছিলেন। তাও সাতের দশকে। ১৯৬৩ সালে যখন বের হয়েছিল প্রথম ‘আশ্চর্য!’ পত্রিকা, তখন নয়। তখন অবধি তার নাম ছিল বিজ্ঞানভিত্তিক কাহিনি। আগে যাঁরা লিখেছেন, যথা প্রেমেন্দ্র মিত্র, তাঁরা এগুলিকে বিজ্ঞানভিত্তিক গল্পের শিরোপা দিয়েছেন। ‘কল্পবিজ্ঞান’ শব্দটি যদিও এসেছে ইংরেজি ‘সায়েন্স ফিকশন’ থেকে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এর মধ্যে যা লেখা হয়েছে, তাতে সায়েন্স ফিকশন, সায়েন্স ফ্যান্টাসি ও সায়েন্টিফিক ফিকশন– সবই চলে এসেছে। ‘সায়েন্স ফিকশন’ নিয়ে গবেষক বোধিসত্ত্ব চট্টোপাধ্যায় তাঁর রিসার্চ পেপারে দেখিয়েছেন যে, ভারতীয় দর্শন ও বিজ্ঞানের মেলবন্ধনে পাশ্চাত্য সায়েন্স ফিকশন থেকে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে তৈরি হয়েছে কল্পবিজ্ঞানের মূলধারা। এবং বাঙালির কল্পবিজ্ঞান তাই অনেকটাই আলাদা জাঁর সায়েন্স ফিকশনের থেকে।
বাংলা সাহিত্য একটি জলধি। তার ভেতরে ছোট্ট একটি পুকুরের সমান লেখালেখি হয়তো কল্পবিজ্ঞান। নারীরা সাহিত্যিক হিসেবে একেই বাংলা সাহিত্যে খুব অল্প জায়গাই দখল করতে পেরেছেন। তার ওপরে বিজ্ঞান আর নারীকে মানসিকভাবে মেলাতেই পারেন না অনেক পাঠক। মেয়েরা অঙ্ক পারে না– এই পুরনো কথনটি রয়েছে বহুদিন যাবৎ, একদা মেয়েরাও এটা বিশ্বাস করতেন। খুব সাহসী ও প্রথাভাঙা কয়েকজন মেয়ে ছাড়া। মেয়েরা অঙ্ক পারে না এই কথা কোনও যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা ছাড়াই বলা হয়েছিল, কারণ তার বদলে তাদের ‘হোম সায়েন্স’ বা ‘ডোমেস্টিক সায়েন্স’ পড়ার বিধান দিতে হবে শিক্ষাব্রতীদের।
এইসব পূর্ব-ধারণার বাধা পেরিয়েও নারী সাহিত্যিকদের পদচারণা ঘটেছে বিজ্ঞানভিত্তিক লেখালেখির নানা পরিসরে। বেগম রোকেয়ার কথা আগেই বলা হয়েছে। তিনি একটি উদাহরণ শুধু নন, স্মর্তব্য। তাঁকে পুনরাবিষ্কার করছেন আজকের নারীবাদীরা এবং কল্পবিজ্ঞান অনুসন্ধানীরা, কারণ তাঁর ‘‘সুলতানা’জ ড্রিম’’-এর ভেতরে এই দুই বিশিষ্ট ধারার প্রচুর লক্ষণ বর্তমান।
পরবর্তী সময়ে, কিশোর-কিশোরীদের পাঠবস্তুর ভেতরেই স্থান করে নেয় কল্পবিজ্ঞান গল্প। বাংলা ভাষায়, অন্তত পশ্চিম বাংলায় তথা ভারতে, যে ধরনের কল্পবিজ্ঞান গল্প লেখা হয়েছে, তা ১৯৬৩-তে প্রকাশিত, অদ্রীশ বর্ধন সম্পাদিত ‘আশ্চর্য!’ পত্রিকার বাইরে, সবটাই কিশোরপাঠ্য। প্রাপ্তবয়স্ক ও প্রাপ্তমনস্ক পাঠকের জন্য খুব কম লেখাই হয়েছে, দু’হাজার সালের পরবর্তীতে ছাড়া।
ফলে এক বিশিষ্ট কিশোরসাহিত্যিক লীলা মজুমদার যে ক’টি কল্পবিজ্ঞান গল্প লিখেছিলেন ‘আশ্চর্য!’ পত্রিকার পাতায়, রহস্য, রোমাঞ্চ, মজার ভেতরে একটি বিজ্ঞানের সুপ্ত বীজ– এইসব সত্ত্বেও, অধিকাংশ লেখাকেই আজকের দৃষ্টিতে নতুন করে দেখতে হবে। যদি বা এদের পাশ্চাত্য কল্পবিজ্ঞানের সংজ্ঞার ভেতরে আঁটানো মুশকিল হয়, ভাবতে হবে ভারতীয় গল্প বলার ঘরানা নিয়ে। কতটা সফল এই গল্পগুলি। কী তার উপযোগিতা! অসামান্য একটি স্বপ্নের দুনিয়া সৃষ্টি করেন লীলা মজুমদার তাঁর ‘টং লিং’ উপন্যাসে, ‘সিঁড়ি’ নামের গল্পে। ব্যাঘ্রপুরাণে আছে বাঘের জেনেটিক মডিফিকেশনের কথা।
লীলা মজুমদারের ‘শূন্য’ গল্পটি ১৯৬৫ সালের ‘আশ্চর্য!’ পত্রিকার শারদ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু সে লেখাটি খুব প্রচারিত নয়। সেখানে অননুকরণীয় রকমের লীলাসুলভ মজাদার ভাষায় ব্যাখ্যা করেছেন রিলেটিভিটিকে, স্পেস-টাইম প্যারাডক্সকে। মাদুরের মতো করে শিলং পাহাড়ের এক চূড়া থেকে আরেক চূড়ার দূরত্বকে গুটিয়ে আনার বিজ্ঞান– এমন উপমা একমাত্র লীলাকলমেই সম্ভব।
এই গল্পগুলি লীলা মজুমদারের ফ্যান্টাসি গোত্রের গল্প, যাতে বিজ্ঞানের ভাগ অল্প হলেও মানবিকতার গুণে এবং রসালো গল্প বলার মুনশিয়ানায় অত্যন্ত রসোত্তীর্ণ। নিজস্ব অনবদ্য কলমের জোরে লীলা মজুমদার এক উজ্জ্বলতম নারী কল্পবিজ্ঞানলেখক।
…পড়ুন সায়েন্স ফিকশনারী-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৯। জরায়ুযন্ত্রে পরিণত হওয়া নারী শরীর কি ডিস্টোপিয়া, না বাস্তব?
পর্ব ৮। উরসুলার মতো সফল নারী লেখককেও সম্পাদক পাঠাতে চেয়েছিলেন পুরুষ ছদ্মবেশে
পর্ব ৭। উরসুলা লেগুইন কল্পকাহিনির আইডিয়া পান স্ট্রিট সাইনগুলো উল্টো করে পড়তে পড়তে
পর্ব ৬। কেবলমাত্র নারীরচিত সমাজ কেমন হবে– সে বিষয়ে পুরুষের অনুমান সামান্য
পর্ব ৫। একমাত্র মানুষের মাংসই সহ্য হত ভিনগ্রহী শিশুটির!
পর্ব ৪। পাল্প ম্যাগাজিনের প্রথম লেখিকা
পর্ব ৩। রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ কি কল্পবিজ্ঞান সংজ্ঞার সবগুলো শর্তই পূরণ করতে পেরেছিল?
পর্ব ২। সুলতানার স্বপ্নেই বিশ্বের প্রথম নারীবাদী ইউটোপিয়ার অবকাশ
পর্ব ১। চ্যালেঞ্জের বশেই লেখা হয়েছিল পৃথিবী প্রথম কল্পবিজ্ঞান কাহিনি, লিখেছিলেন একজন নারীই