ঝুপড়িবাসী থেকে পাঁচতারা– সবরকম মানুষই হচ্ছেন বিজ্ঞাপনের টার্গেট। তাই তাঁদের চালচলন, পছন্দ-অপছন্দ, ভালো-মন্দ, সেন্টিমেন্ট– সব দিকে নজর রাখাটা খুব জরুরি। এইসব কারণেই একসময় আমি সময় পেলেই ট্রামে, বাসে, লোকাল ট্রেনে, হাটে-বাজারে, পাঁচতারা শপিং মলে ঘুরে বেড়াতাম। যাকে বলে ‘ম্যান ওয়াচিং’।
২৩.
বিজ্ঞাপনী কাজ যাঁরা করেন, তাঁদের ভাবনা সবসময়ই মানুষকে নিয়ে। কারণ বিজ্ঞাপন তো মানুষের জন্য। ঝুপড়িবাসী থেকে পাঁচতারা– সবরকম মানুষই হচ্ছেন বিজ্ঞাপনের টার্গেট। তাই তাঁদের চালচলন, পছন্দ-অপছন্দ, ভালো-মন্দ, সেন্টিমেন্ট– সব দিকে নজর রাখাটা খুব জরুরি। এইসব কারণেই একসময় আমি সময় পেলেই ট্রামে, বাসে, লোকাল ট্রেনে, হাটে-বাজারে, পাঁচতারা শপিং মলে ঘুরে বেড়াতাম। যাকে বলে ‘ম্যান ওয়াচিং’।
এইরকমই এক শীত-সন্ধ্যায় আমি বালিগঞ্জ থেকে শিয়ালদহ আসার একটি লোকাল ট্রেনে উঠেছি। উঠে দেখি, সেটা ভেন্ডর-কামরা। এই কামরার বিশেষত্ব হল, কোনও বসার আসন নেই, শুধু ওপরদিকে মাল রাখার কাঠের বাঙ্ক। সারা কামরা সবজির ঝুড়িতে ভর্তি। ট্রেন ছুটছে। মানুষজন গাদাগাদি করে ওই ঝুড়ির ওপর বসেই ঝিমোচ্ছে। এমন সময় এক বিকট চিৎকার করে আবির্ভাব হল এক কলম বিক্রেতার। তার বিজ্ঞাপনের হেডলাইন হল, ‘আমার দিকে তাকান।’ হঠাৎ ওই চিৎকারে ঝিমোনো মানুষগুলো তার দিকে নজর দিল। আর সেই কলমওয়ালা একটা কলমের ঢাকনা খুলে তিরের মতো ছুড়লেন আর কলমটা গিয়ে কাঠের বাঙ্কের গায়ে বিঁধে গেল। ট্রেন ছুটছে, কলম কাঠবিদ্ধ অবস্থায় কাঁপছে। সবাই মুগ্ধ-বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে। আমিও।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখলাম, ডিমনস্ট্রেটিভ এডভার্টাইজিং কাকে বলে। শিয়ালদা এসে গেছে। সবাই ব্যস্ত হয়ে নামছে। আমি দৌড়ে গিয়ে সেই কলমওয়ালাকে ধরলাম। বললাম অভিনন্দন। আমিও আপনার মত কত কী বেচার জন্যে বিজ্ঞাপন করি, দশতলার ওপর ঠান্ডা ঘরে বসে। আর আপনি যা দেখালেন। ভদ্রলোক খুব লজ্জিত হয়ে বললেন কী যে বলেন, এটাই তো আমার কাজ। কিন্তু আপনি কেন ভেন্ডর কামরায়? আমি বললাম, ভাগ্যিস উঠেছিলাম, না হলে এ এক্সপেরিয়েন্সটাই তো হত না।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এবার বিজ্ঞাপনের আসল বক্তব্য, ‘দেখলেন তো. এই কলমের নিবের জোর। ছেলেপুলের হাতে দিন। ভাঙবে না। টাকায় দুটো। চারটে নিলে একটা ফ্রি।’ ভীষণ তেজি ভাষণ। চোখের সামনে মুড়ি-মুড়কির মতো সব কলম বিক্রি হয় গেল!
মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখলাম, ‘ডিমনস্ট্রেটিভ এডভার্টাইজিং’ কাকে বলে। শিয়ালদহ এসে গেছে। সবাই ব্যস্ত হয়ে নামছে। আমি দৌড়ে গিয়ে সেই কলমওয়ালাকে ধরলাম। বললাম, ‘অভিনন্দন। আমিও আপনার মতো কত কী বেচার জন্য বিজ্ঞাপন করি, দশতলার ওপর ঠান্ডা ঘরে বসে। আর আপনি যা দেখালেন!’ ভদ্রলোক খুব লজ্জিত হয়ে বললেন, ‘কী যে বলেন, এটাই তো আমার কাজ। কিন্তু আপনি কেন ভেন্ডর কামরায়?’ আমি বললাম, ‘ভাগ্যিস উঠেছিলাম, না হলে এই এক্সপেরিয়েন্সটাই তো হত না! এবার আসল কথাটা বলুন তো, ওই যে কলমটা ছুড়লেন ওটা কি একটাই? অন্য কলমের নিবগুলো কি…
তিনি হেসে বললেন, ‘ওটা একটাই স্যর।’
ব্র্যান্ড বাজাও-এর অন্যান্য পর্ব
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ২২: লাখ লাখ মানুষ রুটি পড়ছেন আগে, খাচ্ছেন পরে!
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ২১: বিজ্ঞাপনের সুভাষিত ছড়া
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ২০: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আশ্চর্যজনক ‘সুপারব্র্যান্ড’ বলতে দ্বিধাবোধ করব না
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ১৯: ফ্লুরিজকে টেক্কা দিয়েছিল যারা
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ১৮: কথাবার্তা নেই, স্রেফ গন্ধই খাবারের বিজ্ঞাপন
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ১৭: বাড়িতে আগুন লাগলে আপনি কি চকোলেট খাবেন?
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ১৬: বিজ্ঞাপনের গোলকধাঁধায় চিকিৎসাও পণ্য!
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ১৫: বাঘ-ছাগলকে একঘাটে জল খাওয়াতে পারে যে চা
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ১৪: বিষ বিক্রি করে মিলিয়ান ডলারের মালিক!
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ১৩: বুকের দুধের বাজার গরম, ৩০০ মিলিলিটার ৪৫০০ টাকা!
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ১২: গেরুয়া লুঙ্গির কাছে গোহারান হেরেছে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ১১: ধর্মতলার সেই ভিক্ষুক যে বিজ্ঞাপনের কড়া স্ট্রাটেজিস্ট
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ১০: ‘টাটকা’ সবজি ‘জ্যান্ত’ বললে বিক্রি বাড়ে, এটাও বিজ্ঞাপন
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ৯: সে যাত্রায় বন্দুকের নল থেকে রক্ষা করেছিলেন সুনীল গাভাসকর
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ৮: যে কোম্পানির নামে আস্ত একটা নগরী!
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ৭: এক সামান্য নাপিতের উদ্যোগ ও চেষ্টা
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ৬: মহাকাশচারীদের জন্য বানানো টুথপেস্টে এখন শিশু ও পোষ্যদের দাঁত মাজানো হয়
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ৫: একখানা লিপস্টিক প্রায় দেড় কোটি টাকা!
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ৪: ইস চাম্পি মে বড়ে বড়ে গুণ
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ৩: ‘ওরে ব্লোরীন লাগা’
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ২: বাংলাভাষায় প্রথম সার্থক বুদ্ধিদীপ্ত বিজ্ঞাপন, রবীন্দ্রনাথও দিয়েছিলেন শংসাপত্র
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ১: ৫০০০ বছর আগেই ছিল ব্র্যান্ডিংয়ের ধারণা!