অন্য কেউ পারেননি। সরোজ দত্ত পেরেছিলেন, কারণ তিনি বিপ্লববিলাসী ছিলেন না, রাষ্ট্রের সঙ্গে বিপ্লব বিপ্লব খেলার সঙ্গীদের দল থেকে নাম কাটিয়ে তিনি বিপ্লবকে রোজকার কাজ হিসাবে নিতে পেরেছিলেন। হয়তো যে গলি পেরিয়ে একটি ঘরে পৌঁছে তিনি লিখতে বসেছিলেন, সে গলি থেকে তাঁর কমরেডদের রক্তের দাগ শুকোয়নি তখনও। সহযোদ্ধাদের হত্যাকারীর প্রতি নিজের ঘৃণাকে নরম-সরম, গা-সওয়া করে পরিবেশনের কোনও ইন্টেলেকচুয়াল দায় তিনি বোধ করেননি। ‘বামপন্থী বিদ্বজ্জনেরা’ আগুন বড়ই পছন্দ করেন, যদি তা হয় জোনাক পোকার পিছনের লুসিফেরাসের মতো— নরম ও ঠান্ডা, জ্বলবে কিন্তু জ্বালাবে না। সে আগুনে বিষম অরুচি ছিল সরোজ দত্তর। তিনি সত্যি আগুনের বৃত্তে দাঁড়িয়েই স্ফুলিঙ্গ ও অঙ্গার থেকে ভাষার উপাদান খুঁজে নিয়েছিলেন, সুতরাং তাঁর ভাষা আগ্নেয় হয়ে উঠতে পেরেছিল।
২৪.
সরোজ দত্ত। ভারত। দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব।
এ’বঙ্গে ছয়-সাতের দশকেও ‘বামপন্থী বিদ্বজন’ নামে এক কোমলমতি ও লিবারেল সমাজ ছিল। তার চোখে সকলই ছিল শোভন, সকলই নবীন, সকলই বিমল। পরিশীলিত সে সমাজ মোলায়েম মিথ্যেকে তবু মেনে নিতে পারত, কর্কশ সত্যিকে কদাচ নয়। এহেন বিদ্বজ্জনদের মধ্যে একদা জলচল সরোজ দত্ত প্রহ্লাদকূলে দৈত্য হয়ে উঠে দেশব্রতীর পাতায় যেদিন লিখলেন— ‘এরাই যখন আবার… দন্তবিকশিত করে সভাসমিতিতে স্তালিনের জয়ধ্বনি করে, তখন ইচ্ছা করে লাথি মেরে শালাদের দাঁতের পাটি খসিয়ে দিই’— ব্রাহ্ম-ঘরানার বাম বিদ্বজ্জনেরা বড়ই ধাক্কা খেলেন। ছিছিক্কার উঠল— এই কি তবে রাজনীতির ভাষা! এ ভাষা তো রাস্তার লোকের!
নজর করার মতো বিষয় হল, এই ‘রাস্তার লোকের ভাষা’ লিখছেন তিনি, যাঁর কবিতার ধ্রুপদী বন্ধন একসময়ে বাংলার কবিকুলকে মুগ্ধ করে রাখত, যিনি সংস্কৃত ও ইংরেজি সাহিত্যে ব্যুৎপত্তির জন্য কলকাতার বুদ্ধিজীবী মহলে যথেষ্ট সম্মানিত ছিলেন, এবং অনুবাদক বা সাহিত্য-সাংবাদিক হিসাবেও মননশীল পাঠকের সম্ভ্রম আদায় করেছিলেন যিনি। সেই মানুষটি যখন ‘রাস্তার ভাষা’য় কলম ধরেন, তখন বোঝা দরকার সেটা তাঁর ভাষার দীনতা নয়, তিনি সেটা সচেতনভাবে করছেন, অর্থাৎ সচেতনভাবেই নিজেকে ‘রিডিউস’ করছেন। ভাষায় ও সাহিত্যে যাঁর দখল অনস্বীকার্যভাবে আছে, তাঁর পক্ষে বুদ্ধিজীবীর গুমর চিরতরে ছেড়ে নিজেকে এভাবে ‘রিডিউস’ করাটা খুব সহজ প্রক্রিয়া নয় কিন্তু!
‘‘ষাট দশকের শেষ দিকে তার প্রবন্ধ, নিবন্ধের ভাষা পর্যন্ত বদলে গিয়েছিল। উৎসভাষায় তিনি ফিরে যেতে চাইছিলেন। এই সময়ের কিছু দেওয়াল-লিখনের ভাষা তাঁকে প্রেরণা দিয়েছিল। তাঁর মনে হয়েছিল, ক্রোধ আর ঘৃণা প্রকাশের জন্য এটাই সেরা ভাষা-শৈলী। দেশব্রতীর নিবন্ধে দু’-একটা দেওয়াল-লিখন উদ্ধৃতি হিসেবে তিনি ব্যবহার করেছিলেন। যতদূর মনে পড়ে, এক অত্যাচারী পুলিশ কর্তাকে হুমকি দিয়ে লেখা একটি দেওয়াল-লিখন অশুদ্ধ বানানসহ তিনি রচনাতে দিয়েছিলেন। উদ্ধৃতিটি হলো, ‘শুয়োরের বাচ্চা অমুককে কাঁটারি দিয়ে কাঁটবো’। ‘কাঁটারি’ এবং ‘কাঁটবো’ শব্দদুটির অনুনাসিকতা তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। এরকম একাধিক উদ্ধৃতি ব্যবহার করে ব্রাত্যজনের মুখের ভাষা যে সুধী বাঙালির মুখের ভাষার চেয়ে অধিকতর জীবন্ত আর কার্যকর, তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন। আপাত-মূর্ত উৎস ভাষা যে শেষ পর্যন্ত কত বিমূর্ত নিরাকার হয়ে উঠতে পারে, তাঁর এই পর্বের গদ্যশৈলী পড়ে বোঝা যায়। তাঁর গদ্যশৈলী আগাগোড়া পরিবর্তিত হয়েছিল। দেশব্রতীর পাতায় শৈলী পরিবর্তনের অসংখ্য উদাহরণ ছড়িয়ে আছে।
ষাট, সত্তর দশকের ঘটনাবলী সরোজ দত্তকে অবস্থান পাল্টাতে বাধ্য করছিল। চেতনার নির্মাতার ঘাড়ে অর্পিত হয়েছিল সমাজ রূপান্তরের দায়িত্ব। সরোজ দত্ত দায়িত্ব এড়াতে পারেননি। এড়াতে চাননি। সৃজনশীল স্রষ্টা হয়ে উঠলেন শ্রেণীসংগ্রামের সেনাপতি। যাত্রা ভঙ্গ করেননি তিনি। নৌকো পুড়িয়ে তীরে নেমেছিলেন। আত্মপ্রচারবিমুখ এই মানুষটিকে ইতিহাস রক্ষা না করলেও অবিস্মরণীয় করে রেখেছে।” (লিখেছিলেন তাঁর একদা সহযোদ্ধা— এবং পরে শুধুই লেখক— শৈবাল মিত্র)
একটা ব্যাপার লক্ষ করে দেখুন। সরোজ দত্তর ওই ‘রাস্তার লোকের ভাষা’ আদৌ কিন্তু নৈরাজ্যের ভাষা নয়। যে ভাষা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দন কিহোতের মতো তলোয়ার-টলোয়ার ঘুরিয়ে টুরিয়ে একসা করে, কল্পনায় শাসককে ল্যাংটো করে কুচিয়ে কাটে আর বিধানসভায় বোমা মারে (সেও কল্পনাতেই), তারপর ল্যাংটো হয়েই ঘুমিয়ে পড়ে, কারণ কালকে ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস আছে সকাল সকাল। ভাষা নিয়ে ছায়ার সঙ্গে কুস্তি করার অবকাশ বা প্রবৃত্তি, কোনওটাই সরোজ দত্তর ছিল না, তিনি জানতেন, শত্রুর বুলেট ছুটে এলে মোটেই ফ্যাত্ ফ্যাত্ সাঁই সাঁই শব্দ হয় না; তিনি জানতেন, গরমকালে খোলা মাঠে শুতে বাধ্য হওয়া শ্রমিক গগনে চাঁদ দেখে দু’-অক্ষর আর চার অক্ষরের খিস্তি মারে না। নিপীড়িত মানুষ কেন গালি দেয়, তা বুঝতে গেলে ‘আমি নৈরাজ্যবাদী’ এটা প্রমাণের চেয়ে নিপীড়িত মানুষের সঙ্গে একাত্মতাটা জরুরি। সরোজ দত্তর গদ্যশৈলীর সরাসরি প্রভাব লক্ষ করুন মণিভূষণ ভট্টাচার্যর ‘গান্ধীনগরে রাত্রি’-তে:
“অধ্যাপক বলেছিল, দ্যাট্স্ র-ঙ্, আইন কেন তুলে নেবে হাতে?
মাস্টারের কাশি ওঠে, কোথায় বিপ্লব, শুধু মরে গেল অসংখ্য হাভাতে!
উকিল সতর্ক হয়, ‘বিস্কুট নিইনি, শুধু চায়ের দামটা রাখো লিখে’।
চটকলের ছকুমিঞা ‘এবার প্যাঁদাবো শালা হারামি ওসি-কে’।”
‘স্ল্যাং’— কার বিরুদ্ধে এবং কেন ব্যবহার করব— শশাঙ্কর কলামের ক্ষেত্রে তা নির্ধারণ করত শ্রেণিপক্ষ। গদ্যভাষাতে শান দেওয়াটা সরোজ দত্তর কাছে রাইফেলের নল পরিষ্কার করার মতোই যুদ্ধকালীন বাধ্যতা ছিল।
অন্য কেউ পারেননি। সরোজ দত্ত পেরেছিলেন, কারণ তিনি বিপ্লববিলাসী ছিলেন না, রাষ্ট্রের সঙ্গে বিপ্লব বিপ্লব খেলার সঙ্গীদের দল থেকে নাম কাটিয়ে তিনি বিপ্লবকে রোজকার কাজ হিসাবে নিতে পেরেছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে সরোজ দত্ত ইশ্তেহার লিখছিলেন। হয়তো যে গলি পেরিয়ে একটি ঘরে পৌঁছে তিনি লিখতে বসেছিলেন, সে গলি থেকে তাঁর কমরেডদের রক্তের দাগ শুকোয়নি তখনও। সহযোদ্ধাদের হত্যাকারীর প্রতি নিজের ঘৃণাকে নরম-সরম, গা-সওয়া করে পরিবেশনের কোনও ইন্টেলেকচুয়াল দায় তিনি বোধ করেননি। ‘বামপন্থী বিদ্বজ্জনেরা’ আগুন বড়ই পছন্দ করেন, যদি তা হয় জোনাক পোকার পিছনের লুসিফেরাসের মতো— নরম ও ঠান্ডা, জ্বলবে কিন্তু জ্বালাবে না। সে আগুনে বিষম অরুচি ছিল সরোজ দত্তের। তিনি সত্যি আগুনের বৃত্তে দাঁড়িয়েই স্ফুলিঙ্গ ও অঙ্গার থেকে ভাষার উপাদান খুঁজে নিয়েছিলেন, সুতরাং তাঁর ভাষা আগ্নেয় হয়ে উঠতে পেরেছিল, সেকালের বামপন্থী মহলের মহাপণ্ডিত তাত্ত্বিক বুদ্ধিজীবীদের মতো তা ধোঁয়ায় আকীর্ণ ছিল না।
আর কেউ পারলেন না, সরোজ দত্ত পারলেন পরিশীলিত ভাষার আশ্রয় ছেড়ে প্রান্তিক মানুষের ভাষায় নেমে আসতে। পারলেন এই কারণে যে তিনি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে অনুভব করতে পেরেছিলেন, এ আসলে ‘নেমে আসা’ নয়, এটাই উত্তরণ। নির্দ্বিধায় বলা চলে, সরোজ দত্তের লেখার বিষয়বস্তুর মতো তাঁর লেখার আঙ্গিকও শ্রেণির পক্ষ নিয়েছিল। সেটা ধরতে পেরেছিলেন শ্রমিকশ্রেণির অগ্রণী অংশ আর সমাজবদলের লড়াইয়ে শামিল তরুণেরা। মধ্যমেধাশাসিত বাংলার সংসদপোষ্য বাম বুদ্ধিজীবী শিবিরের পক্ষে সরোজ দত্তের কলমের মতো ভাষার দর্শনকে ধরতে পারার কথাই নয়। নিজেদের সুবিধামতো কাটছাঁট আর আপস করে বানানো চিন্তাজগতের খোপে সরোজ দত্তকে আঁটাতে গিয়ে তাঁদের হেঁচকি ওঠারই কথা। কারণ— ওই যে, সরোজ দত্ত যেমনটি বলতেন— প্রজাপতি ধরার জাল দিয়ে সিংহ ধরতে যাওয়াটাই মূঢ়তা।
রাষ্ট্র কিন্তু বুঝেছিল। তাই রাষ্ট্র তাঁকে বাঁচিয়ে রাখার ঝুঁকি নেয়নি। ১৯৭০ সালে শেষবারের মতো বিদায় নিয়ে তিনি চলে যাওয়ার আগে জীবনসঙ্গিনী ও সহযোদ্ধা বেলা দত্ত তাঁকে শুধু সাবধানে থাকতে বলেছিলেন। উত্তরে তিনি স্মিত হেসে বলেছিলেন— ‘সেনাপতির বুকে গুলি লাগবে বলে সেনাপতি কি যুদ্ধক্ষেত্রে যাবে না?’ বড় গৌরবের মৃত্যু অর্জন করে সরোজ দত্ত প্রমাণ করে দিয়েছিলেন যে, তিনি যুদ্ধক্ষেত্রেই ছিলেন, সঞ্জয়ের ভূমিকায় নয়।
[কবি ও বধ্যভূমি-র লেখক আমিও কি পারলাম শীলিত ভাষার অগভীর গুমর ছেড়ে-ছুড়ে বেরিয়ে আসতে? তাই তো প্রমিত বাংলায় শহিদ কবিদের আখ্যান গেঁথে গেলাম! আর সরোজ দত্তর ‘রাস্তার ভাষার’ দীর্ঘ ছায়া আমার লিখনের সুপাঠ্য হয়ে ওঠার যাবতীয় কসরতকে নিয়ত খর্ব করে গেল।
সরোজ দত্তকে নিয়ে এই লেখাটি, এবং ‘কবি ও বধ্যভূমি’ লেখমালাটি, আজ সমাপ্ত হল। কবিদের স্বপ্ন অসমাপ্ত থেকে গেল, কবিরা আমাদের স্বপ্নে রয়ে গেলেন। বধ্যভূমিই শেষ কথা নয়, তা প্রমাণের দায় নিয়ে।]
সরোজ দত্তর প্রতিকৃতিটি শিল্পী সুমন সেনগুপ্তর আঁকা
ঋণ: শহীদ সরোজ দত্ত স্মৃতিরক্ষা কমিটি; জলার্ক; প্রতিরোধের ভাষা
(সমাপ্ত)
…পড়ুন কবি ও বধ্যভূমি…
পর্ব ২৩। অসতর্ক কোনও ছত্রে ধ্বনিবে না ক্রন্দন আমার/১
পর্ব ২২: হাত দিয়ে বল সূর্যের আলো রুধিতে পারে কি কেউ?
পর্ব ২১: অলিভ-বাগান, উম্ম সাআদ আর হাইফায় ফেরা
পর্ব ২০: যে তাঁত বুনেছে রক্তপতাকা
পর্ব ১৯: আমাকে দেখাও সেই বন্দিকক্ষ
পর্ব ১৮: কতটা দীর্ঘ হলে জনযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয়? (২য়)
পর্ব ১৭: কতটা দীর্ঘ হলে জনযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয়? (১ম)
পর্ব ১৬: পারো যদি বজ্র হয়ে এসো
পর্ব ১৫: কামানের মুখে কলহাস্যে এ কী ভালোবাসা!
পর্ব ১৪: গান্ধিনগরে রাত্রি
পর্ব ১৩: সিলারের পাপড়ি অথবা একজন পেশমেরগার মৃত্যু
পর্ব ১২: ডানার পালকে সূর্যকে নিয়ে…
পর্ব ১১: প্রিয় কমরেড, এসো একসাথে মরি
পর্ব ১০: প্রাণভিক্ষা? বেছে নিই মৃত্যুর অহংকার বরং!
পর্ব ৯: তিমিরের অন্তে যদি তিমিরবিনাশ
পর্ব ৮: অক্সিজেন মৃতদের জন্য নয়!
পর্ব ৭: আকাশে তারারা জ্বলছে, ফ্যলাস্তিনকে ভয় দেখিও না!
পর্ব ৬: কোথায় লুকোবে কালো কোকিলের লাশ?
পর্ব ৫: আমার দুঃখের কথা কি পাথরকে বলব?
পর্ব ৪: আমি সেই মেয়ে, যে আর ফিরবে না
পর্ব ৩: আমাকে পোড়াতে পারো, আমার কবিতাকে নয়!
পর্ব ২: এস্তাদিও চিলে আর চল্লিশটা বুলেটের ক্ষত
পর্ব ১: বিপ্লব, প্রেম ও কবিতাকে আমৃত্যু আগলে রেখেছিলেন দ্রোণাচার্য ঘোষ