কাবাবের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক যুগ যুগ ধরে, সেই প্রাচীন কাল থেকে মধ্যযুগ অবধি। মধ্যযুগেও বিভিন্ন গল্পে রাজাদের শিকারে বা ‘মৃগয়ায়’ বেরনোর গল্প শোনা যায় । রাজারা একসঙ্গে মিলিত হয়ে শিকার করার ফাঁকে আইন ও আগ্রাসন নিয়ে পরামর্শ সেরে নিতেন আর সেই শিকারে পাওয়া মাংস খোলা কাঠের আগুনে ঝলসিয়ে নুন আর লেবু ঘষে খাওয়া হত, উদবৃত্ত মাংস আচার মাখিয়ে রেখে দেওয়া হত পরের দিনের খাবার হিসাবে। সেই ঝলসানো মাংস পরবর্তী কালে কাবাব নামে বাজার মাতাচ্ছে।
২৪.
কয়েক সপ্তাহ আগে কাশী-র গোধুলিয়া মোড়ে উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়াতে দেখে এক ভদ্রলোক স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন আমি কী খুঁজছি। আমার হয়তো উত্তরে শান্তি বা পুণ্য বলা উচিত ছিল, কিন্তু স্থান-মাহাত্ম্যে মুখ দিয়ে সত্যিটাই বেরল– ‘সুনা থা সর্দি কি মৌসম মে ইহা বড়িয়া গোস্ত অউর কাবাব মিলতা হ্যায়, মেহেরবানি করকে গাইড করেঙ্গে?’ আমার প্রশ্ন শুনে ভদ্রলোকের চোখে যে ঘৃণা ফুটে উঠল, পরিষ্কার বুঝলাম গত দুইদিনের অর্জিত পুণ্য পঞ্চভূতে বিলীন হল। ‘ফালতু আদমি’ বলে হনহনিয়ে চলে গেলেন ভদ্রলোক।
…………………………………………………………………………………………………………………………………
বাঙালি আমিষ খায় বলে না হয় ভারতচন্দ্র তাঁর ‘অন্নদামঙ্গল’-এ লিখেছেন দেবী অন্নপূর্ণা রাঁধেন ‘অন্নমাংস সিকভাজা কাবাব করিয়া’, কিন্তু রামায়ণের অযোধ্যা কাণ্ডে শিকার করে আনা হরিণের মাংস ঝলসে খাওয়ার কথা লেখা আছে। মহাভারতে রাজা দুষ্মন্তর শিকারে গিয়ে চটজলদি পশুর মাংস পুড়িয়ে খাওয়ার বর্ণনা রয়েছে। এমনকী, ১৬৪০ সালে আঁকা মেওয়ারের রামায়ণ পুঁথি-তে পরিষ্কার দেখা যায় রামচন্দ্রের বাড়ির ভোজনে একজন শিক কাবাব গোছের কিছু বানাচ্ছে।
………………………………………………………………………………………………………………………………….
বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম কী অন্যায় করলাম! কাবাবের সঙ্গে তো সেই পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারতের সম্পর্ক! হ্যাঁ, নাম হয়তো আলাদা ছিল, কিন্তু খাবারটা তো কাবাবই ছিল! বাঙালি আমিষ খায় বলে না হয় ভারতচন্দ্র তাঁর ‘অন্নদামঙ্গল’-এ লিখেছেন দেবী অন্নপূর্ণা রাঁধেন ‘অন্নমাংস সিকভাজা কাবাব করিয়া’, কিন্তু রামায়ণের অযোধ্যা কাণ্ডে শিকার করে আনা হরিণের মাংস ঝলসে খাওয়ার কথা লেখা আছে। মহাভারতে রাজা দুষ্মন্তর শিকারে গিয়ে চটজলদি পশুর মাংস পুড়িয়ে খাওয়ার বর্ণনা রয়েছে। এমনকী, ১৬৪০ সালে আঁকা মেওয়ারের রামায়ণ পুঁথি-তে পরিষ্কার দেখা যায় রামচন্দ্রের বাড়ির ভোজনে একজন শিক কাবাব গোছের কিছু বানাচ্ছে। সংস্কৃত প্রাচীন রন্ধনশৈলীর পুঁথি ‘ক্ষীমকুতুহলম’-এও কাবাবের উল্লেখ রয়েছে। হ্যাঁ, এটা সত্যি যে শূলপক্ক মাংসকে কাবাব উপাধিতে ভূষিত করেছে পারস্য দেশ, কারণ ফার্সিতে ‘কম’ আর ‘আব’– মানে হল কম জল, সেইখান থেকেই কাবাব নামের উৎপত্তি, কারণ কাবাব রান্নায় জল প্রায় দেওয়াই হয় না। কিন্তু সে তো সংস্কৃতেও ‘অব’ মানে জল! যাই হোক, কাবাব শব্দটার মালিকানা না হয় মধ্যপ্রাচ্যের হাতে ছেড়ে দিলেও কাবাবের ভারতবর্ষে প্রবেশ মুসলিম শাসকদের হাত ধরে– এই মতবাদ জল মেশানো, সেটা রামায়ণ আর মহাভারতের উদাহরণেই বললাম। আদপে কাবাবের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক যুগ যুগ ধরে, সেই প্রাচীন কাল থেকে মধ্যযুগ অবধি। মধ্যযুগেও বিভিন্ন গল্পে রাজাদের শিকারে বা ‘মৃগয়ায়’ বেরনোর গল্প শোনা যায় । এখনকার গলফের মতো শিকার ছিল এক কর্পোরেট ব্যাপার– রাজারা একসঙ্গে মিলিত হয়ে শিকার করার ফাঁকে আইন ও আগ্রাসন নিয়ে পরামর্শ সেরে নিতেন আর সেই শিকারে পাওয়া মাংস খোলা কাঠের আগুনে ঝলসে নুন আর লেবু ঘষে খাওয়া হত, উদবৃত্ত মাংস আচার মাখিয়ে রেখে দেওয়া হত পরের দিনের খাবার হিসেবে। সেই ঝলসানো মাংস পরবর্তী কালে কাবাব নামে বাজার মাতাচ্ছে। গপ্পে বলে, মহারাজ পুরু, আলেকজান্ডারকে আপ্যায়ন করেছিলেন এইরকম এক পদ দিয়ে।
এক এক কাবাবের পিছনে এক এক গল্প। ইরানের জাতীয় খাবার চেলো কাবাব– সেই দেশে ‘চেলো’ শব্দের মানে ‘সেদ্ধ ফেন ঝরা ভাত’– চেলোর সঙ্গের কাবাবটা এসেছিল প্রতিবেশী ককেশিয়দের কাবাব– কুবিদেহ থেকে। কথিত আছে, কাজার সাম্রাজ্যের নবাব নাসির-এ-দিন শাহ প্রায় শুক্রবার ‘সপরিবারে’ (তাঁর চার স্ত্রী, সাতাশি উপপত্নী, দু’শো ক্রীতদাসী-সহ) আর চাকরের দল– সব মিলিয়ে প্রায় হাজার খানেক লোক নিয়ে হজরত আব্দুল আজিমের দরগায় যেতেন। বিবিসাহেবারা ওখানকার কুবিদেহ খেতে পছন্দ করতেন বলে পত্নী আর উপপত্নীদের প্রতি স্নেহশীল বাদশা স্থানীয় ককেশিয়দের কাছ থেকে এক বিশেষ কুবিদেহ বানানোর কৌশল আদায় করেছিলেন, আর সেই কৌশলে প্রথম আজকের চেলো কাবাব তৈরি হয়।
তুণ্ডা কাবাবও তৈরি হয়েছিল এক কাবাব-প্রেমিক দন্তহীন নবাবের জন্যে, যিনি কাবাবের টানে ঘোষণা করেছিলেন, তাঁকে যে সবচেয়ে নরম মাংস খাওয়াতে পারবে, সে এক বিশেষ নবাবি পারিতোষিক পাবে। এক নুলো হাজি মুরাদ আলী, যাকে তার প্রতিবন্ধকতার জন্যে লোকে তুণ্ডা মিয়াঁ বলত– এই বাজি জিতে নেন এক মনপসন্দ কাবাব বানিয়ে। এই কাবাব বানাতে তুণ্ডা মিয়াঁ একশো ষাট রকমের শেকড় আর মশলা নাকি ব্যবহার করেন, যার মধ্যে নাকি সোনা ভস্ম, রুপো ভস্ম থেকে শুরু করে চন্দনকাঠ অবধি ছিল। আসল তুণ্ডা কাবাবের কৌশল আজও গোপনীয়, শুধু তুণ্ডা মিয়াঁর পরিবারের মহিলাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়।
কাকোরি কাবাবের নাম এসেছে লখনউয়ের পাশে এক ছোট্ট শহরতলি কাকোরি থেকে। সেখানে হজরত শাহ আবি আহদের দরগায় মাথা ঠেকাতে আসা লক্ষ লক্ষ ভক্তদের খাওয়ানোর জন্যে স্থানীয় পাচকরা এক ‘তবাররুখ পরশাদ’ বানায়, যেটা পরে কাকোরি কাবাব হয়ে দাঁড়ায়। গালৌতি কাবাব বানানো হয়েছিল বর্ষীয়ান নবাব ওয়াজেদ আলী শা-এর জন্যে। প্রথমে রাজ্য, তারপর দাঁত– একের পর এক প্রিয় জিনিস হারিয়ে নবাব শোকে মুহ্যমান হয়ে পরেছিলেন, মাংসের প্রতি তাঁর ছিল দুর্নিবার আকর্ষণ। কচি পেঁপের ক্কাথ, নির্দিষ্ট কিছু শেকড় আর মশলা মিহি করে বেটে মাংসে মাখিয়ে তাকে নরম করে গাওয়া ঘিতে ভেজে গলৌতি কাবাব বানানো হয়েছিল, যা মুখে গলে যায়, আর সেখান থেকেই এর নাম।
বেনারস থেকে লখনউ অবধি পৌঁছে গিয়েছিলাম কাবাবের লোভে। তুণ্ডা থেকে শুরু করে পেশাওয়ারি, কাকোরি, হরিয়ালি, বর্রা কাবাব– সব খেয়ে আমার সোনার কেল্লার মুকুলের মতো বলতে ইচ্ছে করল ‘আমি বাড়ি যাব। কলকাতায়।’ ‘ভাজারদুয়ারি’র হেঁশেল গোটানোর আগে কলকাতার জন্যে মন কাঁদার কারণ বলে দিই– পার্ক সার্কাস, জাকারিয়া স্ট্রিট, তালতলা বাদই দিলাম, আমাদের কলকাতার বাগবাজার, সুকিয়া স্ট্রিট থেকে শুরু করে রাসবিহারী কানেক্টর, গড়িয়াতে গজিয়ে ওঠা পথের পাশের কাবাবের দোকানগুলো ইদানীং যে কাবাব বানাচ্ছে, আজকের তারিখে অন্য শহরদের বিরুদ্ধে খেলতে নামলে তারা ড্র তো করবেই, জিতে গেলেও আশ্চর্য হব না!
(সমাপ্ত)
…ভাজারদুয়ারি-র অন্যান্য পর্ব…
ভাজারদুয়ারি পর্ব ২৩: কোফতা যেভাবে হয়ে উঠেছিল ‘লাই-ডিটেক্টর’
ভাজারদুয়ারি পর্ব ২২: শীতে চর্বির পিঠে গত কয়েক মরশুমেই ছক্কার পর ছক্কা মারছে
ভাজারদুয়ারি পর্ব ২১: যে ভারতীয় খাবারের রেসিপি জোগাড় করতে না পারায় প্রাণ দিয়েছিলেন সাহেব
ভাজারদুয়ারি পর্ব ২০: নর্স ভাষায় ‘কাকা’ নামে এক ধরনের রুটি ছিল, যা আজকের কেকের পূর্বপুরুষ
ভাজারদুয়ারি পর্ব ১৯: গোস্ত কা হালুয়া, বলেন কী!
ভাজারদুয়ারি পর্ব ১৮: আরে, এ তো লিট্টির বৈমাত্রেয় ভাই!
ভাজারদুয়ারি পর্ব ১৭: ল্যাদের সঙ্গে খিচুড়ির অবৈধ সম্পর্ক
ভাজারদুয়ারি পর্ব ১৬: আগুন যখন পবিত্র, ঝলসানো মাংসই সুপারহিট
ভাজারদুয়ারি পর্ব ১৫: শ্রমের বিনিময়ে খাদ্য– এভাবেই তৈরি হয়েছিল বিরিয়ানি
ভাজারদুয়ারি পর্ব ১৪: যে সুস্বাদু জিলিপি আর ফাফরার জন্যে দুরন্ত ষাঁড়ের পিছনেও ছোটা যায়
ভাজারদুয়ারি পর্ব ১৩: শ্রীকৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনামকে টেক্কা দেবে ভাতের বিবিধ নাম
ভাজারদুয়ারি পর্ব ১২: জুয়া-লগ্নে যে খাবারের জন্ম, এখন তা ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে
ভাজারদুয়ারি পর্ব ১১: নারকোলের বিদেশযাত্রা
ভাজারদুয়ারি পর্ব ১০: সন্দেশের ব্যাপারে একটি জরুরি সন্দেশ
ভাজারদুয়ারি পর্ব ৯: আলু গোল বলে আলুর চপকেও গোল হতে হবে নাকি?
ভাজারদুয়ারি পর্ব ৮: পা দিয়ে ময়দা মেখে রুটি বানানো হয় বলে নাম পাউরুটি, এ এক্কেবারেই ভুল কথা!
ভাজারদুয়ারি পর্ব ৭: যুদ্ধক্ষেত্রে রুটির ওপরে চিজ আর খেজুরই আজকের পিৎজা
ভাজারদুয়ারি পর্ব ৬: পান্তা ভাতে টাটকা বেগুনপোড়া
ভাজারদুয়ারি পর্ব ৫: ইউরোপের ক্রেপ-কে গোলারুটির চ্যালেঞ্জ
ভাজারদুয়ারি পর্ব ৪: ২০০ পরোটা কোন রাক্ষসে খায়!
ভাজারদুয়ারি পর্ব ৩: হাজার বছর পার করেও বাসি হয়নি শিঙাড়ার যাত্রা
ভাজারদুয়ারি পর্ব ২: পাড়ার মোড়ের দোকানের চপ-তেলেভাজা হচ্ছে টিভি সিরিয়াল
ভাজারদুয়ারি পর্ব ১: বাঙালি তেলে ভাজবে না ঘি-এ ভাজবে?