চাটের শুরু কোথা থেকে বলা খুব শক্ত। ইশকুলে পড়ার সময় জেনেছি, মোগল বাদশা শাহজাহান তৈরি করেছেন তাজমহল। পরে এক সময় জেনেছিলাম, বাদশার স্ত্রী মমতাজ মহল আজকের বিরিয়ানির নেপথ্যে। হালে জানলাম, শাহজাহানের জন্যে প্রথম চাট তৈরি হয়েছিল। বাদশা নাকি একবার অসুখে ভুগে এমন কাবু হয়েছিলেন যে, কোনও খাবারের স্বাদ পাচ্ছিলেন না মুখে। শাহি হাকিম তখন মশলাদার খাবার খাইয়ে বাদশার মুখের স্বাদ ফেরান– আর সেখান থেকেই চাটের উৎপত্তি।
২১.
সকালের জলখাবার, ইশকুল বা অফিস থাকলে দুপুরের টিফিন আর বাড়িতে থাকলে মধ্যাহ্নভোজ, আর রাতের খাবার– এই তিনটে হল মিল। আর এর বাইরে বিকেলে একপ্রস্থ খাওয়া হত। কখনও বুলবুলভাজা, কখনও ঘটি-গরম, আলুকাবলি, ফুচকা ইত্যাদি। চিরকাল জেনে এসেছি, এইসব স্ন্যাক্স খাওয়ার ওপরে কিছু বিধিনিষেধ আছে। কারণ, এদের সঙ্গে স্বাস্থ্যের এক ধরনের শত্রুতা আছে। যদিও যা কিছু খেয়ে আঙুল চাটতে হয়, সেটাই চাট আর সেই কারণে এই খাবারগুলো চাট হিসেবে কৌলীন্যের দাবিদার ছিল। তবু ‘চাট’ কথাটা বাঙালি সমাজে বিশেষ ব্যবহার হত না, কথাটার মধ্যে এক নিষিদ্ধ আনন্দ আছে। বাঙালি বাড়িতে ভাত-ডালের সঙ্গে চাটের সম্পর্ক বিয়ে করা বউ আর প্রেমিকার মতো– একজনকে সমাজ স্বীকৃতি দিয়েছে আর একজনকে মন। দু’জনার মধ্যে একেবারেই বনিবনা নেই। কারণ, সন্ধের পরে রঙিন জল নিয়ে আহ্নিকে বসলে পার্ক স্ট্রিটে যা স্ন্যাক্স, খালাসিটোলা বা পাড়ার ঠেকে সেটা ‘চাট’ হয়ে যেত। তাই আমাদের কাছে চাট মানে ডিমের ভুজিয়া, মুরগির গিলা, মেটের চচ্চড়ি ছিল। সেগুলো খেতে ভালো, কিন্তু খেয়ে আঙুল চাটতে হয় কি? তাই এদের চাট না বলে টাক্না বলা ভালো– তাতে চাটের সম্মান থাকে, বাড়িতে শান্তি থাকে।
ডালহৌসিতে দুপুরবেলায় যে চিলরা বা চানা সামোসা খেয়েছি বহুবার, সেটা যে চাট পরিবারের সদস্য, তা শালপাতা চাটা থেকেই বোঝা যায়। গুজরাতে থাকার সময় জানলাম চাট আদপে কুলীন ব্রাহ্মণ, তাই চাট-কুলের সদস্য গুনে শেষ করা যায় না, আর তাদের প্রতাপও অপরিসীম। পশ্চিমে সূর্যাস্ত দেরিতে হয়, সেখানে সূর্যাস্তের ঠিক পরেই ডিনার খেয়ে নেওয়া দস্তুর। আটটার সময় ডিনার করে আবার রাত সাড়ে এগারোটা-বারোটা নাগাদ খিদে পেয়ে যায়, তাই বাড়ি থেকে সবাই বেরিয়ে পড়ে চাট খেতে। মিক্সড চাট, রাজ কচোরি চাট থেকে বিভিন্ন চাটের দোকান সেখানে জেগে ওঠে রাত দশটা থেকে আর রাত দুটো অবধি সেইসব দোকানে ভিড়। সেখানে সকাল দেরিতে হয়, রাত বারোটায় চাট খেয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে যায় লোকে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
জেনারেল সাহেব সন্ধেবেলা ভেলপুরি পরিবেশন করতে বললে হ্যারল্ড কাঁচুমাচু হয়ে বললেন সেদিনের মতো ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খেয়ে নিতে, কারণ তিনি রেসিপি জোগাড় করতে পারেননি। ক্ষিপ্ত জেনারেল সটান গুলি চালিয়ে দিয়েছিলেন হ্যারল্ডের ওপর– সেখানেই মারা যান হ্যারল্ড।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
চাটের শুরু কোথা থেকে বলা খুব শক্ত। ইশকুলে পড়ার সময় জেনেছি, মোগল বাদশা শাহজাহান তৈরি করেছেন তাজমহল। পরে এক সময় জেনেছিলাম, বাদশার স্ত্রী মমতাজ মহল আজকের বিরিয়ানির নেপথ্যে। হালে জানলাম, শাহজাহানের জন্যে প্রথম চাট তৈরি হয়েছিল। বাদশা নাকি একবার অসুখে ভুগে এমন কাবু হয়েছিলেন যে, কোনও খাবারের স্বাদ পাচ্ছিলেন না মুখে। শাহি হাকিম তখন মশলাদার খাবার খাইয়ে বাদশার মুখের স্বাদ ফেরান– আর সেখান থেকেই চাটের উৎপত্তি। আরেকটা মত শোনা যায়, চাটের উৎপত্তি নিয়ে– কিন্তু সেটাও শাহজাহানের আমলেই ঘটেছিল। পুরনো দিল্লির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া যমুনার জল ক্ষারীয় উপাদান খুব বেশি হওয়ায় পানের উপযুক্ত ছিল না। বাদশার আমলে একবার অনাবৃষ্টিতে এমন জলাভাব হল যে, সাধারণ মানুষ বাধ্য হয়ে যমুনার জল খেতে শুরু করল। আর ফলে যা হওয়ার তাই হল। প্রচুর লোক অসুস্থ হয়ে পড়ল। এই মহামারীর প্রতিষেধক হিসেবে নবাবের বৈদ্যরা নিদান দিল, মশলাদার আর ভাজা খাবার খেতে– সম্ভব হলে দইয়ের সঙ্গে খেতে। সেই যাত্রায় এই খাবার দিল্লিবাসীর প্রাণ বাঁচিয়েছিল– আর সময়ের সঙ্গে শুধু দিল্লি নয়, পুরো উত্তর ভারতে ছড়িয়ে পড়ল চাট হিসেবে। আবার সেই বিরিয়ানির ইতিহাসের মতো গোলমেলে ব্যাপার– সেই শাহজাহানের সঙ্গেই আবার আচাইয়া সাহেব খুঁড়ে বের করেছেন ২৫০০ বছর আগেও দইবড়া ছিল!
ইংল্যান্ডের রাজপুরুষরা পারতপক্ষে ভারতবর্ষে আসত না– এই দেশ ছিল ইংল্যান্ডের নিম্ন-মধ্যবিত্তদের স্বর্ণখনি, বড়লোক হওয়ার জায়গা। ইংল্যান্ডের নামী শেফ উইলিয়াম হ্যারল্ড এদেশে এসেছিলেন সেনাদলে উচ্চপদে সামিল হয়ে এক ব্রিটিশ জেনারেলকে ভালো-মন্দ খাইয়ে তাঁদের মেজাজ শরিফ রাখতে। সেই জেনারেল কোথাও গিয়ে এক ভারতীয় স্ন্যাক্স খেয়ে খুশমেজাজ হয়ে গিয়েছিলেন আর হ্যারল্ডকে ফরমান জারি করেছিলেন, সেই স্ন্যাক্স আবার খাওয়াতে। খবর নিয়ে হ্যারল্ড জানতে পারলেন, জেনারেল সাহেব ভেলপুরি খেয়েছিলেন, তাই তিনি বেরলেন রেসিপির সন্ধানে। কিন্তু এই পদের তো নির্দিষ্ট রেসিপি নেই, তাই তিনি ফিরলেন হরেক রকম রেসিপি নিয়ে। জেনারেল সাহেব সন্ধেবেলা ভেলপুরি পরিবেশন করতে বললে হ্যারল্ড কাঁচুমাচু হয়ে বললেন সেদিনের মতো ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খেয়ে নিতে, কারণ তিনি রেসিপি জোগাড় করতে পারেননি। ক্ষিপ্ত জেনারেল সটান গুলি চালিয়ে দিয়েছিলেন হ্যারল্ডের ওপর– সেখানেই মারা যান হ্যারল্ড। অন্যান্য অফিসার প্রবল বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল জেনারেলের এই নৃশংসতায়। জেনারেলকে অপসারণ করা হয় এই ঘটনার পরে।
বাংলার প্রিয় ঝালমুড়ি নিয়ে অবশ্য খুনোখুনি নেই। মুড়ির সঙ্গে বাঙালির দোস্তি কবে থেকে, তার হিসেব করা মুশকিল। বিকেলে একধামা মুড়ি তেলে মেখে পেঁয়াজ আর কাঁচালঙ্কা কামড়ে খাওয়া গ্রামের দিকে একশো বছর আগেও দেখা যেত। বিহারিরা এই মুড়িতে বিভিন্ন মশলা, পেঁয়াজ আর শশা কুচি, বাদাম আর ছোলা মিশিয়ে আরও উপাদেয় করে তুলল– নতুন এই আইটেমের নাম হল ‘ঝালমুড়ি’। এই ঝালমুড়ি এতটাই হিট হল যে, খোদ লন্ডনে সাহেব-কূল চাকরি ছেড়ে ঝালমুড়ি বেচছে!
লখনউ-র এমজি রোডে বাস্কেট চাট খেতে খেতে আশপাশে চাটের দোকানে ভিড় দেখছিলাম আর চাটের রকমারি ভাবছিলাম। চাট শেষ হয়ে যেতে পাত্রটা ফেলতে যাব– পাশের মানুষ আটকাল– ‘ফেলছ কী! এটাও চাট!’
…ভাজারদুয়ারি-র অন্যান্য পর্ব…
ভাজারদুয়ারি পর্ব ২০: নর্স ভাষায় ‘কাকা’ নামে এক ধরনের রুটি ছিল, যা আজকের কেকের পূর্বপুরুষ
ভাজারদুয়ারি পর্ব ১৯: গোস্ত কা হালুয়া, বলেন কী!
ভাজারদুয়ারি পর্ব ১৮: আরে, এ তো লিট্টির বৈমাত্রেয় ভাই!
ভাজারদুয়ারি পর্ব ১৭: ল্যাদের সঙ্গে খিচুড়ির অবৈধ সম্পর্ক
ভাজারদুয়ারি পর্ব ১৬: আগুন যখন পবিত্র, ঝলসানো মাংসই সুপারহিট
ভাজারদুয়ারি পর্ব ১৫: শ্রমের বিনিময়ে খাদ্য– এভাবেই তৈরি হয়েছিল বিরিয়ানি
ভাজারদুয়ারি পর্ব ১৪: যে সুস্বাদু জিলিপি আর ফাফরার জন্যে দুরন্ত ষাঁড়ের পিছনেও ছোটা যায়
ভাজারদুয়ারি পর্ব ১৩: শ্রীকৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনামকে টেক্কা দেবে ভাতের বিবিধ নাম
ভাজারদুয়ারি পর্ব ১২: জুয়া-লগ্নে যে খাবারের জন্ম, এখন তা ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে
ভাজারদুয়ারি পর্ব ১১: নারকোলের বিদেশযাত্রা
ভাজারদুয়ারি পর্ব ১০: সন্দেশের ব্যাপারে একটি জরুরি সন্দেশ
ভাজারদুয়ারি পর্ব ৯: আলু গোল বলে আলুর চপকেও গোল হতে হবে নাকি?
ভাজারদুয়ারি পর্ব ৮: পা দিয়ে ময়দা মেখে রুটি বানানো হয় বলে নাম পাউরুটি, এ এক্কেবারেই ভুল কথা!
ভাজারদুয়ারি পর্ব ৭: যুদ্ধক্ষেত্রে রুটির ওপরে চিজ আর খেজুরই আজকের পিৎজা
ভাজারদুয়ারি পর্ব ৬: পান্তা ভাতে টাটকা বেগুনপোড়া
ভাজারদুয়ারি পর্ব ৫: ইউরোপের ক্রেপ-কে গোলারুটির চ্যালেঞ্জ
ভাজারদুয়ারি পর্ব ৪: ২০০ পরোটা কোন রাক্ষসে খায়!
ভাজারদুয়ারি পর্ব ৩: হাজার বছর পার করেও বাসি হয়নি শিঙাড়ার যাত্রা
ভাজারদুয়ারি পর্ব ২: পাড়ার মোড়ের দোকানের চপ-তেলেভাজা হচ্ছে টিভি সিরিয়াল
ভাজারদুয়ারি পর্ব ১: বাঙালি তেলে ভাজবে না ঘি-এ ভাজবে?