ততদিনে কলকাতা শহরের কানাগলিতেও কেচ্ছা ভাসছে, অমিতাভ বচ্চন ও রেখার মধ্যে একটা ইয়ে আছে। যশ চোপড়ার ‘সিলসিলা’ সেই গুজবের সলতেতে আগুন ধরিয়ে দিল। ‘সিলসিলা’ দেখে এক পাড়ার জ্যাঠা গোছের কেউ বলেছিল, ‘স্ক্যান্ডালটা পুরো এক্সপোজ করে দিল!’ শুনে এক চ্যাংড়া ছোঁড়া কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেছিল, ‘আপনিই তো এই সিনেমাটা বানানোর জন্য পারফেক্ট ছিলেন! আপনি থাকতে অন্য কেউ বানাল কেন?’ বলার কারণ একটিই, এই জ্যাঠাটি প্রায় নিশ্চিত হয়ে রাজ কাপুরের জন্য টিফিন নিয়ে এসে তার ঘর বন্ধ দেখে নার্গিসের চিরতরে চলে যাওয়া, ওয়াহিদা কেন গুরু দত্তকে ‘আমাকে টাচ করবে না’ জাতীয় হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, ইত্যাদি বলে বেড়াতেন যত্রতত্র।
২০.
‘হোটেল এণ্ড রেষ্টুরেন্ট’– এই বানান এখনও কলকাতা উত্তর ঢুঁড়লেই বহু সাইনবোর্ডে মিলবে। এক রসিক ব্যক্তি পান চিবুতে চিবুতে বলেছিলেন, এর মানে আসলে হল গিয়ে, ‘হোটেল এণ্ড, রেষ্টুরেন্ট স্টার্ট’। দীর্ঘদিন পর্যন্ত ‘রেস্টুরেন্ট’ বা রেস্তোরাঁ ছিল শৌখিন বিষয়। যেভাবে বাঙালি ‘বই’ অথবা ‘বায়োস্কোপ’ দেখত, সেভাবেই ‘হোটেল’-এ খেত। হাতিবাগান চত্বর জুড়ে এমন বায়োস্কোপের স্বপ্নঘর আর হোটেলের অমোঘ ফ্রাই-কাটলেট-মোগলাই পরোটার হাতছানির আশ্চর্য সহাবস্থান ছিল। তখনও প্রথম ‘অপারেশন সানশাইন’ হয়নি। কলকাতার মন তখন আরেকটু বড়, তাই ফুটপাতে হাঁটাচলা আর টুকটাক বাজারের জন্য হকারের ডাক যুযুধান দু’পক্ষ হয়ে দাঁড়ায়নি। ঝাঁ-চকচকে শৌখিন দোকানে ঢোকার সাধ্যি সবার নেই মোটেই। হকারের সস্তা ও হোলসেল আহ্বান তাই কানের ভেতর দিয়ে মরমে পশিত সকলের। ভদ্রলোকের ফুটপাত দখল হয়ে যাচ্ছে, এমন হাহারব তখনও পর্যন্ত নেই। আর এই অস্থায়ী বাজার, সার্কাসের তাঁবুর মতো রোমাঞ্চকর বায়োস্কোপ-মহল ও রসনার রকমফেরের হোটেলমুখর জীবন উত্তুরে বহু সন্ধের প্রাণভোমরা ছিল।
‘টকিশো হাউজ’-এ ইভনিং শো-এ ‘নমকহারাম’ দেখে, একটু ঘুরে কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের এদিকটায় এসে, দিলরুবা-র মোগলাই খেয়ে, হাতিবাগান থেকে কিছু কেনাকাটা করে বাড়ি ফেরার প্রায় দুঃসাহসিক পরিকল্পনা করে এক নিতান্তই নিম্ন-মধ্যবিত্ত যুগল হেমন্ত-সন্ধ্যার হিম মেখে বেরিয়ে পড়েছিল। ‘নমকহারাম’-এর টিকিট মেলা তখন প্রায় দুষ্কর। রাজেশ খান্না, অমিতাভ বচ্চনের মণিকাঞ্চনযোগ ও রেখা-র ত্র্যহস্পর্শে, গুলজারের চিত্রনাট্য ও হৃষীকেশ মুখুজ্জের পরিচালনায়, আনন্দ বক্সির লিরিকে ও সদ্য ৮৫ বছরের জন্মদিন পেরনো রাহুল দেব বর্মনের সুরের রাসায়নিক বিক্রিয়ায় তখন বিস্ফোরক হয়ে উঠেছে সেই ছবি। ‘টকিশো হাউজ’-এ ব্ল্যাকে প্রায় পঁচিশ পয়সা বেশি দিয়ে ড্রেস সার্কলের টিকিট মিলল। সিনেমা ততক্ষণে শুরু হয়েছে সবে, টিকিট জোগাড় করতে যেটুকু সময়, তার মধ্যেই, ‘দেয়া নেয়া’-য় লিলি চক্রবর্তীর সংলাপ-মাফিক, ‘ইন্ডিয়ান নিউজ রিভিউ’ ও ‘কাপড় কাচার সাবান’-এর বিজ্ঞাপন সারা হয়েছে। যা হোক, সবে জেলফেরত অমিতাভ বচ্চন মুখোমুখি হচ্ছে ছবির আরেক নায়িকা সিমি গারেওয়ালের, তখন কোনও মতে অন্ধকারে টর্চের আলোর তাড়াহুড়োয় সিট খুঁজে বসতে গেছে সেই কপোত-কপোতী, হঠাৎ একটা বাঁজখাই ‘কে রে’ শুনে তারা তো বটেই, আশপাশের তিন-চারটি রো-এর পিলে একযোগে চমকে উঠল। সমস্যাটা হয়েছে, এক মধ্যবয়সি দম্পতির কর্তা-গিন্নির সিটই ব্ল্যাকের টিকিটে ধার্য হয়েছে এই যুগলের জন্য। কোনওভাবে প্রেমিকটি সিটের নরম গদি ভেবে ওই কর্তার ক্রোড়টিতেই অধিষ্ঠান করতে গিয়েছিল।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
অমিতাভ বচ্চনকে ততদিনে ভবিষ্যতের নায়ক বলে চিনে যাওয়া প্রেমিকপ্রবরটিকে নস্যাৎ করে প্রেমিকার ভোট ছিল চির-রোমান্টিক ও এই ছবির গরিব (ফলত আসলি হিরো) ও ট্র্যাজিক পরিণতির রাজেশ খান্নার দিকে। তার মধ্যেও গানের রেশ ছিল অটুট, ‘নদিয়া কি দরিয়া’ বা ‘দিয়ে জ্বলতে হ্যায়’ গুনগুন করে উঠেছে দু’জনেরই মন সময়ে সময়ে। কিন্তু দু’জনের আদত মনের মিলটা ঘটেছিল অন্যত্র, তারা দু’জনেই, মুগ্ধ হয়েছিল নায়িকায়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
যা হোক, এহেন গোলযোগ টের পেয়ে, হলের বাকিরা যাতে আর বিব্রত ও বিরক্ত না হয়, তার জন্য সিঁড়ির এককোণে তড়িঘড়ি সেই যুগলকে বসিয়ে দিল টর্চধারী পথপ্রদর্শক, হলের অন্ধকারে যে অগতির গতি। তিন-চারটি আড়চোখ বড়পর্দার তারকাখচিত ঘটনাক্রম থেকে অল্প অল্প বিচ্যুত হয়ে মাঝেমধ্যেই এই যুগলের ওপর স্থাপিত হচ্ছিল। কারণ সিঁড়ির অমন কোণে বসার দরুন, অনেকটা আলো যেন তারাই কেড়ে নিচ্ছিল।
ড্রেস সার্কলের টিকিটের বাড়তি ২৫ টাকা নষ্ট হওয়ার যাবতীয় দুঃখ ব্ল্যাকারকে পরে ‘একা পেলে’ সমুচিত শিক্ষা দেওয়ার অঙ্গীকারের রবরবা দিয়ে চাপা দিয়ে, দিলরুবা-র বরাদ্দে ঘাটতি হওয়ার দরুন একটিই চিকেন কাটলেট মাথা নিচু করে নীরবে ভাগাভাগি করে খেয়ে, হাতিবাগানের হকারদের ঝাঁপ ফেলে দেওয়া দোকানের সামনে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফিরে আসা কিছুটা লজ্জিত ও কুণ্ঠিত সেই যুগল কিন্তু আড়াআড়ি ভাগ ছিল দু’পক্ষে। অমিতাভ বচ্চনকে ততদিনে ভবিষ্যতের নায়ক বলে চিনে যাওয়া প্রেমিকপ্রবরটিকে নস্যাৎ করে প্রেমিকার ভোট ছিল চির-রোমান্টিক ও এই ছবির গরিব (ফলত আসলি হিরো) ও ট্র্যাজিক পরিণতির রাজেশ খান্নার দিকে। তার মধ্যেও গানের রেশ ছিল অটুট, ‘নদিয়া কি দরিয়া’ বা ‘দিয়ে জ্বলতে হ্যায়’ গুনগুন করে উঠেছে দু’জনেরই মন সময়ে সময়ে। কিন্তু দু’জনের আদত মনের মিলটা ঘটেছিল অন্যত্র, তারা দু’জনেই, মুগ্ধ হয়েছিল নায়িকায়।
জিনাত আমন একটি সাক্ষাৎকারে দৃপ্তভাবে বলেছিলেন, ‘নব্বই শতাংশ মহিলা কেবল আলংকারিক চরিত্রে অভিনয় করে বলিউডে। তারা নাচে-গায়, নায়কের আশপাশে ঘোরে। কিন্তু বদল একটা আসছে। মহিলারা ঠিক করছেন, তাঁরা কী ধরনের চরিত্র করবেন বা করবেন না।’ সাতের দশকে জিনাত আমন-দের এই অন্তর্ঘাতের মধ্যেই ধারালো তলোয়ারের মতো ঝকঝক করে উঠলেন ভানুরেখা গণেশন, ওরফে রেখা। ওই সিঁড়িতে বসে রেখাকে দেখা যুগল ড্রেস সার্কলে বসেই ‘মুকাদ্দর কা সিকান্দার’ এবং ‘খুবসুরত’-ও দেখেছিল। ততদিনে কলকাতা শহরের কানাগলিতেও কেচ্ছা ভাসছে, অমিতাভ বচ্চন ও রেখার মধ্যে একটা ইয়ে আছে। যশ চোপড়ার ‘সিলসিলা’ সেই গুজবের সলতেতে আগুন ধরিয়ে দিল। ‘সিলসিলা’ দেখে এক পাড়ার জ্যাঠা গোছের কেউ বলেছিল, ‘স্ক্যান্ডালটা পুরো এক্সপোজ করে দিল!’ শুনে এক চ্যাংড়া ছোঁড়া কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেছিল, ‘আপনিই তো এই সিনেমাটা বানানোর জন্য পারফেক্ট ছিলেন! আপনি থাকতে অন্য কেউ বানাল কেন?’ বলার কারণ একটিই, এই জ্যাঠাটি প্রায় নিশ্চিত হয়ে রাজ কাপুরের জন্য টিফিন নিয়ে এসে তার ঘর বন্ধ দেখে নার্গিসের চিরতরে চলে যাওয়া, ওয়াহিদা কেন গুরু দত্তকে ‘আমাকে টাচ করবে না’ জাতীয় হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, ইত্যাদি বলে বেড়াতেন যত্রতত্র। ‘ম্যাজেস্টিক’ হলে এই ‘সিলসিলা’ দেখে বেরিয়েই প্রথম ‘চাং ওয়া’-তে ঢোকা এক কিশোরের, তার মামা-মামির সঙ্গে। নিষিদ্ধ প্রেমের ছবি ও পানশালার অভিজ্ঞতা একদিনে হওয়ায়, ওই দিনটি তার স্মৃতিতে উজ্জ্বল ছিল।
একই সময় কলকাতার ‘ওরিয়েন্ট’, ‘জেম’, ‘বীণা’, ‘পূর্ণশ্রী’, ‘প্রিয়া’-য় রমরমিয়ে চলছে ‘ত্রিশূল’, ‘ডন’, রবীন্দ্র সদনে ‘টিনের তলোয়ার’ বা ‘জগন্নাথ’, ‘মারীচ সংবাদ’-এর বিজ্ঞাপন খবরের কাগজে জ্বলজ্বল করছে তার পাশেই। ‘ডন’-র হেলেন যখন ‘ইয়ে মেরা দিল’-এর সম্মোহনে অমিতাভ বচ্চনের কামহীন ধূর্ত মুখ ছাপিয়ে শিহরন জাগাচ্ছে হলে, বা অ্যাকশন অবতারের জিনাত আমন শলাকা বেঁধাচ্ছেন, তখন আবার হয়তো ‘মোকাম্বো’-তে ‘ফ্লোরা’, ‘ট্রিংকাস’-এ ‘শার্লি/আর্থার’-রা নেচে উঠছেন হিন্দি-ইংরেজি নানা গানের তালে। রঙিন সেই কলকাতায় কথায় কথায় উচ্ছেদ হত না। ‘চৌরঙ্গীর আলো এবং লোডশেডিং’ সেখানে সহবাস করত। ঝকঝকে এবং উন্নত হওয়ার তাড়া ছিল না সেই শহরের। বরং জীবন ছিল ভরপুর, সহজ এবং জটিল, কষ্টদীর্ণ, এবং তুমুল আনন্দের।
…পড়ুন জনতা সিনেমাহল-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১৯। দেওয়ালে সাঁটা পোস্টারে আঁকা মধুবালাকে দেখে মুগ্ধ হত স্কুলপড়ুয়া মেয়েরাও
পর্ব ১৮। পানশালায় তখন ‘কহি দূর যব’ বেজে উঠলে কান্নায় ভেঙে পড়ত পেঁচো মাতাল
পর্ব ১৭। গানই ভেঙেছিল দেশজোড়া সিনেমাহলের সীমান্ত
পর্ব ১৬। পুলিশের কাছেও ‘আইকনিক’ ছিল গব্বরের ডায়লগ
পর্ব ১৫। ‘শোলে’-র চোরডাকাতরা এল কোথা থেকে?
পর্ব ১৪। ‘শোলে’-তে কি ভারত আরও আদিম হয়ে উঠল না?
পর্ব ১৩। ‘জঞ্জির’ দেখে ছেলেটা ঠিক করেছিল, প্রতিশোধ নেবে
পর্ব ১২। ‘মেরে পাস মা হ্যায়?’-এর রহস্যটা কী?
পর্ব ১১। ইন্দ্রজাল কমিকস-এর গ্রামীণ নায়ক বাহাদুর পাল্পে এসে রংচঙে হল
পর্ব ১০। দু’টাকা পঁচিশের টিকিটে জমে হিরোইনের অজানা ফ্যানের স্মৃতি
পর্ব ৯। খান্না সিনেমায় নাকি পৌরাণিক সিনেমা চলছে
পর্ব ৮। পাড়াতুতো ট্র্যাজেডিতে মিলে গেলেন উত্তমকুমার আর রাজেশ খান্না
পর্ব ৭। পাড়ার রবিদা কেঁদেছিল ‘কাটি পতঙ্গ’ আর ‘দিওয়ার’ দেখে, সাক্ষী ছিল পাড়ার মেয়েরা
পর্ব ৬। যে কলকাতায় পুলিশ-পকেটমার মিলেমিশে গেছে, সেখানে দেব আনন্দ আর নতুন করে কী শিরশিরানি দেবেন?
পর্ব ৫। হিন্দি ছবির পাপ ও একটি অ্যাডাল্ট বাড়ির গল্প
পর্ব ৪। দেব আনন্দ, একটি বোমা ও অন্ধকারে হাত ধরতে চাওয়ারা
পর্ব ৩। অন্ধকারে ঢাকা পড়ল কান্না থেকে নিষিদ্ধ স্বপ্ন!
পর্ব ২। ‘জিনা ইঁয়াহা মরনা ইঁয়াহা’ উত্তর কলকাতার কবিতা হল না কেন?
পর্ব ১। সিনেমা হলে সন্ত্রাস ও জনগণমন-র দলিল