রবীন্দ্রনাথ জানতেন ভারতীয় জনসাধারণ ধর্মবিবিক্ত নন। তাঁদের নিহিত ধর্মবোধকে প্রাতিষ্ঠানিক হিন্দুত্বপন্থী বা ইসলামপন্থীদের সঙ্গে আঁতাঁত তৈরি করে কাজে লাগাতে চায় ধর্মপন্থী দলগুলি। ধর্ম এই দলগুলির মুখোশ, স্বার্থ ও ক্ষমতার রাজনীতি তাদের মুখ। এই বিপন্নতা থেকে বাঁচার উপায় ধর্মবোধের স্বাধিকার অর্জন করা।
১৯৩০। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ক্ষিতিমোহন সেনের বই ‘ভারতীয় মধ্যযুগে সাধনার ধারা’। সাধারণভাবে পাশ্চাত্যের সূত্রে ‘মধ্যযুগ’ শব্দটিকে বিচার করলে অন্ধকার যুগের ছবি ভেসে ওঠে। ক্ষিতিমোহন ভারতবর্ষের মধ্যযুগের যে সাধনার ধারার ছবি এ-বইতে প্রকাশ করেছিলেন তা কিন্তু অন্ধকারের নয়, আলোর– সম্মিলনের। এ-বইটি আদতে বক্তৃতার লিখিত রূপ। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘অধর মুখার্জি লেক্চর’ দিয়েছিলেন ক্ষিতিমোহন– ১৯২৯-এ, সেই মুখের কথাই লেখার ভাষায় প্রকাশিত হয়েছিল। এ-বইয়ের ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘ভারতের একটি স্বকীয় সাধনা আছে; সেটি তার অন্তরের জিনিস।… আশ্চর্যের বিষয় এই যে এই ধারা শাস্ত্রীয় সম্মতির তটবন্ধনের দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়… বস্তুতপক্ষে এই সাধনা অনেকটা পরিমাণে অশাস্ত্রীয়, এবং সমাজশাসনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়।… যাঁদের চিত্তক্ষেত্রে এই প্রস্রবণের প্রকাশ, তাঁরা প্রায় সকলেই সামান্য শ্রেণীর লোক…।’ রবীন্দ্রনাথ যখন মধ্যযুগের ধর্মসাধনার বিশেষ একটি ধারার দিকে দৃষ্টিপাত করছিলেন, তখন ইংরেজ-শাসিত ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমান দুই ধর্মের শাস্ত্রীয় কাঠামোকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের আধুনিক উপক্রম তৈরি হয়েছে। এই শাস্ত্রীয় ধর্মীয় কাঠামোসঞ্জাত রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, নিয়ন্ত্রণ করতে চায় সমাজ-ধর্ম-সংস্কৃতিকে, ওপর থেকে। রবীন্দ্রনাথ খেয়াল করিয়ে দিয়েছিলেন যে, ধর্মসাধনার কথা ক্ষিতিমোহন লিখছেন, সেই ধর্মসাধনার পথ-প্রদর্শকরা সমাজের নিম্নবর্তী সামান্য শ্রেণির মানুষ। তাঁরা নিজের মনের অনুভবকে ধর্মে প্রকাশ করছেন, সেই প্রকাশের মধ্যে বিধি-বিধানের চলে আসা অচল অনুশাসন ক্রিয়াশীল নয়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
কীভাবে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য ধর্মকে ব্যবহার করে দাঙ্গা লাগাতে হয়, প্রয়োজনে দরিদ্র মুসলমানদের ভাতে মারতে হয়, তার নিখুঁত ছবি ‘ঘরে-বাইরে’। সন্দীপ একালের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিবিদদের এক অর্থে কুলগুরু। তার লাগানো দাঙ্গার শিকার অমূল্য, নিখিলেশ মারাত্মক জখম হয়েছিল– সত্যজিতের ছবি ‘ঘরে-বাইরে’তে নিখিলেশের প্রাণ গিয়েছিল। দাঙ্গা যার মস্তিষ্ক-সঞ্চালনের ফল, সেই সন্দীপ অবশ্য যথারীতি পালিয়ে যায়। গোধরায় যারা একালেও আগুন জ্বালায় তারাও পালাতে পারে। যা তিনি লিখছেন তা যে নিতান্ত কাল্পনিক নয়– রবীন্দ্রনাথ তা জানতেন।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ক্ষিতিমোহন যেমন অণ্ডালের পরিচয় দিতে গিয়ে লিখেছিলেন দক্ষিণ ভারতের দ্বাদশ ‘আলরারের নয় জন’-এর মধ্যে নীচকুলজাত মানুষের সংখ্যাধিক্য। অণ্ডাল একজন নারী। ডোমজাতীয় শঠকোপের মুখের বাণী বেদের থেকেও বৈষ্ণবদের কাছে অধিকতর মান্য। রামানন্দের প্রধান দ্বাদশ শিষ্যের পরিচয় দিতে গিয়ে ক্ষিতিমোহন লেখেন রবিদাস চামার, কবীর জোলা মুসলমান, সেনা নাপিত, ধন্না জাঠ। এই উদাহরণ থেকে স্পষ্ট, রবীন্দ্রনাথ কী বোঝাতে চাইছেন। কী বোঝাতে চাইছেন যেমন জরুরি, তেমনই জরুরি কেন ১৯৩০-এ এ-কথা তাঁকে বোঝাতে হচ্ছে! বোঝাতে যে হবে, তার আভাস অবশ্য রবীন্দ্রনাথ আগেই পেয়েছিলেন। শুধু যে পেয়েছিলেন, তা-ই নয় নিজের মৌলিক রচনায় সে-বিষয়ে সকলকে সাবধান করে দিয়েছিলেন। ‘গোরা’ উপন্যাসে হিন্দুত্ব নিয়ে মাতামাতি করা গোরার বোধোদয় ঘটান তিনি। গোরা নিজের কল্পিত পারিবারিকতার ব্রাহ্মণ্যবাদী পরিবেশে যে হিন্দুত্বের স্বপ্নে বিভোর ছিল, তা ভেঙে যায় বাস্তবের অভিঘাতে। গ্রামে গিয়ে গোরা দেখতে পায় উচ্চবর্ণ ধনী হিন্দুরা কীভাবে নিম্নবর্ণীয় দরিদ্রদের ওপরে অত্যাচার করে। সেই অভিজ্ঞতা গোরার ধর্মকে মানবিক করেছিল। শাস্ত্রের শাসন থেকে গোরা বাইরে আসতে পেরেছিল। ‘সবুজ পত্র’ সাময়িকীতে যখন রবীন্দ্রনাথ ‘ঘরে-বাইরে’ লিখছিলেন তখনও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানোর রাজনৈতিক পরিকল্পনা সম্বন্ধে সাধারণের ধারণা স্পষ্ট নয়। কীভাবে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য ধর্মকে ব্যবহার করে দাঙ্গা লাগাতে হয়, প্রয়োজনে দরিদ্র মুসলমানদের ভাতে মারতে হয়, তার নিখুঁত ছবি ‘ঘরে-বাইরে’। সন্দীপ একালের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিবিদদের এক অর্থে কুলগুরু। তার লাগানো দাঙ্গার শিকার অমূল্য, নিখিলেশ মারাত্মক জখম হয়েছিল– সত্যজিতের ছবি ‘ঘরে-বাইরে’তে নিখিলেশের প্রাণ গিয়েছিল। দাঙ্গা যার মস্তিষ্ক-সঞ্চালনের ফল, সেই সন্দীপ অবশ্য যথারীতি পালিয়ে যায়। গোধরায় যারা একালেও আগুন জ্বালায় তারাও পালাতে পারে। যা তিনি লিখছেন তা যে নিতান্ত কাল্পনিক নয়– রবীন্দ্রনাথ তা জানতেন।
এর নিরাময় কোথায়? শাস্ত্রের ও প্রাতিষ্ঠানিকতার কাঠামোর অন্তর্গত যে ধর্ম হিন্দুত্ব ও মুসলমানত্বের রাজনীতিকে প্রখর করে তুলছিল, তার বাইরে সমাজের আরেক অংশের দিকে তাকানোর চেষ্টা করছিলেন তাঁরা। রবীন্দ্রনাথের সহযোগী হয়ে উঠতে পেরেছিলেন ক্ষিতিমোহন সেন। ক্ষিতিমোহনের জন্ম কাশীতে। সেই কাশী আজকের আধুনিক ভারতের বিশ্বনাথের করিডর তৈরি করা কাশী নয়। রাষ্ট্রীয় পুঁজির শাস্ত্রীয় অনুশাসন, ক্ষিতিমোহনের কাশীতে ছিল না। লিখেছেন তিনি, ‘বাল্যকালে কাশীতে নানা সম্প্রদায়ের সাধুসন্তদের সহিত পরিচয় ঘটিল।… সেই সব পুরাতন সাধকগণের সাধনা ও বাণী এমন উদার গভীর ও মনোহর যে অল্প বয়সেই তাহাতে আমার নেশা লাগিয়া গেল।’ সেই নেশারই ফল ক্ষিতিমোহনের পরবর্তী গবেষণা– কবীর, দাদূ বিষয়ক গ্রন্থ। রবীন্দ্রনাথের আশ্রম বিদ্যালয়ে এসে যোগ দিয়েছিলেন কাশীর ক্ষিতিমোহন। রবীন্দ্রনাথের কাছে ভারতবর্ষের অতীতের বিশেষ একটি দিক নতুনভাবে উন্মোচিত হল। পিতার কাছ থেকে উপনিষদনিষিক্ত ব্রাহ্মধর্মের উত্তরাধিকার গ্রহণ করেছিলেন তিনি, জমিদারির কাজে যখন পূর্ববঙ্গে গিয়েছিলেন সেখানে সহজিয়া বৈষ্ণবধারা ও বাউল ধর্মের সঙ্গে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার যোগ তৈরি হয়েছিল তাঁর। ক্ষিতিমোহনের কাছে আরেক ভারতবর্ষকে চিনলেন তিনি– সেই ভারতের ভাষা ‘সংস্কৃত’ নয়, সেই ভারত বেদের অনুশাসনে আবদ্ধ নয়। সেই ভারতে ধর্মে-ধর্মে, মানুষে-মানুষে নানা মিশেল ঘটে। এই মিশেল ব্যক্তি অনুভবের ফল– রাষ্ট্র ও সমাজের ওপর থেকে নেমে আসা বিধি এই লোকসাধারণের কাছে অচল। এ ভারতবর্ষ হিন্দুর নয়, মুসলমানের ভারতবর্ষও নয়– বহুত্ববাদী ভারতবর্ষের এই সাধনার ধারা উত্তর থেকে দক্ষিণে, পশ্চিম থেকে পূর্বে সুবিস্তৃত। পারস্পরিক সংযোগের হেতু রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক অনুশাসন নয়, সংযোগের হেতু মরমিয়া আবেগ।
রবীন্দ্রনাথ জানতেন ভারতীয় জনসাধারণ ধর্মবিবিক্ত নন। তাঁদের নিহিত ধর্মবোধকে প্রাতিষ্ঠানিক হিন্দুত্বপন্থী বা ইসলামপন্থীদের সঙ্গে আঁতাঁত তৈরি করে কাজে লাগাতে চান ধর্মপন্থী দলগুলি। ধর্ম এই দলগুলির মুখোশ, স্বার্থ ও ক্ষমতার রাজনীতি তাদের মুখ। এই বিপন্নতা থেকে বাঁচার উপায় ধর্মবোধের স্বাধিকার অর্জন করা। ধর্মবোধের এই স্বাধিকার অর্জনের একরকম ইতিহাস মধ্যযুগের ভারতীয় ধর্মসাধনার মধ্যে রয়েছে। ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে এই সাধনার কথা মনে করিয়ে দিয়েও রবীন্দ্রনাথ দেশের মানুষের সাম্প্রদায়িক মনকে মুক্ত করতে পারেননি। দাঙ্গা হয়েছিল, ধর্মের নামে দেশভাগও। তবে রবীন্দ্রনাথের মতো মানুষেরা না-থাকলে দাঙ্গার বাস্তব নিষ্ঠুরতর হত। তাই মানুষের সাম্প্রদায়িক মনকে যেমন সম্পূর্ণ মুক্ত করতে পারেননি, তেমনই সন্দেহ নেই অনেককে মুক্ত করতে পেরেওছিলেন। আজকের ভারতে পুঁজিতান্ত্রিক ধর্মীয় রাজনীতির হাত দীর্ঘতর। সুতরাং রবীন্দ্রনাথের ভাবনা ও লেখা উদ্ধার করলেই যে ধর্মধ্বজীদের উল্লাস বন্ধ হয়ে যাবে এমন নয়। তবুও ইতিহাস তো বলতেই হয়– সেই ইতিহাসের শিক্ষা যদি একজনেরও কর্ণগোচর হয় তাহলেও আশা মরতে মরতে মরে না। রাষ্ট্রিক ধর্মের রাজনীতির বাইরে ধর্মের স্বাধিকার ও ব্যক্তিগত অনুভবের যে নিজত্ব তাই লোকায়ত ধর্মসাধনার ঐতিহ্য– হয়তো মুছতে চেয়েও তাকে মোছা যায় না। ইতিহাস তো তাই শেখাচ্ছে।
…………………ছাতিমতলা অন্যান্য পর্ব……………………..
ছাতিমতলা পর্ব ২২: রামায়ণে রাম-রাবণের যুদ্ধ রবীন্দ্রনাথের কাছে ছিল গৌণ বিষয়
ছাতিমতলা পর্ব ২১: রবীন্দ্রনাথ পড়ুয়াদের সঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজতেন, চাঁদের আলোয় গান গাইতেন
ছাতিমতলা পর্ব ২০: সুভাষচন্দ্র বসুকে তীব্র তিরস্কার করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ!
ছাতিমতলা পর্ব ১৯: আবেগসর্বস্ব ধর্ম ও রাজনীতির বিরোধিতা করে অপ্রিয় হয়েছিলেন
ছাতিমতলা পর্ব ১৮: রবীন্দ্রনাথ কখনও গীতাকে যুদ্ধের প্রচারগ্রন্থ হিসেবে বিচার করেননি
ছাতিমতলা পর্ব ১৭: ক্রিকেটের রাজনীতি ও সমাজনীতি, দু’টি বিষয়েই তৎপর ছিলেন রবীন্দ্রনাথ
ছাতিমতলা পর্ব ১৬: রবীন্দ্রনাথ কি ক্রিয়েটিভ রাইটিং শেখানোর কিংবা কপি এডিটিং করার চাকরি পেতেন?
ছাতিমতলা পর্ব ১৫: কবি রবীন্দ্রনাথের ছেলে হয়ে কবিতা লেখা যায় না, বুঝেছিলেন রথীন্দ্রনাথ
ছাতিমতলা পর্ব ১৪: ছোট-বড় দুঃখ ও অপমান কীভাবে সামলাতেন রবীন্দ্রনাথ?
ছাতিমতলা পর্ব ১৩: পিতা রবীন্দ্রনাথ তাঁর কন্যা রেণুকার স্বাধীন মনের দাম দেননি
ছাতিমতলা পর্ব ১২: এদেশে ধর্ম যে চমৎকার অস্ত্রাগার, রবীন্দ্রনাথ তা অস্বীকার করেননি
ছাতিমতলা পর্ব ১১: কাদম্বরীকে বঙ্গজ লেখকরা মুখরোচক করে তুলেছেন বলেই মৃণালিনীকে বাঙালি জানতে চায়নি
ছাতিমতলা পর্ব ১০: পাশ্চাত্যের ‘ফ্যাসিবাদ’ এদেশেরই সমাজপ্রচলিত নিষেধনীতির প্রতিরূপ, বুঝেছিলেন রবীন্দ্রনাথ
ছাতিমতলা পর্ব ৯: দেশপ্রেম শেখানোর ভয়ংকর স্কুলের কথা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, এমন স্কুল এখনও কেউ কেউ গড়তে চান
ছাতিমতলা পর্ব ৮: অসমিয়া আর ওড়িয়া ভাষা বাংলা ভাষার আধিপত্য স্বীকার করে নিক, এই অনুচিত দাবি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথও
ছাতিমতলা পর্ব ৭: বাঙালি লেখকের পাল্লায় পড়ে রবীন্দ্রনাথ ভগবান কিংবা ভূত হচ্ছেন, রক্তমাংসের হয়ে উঠছেন না
ছাতিমতলা পর্ব ৬: যে ভূমিকায় দেখা পাওয়া যায় কঠোর রবীন্দ্রনাথের
ছাতিমতলা পর্ব ৫: চানঘরে রবীন্দ্রসংগীত গাইলেও আপত্তি ছিল না রবীন্দ্রনাথের
ছাতিমতলা পর্ব ৪: যে রবীন্দ্র-উপন্যাস ম্যারিটাল রেপের ইঙ্গিতবাহী
ছাতিমতলা পর্ব ৩: ‘রক্তকরবী’র চশমার দূরদৃষ্টি কিংবা সিসিটিভি
ছাতিমতলা পর্ব ২: ‘পলিটিকাল কারেক্টনেস’ বনাম ‘রবীন্দ্র-কৌতুক’
ছাতিমতলা পর্ব ১: ‘ডাকঘর’-এর অমলের মতো শেষশয্যা রবীন্দ্রনাথের কাঙ্ক্ষিত, কিন্তু পাননি