পিঠে-পুলির অতীত আর বর্তমান নিয়ে পড়ে যারা মনে দুঃখ মেখে মুঠোফোনে ইতু সংক্রান্তি আর পৌষ সংক্রান্তির খাবারদাবার নিয়ে পড়াশুনা শুরু করে দিয়েছেন, কিংবা যাঁরা নিরামিষ খাবার সামনে দেখলে টক্ করে উদাসীন হয়ে যান আর খিদে চলে যায়, তাঁদের জন্যে সুখবর– আমিষ চর্বির পিঠে এই মরশুমে বেশ কিছু বছর ধরে ছক্কার পর ছক্কা মারছে। এই পিঠের সঙ্গে কোরবানির ইদের একটা যোগ আছে, কারণ এর শুরু ঈদ-উল-আধা-র পর জমে যাওয়া চর্বি থেকে।
২২.
সামনেই পৌষ সংক্রান্তি। স্মৃতি-মেদুর বাঙালি বছরের এই সময়টায় সালতামামিতে বসে ছোটবেলায় রান্নাঘরে উনুনের পাশে বসে পিঠে ভাজা আর নতুন গুড়ের গন্ধ খোঁজে; বাড়িতে পিঠে বানানোর ঝক্কি আজকাল প্রায় কেউই নেয় না। ফ্ল্যাট বাড়ির মডিউলার কিচেনের এগজস্ট বেয়ে পিঠের গন্ধ বাইরে ছড়ালে স্মৃতির ঝাঁজে প্রতিবেশীদের চোখে জল চলে আসে আর তাতে নানাবিধ অশান্তি তৈরি হয়– তাই পাড়ার মিষ্টির দোকানে খবর নেয় পাটিসাপটা আর দুধ-পুলি কবে থেকে পাওয়া যাবে।
পৌষ মাস পিঠে খাওয়ার মাস– এই কথাটা আমাদের মনের মধ্যে যতই গেড়ে বসুক, আদপে পিঠে খাওয়া শুরু হয় অগ্রহায়ণের শুরু থেকে আর পিঠের পরব শেষ হয় পৌষ সংক্রান্তিতে। নতুন ধান উঠত এই অগ্রহায়ণ মাসে। বাংলা চিরকালই শস্য-প্রধান দেশ, সেখানে বছরের সেরা ধানটা ওঠার সঙ্গে সবাই আনন্দে মেতে উঠত আর নতুন বছরের যাত্রা শুরু হত এই মাস থেকে। আজও যে কারণে বাংলা মেতে ওঠে নবান্ন উদযাপন করতে।
পুজোর রেশ চলে কার্তিক মাস পর্যন্ত– কার্তিকের মাঝামাঝি হিম পড়তে শুরু হয়ে যায় রাতে। বারো মাসে তেরো পার্বণের বাংলা আবার উৎসবে মেতে উঠত অগ্রহায়ণের শুরুতে। আজও পূর্ব বর্ধমান জেলা আর তার সংলগ্ন বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, হুগলি, নদিয়া আর পশ্চিম বর্ধমানের গ্রামগুলো মেতে ওঠে নবান্ন উদযাপন করতে। পূর্ববাংলায় নবান্ন প্রায় এক জাতীয় উৎসব– পয়লা অগ্রহায়ণে বিশাল ঘটা করে নবান্ন উদযাপন করা হয় দেশের কোনায় কোনায়। ঢেঁকিতে ছাঁটা নতুন চাল শিলনোড়ায় বেটে, তাতে দুধ আর বাড়ির খেজুর গাছের জিরন রস থেকে বানানো নলেন গুড় মেখে নবান্ন তৈরি হত– কখনও এর সঙ্গে নারকেল কোরা আর সন্দেশ মিশিয়ে দেওয়া হত আরও সুস্বাদু করতে। দিদিভাইয়ের কাছে শুনেছি তার ছোটবেলায় দেখা নবান্নর কথা। ঠাকুরমা নবান্ন বানিয়ে কলাপাতায় বেড়ে দিদিভাইকে দিতেন আর দিদিভাই তা নিয়ে দৌড়ে বাড়ির বিভিন্ন প্রান্তে রেখে আসত। পুকুরপারে কলাপাতা ভাসিয়ে বলত, ‘মাছ, তোমাদের নবান্ন দিলাম, সবাই মিলে খেও’, গোয়ালঘরে নবান্ন রেখে বলত, ‘গরু তোমাকে নবান্ন দিলাম, বাছুরদের দিয়ে খেও’, বাড়ির বাগানে রেখে বলত, ‘গাছ তোমাদের নবান্ন দিলাম, পাখিদের দিয়ে খেও’। এইভাবে রান্নাঘর, কুয়োতলার মতো বিভিন্ন জায়গায় নবান্ন রেখে আসার পর দিদিভাই নবান্ন খেতে পারত। তারপর শুরু হত পাড়া-প্রতিবেশীদের বাড়ি গিয়ে নবান্ন দিয়ে আসার কাজ। নবান্ন তৈরি হয়ে গেলে তারপর শুরু হত এক এলাহি ভোজের আয়োজন– বিভিন্ন ভাজা আর মরশুমি সবজি দিয়ে রান্না সেই ভোজের শেষপাতে থাকত বিভিন্ন রকমের পিঠে-পুলি; আস্কে পিঠে, দুধ পুলি, ভাজা পিঠে থেকে গোকুলপিঠে– কিছুই বাদ থাকত না সেদিনের ভোজে। শীত যত জমিয়ে পড়ে, রাতের মেনু বদলায়। কখনও কড়াইশুঁটির পুর দেওয়া কচুরি আর তার সঙ্গে ছোট ছোট নতুন আলুর দম। কখনও সরুচাকলি আর গরম করা ঝোলা গুড়। ওপার বাংলায় চিতই পিঠে, ফুল পিঠে, পাক্কন আর আরও হরেক রকমের পিঠে বানানো শুরু হয়ে যেত এই সময়ে।
সময় বদলে গেছে, ঢেঁকিতে আর ধান ছাঁটা হয় না– এখন সব রাইস-মিলে হয়। কিন্তু আচার এখনও রয়ে গিয়েছে, এখনও একেকটা গ্রামে একেকদিন নবান্ন, যাতে আশপাশের গ্রামের মানুষ মাসভর নবান্নর আনন্দ নিতে পারে। বড় গ্রামগুলোতে এখনও মেলা বসে। অগ্রহায়ণ আর পৌষ জুড়ে জেলাগুলোতে যে মেলা হয়, এখন সেখানেও পিঠে-পুলি পাওয়া যায়– কিন্তু সেই দোকানে ভিড় কম থাকে, নবান্নর দিন এখনও বিভিন্ন পিঠে বানানো হয়ে থাকে যে! কিন্তু শহরে? পিঠে-পুলি কেবলই পৌষ পার্বণ হয়ে থেকেছে, কারণ অগ্রহায়ণের পিঠে নবান্নর পিঠোপিঠি– শহরে নতুন চাল ওঠার আনন্দ-উদ্দীপনাই বা কোথায়, খেজুর গুড়ের বাসই বা কোথায়, আর শহুরে শীত তো ক্যালেন্ডার দেখে ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে পৌঁছয়, তিন সপ্তাহ বাদে তার ফেরার টিকিট কাটা থাকে। আর শহুরে ব্যস্ততার মধ্যে পৌষ শেষ হওয়ার ঠিক আগে পিঠে খাওয়া– সেই আচার আবার। কিন্তু অন্যভাবে। মেলায় গিয়ে পিঠের দোকানে লাইন দেওয়া এখন দস্তুর– সে শিল্পমেলা হোক কি বইমেলা!
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
পুকুরপাড়ে কলাপাতা ভাসিয়ে বলত, ‘মাছ, তোমাদের নবান্ন দিলাম, সবাই মিলে খেও’, গোয়ালঘরে নবান্ন রেখে বলত, ‘গরু তোমাকে নবান্ন দিলাম, বাছুরদের দিয়ে খেও’, বাড়ির বাগানে রেখে বলত, ‘গাছ তোমাদের নবান্ন দিলাম, পাখিদের দিয়ে খেও’। এইভাবে রান্নাঘর, কুয়োতলার মতো বিভিন্ন জায়গায় নবান্ন রেখে আসার পর দিদিভাই নবান্ন খেতে পারত।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
অনেক মনখারাপের কথা হল। পিঠে-পুলির অতীত আর বর্তমান নিয়ে পড়ে যারা মনে দুঃখ মেখে মুঠোফোনে ইতু সংক্রান্তি আর পৌষ সংক্রান্তির খাবারদাবার নিয়ে পড়াশুনা শুরু করে দিয়েছেন, কিংবা যাঁরা নিরামিষ খাবার সামনে দেখলে টক্ করে উদাসীন হয়ে যান আর খিদে চলে যায়, তাঁদের জন্য সুখবর– আমিষ চর্বির পিঠে এই মরশুমে বেশ কিছু বছর ধরে ছক্কার পর ছক্কা মারছে। এই পিঠের সঙ্গে কোরবানির ইদের একটা যোগ আছে, কারণ এর শুরু ঈদ-উল-আধা-র পর জমে যাওয়া চর্বি থেকে। কিন্তু এখন লোকে অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে খাসির মাংস কিনতে গিয়ে আলাদা করে চর্বি কেনে আর জমিয়ে রাখে ফ্রিজে। বেশ কিছুটা চর্বি জমলে সেগুলো ধুয়ে পরিষ্কার করে কড়াইতে ফুটিয়ে গলানো হয়। চর্বি গলে তেল হয়ে গেলে সেই তেল এক পাত্রে সরিয়ে রাখা হয়, যা ঠান্ডা হয়ে জমাট বেঁধে রূপ বদলে এক্কেবারে জমা ডালডা! আগে থেকে ভিজিয়ে রাখা চাল বেটে তাতে ডিম, আদা-পেঁয়াজ-রসুন বাটা, হলুদ আর নুন মিশিয়ে একটা লেই বানিয়ে এক হাতা লেই ফুটন্ত চর্বির তেলের মধ্যে ছেড়ে দিলে সেই লেই লুচির মতো ফুলে ওঠে। উল্টেপাল্টে ভাজা সেই লুচি (যার অপর নাম চর্বির পিঠে) আমিষাশীদের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে পিঠে-প্যারেডে প্রত্যেক বছর অংশগ্রহণ করছে ইদানীং।
…ভাজারদুয়ারি-র অন্যান্য পর্ব…
ভাজারদুয়ারি পর্ব ২১: যে ভারতীয় খাবারের রেসিপি জোগাড় করতে না পারায় প্রাণ দিয়েছিলেন সাহেব
ভাজারদুয়ারি পর্ব ২০: নর্স ভাষায় ‘কাকা’ নামে এক ধরনের রুটি ছিল, যা আজকের কেকের পূর্বপুরুষ
ভাজারদুয়ারি পর্ব ১৯: গোস্ত কা হালুয়া, বলেন কী!
ভাজারদুয়ারি পর্ব ১৮: আরে, এ তো লিট্টির বৈমাত্রেয় ভাই!
ভাজারদুয়ারি পর্ব ১৭: ল্যাদের সঙ্গে খিচুড়ির অবৈধ সম্পর্ক
ভাজারদুয়ারি পর্ব ১৬: আগুন যখন পবিত্র, ঝলসানো মাংসই সুপারহিট
ভাজারদুয়ারি পর্ব ১৫: শ্রমের বিনিময়ে খাদ্য– এভাবেই তৈরি হয়েছিল বিরিয়ানি
ভাজারদুয়ারি পর্ব ১৪: যে সুস্বাদু জিলিপি আর ফাফরার জন্যে দুরন্ত ষাঁড়ের পিছনেও ছোটা যায়
ভাজারদুয়ারি পর্ব ১৩: শ্রীকৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনামকে টেক্কা দেবে ভাতের বিবিধ নাম
ভাজারদুয়ারি পর্ব ১২: জুয়া-লগ্নে যে খাবারের জন্ম, এখন তা ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে
ভাজারদুয়ারি পর্ব ১১: নারকোলের বিদেশযাত্রা
ভাজারদুয়ারি পর্ব ১০: সন্দেশের ব্যাপারে একটি জরুরি সন্দেশ
ভাজারদুয়ারি পর্ব ৯: আলু গোল বলে আলুর চপকেও গোল হতে হবে নাকি?
ভাজারদুয়ারি পর্ব ৮: পা দিয়ে ময়দা মেখে রুটি বানানো হয় বলে নাম পাউরুটি, এ এক্কেবারেই ভুল কথা!
ভাজারদুয়ারি পর্ব ৭: যুদ্ধক্ষেত্রে রুটির ওপরে চিজ আর খেজুরই আজকের পিৎজা
ভাজারদুয়ারি পর্ব ৬: পান্তা ভাতে টাটকা বেগুনপোড়া
ভাজারদুয়ারি পর্ব ৫: ইউরোপের ক্রেপ-কে গোলারুটির চ্যালেঞ্জ
ভাজারদুয়ারি পর্ব ৪: ২০০ পরোটা কোন রাক্ষসে খায়!
ভাজারদুয়ারি পর্ব ৩: হাজার বছর পার করেও বাসি হয়নি শিঙাড়ার যাত্রা
ভাজারদুয়ারি পর্ব ২: পাড়ার মোড়ের দোকানের চপ-তেলেভাজা হচ্ছে টিভি সিরিয়াল
ভাজারদুয়ারি পর্ব ১: বাঙালি তেলে ভাজবে না ঘি-এ ভাজবে?