…অতীব সাধারণ চেহারার যে মানুষটি বসে তাঁত চালাচ্ছিলেন, বললেন যে তিনিই কালাচাঁদ। অজয় চমকেছিলেন বটে! একজন তাত্ত্বিক, দাপুটে নেতাকে তিনি এভাবে মোটেই কল্পনা করে আসেননি। একটু হতাশও কি হয়েছিলেন তিনি? হলেও, তা মুছে যেতে বেশি সময় লাগেনি। মার্কসীয় তত্ত্বজ্ঞানে কালাচাঁদের গভীরতা ছিল নিখাদ। অজয় এবং তাঁর কালাদা— অচিরেই একে অন্যের ছায়াসঙ্গী হয়ে উঠলেন। অগ্নিগর্ভ সত্তরেও তাঁদের পথের বাঁকবদল ঘটল হাতে হাত রেখেই।
২০.
কালাচাঁদ দালাল। ভারত
আগে আমরা অজয়ের কথা বলি? নদীয়ার শান্তিপুর অঞ্চলে গণনাট্য সংঘের জনপ্রিয় সংগঠক অজয় ভট্টাচার্য যৌবনে কিন্তু জেল খেটেছেন ব্যাঙ্ক ডাকাতির দায়ে। আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে কমিউনিস্ট বন্দি অমর রাহার সঙ্গে আলাপের সুবাদে মার্কসবাদের সঙ্গে অজয়ের প্রথম পরিচয়। আগ্রহ ক্রমে বিশ্বাসে বদলাতে থাকে, বিশ্বাস সংকল্পে। অজয় সিদ্ধান্ত নেন কমিউনিস্ট রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার। জেল থাকে বেরনোর সময়ে তাঁকে পরামর্শ দেওয়া হয় শান্তিপুরের সিপিআই(এম) সংগঠক কালাচাঁদ দালালের সঙ্গে দেখা করার। কারণ কালাচাঁদ দালাল তাত্ত্বিকভাবে খুবই অগ্রণী কমরেড, খোদ রাজ্য কমিটির নেতারা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেন।
শান্তিপুরের সাহাপাড়া হল তাঁতিদের পাড়া। যে-বাড়ির ঠিকানা ছিল, সেখানে গিয়ে কালাচাঁদ দালালের খোঁজ করতে অতীব সাধারণ চেহারার যে-মানুষটি বসে তাঁত চালাচ্ছিলেন, বললেন যে তিনিই কালাচাঁদ। অজয় চমকেছিলেন বটে! একজন তাত্ত্বিক, দাপুটে নেতাকে তিনি এভাবে মোটেই কল্পনা করে আসেননি। একটু হতাশও কি হয়েছিলেন তিনি? হলেও, তা মুছে যেতে বেশি সময় লাগেনি। মার্কসীয় তত্ত্বজ্ঞানে কালাচাঁদের গভীরতা ছিল নিখাদ। অজয় এবং তাঁর কালাদা— অচিরেই একে অন্যের ছায়াসঙ্গী হয়ে উঠলেন। অগ্নিগর্ভ সত্তরেও তাঁদের পথের বাঁকবদল ঘটল হাতে হাত রেখেই। নকশালবাড়ি-পরবর্তী সময়ে নতুন পার্টি গড়ে উঠলে দু’জনেই আবার নতুন পথে চলা শুরু করলেন নতুন উদ্যমে। কালাচাঁদ দালালের সঙ্গে রাজনৈতিক আলোচনা করতে চারু মজুমদার নিজে গিয়েছিলেন শান্তিপুরে।
অসম্ভব নরম মনের মানুষ কালাচাঁদ ঠিক ততটাই দৃঢ় ছিলেন রাজনৈতিক বিশ্বাস ও যাপনে। শান্তিপুরের শহীদ শম্ভুনাথ সরকারের ভাই স্মৃতিচারণ করছেন— ‘আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত খারাপ।… দাদা সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দিলে বিষয়টা প্রাথমিকভাবে আমাদের ভালো লাগেনি। ধীরে ধীরে অজয় ভট্টাচার্য আর কালাচাঁদ দালাল তাঁদের ব্যবহারে আমাদের জয় করেন। তাঁদের দেখতাম আর মনে মনে ভাবতাম, বামপন্থী রাজনীতি এত স্বচ্ছ, এত সুন্দর! আত্মসমালোচনার মধ্য দিয়ে আত্মশুদ্ধির অসামান্য ক্ষমতা ছিল কালাচাঁদ দালালের। একটা ঘটনা বলি। তখন বর্ষাকাল। অজয় ভট্টাচার্য, কালাচাঁদ দালাল, মধুসূদন চ্যাটার্জী আর শম্ভুনাথ সরকার আশ্রয় নিয়েছিলেন এক কৃষক পরিবারে। উঠোনে এক জায়গায় একটা হাপর দেওয়া ছিল। কেউ একজন সেখানে মাড়িয়ে দেয়। কালাচাঁদ দালাল চিন্তা করে দেখে সিদ্ধান্তে আসেন যে এ-কাজ তাঁদের মধ্যেই কারোর। কথা উঠতে অজয় ভট্টাচার্য বলেন, এই কাজ তিনিই করে ফেলেছেন। কালাচাঁদ দালাল তাঁকে কৃষক পরিবারটির কাছে ভুল স্বীকার করতে বলেন। কৃষক পরিবারের সদস্যদের ডেকে নিজেদের ভুল স্বীকার করতে পরিবারটির সদস্যরা তো অবাক। আজকে এই ছোট ভুলের জন্য যদি আত্মসমালোচনা না-করা হয়, তবে আগামী দিনে তা আরো বড় কোন অন্যায়ের দিকে এগিয়ে দেবে। সেই দিন কিন্তু কৃষক পরিবারটিতে আর তাঁদের আশ্রয় হবে না। এই ছিলেন কালাচাঁদ দালাল।’
কালাচাঁদ স্বভাবকবি, গীতিকবিতা লিখতেন। সেগুলিকে ‘গীত’ বলতেন তিনি। নিজেই সুর দিতেন, শোনাতেনও দুঃখী মানুষজনকে। প্রথমদিকে তার ধরন এরকম:
ভাঙ্গা মেঘ আর ভাঙ্গা চাঁদ
করে লুকোচুরি খেলা
খর নদী পরে তরী বেয়ে যাই
মুক্তির পাল তোলা
করে লুকোচুরি খেলা⋯⋯
ঝরাপাতা আজ যাক ঝরে যাক
নতুনের আজ বান ডেকে যাক
দূষিত বাতাস দূরে চলে যাক
সাথে যাক ধুলাগুলা।
কিন্তু অচিরেই নিজের গীতকে করে তুললেন সরাসরি রাজনীতি-শিক্ষার অস্ত্র:
ভাল করে পড়গা যা
মার্কসইজিমের পাঠশালে,
সেথা মার্কস এঙ্গেল্স লেনিন ষ্ট্যালিন
(এখন) মাও সেতুং-এ দীপ জ্বালে৷
আমরা ১৯৭২ সালের ৩ মে-র গল্প বলব। অজয় ভট্টাচার্য, কালাচাঁদ দালাল, মধুসূদন চ্যাটার্জী আর শম্ভুনাথ সরকার— এই চার কমরেড শান্তিপুরে রেলওয়ে গেটের কাছে এক আমবাগানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। খাবার পৌঁছে দেওয়ার নাম করে অ্যান্টি-নকশাল স্কোয়াডের দু’জন পুলিশের কাছে সে-খবর পৌঁছে দিয়েছিল। বিশাল পুলিশবাহিনী বাগান ঘিরে ফেলে গুলি চালাতে শুরু করে। অজয়ের পায়ে প্রথম গুলিটা লাগলে তাঁকে আমগাছে তুলে দিয়ে পাল্টা আক্রমণ শুরু করেন তাঁরা। পুলিশ মাইকে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেয়। রক্তাক্ত বিপ্লবীরা উত্তরে বজ্রকন্ঠে তোলা স্লোগানে জানিয়ে দেন— ‘ভারতবর্ষে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতে দেখতে আমরা মৃত্যুবরণ করছি। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।’ যুদ্ধ জারি থাকে, যতক্ষণ না পুলিশের গুলি চারজনকেই পুরো ঝাঁঝরা করে দেয়। এরকম অনমনীয় আত্মত্যাগের সামনে পুলিশরাও হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিল।
ওই যে দেখুন, কতজন পুলিশ ওঁদের মৃতদেহ ঘিরে দাঁড়িয়ে টুপি খুলে নির্দ্বিধায় সম্মান জানাচ্ছেন এই শাহাদাতকে! আর কিছুক্ষণের মধ্যে শান্তিপুর জুড়ে কারফিউ শুরু হবে। মানুষের ঢেউ নামবে এক্ষুনি তাদের প্রিয় মানুষগুলিকে একবার দেখার জন্য। মানুষের ঢেউ…। কালাচাঁদের জন্য কেউ কি একটা গীত লিখবেন না?
ঋণস্বীকার: এবং জলার্ক প্রকাশিত ‘সত্তরের শহীদ লেখক শিল্পী’ এবং ‘সত্তরের শহীদ’
…পড়ুন কবি ও বধ্যভূমি…
পর্ব ১৯: আমাকে দেখাও সেই বন্দিকক্ষ
পর্ব ১৮: কতটা দীর্ঘ হলে জনযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয়? (২য়)
পর্ব ১৭: কতটা দীর্ঘ হলে জনযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয়? (১ম)
পর্ব ১৬: পারো যদি বজ্র হয়ে এসো
পর্ব ১৫: কামানের মুখে কলহাস্যে এ কী ভালোবাসা!
পর্ব ১৪: গান্ধিনগরে রাত্রি
পর্ব ১৩: সিলারের পাপড়ি অথবা একজন পেশমেরগার মৃত্যু
পর্ব ১২: ডানার পালকে সূর্যকে নিয়ে…
পর্ব ১১: প্রিয় কমরেড, এসো একসাথে মরি
পর্ব ১০: প্রাণভিক্ষা? বেছে নিই মৃত্যুর অহংকার বরং!
পর্ব ৯: তিমিরের অন্তে যদি তিমিরবিনাশ
পর্ব ৮: অক্সিজেন মৃতদের জন্য নয়!
পর্ব ৭: আকাশে তারারা জ্বলছে, ফ্যলাস্তিনকে ভয় দেখিও না!
পর্ব ৬: কোথায় লুকোবে কালো কোকিলের লাশ?
পর্ব ৫: আমার দুঃখের কথা কি পাথরকে বলব?
পর্ব ৪: আমি সেই মেয়ে, যে আর ফিরবে না
পর্ব ৩: আমাকে পোড়াতে পারো, আমার কবিতাকে নয়!
পর্ব ২: এস্তাদিও চিলে আর চল্লিশটা বুলেটের ক্ষত
পর্ব ১: বিপ্লব, প্রেম ও কবিতাকে আমৃত্যু আগলে রেখেছিলেন দ্রোণাচার্য ঘোষ
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved