সন্ধ্যায় ভারত-সোভিয়েত সংস্কৃতি সমিতিতে যথারীতি রুশ ভাষার ক্লাস নিচ্ছি, এমন সময় খবর পেলাম কে একজন আমার সঙ্গে দেখা করতে চান, সমিতির অফিসঘরে অপেক্ষা করছেন। ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে ননীদাকে দেখে আমি তো অবাক। আমাকে দেখে হেসে বললেন, ‘পর্বত যদি মহম্মদের কাছে না আসে, তাহলে মহম্মদই পর্বতের কাছে যাবে। তুমি তো এলে না, তাই আমাকেই আসতে হল।’
২০.
মস্কোর হাতছানি
কলকাতায় থাকতে রুশ ভাষার শিক্ষকতার সূত্রে আবার মস্কো যাওয়ার সুযোগ মিলে গেল ১৯৬৯ সালে। রুশ ভাষার শিক্ষকদের আন্তর্জাতিক সেমিনারে যোগদানের আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম তখন। মাসখানেকের মেয়াদ। এবারেও নানা ঝামেলায় ননীদার সঙ্গে বার চারেকের বেশি সাক্ষাতের সুযোগ হয়নি। তবে তাঁর বাড়িতে প্রতিবারই পেয়েছি উৎসবের পরিবেশ, তাঁর আন্তরিকতার ও দরাজ-দিলের পরিচয়, প্রতিবারই তাঁর বাড়িতে ঘটেছে নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয়।
১৯৭১-এর শীতকাল। খুব সম্ভব ডিসেম্বর মাস। খবর পেলাম ননীদা কলকাতায় এসেছেন ছুটিতে। এবারে উনি একাই এসেছেন, বউদি আসতে পারেননি। উঠেছেন বিবেকানন্দ রোডে দিদির বাড়িতে। জনৈক বন্ধুর মুখে শুনলাম, ননীদা নাকি আমাকে খুঁজছেন। ব্যাপার জিজ্ঞেস করতে বন্ধুবর হেসে বললেন, ‘‘আর কী, এবারে মস্কো যাওয়ার জন্য তৈরি হন। ‘প্রগতি প্রকাশন’-এর জন্য অনুবাদক চাই বলেছিলেন ননীদা। সরাসরি রুশ থেকে অনুবাদ করতে হবে। এমন লোক তখন ওখানে ননী ভৌমিক ছাড়া আর কেউ নেই। আমরা আপনার নাম করতে ননীদা সাগ্রহে বললেন, ‘ওকে পেলে তো ভালোই হয়।’’
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
তখন সোভিয়েত বার্তা বিভাগের অফিস ছিল উড স্ট্রিটে। বিভাগের প্রধান ছিলেন মরোজ্ভ। ওঁকে আমি চিনতাম। ওঁর স্ত্রীকে আমি সেই সময় বাংলা শেখাতাম। ভদ্রমহিলা ভালো রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন। তবে কণ্ঠস্বর যেহেতু সপ্রানোতে বাঁধা, তাই চড়া পর্দায় তার গলা ভালো খেলত। আমাকে দিয়ে রবীন্দ্রসংগীতের ওপর বাংলায় লেখা বেশ কিছু বই, প্রবন্ধ ইত্যাদি অনুবাদও করিয়ে নিতেন। পরবর্তীকালে তিনি তাঁর নিজের দেশে রবীন্দ্রসংগীত বিশেষজ্ঞ হিসেবে নামও করেছিলেন।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
বিবেকানন্দ রোডের বাড়ির ঠিকানাটা পেলাম বটে, কিন্তু আমার চিরাচরিত আলস্যের দরুন ‘আজ যাব কাল যাব’ করে কিছুতেই আর যাওয়া হয়ে উঠল না। সেদিন সন্ধ্যায় ভারত-সোভিয়েত সংস্কৃতি সমিতিতে যথারীতি রুশ ভাষার ক্লাস নিচ্ছি, এমন সময় খবর পেলাম কে একজন আমার সঙ্গে দেখা করতে চান, সমিতির অফিসঘরে অপেক্ষা করছেন। সেই মুহূর্তে অফিসঘরে যারা ছিল, তারা সব অল্পবয়সি ছেলেমেয়ে, ননীদার সঙ্গে চাক্ষুষ পরিচয় এদের কারওরই নেই। ননীদাও তাদের কাছে নিজের পরিচয় দেননি। ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে ওঁকে দেখে আমি তো অবাক! আমাকে দেখে হেসে বললেন, ‘পর্বত যদি মহম্মদের কাছে না আসে, তাহলে মহম্মদই পর্বতের কাছে যাবে। তুমি তো এলে না, তাই আমাকেই আসতে হল।’ আমি, বলাই বাহুল্য, লজ্জিত, অভিভূতও। কিন্তু কোন অনুভূতিটা তখন বেশি কাজ করছিল, বলা কঠিন। কাজের কথা পাড়লেন। আমি যেন হাতে স্বর্গ পেয়ে গেলাম।
এটাই তো চাইছিলাম এতদিন! অথচ এই সুযোগটাই কিনা হেলায় হারাতে বসেছিলাম।
ননীদার কথামতো কলকাতার সোভিয়েত দূতস্থানের বার্তা বিভাগ থেকে টেস্ট কপি হিসেবে রুশ ভাষায় লেখা একটা গদ্যাংশ দিতে হবে। সেটা অনুবাদ করে ওখানে জমা দিলে পরীক্ষা করে দেখার জন্য মস্কোয় ‘প্রগতি প্রকাশন’-এর অফিসে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। ননীদা বললেন জমা দেওয়ার আগে একবার যেন ওঁকে দেখিয়ে নিই।
তখন সোভিয়েত বার্তা বিভাগের অফিস ছিল উড স্ট্রিটে। বিভাগের প্রধান ছিলেন মরোজ্ভ। ওঁকে আমি চিনতাম। ওঁর স্ত্রীকে আমি সেই সময় বাংলা শেখাতাম। ভদ্রমহিলা ভালো রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন। তবে কণ্ঠস্বর যেহেতু সপ্রানোতে বাঁধা, তাই চড়া পর্দায় তার গলা ভালো খেলত। আমাকে দিয়ে রবীন্দ্রসংগীতের ওপর বাংলায় লেখা বেশ কিছু বই, প্রবন্ধ ইত্যাদি অনুবাদও করিয়ে নিতেন। পরবর্তীকালে তিনি তাঁর নিজের দেশে রবীন্দ্রসংগীত বিশেষজ্ঞ হিসেবে নামও করেছিলেন। মস্কোতে আমার প্রথম বছরের ছুটিতে মস্কো এসে মরোজভ্ আমার বাসায় এসেছিলেন, সেদিন ননীদাও এসেছিলেন।
সে যাই হোক, মরোজভের কাছে টেক্সট চাইতে উনি বললেন, ও, ননী ভৌমিক বলেছেন। তাইলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হও। আমি আরও ভরসা পেয়ে গেলাম, এবারে আর দেরি নয়। অনুবাদ শেষ করেই একদিন ভোরবেলা ছুটলাম ননীদার কাছে। বাড়ি খুঁজে বের করে পৌঁছতে পৌঁছতে বেলা দশটা বেজে গেল। আমার সন্দেহ হচ্ছিল, এত বেলায় ওঁকে পেলে হয়। এসে শুনি ননীদা তখনও শয্যাত্যাগ করেননি। অস্বস্তি বোধ করলাম। কিন্তু উনি খবর পেয়ে শোওয়ার ঘরেই আমাকে ডেকে পাঠালেন। দরজা-জানলা বন্ধ করে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়েছিলেন। শুয়ে শুয়েই নস্যি নিতে নিতে আমার লেখাটা পড়লেন। বললেন, ‘ভালোই হয়েছে। জমা দিয়ে দাও। মস্কোতে পাঠিয়ে দেবে ওরা। তারপর দেখা যাবে।’
এই সময়, পূর্বাপর দেখে-শুনে আমার যেটা মনে হয়েছিল তা এই যে, অনুবাদক নির্বাচনের পদ্ধতিও যেন বেশ খানিকটা পাল্টে গেছে। প্রথম প্রথম অনুবাদক নেওয়া হত দিল্লির সোভিয়েত দূতাবাসের মাধ্যমে। কিন্তু ১৯৫৬ সাল থেকে ভারত সরকারের বিদেশ মন্ত্রকের একটি কমিটির ওপর সে নির্বাচনের ভার দেওয়া হয়– নাম নির্বাচিত হয়ে গেলে যথারীতি পুলিশি তদন্তের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হত। সুভাষদা ও দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের নাম সম্ভবত এখানেই কোথাও আটকে গিয়েছিল, কিন্তু আমাদের সময় ওরকম কোনও কমিটি ছিল না, আর পুলিশি তদন্তের ব্যাপারটা কেবল এই পাসপোর্ট পাওয়ার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল। অর্থাৎ, নিয়োগ মস্কোর প্রকাশভবনের ওপরই পুরোপুরি নির্ভর করত। এমনকী, অনেক সময় স্থানীয় ছাত্রী যারা ওদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করেছে, তাদের মধ্য থেকেও অনুবাদক নিয়োগ করা হত। আর এই নিয়োগের ক্ষেত্রে সেদিন কেন, পরেও বেশ কিছুদিন পর্যন্ত প্রগতির বাংলা বিভাগে ননীদাই শেষ কথা বলে আমার মনে হয়েছিল।
সেদিন ননীদা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কতটা সময় লেগেছে অনুবাদ করতে। আমি বললাম। শুনে হিসেব করে বললেন, ‘তাহলে তো কোটিপতি হয়ে যাবে হে! হাঃ হাঃ হাঃ।’ আমি একটু থতমত খেয়ে গেলাম। সেই প্রথম জানতে পারলাম ধরাবাঁধা মাইনে বলতে যা বোঝায়, ওখানকার প্রকাশ সংস্থায় তা নেই। কাজের পরিমাণ হিসেবে মাইনে। এরা বলে ফুরনের কাজ। শুনে একটু ধন্ধে পড়ে গেলাম।
…পড়ুন রুশকথার অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১৯। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় নাকি খুব ভালো রুশভাষা জানতেন, প্রমথনাথ বিশী সাক্ষী
পর্ব ১৮। লেডি রাণু মুখার্জিকে বাড়ি গিয়ে রুশ ভাষা শেখানোর দায়িত্ব পড়েছিল আমার ওপর
পর্ব ১৭। একদিন হঠাৎ সুভাষদা আমাদের বাড়ি এসে উপস্থিত ফয়েজ আহমেদ ফয়েজকে নিয়ে
পর্ব ১৬। মুখের সেই পরিচিত হাসিটা না থাকলে কীসের সুভাষ মুখোপাধ্যায়!
পর্ব ১৫। রুশ ভাষা থেকেই সকলে অনুবাদ করতেন, এটা মিথ
পর্ব ১৪। মস্কোয় ননীদাকে দেখে মনে হয়েছিল কোনও বিদেশি, ভারতীয় নয়
পর্ব ১৩। যিনি কিংবদন্তি লেখক হতে পারতেন, তিনি হয়ে গেলেন কিংবদন্তি অনুবাদক
পর্ব ১২। ‘প্রগতি’ ও ‘রাদুগা’র অধঃপতনের বীজ কি গঠনপ্রকৃতির মধ্যেই নিহিত ছিল?
পর্ব ১১। সমর সেনকে দিয়ে কি রুশ কাব্যসংকলন অনুবাদ করানো যেত না?
পর্ব ১০। সমর সেনের মহুয়ার দেশ থেকে সোভিয়েত দেশে যাত্রা
পর্ব ৯। মস্কোয় অনুবাদচর্চার যখন রমরমা, ঠিক তখনই ঘটে গেল আকস্মিক অঘটন
পর্ব ৮: একজন কথা রেখেছিলেন, কিন্তু অনেকেই রাখেননি
পর্ব ৭: লেনিনকে তাঁর নিজের দেশের অনেকে ‘জার্মান চর’ বলেও অভিহিত করত
পর্ব ৬: যে-পতাকা বিজয়গর্বে রাইখস্টাগের মাথায় উড়েছিল, তা আজ ক্রেমলিনের মাথা থেকে নামানো হবে
পর্ব ৫: কোনটা বিপ্লব, কোনটা অভ্যুত্থান– দেশের মানুষ আজও তা স্থির করতে পারছে না
পর্ব ৪: আমার সাদা-কালোর স্বপ্নের মধ্যে ছিল সোভিয়েত দেশ
পর্ব ৩: ক্রেমলিনে যে বছর লেনিনের মূর্তি স্থাপিত হয়, সে বছরই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার সূচনাকাল
পর্ব ২: যে দেশে সূর্য অস্ত যায় না– আজও যায় না
পর্ব ১: এক প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে রাশিয়ার খণ্ডচিত্র ও অতীতে উঁকিঝুঁকি
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved