রাহুল ঝড়ের গতিতে প্রস্তুতি শুরু করে দিল। আলিপুরদুয়ারে ফোন করে অতনুকে জানাল সে যাচ্ছে। কিন্তু কাকপক্ষীতেও যাতে খবর না পায়। একদম ছোট টিম সঙ্গে নিচ্ছে রাহুল। দরকার হলে স্থানীয় পুলিশের সাহায্য নেওয়া যাবে।
২৭.
কিছুদিন কাটল।
রাহুল বুঝতে পারছে যেকোনও দিনই তার হাত থেকে দায়িত্ব যাবে। ডিপার্টমেন্টে বেইজ্জত, আর সত্যি কথা বলতে কী, নিজের মধ্যেও একটা অস্বস্তি। সুনেত্রা বারবার হারিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। থানার সিসি ক্যামেরার ছবির যা হাল, মহিলা যেভাবে জেনেবুঝে পজিশন নিয়েছিল, তাতে ছবি খুব একটা কাজে লাগাও কঠিন। তবু, রুটিন কাজ চলছে।
কুসুমডিহা স্বাভাবিক, তবে কোনও এক অজানা আশঙ্কার মেঘ মাঝেমধ্যে আকাশে ভেসে বেড়ায়। সুমিতকে ঘিরে রেশমির যে আবেগটা কাজ করছিল, সেটা মাঝপথে থমকেই গিয়েছে। হিরো ভাবটাই নেই। সুমিত চাকরি করে, আর সমাজসেবাটা চৌকাঠের মধ্যে, শখের। এর সাহস নেই, ঝুঁকির মানসিকতা নেই। আকর্ষণটা চলে যাচ্ছে রেশমির। হৃদয় ভেসে যাচ্ছিল। এখন নিজের হৃদয়ের লাগাম ধরে নিয়েছে রেশমি।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
অতনু সমাদ্দারের গলায় এই ‘সমর বারুই মডেল’-এর প্রতিধ্বনি ছিল। আলিপুরদুয়ার জেলে সন্দেহ করেছে দু’জনকে। অথচ সরাসরি চেনে না অতনু। সবদিক থেকে সন্দেহ প্রবল। তাই রাহুলকে ফোন করেছে। কাদের সন্দেহ, কেন সন্দেহ জানিয়েছে সবিস্তারে। অতঃপর রাহুলের এই চাঞ্চল্য এবং আলিপুরদুয়ার সফর। টিমে লেডি কনস্টেবল নীলিমাকেও রেখেছে, রাখতে হয়েছে, লাগবে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সাগরটিলার ওপরটা যেন তছনছ। সেই প্রাণভরা উপদ্বীপ থমথমে। পুলিশ-চৌকিতে দু’জন করে বসছে। এখানে লুকিয়ে ছিল সুনেত্রারা। হয়তো না বুঝে ছদ্মপরিচয়ে বিভ্রান্ত হয়েই থাকতে দিয়েছিল। কিছুদিন থানা-পুলিশের চক্করে কোমর ভেঙে গিয়েছে গরিব মানুষগুলোর।
একটা চাপা জল্পনা ঘোরে কুসুমডিহাতে। বিদ্যুৎ রাগ মেটাতে আসবেই, আজ না হলে কাল। কে ঠেকাবে তাকে? পুলিশ না কমরেড ব্রহ্মা? ব্রহ্মা কি এখনও কুসুমডিহার ওপর নজর রাখছেন?
দূরের জেলে বন্দি কমরেড বিশাল আর কমরেড রুদ্র খানিকটা নিশ্চিন্ত। ঝুঁকির অপারেশনের পর পুলিশ খুঁজে বেড়ালেও সুনেত্রা ধরা পড়েনি। নিশ্চয়ই নিরাপদ কোনও জায়গায় গা ঢাকা দিয়েছে। ঠিক এরকম যখন একটা– ন যযৌ ন তস্থৌ পরিস্থিতি, ঠিক তখন রাতের দিকে একটা ফোন পেল রাহুল। অতনু সমাদ্দারের ফোন। অতনু জেল সার্ভিসে আছে। সে যখন আরামবাগের জেলার ছিল, তখন কাজের সূত্রেই রাহুলের সঙ্গে আলাপ। সেই আলাপটা থেকে গিয়েছে।
মিনিট দশেক কথা হল দু’জনের। রাহুলের চেহারায় ক্রমশ পরিবর্তন। হতাশ, ক্লান্ত মুখটা যেন আবার জেগে উঠছে। ফোন ছাড়ার পর একটু ভাবল। তারপর সটান ফোন করল ত্রিপাঠী সাহেবকে।
–স্যর, আমি জানি আমার হাতে সময় নেই। ট্রান্সফারের অর্ডার আসা শুধু সময়ের অপেক্ষা। তবু, স্যর, আমি একটা শেষ সুযোগ চাই। দু’-তিনদিনের ব্যাপার। একবার আলিপুরদুয়ার যাব।
–আলিপুরদুয়ার? হঠাৎ?
রাহুল কিছু বলল। ওপাশ থেকে একটু নীরবতার পর কণ্ঠ এল, ‘যাও। শুভেচ্ছা রইল। আশা করি টিপ কাজে লাগবে।’
রাহুল ঝড়ের গতিতে প্রস্তুতি শুরু করে দিল। আলিপুরদুয়ারে ফোন করে অতনুকে জানাল সে যাচ্ছে। কিন্তু কাকপক্ষীতেও যাতে খবর না পায়। একদম ছোট টিম সঙ্গে নিচ্ছে রাহুল। দরকার হলে স্থানীয় পুলিশের সাহায্য নেওয়া যাবে।
ভাবলেই উত্তেজনা অনুভব করছে রাহুল। খবর যদি ঠিক হয়! অনুমান যদি মেলে! কৌশলটা জব্বর। এবং এভাবেই তো এসব হয়।
এটা ওই ‘সমর বারুই মডেল’। নয়ের দশকে একটা বড় পারিবারিক হত্যাকাণ্ড হয়েছিল। নিজের এবং নিজের মায়ের ওপর অত্যাচার, অপমানের জবাব দিতে বাবা, সৎ মা, সৎ ভাই বোনকে খুন করেছিল কিশোর সমর বারুই। তার কিছু বন্ধুর সাহায্যে। ধরা পড়ে যায়। দীর্ঘদিন জেলে ছিল। সুন্দর চেহারা, ব্যবহার, দারুণ ছবি আঁকার হাত। কিন্তু নির্বান্ধব সমাজে জেলবৃত্তেই প্রভাবিত হয় সমর। মুক্তির পর ফের সেই চোরাস্রোতেই আটকে যায়। ডাকাতির অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। এরপর হঠাৎ সে উধাও। পুলিশ সর্বত্র খুঁজেও তার টিকি ছুঁতে পারে না। অবশেষে অবাক কাণ্ড। বর্ধমান জেলে বদলি হওয়া এক জেলারের চেনা লাগল এক যুবক বন্দিকে।
-তুমি সমর না? তুমি তো আমার জেলে ছিলে, তখন আমি দমদমে। যুবক বলল, ‘না, আমি ইরফান।’ জেলারের বিশ্বাস হল না। কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরল। ওটা সমরই। বড় অপরাধ করে কিছুদিন গা ঢাকা দিতে ছোট করে অপরাধে কার্যত স্বেচ্ছায় ধরা দিয়ে নাম ভাঁড়িয়ে দূরের জেলে রয়েছে। জল থিতু হলেই জামিন নিয়ে বেরিয়ে যাবে।
অতনু সমাদ্দারের গলায় এই ‘সমর বারুই মডেল’-এর প্রতিধ্বনি ছিল। আলিপুরদুয়ার জেলে সন্দেহ করেছে দু’জনকে। অথচ সরাসরি চেনে না অতনু। সবদিক থেকে সন্দেহ প্রবল। তাই রাহুলকে ফোন করেছে। কাদের সন্দেহ, কেন সন্দেহ জানিয়েছে সবিস্তারে। অতঃপর রাহুলের এই চাঞ্চল্য এবং আলিপুরদুয়ার সফর। টিমে লেডি কনস্টেবল নীলিমাকেও রেখেছে, রাখতে হয়েছে, লাগবে।
এদিকে, পুলিশবাহিনীতে যত বজ্রআঁটুনি, তত ফসকা গেরো। রাহুল যে টিম নিয়ে উত্তরবঙ্গ যাচ্ছে, যারা জানার, ঠিক জানল। কুসুমডিহার চারপাশে পুলিশি তৎপরতাও শিথিল একটু। মাথার পোকা নড়ে উঠল। এই সময়েই কুসুমডিহাতে আক্রমণ করতে হবে। মাধাই ,আর দু’-একজনের লাশ না দেখলে বিদ্যুতের ঘুম আসছে না। বাবার মৃত্যু হজম হয়নি বিদ্যুতের, তাছাড়া এটা যেন তার আত্মসম্মানের প্রশ্ন হয়ে অজগরের মতো জড়িয়ে দমবন্ধ করে দেয়। মার খেয়ে চুপ করে বসে আছে! বিদ্যুৎ টাকার পরোয়া করেনি, করল না। নতুন হামলাকারী টিম। রাহুল কেন যে নর্থ বেঙ্গল যাচ্ছে, কে জানে।
নিশ্চয়ই কোনও খবর আছে। সে যাক। কিন্তু ওই সময়টাতেই কুসুমডিহাতে আক্রমণ করে তছনছ করে দেবে তার বাহিনী। লোকে বুঝবে, বিদ্যুৎ আছে আগের মতোই।
(চলবে)
…পড়ুন কুসুমডিহার কাব্য-এর অন্যান্য পর্ব…
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২৬: যদি ওই মহিলা সত্যিই সুনেত্রা হয়, তাহলে অবশেষে তাকে দেখা গিয়েছে
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২৫: ছায়ার মৃত্যুর খবর গেল শঙ্করের কাছে
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২৪: মলিন চেহারার এই মহিলাকে ধরতে এত পুলিশ?
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২৩: শঙ্কর বারিকের স্ত্রী ছায়া মাহাতো ধরা পড়েছে পুলিশের হাতে
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২২: গুন্ডাবাহিনীর বিরুদ্ধে মাওবাদীরা, কুসুমডিহায় মনোবল বাড়ছে মানুষের
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২১: কুসুমডিহা এক বুক আশঙ্কা নিয়ে দিন কাটায়
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২০: মানুষকে একজোট করতে চায় রেশমি
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৯: দূত এবং দূতের দূত মারফত খবর গিয়েছে কুসুমডিহায়
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৮: টিলার ওপরের মহিলাদের নিয়ে পুলিশের কৌতূহল প্রবল
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৭: পল্টু জবার পিছনে খরচ বাড়িয়ে ইদানীং এদিক-ওদিক হাত পেতে ফেলছে
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৬: কমরেড ব্রহ্মা কতদিন পালিয়ে বেড়াবে?
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৫: প্রতিমাকে পাওয়া গেল কুসুমডিহায়, মিথ্যে ধর্ষণের মামলায় ফাঁসি হয়েছে তাঁর বরের
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৪: এখন খবরের শীর্ষে কুসুমডিহায় মাওবাদী হামলা আর কমরেড ব্রহ্মা
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৩: কমরেড ব্রহ্মা তাহলে যেখানেই থাকুন, কুসুমডিহার ওপর নজর রেখেছেন
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১২: থমথমে কুসুমডিহাতে টহল দিচ্ছে পুলিশ
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১১: ছদ্মপরিচয়ে কুসুমডিহাতে প্রবেশ পুলিশ ফোর্সের
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১০: শান্ত কুসুমডিহা এখন হিংস্র হয়ে ফুঁসছে
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৯: কুসুমডিহাতে পুলিশ, নেতা, বুদ্ধিজীবী, মহিলা কমিশন, মিডিয়ার ভিড়
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৮: জঙ্গলমহলের তল্লাট থেকে উত্তাপ ছড়াল কলকাতার মিডিয়াগুলির স্টুডিওতেও
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৭: কুসুমডিহাতেই দেখিয়ে দেব আমরা মরে যাইনি
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৬: পরিচয় যত বাড়ছে, সুমিত অনুভব করছে এলাকা গরম হচ্ছে
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৫: পশ্চিমগড়ের মৃতদেহর খবর এখনও কলকাতা সংস্করণে জায়গা পায়নি
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৪: সভা আর প্রচার মানেই বন্দুক ধরা নয়
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৩: ‘বন্দুক হাতে নেওয়া প্রত্যেকটা মেয়েকে সমর্থন করি’
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২: সিস্টেমের দোষেই কুসমডিহাতে ফের অমঙ্গলের পদধ্বনি, সুমিতকে বোঝাল রেশমি
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১: জঙ্গলমহলের কুসুমডিহার নতুন পোস্টমাস্টার সুমিত, জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করে পারবে!