রুশ সাহিত্যিকরাও ননী ভৌমিককে লেখক হিসেবে চিনতেন না। ননী ভৌমিকের অগ্রবর্তী, তাঁর সমসাময়িক এবং তাঁর পরবর্তী বহু খ্যাত-অখ্যাত লেখকের গল্প-উপন্যাস বাংলা থেকে রুশ ভাষায় অনূদিত হয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন প্রকাশ ভবন থেকে প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু ননী ভৌমিকের কোনও লেখা রুশ ভাষায় অনূদিত হয়নি। তাই তিনি কেমন লেখক, সেটাও ওদেশের কোনও লেখকের পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না। নিজের বই অনুবাদের জন্য তিনি কোথাও কারও কাছে দরবার করতে যাননি। বহু বিশিষ্ট রুশ অনুবাদকের সঙ্গে ওঁর পরিচয় ছিল। কিন্তু উনি নিজের সম্পর্কে কাউকে কখনও বলতেন না।
২৫.
ননীদার বিদ্রোহী মনটা ছকে পড়ে গিয়েছিল
‘ধুলোমাটি’-র লেখক ননী ভৌমিক তাঁর একমাত্র উপন্যাস সম্পর্কে মাত্র একবারই কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে, এটিকে তাঁর একটি এপিকধর্মী ট্রিলজি করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু বাস্তবে সেটা আর হয়ে ওঠেনি। মস্কো চলে আসার পরও হয়তো প্রথম প্রথম একটা ক্ষীণ ইচ্ছে তাঁর ছিলও। কিন্তু বিদেশের মাটিতে থেকে যে তা করা সম্ভব নয়, সেটা বুঝতে পেরে বাস্তব কারণেই সে পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত তাঁকে ত্যাগ করতে হয়। জিজ্ঞেস করলেই বলতেন, তা কী করে সম্ভব? ননীদার অনুজ কৃষ্ণগোপাল ভৌমিকের একটি সাক্ষাৎকার (গল্পসরণি, বার্ষিক সংকলন: ১৪১৭, ননী ভৌমিক বিশেষ সংখ্যা, পৃ. ৪১৫) থেকে জানতে পারছি: ‘‘আমাকে দাদা বলেছিলেন যে ‘ধুলোমাটি’ উপন্যাসের আরো দুটি খণ্ড লিখবেন। আমার বোনও দাদাকে ধুলোমাটির পরবর্তী অংশ লেখার জন্য অনুরোধ করেছিল। কিন্তু দাদা মস্কো থেকে ফিরে এসে বলেছিলেন– হবে না। ডাল চচ্চড়ি না খেলে ‘ধুলোমাটি’র মতো উপন্যাস লেখা যায় না। তবু আমার বোন বলেছিল তুই তাহলে আর লিখবি না? দাদা বলেছিলেন– ও আর আমার দ্বারা হবে না।’’
রুশ সাহিত্যিকদের সঙ্গে আমাদের অনুবাদকদের মেলামেশা করার সুযোগ ছিল না, যদি না কোনও সেমিনারে দেখা হল বা ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ বা সাক্ষাৎকার হল। অর্থাৎ, নিজের দেশের সাহিত্যিক মহল থেকে তো বটেই, ওদেশের সাহিত্যিক মহল থেকেও ননী ভৌমিক বিচ্ছিন্ন– তাহলে আর কী করে কোনও মৌলিক লেখা সম্ভব? রুশ সাহিত্যিকরাও ননী ভৌমিককে লেখক হিসেবে চিনতেন না। ননী ভৌমিকের অগ্রবর্তী, তাঁর সমসাময়িক এবং তাঁর পরবর্তী বহু খ্যাত-অখ্যাত লেখকের গল্প-উপন্যাস বাংলা থেকে রুশ ভাষায় অনূদিত হয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন প্রকাশ ভবন থেকে প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু ননী ভৌমিকের কোনও লেখা রুশ ভাষায় অনূদিত হয়নি। তাই তিনি কেমন লেখক, সেটাও ওদেশের কোনও লেখকের পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না। নিজের বই অনুবাদের জন্য তিনি কোথাও কারও কাছে দরবার করতে যাননি। বহু বিশিষ্ট রুশ অনুবাদকের সঙ্গে ওঁর পরিচয় ছিল। কিন্তু উনি নিজের সম্পর্কে কাউকে কখনও বলতেন না। ‘ধুলোমাটি’ উপন্যাসটা অন্তত রুশ ভাষায় অনুবাদ হতেই পারত। কিন্তু নিজের প্রসঙ্গ উঠলে সব সময় তিনি বলতেন– ওসব বাদ দাও।
মুশকিল হত সভে্তলানাকে নিয়ে। কিছু কিছু বাংলা আর ইংরেজিও তিনি বুঝতে পারতেন। আমাদের কথাবার্তার মাঝখানে ওঁর কথা বলা চাই। ভাঙা ভাঙা বাংলায় এবং বেশিরভাগই রুশিতে তিনি তাঁর মন্তব্য প্রকাশ করতেন। আসরে যাঁরা রুশি বুঝতেন না, তাঁদের জন্য অনুবাদ করার ভার ননীদার ওপর। ননীদা সে কাজে আমাকে ভিড়িয়ে দিয়ে মজা পেতেন। অনেক সময়ই অজুহাত দেখাতেন, ‘আমার চেয়ে ভালো বলতে পারবে।’ অনেক সময়ই আমি ফ্যাসাদে পড়তাম। অপ্রীতিকর কোনও কথা থাকলে তা বাদ দিতে গেলে অথবা অনুবাদে কোনও ভুলচুক হলে ঠিক ধরে ফেলতেন সভে্তলানা– প্রচণ্ড রেগে যেতেন, পরিস্থিতি ঘোরালো করে তুলতেন।
ননীদা যেমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারকেই হেসে উড়িয়ে দিতেন, তেমনই তিলকে তাল করার ব্যাপারে সভে্তলানার জুড়ি মেলা ভার। আমাদের আলোচনার ভাষা কোনও কোনও সময় তাঁর কাছে দুর্বোধ্য হয়ে পড়লে তিনি ধমক দিয়ে রুশ ভাষায় কথা বলতে আমাদের বাধ্য করতেন। ননীদা অসাধারণ লেখক ছিলেন, দেশে খ্যাতনামা সাহিত্যিক ছিলেন– আমাদের মুখে একাধিকবার এ ধরনের কথা শুনতে শুনতে তিনি বিরক্ত। ‘ধুলোমাটি’ ও ‘ধানকানা’-র লেখক সম্পর্কে কতটুকু ধারণাই বা তাঁর থাকতে পারে। অথচ আমরা কেন ননীদাকে অতীতের পর্যায়ে ফেলছি, এই জন্য সভে্তলানার ক্ষোভ। রেগে চিৎকার করে উঠতেন, প্রতিবাদ করে বলতেন, ‘ছিলেন বলছ কেন? ননী এখনও লেখক।’ ননীদা যে দেশে ফিরতে পারছেন না, তাঁর সাহিত্যিক জীবনের যে অবসান ঘটল বিদেশ স্থায়ী আস্তানা গাড়ার ফলে, তার জন্য কি মনে মনে কোনও অপরাধবোধ কাজ করছে সভে্তলানার? সেই জন্যই কি এই প্রতিক্রিয়া? আমাদের ক্ষোভটা তিনি যেন বুঝতে চাইতেন না। ‘ধুলোমাটি’, ‘ধানকানা’-র লেখক সম্পর্কে তাঁর স্পষ্ট কোনও ধারণা না থাকলে আমাদের ক্ষোভ বোঝার মতো বুদ্ধি যে তাঁর ছিল না, তা মনে হয় না। আসলে প্রসঙ্গটা তাঁর কাছে হত অপ্রীতিকর, তাই প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলতেন জোর করে। আমরাও চুপ করে যেতাম। ননীদাও স্বস্তি পেতেন। আবার কোনও অসতর্ক মুহূর্তে সভে্তলানার উপস্থিতিতেই আমরা কেউ যদি মুখ ফসকে বলে ফেলতাম– আর কেন ননীদা, এবারে দেশে চলুন, অমনি সভে্তলানা কটমট করে তাঁর দিকে তাকাতেন। সভে্তলানা আমাদের দেশে থাকতে চাননি। ননীদা বলতেন, ও তাহলে কোথায় যাবে? দেখেশুনে মনে হত প্রেমের রসায়ন বাস্তবিকই ভারি বিচিত্র। কোনটা ‘বড় প্রেম’, কোনটা ‘ছোট প্রেম’– তা নির্ধারণ করা বড় কঠিন।
সভে্তলানার কাছে আমার সবাই কোনও না কোনও কারণে খারাপ হয়েছি– সে তাঁর খামখেয়ালি স্বভাবের জন্য। কিন্তু পরে দেখা হলেই অমায়িক অভ্যর্থনা জানাতেন, যেন আগের দিন কিছুই হয়নি। ননীদাকে কিন্তু কখনও কারও ওপর রাগ করতে দেখিনি। কারও ওপর রাগ করলেও রাগের প্রকাশটা হত কৃত্রিম। বড়জোর বলতেন, ওকে পশ্চাদ্দেশে লাথি মেরে বের করে দাও। পরক্ষণেই হেসে উঠতেন ‘হাঃ হাঃ’ করে। ওঁর মুখে কারও নিন্দা কখনও শুনিনি। আমরা যখন ওঁর সামনে কারও নিন্দা করতাম, উনি শুনে শুধু প্রশ্ন করতেন, ‘তাই নাকি?’ তারপর মজা করে দরাজ হেসে প্রসঙ্গটি উড়িয়ে দিতেন। আমরা মিইয়ে যেতাম, কিন্তু নিন্দাচর্চা ছাড়া কি আসর জমে? ননীদার সেই অভাবটুকু সুদেমূলে পুশিয়ে দিতেন সভে্তলানা। তবে মানতে হবে, তাঁর নিন্দাচর্চার মধ্যে বিদ্বেষের কোনও জ্বালা থাকত না, রাগ পুষে রাখা ওঁর স্বভাব নয়।
ক্ষোভ ছিল, অভিমান ছিল– এটা বুঝতে অসুবিধে হয় না। ‘প্রগতি’তে কাজ করতে গিয়ে তাঁকে অনুবাদ করতে হয় বেশিরভাগই রাজনীতি, সমাজনীতি ও অর্থনীতি সংক্রান্ত বই। আর ছিল শিশুসাহিত্য। শিশুসাহিত্যের অনুবাদে তিনি স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন। ক্ল্যাসিক রুশ সাহিত্য ওদের কর্মসূচিতে কদাচিৎ থাকত। শিশুদের জন্য অনেক ছড়াও তিনি অনুবাদ করেছেন। অসাধারণ সে অনুবাদ। পরবর্তীকালে ‘পঞ্চাশজন সোভিয়েত কবি’ এবং ‘পুশকিনের কবিতা সংকলন’ প্রগতি থেকে বাংলায় প্রকাশিত হয়েছিল, কিন্তু সে অনুবাদের ভার পেলেন না ননীদা। পেলেন না অথবা তাঁর কাছে তখন সব সমান বলে সে ভার তিনি নিলেন না। অথচ ইচ্ছে করলে কবিতার অনুবাদও তিনি করতে পারতেন– ওঁর সাহিত্য জীবনই তো শুরু হয়েছিল কবিতা দিয়ে। কিন্তু ওখানে অনুবাদকের পছন্দ অপছন্দের কোনও জায়গা ছিল না। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। একটা বাঁধা ছকের মধ্যে পড়ে গেল এককালের বিদ্রোহী মনটা।
একেক সময় তাই অনুবাদকের কলম তাঁকে ধরতে হয়েছে ‘ধুত্তোর’ মনোভাব নিয়ে। ১৯৮২ সালে সাহিত্য অনুবাদের জন্য ‘রাদুগা’ প্রকাশন আলাদাভাবে প্রতিষ্ঠিত হলেও ননীদা তাতে আর যোগ দিলেন না, রয়ে গেলেন ‘প্রগতি’তেই। তাঁর তখন নির্বিকার ভাব– রাজনৈতিক প্রবন্ধ বা সাহিত্য– তাঁর কাছে সব সমান। অবশ্য অনেক সময় ‘রাদুগা’ ‘প্রগতি’র কাজের বাইরেও ননীদাকে অনুবাদের কাজ দিত। আমি যেমন ‘রাদুগা’র কাজের বাইরে ‘প্রগতি’, ‘সোভিয়েত নারী’, ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন’-এর কাজ করতাম, ননীদা আগে থেকেই ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন’ ও ‘সোভিয়েত নারী’-র কাজ করতেন। ওদের এ জন্য আলাদা কোনও স্টাফ ছিল না।
শেষ কয়েক বছর অবশ্য জোর করে ভুলে থাকার কষ্ট স্বীকার করতে হচ্ছিল না ননীদাকে। তিনি ছিলেন নিজের এক মনগড়া জগতে।
১৯৮৯ সালে ‘বঙ্কিম পুরস্কার’ যখন তিনি পেলেন, তার অনেক আগেই তিনি ফুরিয়ে গিয়েছিলেন– সব দিক থেকেই। যে সময়ে তাঁর পুরস্কার প্রাপ্তির কথা ঘোষিত হল, তখন তাঁর জীবনের চরমতম ট্র্যাজেডি। যেমন তাঁর জীবনের অন্তিম মুহূর্তে, তেমনই ওই ট্র্যাজিক মুহূর্তেও থাকতে পারিনি তাঁর পাশে– এ আমার বড় আক্ষেপ।
আমি তখন ছুটি কাটাতে কলকাতা এসেছি। এখানকার কাগজেই খবর পেলাম ননীদার ‘বঙ্কিম পুরস্কার’ প্রাপ্তির সংবাদ, এও শুনলাম যে উনি নিজে পুরস্কার নিতে আসবেন। ২৮ জুন রবীন্দ্রসদনে এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার লেখকের হাতে তুলে দেওয়া হবে। কিন্তু আসা হল না যথাসময়ে। তার দু’দিন বাদেই আকস্মিক দুঃসংবাদ– ননীদার একমাত্র সন্তান দিমার শোচনীয় মৃত্যু। আকস্মিক দুর্ঘটনার বলি হল ২৬ বছরের এক তরতাজা যুবক। কিন্তু আকস্মিক দুর্ঘটনা বলেই ছেড়ে দেব কি? নাকি কোনও অমোঘ নিয়মের পরিণতি? দিমার মৃত্যুটা ছিল খুবই রহস্যজনক। কোনও এক অর্ধসমাপ্ত পরিত্যক্ত বাড়ির চাতালে তাঁকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় ভোররাত্রে, বোতলের ভাঙা কাচ ফুটে পায়ের শিরা কেটে গিয়েছিল। সারারাত রক্তক্ষরণের ফলে মৃত্যু। যতদূর জানি, রহস্যের কোনও কিনারা হয়নি। কোনও তদন্তই বা কেন হল না, নাকি সবটাই চাপা পড়ে গেল– সেও এক রহস্য। শোনা যায়, লেনিনগ্রাদের কোথায় নাকি দিমার পুত্রসন্তান আছে।
………………………………………………………………
দিমার মৃত্যুসংবাদ ‘প্রগতি প্রকাশন’-এ ননীদার সহকর্মীরা যে রাতে জানতে পারলেন, সেটাও ভারি অদ্ভুত। ‘প্রগতি’র বাংলা বিভাগের প্রধান সম্পাদিকা কোন এক সূত্রে জানতে পারলেন দিমার মৃত্যুসংবাদ। সংবাদের সত্যতা যাচাই করার জন্য বাংলা বিভাগে আমাদের বন্ধু দ্বিজেন শর্মাকে ফোন করেন তিনি। দ্বিজেনদাও জানেন না সেই সংবাদ। ঠিক হল তিনিই নদীদাকে ফোন করে কোনওভাবে যাচাই করে নেবেন। দ্বিজেনদা বোধহয় সেই সময় বাংলাদেশের বাংলা অকাদেমির কোনও একটা পুরস্কার পেয়েছিলেন, সংবাদটা শোনার পর তিনি নাকি বলেছিলেন, তিনিও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উচ্চশিক্ষা মন্ত্রকের ‘বঙ্কিম পুরস্কার’-এ ভূষিত হয়েছেন।
………………………………………………………………
বিলম্বে হলেও ১৯৮৯ সালের সেপ্টেম্বরে ননীদা কলকাতায় ‘বঙ্কিম পুরস্কার’ নিতে এসেছিলেন– সস্ত্রীকই এসেছিলেন। এই সময় তিনি দু’-একটি সাক্ষাৎকারও দিয়েছিলেন। কিন্তু তখন খুব একটা স্বাভাবিক তিনি ছিলেন না। আমি আবার ততদিনে মস্কোয় ফিরে গিয়েছি।
মস্কো ফিরে পরে ননীদার সঙ্গে দেখা হলেও সমবেদনা জানাতে পারিনি তাঁকে, কারণ সেটা জানাতে গেলেও তো দিমার মৃত্যুসংবাদকে স্বীকৃতি দিতে হয়, অথচ ননীদা তা স্বীকার করতে নারাজ।
দিমার মৃত্যুসংবাদ ‘প্রগতি প্রকাশন’-এ ননীদার সহকর্মীরা যে রাতে জানতে পারলেন, সেটাও ভারি অদ্ভুত। ‘প্রগতি’র বাংলা বিভাগের প্রধান সম্পাদিকা কোনও এক সূত্রে জানতে পারলেন দিমার মৃত্যুসংবাদ। সংবাদের সত্যতা যাচাই করার জন্য বাংলা বিভাগে আমাদের বন্ধু দ্বিজেন শর্মাকে ফোন করেন তিনি। দ্বিজেনদাও জানেন না সেই সংবাদ। ঠিক হল তিনিই নদীদাকে ফোন করে কোনওভাবে যাচাই করে নেবেন। দ্বিজেনদা বোধহয় সেই সময় বাংলাদেশের বাংলা অকাদেমির কোনও একটা পুরস্কার পেয়েছিলেন, সংবাদটা শোনার পর তিনি নাকি বলেছিলেন, তিনিও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উচ্চশিক্ষা মন্ত্রকের ‘বঙ্কিম পুরস্কার’-এ ভূষিত হয়েছেন। এরপর ফোনে দু’জনের দীর্ঘ কথোপকথন, এমনকী, হাসি-তামাশাও নাকি চলে। ততক্ষণে দ্বিজেনদা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছেন যে দিমার মৃত্যুসংবাদ মিথ্যা। শেষকালে জিজ্ঞেস করলেন, ‘যা হোক ভালো আছেন তো?’ ননীদার উত্তর– ‘আছি তো এমনিতে ভালোই, তবে ছেলেটা গত রাতে মারা গেল…।’ ঠিক এইরকমই কোনও একটা মুহূর্ত থেকে ননীদা আর স্বাভাবিক ছিলেন না, তাই তিনি যখন ‘বঙ্কিম পুরস্কার’ নিতে দেশে গিয়েছিলেন, তখনও খুব একটা স্বাভাবিক ছিলেন না।
ননীদার চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছিল। দিমার শ্রাদ্ধবাসরে তাঁকে কেউ কাঁদতে দেখেনি। সভে্তলানা অবশ্য কেঁদেছিলেন, কিন্তু ননীদা সেখানেও রসিকতা করে গিয়েছেন।
……………………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………………
এর পর থেকেই এক আশ্চর্য জগতে বাস করতে লাগলেন ননীদা। সেখানে নিত্য প্রতীক্ষা করছেন ননীদা। দিমা কলকাতায় গিয়েছে, শিগগিরিই ফিরে আসবে, যে কোনও দিন ফিরতে পারে। দিমা মারা যাওয়ার পর প্রথম যেদিন ননীদার বাড়ি গিয়েছি, ননীদা ও সভে্তলানার সঙ্গে কথাবার্তা বলার পর বিদায় নিয়ে চলে আসছি, ননীদা বললেন– ‘যাওয়ার সময় দরজাটা খোলা রেখো, দিমা আবার কখন আসে কে জানে!’ সভে্তলানা অসহায়ের মতো ছলছল চোখে আমার দিকে চেয়ে রইলেন।
…পড়ুন রুশকথা-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ২৪। মস্কোয় শেষের বছর দশেক ননীদা ছিলেন একেবারে নিঃসঙ্গ
পর্ব ২৩। শেষমেশ মস্কো রওনা দিলাম একটি মাত্র সুটকেস সম্বল করে
পর্ব ২২। ‘প্রগতি’-তে বইপুথি নির্বাচনের ব্যাপারে আমার সঙ্গে প্রায়ই খিটিমিটি বেধে যেত
পর্ব ২১। সোভিয়েতে অনুবাদকরা যে পরিমাণ অর্থ উপার্জন করত, সে দেশের কম মানুষই তা পারত
পর্ব ২০। প্রগতি-র বাংলা বিভাগে নিয়োগের ক্ষেত্রে ননীদাই শেষ কথা ছিলেন
পর্ব ১৯। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় নাকি খুব ভালো রুশভাষা জানতেন, প্রমথনাথ বিশী সাক্ষী
পর্ব ১৮। লেডি রাণু মুখার্জিকে বাড়ি গিয়ে রুশ ভাষা শেখানোর দায়িত্ব পড়েছিল আমার ওপর
পর্ব ১৭। একদিন হঠাৎ সুভাষদা আমাদের বাড়ি এসে উপস্থিত ফয়েজ আহমেদ ফয়েজকে নিয়ে
পর্ব ১৬। মুখের সেই পরিচিত হাসিটা না থাকলে কীসের সুভাষ মুখোপাধ্যায়!
পর্ব ১৫। রুশ ভাষা থেকেই সকলে অনুবাদ করতেন, এটা মিথ
পর্ব ১৪। মস্কোয় ননীদাকে দেখে মনে হয়েছিল কোনও বিদেশি, ভারতীয় নয়
পর্ব ১৩। যিনি কিংবদন্তি লেখক হতে পারতেন, তিনি হয়ে গেলেন কিংবদন্তি অনুবাদক
পর্ব ১২। ‘প্রগতি’ ও ‘রাদুগা’র অধঃপতনের বীজ কি গঠনপ্রকৃতির মধ্যেই নিহিত ছিল?
পর্ব ১১। সমর সেনকে দিয়ে কি রুশ কাব্যসংকলন অনুবাদ করানো যেত না?
পর্ব ১০। সমর সেনের মহুয়ার দেশ থেকে সোভিয়েত দেশে যাত্রা
পর্ব ৯। মস্কোয় অনুবাদচর্চার যখন রমরমা, ঠিক তখনই ঘটে গেল আকস্মিক অঘটন
পর্ব ৮: একজন কথা রেখেছিলেন, কিন্তু অনেকেই রাখেননি
পর্ব ৭: লেনিনকে তাঁর নিজের দেশের অনেকে ‘জার্মান চর’ বলেও অভিহিত করত
পর্ব ৬: যে-পতাকা বিজয়গর্বে রাইখস্টাগের মাথায় উড়েছিল, তা আজ ক্রেমলিনের মাথা থেকে নামানো হবে
পর্ব ৫: কোনটা বিপ্লব, কোনটা অভ্যুত্থান– দেশের মানুষ আজও তা স্থির করতে পারছে না
পর্ব ৪: আমার সাদা-কালোর স্বপ্নের মধ্যে ছিল সোভিয়েত দেশ
পর্ব ৩: ক্রেমলিনে যে বছর লেনিনের মূর্তি স্থাপিত হয়, সে বছরই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার সূচনাকাল
পর্ব ২: যে দেশে সূর্য অস্ত যায় না– আজও যায় না
পর্ব ১: এক প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে রাশিয়ার খণ্ডচিত্র ও অতীতে উঁকিঝুঁকি