নিউ ইয়র্কের এগজিবিশন ক্যাটালগে রবীন্দ্রনাথের ছবি প্রসঙ্গে কুমারস্বামীর লেখা ফরোয়ার্ড তেমন জুতসই ছিল না। রবীন্দ্রনাথের ছবির পালস তিনি কতটা ধরতে পেরেছিলেন, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। প্রাচ্যের প্রোফেটরূপে রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা শোনার জন্যে পশ্চিমের যে আকুতি, তাঁর ছবির গ্যালারিতে সেই আঁচ তেমন পড়েনি। এমনকী, ফিলাডেলফিয়ায় দর্শক টানতে গ্যালারিতে তাঁর কবিতাপাঠের আসর বসাতে হয়েছিল।
১২.
রবীন্দ্রনাথ তাঁর তোরঙ্গে সেই যে শ-চারেক ছবি ভরে বিদেশ পাড়ি দিয়েছিলেন, তার প্রায় সবই বিভিন্ন গ্যালারিতে প্রদর্শিত হয়েছিল। কিছু সংখ্যক ছবি বিদেশের গ্যালারি থেকে সংগ্রহও করেছিলেন অনেকে। তবে প্যারিসে প্রদর্শনীর সময় ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো যখন ছবি বিক্রির প্রসঙ্গ তোলেন, তাতে সায় দেননি রবীন্দ্রনাথ। তাঁর মনে হয়েছিল, ভিক্টোরিয়া বোধহয় ছবিগুলো নিজেই কিনে নিতে চাইছে। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘এখন বেচবার কথা বন্ধ থাক’।
প্রথম এগজিবিশনেই সমস্ত ছবি বেহাত হয়ে যাক– এমনটা হয়তো তিনি চাননি। ফ্রান্স ছাড়া অন্য দেশের মাটিতেও তাঁর ছবিগুলো যাচাই করতে চেয়েছিলেন। ছবি বিক্রি করার ভাবনা আসে পরে এবং বিশ্বভারতীর আর্থিক অবস্থার কথা মাথায় রেখে। অন্যদিকে ভালোবেসে ছবি দান করতেও তিনি পিছ-পা হননি। বার্লিনের ন্যাশনাল গ্যালারিকে পাঁচখানা ছবি উপহার দিয়েছেন। তাদের টাকা নেই, কিনতে পারছে না– এ কথা জেনে নিজের থেকেই উপহার দিলেন। তার কিছুকাল পরে হিটলার যখন ‘এনটি-আর্ট’-এর তকমা লাগিয়ে অজস্র আধুনিক ছবি ভাস্কর্য ভেঙে পুড়িয়ে নষ্ট করেছিল, তখন সেই পাঁচখানা ছবিও পড়েছিল হিটলারের রোষে। সে গল্প অন্যদিনের জন্য তোলা রইল।
শেষ পর্যন্ত জার্মানিতে তাঁর উপহার দেওয়া ছবিগুলোর কী দশা হয়েছিল বলা শক্ত। আবার মস্কোতে প্রদর্শনীর সময় প্রশান্ত মহলানবিশকে লিখছেন– ‘এদের গ্যালারির জন্যে চারখানা ছবি কিনবে বলে এরা যথেষ্ট চেষ্টা করচে– কিন্তু এদের অর্থাভাব প্রায় আমাদের বিশ্বভারতীরই মতো– তবু এরা কোনোরকম করে জোগাড় করবার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছে’। এখানেও শেষমেশ চারটে ছবি মস্কোর আর্ট গ্যালারি কিনতে পেরেছিল কি না, সে খবর পাওয়া যায় না। বার্লিনের মতো এখানেও উনি ছবি দান করলেন কি না, জানি না। কিন্তু আমেরিকায় ছবি বিক্রি হবে, এমন একটা ধারণা তাঁর মনে দৃঢ় হয়েছিল। প্রদর্শনী চলাকালীন রথী ঠাকুরকে লিখেছেন– ‘ইতিমধ্যে বস্টন থেকে খবর পাচ্চি একজিবিশন খুব জমেচে– বিক্রিও শুরু হয়েচে। মোটের উপর আশাজনক।’ বলছেন– ‘আমার বিশ্বাস হয়েচে ছবি এঁকে আমার ভবিষ্যতের একটা রাস্তা খোলসা হবে।’ প্রতিমা দেবীকে লেখা চিঠির ভাষায় তা আরও স্পষ্ট। লিখছেন– ‘যদি বিক্রি হয় তা হলে কিছু মোটা গোছের টাকা হাতে আসবে। এই টাকাটা সমস্তই যেন তোমাদের ধার শোধের জন্যেই ব্যবহার করা হয়। আর কিছুরই জন্যে নয়। তোমাদের বৈষয়িক ব্যাপারে একটুও হাত দিতে চাইনে বলেই নিষ্ক্রিয় হয়ে ছিলুম। অথচ বুঝতে পারছিলুম রথীর শরীর ভেঙে যাবার অন্যতম কারণ এই দুশ্চিন্তা। আমার ছবি বিক্রি করে এই দায় ঘোচাব বলে একান্ত আশা করেছিলুম। এই অত্যাশ্চর্য ব্যাপারটা ক্রমে আমার প্রত্যয়গোচর হয়েচে যে, আমার ছবির দাম আছে এবং সে দাম বাড়বে। আজ হোক কাল হোক এই ছবি থেকে ঋণ শোধ হবেই।’ পরে আবার রথীকে– ‘ছবির কথাটা বলে রাখি। আরিয়াম হলেন তার উদ্যোগী। বস্টনে কাজ শুরু হয়েচে। সেও দেখি মুক্তকণ্ঠ– অর্থাৎ সেও দরাজ গলায় বলচে, ছবি কসে বিক্রি হবে। লোকে খুসি, এবং যাকে বলে বিস্মিত। তা ছাড়া বোধহয় এও ভাবছে এ মানুষটার কি জানি কখন কি হয়, এর পরে ছবিগুলোর দাম বাড়বে। যাই হোক ভাবগতিক দেখে আরিয়াম ঠিক করে রেখেচে বস্টনে এবং নিউইয়র্কে ছবি সমস্ত বিকিয়ে যাবে। আমারও সেটা অসম্ভব বোধ হচ্চে না– কারণ আমার সম্বন্ধে এখানকার লোকেরা সত্য সত্যই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেচে।’
আমরা জানি, রবি ঠাকুরের মন বরাবরই আবেগের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, বার বার এমনটা ঘটেছে। এখানেও আরিয়াম ও অন্যদের কথায় ছবি বিক্রির ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত প্রত্যয়ী, অবশ্য তা হওয়ার কথাও। তবে যতটা তিনি ভেবেছিলেন ছবি কেনার উৎসাহ, ঠিক তেমনটা দেখা যায়নি। ছবি বিক্রির টাকা থেকে বিশ্বভারতীর আর্থিক দীনতা দূর হওয়ার মতো অবকাশ ঘটেনি। তার কারণ ছিল সেই পর্বের মন্দাবাজার। সেইসঙ্গে প্রচারের বেশ ঘাটতিও একটা কারণ বলে মনে হয়। কারও কারও মতে, নিউ ইয়র্কের এগজিবিশন ক্যাটালগে রবীন্দ্রনাথের ছবি প্রসঙ্গে কুমারস্বামীর লেখা ফরোয়ার্ড তেমন জুতসই ছিল না। রবীন্দ্রনাথের ছবির পালস তিনি কতটা ধরতে পেরেছিলেন, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। যাই হোক, আরিয়ামের ওপর যতটা তিনি নির্ভর করেছিলেন, ঠিক ততটা কাজ হয়নি। আরিয়াম বরাবর একটু ঢিলেঢালা গোছের, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সবসময় সামলে রাখতে পারতেন না। এখানে তাঁর আরও প্রফেশনাল সেক্রেটারির দরকার ছিল। আরেকটা ব্যাপার মনে হয়, প্রাচ্যের প্রোফেটরূপে রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা শোনার জন্যে পশ্চিমের যে আকুতি, তাঁর ছবির গ্যালারিতে সেই আঁচ তেমন পড়েনি। এমনকী, ফিলাডেলফিয়ায় দর্শক টানতে গ্যালারিতে তাঁর কবিতাপাঠের আসর বসাতে হয়েছিল। তবে কি আমেরিকায় ছবিঠাকুরের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন কবিঠাকুর?
সে যাই হোক, রবীন্দ্রনাথের প্রত্যাশা মতো বোস্টনে ছবি বিক্রি আশানুরূপ হয়নি। বিক্রি না-হওয়ার জন্য রথীকে তিনি খানিকটা এক্সকিউজও দিয়েছেন, লিখেছেন– ‘বস্টনে আমার ছবি সম্বন্ধে ঔৎসুক্য হয় নি তা নয় কিন্তু ওদের বোধ হয় কিছু ধাঁধা লেগেছে– তা ছাড়া বস্টন ইংরেজের আঁচল ধরা, কন্টিনেন্টাল নয়, ভারতবর্ষের ওপর ওদের দরদ নেই। তবু কিছু বিক্রি হয়েচে।… সোমবারে নিউইয়র্কে যাব। নিউইয়র্কে ফিলাডেলফিয়ায় মিলে ছবি যদি কিছু বিক্রি হয় তাহলে কিছু টাকা হাতে আসবে।’ তবে বোস্টনে ভালো বিক্রি না হলেও শেষ পর্যন্ত আশা ত্যাগ করেননি রবীন্দ্রনাথ।
লিখেছেন– ‘য়ুরোপে আমার যেটুকু অভিজ্ঞতা হয়েচে তাতে বুঝেচি ছবি আঁকার উপরে আমি ভরসা করতে পারি। তাই মনে করে আমার মন বেশ খুসিতে আছে।’ রবি ঠাকুরের কাছে এইটে আমাদের শিখে নেওয়ার, সে হল– কোনও অবস্থাতেই প্রতিকূলতার কাছে নতিস্বীকার না-করার এক কঠিন মন্ত্র। অনুসন্ধান করলে দেখি, সেবারে নিউইয়র্ক আর ফিলাডেলফিয়াতে তাঁর ছবির প্রদর্শনী সাফল্য পেলেও বিক্রির ব্যাপারে তেমন সাড়া মেলেনি। কিছু ছবি রেখে আসার কথাও ভেবেছিলেন। এমনকী রবীন্দ্রনাথ অসুস্থ অবস্থায় তাঁর বক্তৃতার সংখ্যা কমিয়ে দিয়ে ছবি বিক্রির টাকা বিশ্বভারতীর স্বার্থে, দেশের কাজে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন– কিন্তু তাঁর অন্যতম প্রতিবন্ধক ছিল সেই পর্বের বিশ্ববাজারের মন্দা। তবে আমাদের পরম সৌভাগ্য যে, তাঁর প্রায় সব ছবিই দেশে ফিরেছিল, আর তা রক্ষিত আছে রবীন্দ্রভবন ও অন্যান্য সংগ্রহালয়ে। অন্যথায় আধুনিক ভারতীয় চিত্রকলার একটা প্রধান অংশ আমাদের কাছে চিরকালের জন্য অধরা থেকে যেত।
(চলবে)
…পড়ুন ছবিঠাকুর-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১১: নন্দলাল ভেবেছিলেন, হাত-পায়ের দুয়েকটা ড্রয়িং এঁকে দিলে গুরুদেবের হয়তো সুবিধে হবে
পর্ব ১০: ১০টি নগ্ন পুরুষ স্থান পেয়েছিল রবীন্দ্র-ক্যানভাসে
পর্ব ৯: নিরাবরণ নারী অবয়ব আঁকায় রবিঠাকুরের সংকোচ ছিল না
পর্ব ৮: ওকাম্পোর উদ্যোগে প্যারিসে আর্টিস্ট হিসেবে নিজেকে যাচাই করেছিলেন রবি ঠাকুর
পর্ব ৭: শেষ পর্যন্ত কি মনের মতো স্টুডিও গড়ে তুলতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ?
পর্ব ৬: রবীন্দ্র চিত্রকলার নেপথ্য কারিগর কি রানী চন্দ?
পর্ব ৫: ছবি আঁকার প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ পরলোকগত প্রিয়জনদের মতামত চেয়েছেন
পর্ব ৪: প্রথম ছবি পত্রিকায় প্রকাশ পাওয়ামাত্র শুরু হয়েছিল বিদ্রুপ
পর্ব ৩: ঠাকুরবাড়ির ‘হেঁয়ালি খাতা’য় রয়েছে রবিঠাকুরের প্রথম দিকের ছবির সম্ভাব্য হদিশ
পর্ব ২: রবীন্দ্রনাথের আঁকা প্রথম ছবিটি আমরা কি পেয়েছি?
পর্ব ১: অতি সাধারণ কাগজ আর লেখার কলমের ধাক্কাধাক্কিতে গড়ে উঠতে লাগল রবিঠাকুরের ছবি