কমরেডদের উপর বাড়তি ঝামেলা না চাপিয়ে প্রথম ক’টা দিন জেলে থাকাটাই ভালো। নাম বদলে, পরিচয় বদলে। এখানে চা বাগান, জঙ্গল এলাকায় ছোটখাটো মারামারি লেগেই থাকে। পুলিশ ধরে রাখে কিছুদিন, পেটি কেস দেয়, তারপর মুক্তি।
পরিকল্পনামতোই কাজ। বাসস্ট্যান্ডের কাছে একটা ভাতের হোটেলে খেয়ে দাম দিল না সুনেত্রা। দোকানের কর্মীদের সঙ্গে হাতাহাতি। বিষ্ণু কোথা থেকে এসে একটা কাচ ভেঙে দিল।
২৮.
কৌশলটা পুরনো, তবে কাজের।
পুলিশ যখন খোঁজে, তখন গা ঢাকা দিয়ে থাকার সবচেয়ে সহজ উপায় হল জেলে থাকা। দূরের কোনও এলাকায় সজ্ঞানে কোনও অপরাধ করে পুলিশি ঝামেলায় জড়ানো, একটা পেটি মামলা খাওয়া, তারপর জামিন না নিয়ে জেলে কিছুদিন কাটিয়ে দেওয়া। প্রথম ক’টা দিনের হল্লা থামলে তারপর জেল থেকে বেরিয়ে নিরাপদ কোনও ঠেকের সন্ধান করা।
সুনেত্রা, বিষ্ণুরা এর আগেও দু’-একবার এই কৌশলের পথ নিয়েছে। এবারও নিতে হল। কুসুমডিহার অপারেশনের পর কমরেড ব্রহ্মার নির্দেশ ছিল, আপাতত এই তল্লাটে নয়। উত্তরবাংলার ডুয়ার্সে চা বাগান বেল্টে চলে যেতে হবে। ওড়িশা, অন্ধ্র, ছত্তিশগঢ়, ঝাড়খণ্ডের দিকে যাওয়া যাবে না। ডুয়ার্সে কিছুদিন গা ঢাকা।
ওখানেও কমরেডরা আছে। বিষ্ণুরা ঠিক করল আপাতত ক’টা দিন জেলে। তারপর কমরেডদের কাছে। কারণ পুলিশ তাদের গতিবিধি উত্তরবঙ্গেও নজর রাখে। কমরেডদের উপর বাড়তি ঝামেলা না চাপিয়ে প্রথম ক’টা দিন জেলে থাকাটাই ভালো। নাম বদলে, পরিচয় বদলে। এখানে চা বাগান, জঙ্গল এলাকায় ছোটখাটো মারামারি লেগেই থাকে। পুলিশ ধরে রাখে কিছুদিন, পেটি কেস দেয়, তারপর মুক্তি।
পরিকল্পনামতোই কাজ। বাসস্ট্যান্ডের কাছে একটা ভাতের হোটেলে খেয়ে দাম দিল না সুনেত্রা। দোকানের কর্মীদের সঙ্গে হাতাহাতি। বিষ্ণু কোথা থেকে এসে একটা কাচ ভেঙে দিল। অতঃপর পুলিশ। সুনেত্রা, বিষ্ণু নাম ভাঁড়িয়ে গ্রেপ্তার। ঠিকানা হল আলিপুরদুয়ার জেল। পরিকল্পনা, দিন চোদ্দো বা আঠাশ, এখানে কাটানো। ততদিনে ঠিকঠাক একটা শেল্টার খুঁজে রাখবে কমরেডরা।
কিন্তু এবার হিসেব মেলেনি। এক জেলারের চাউনিতেই সুনেত্রা বুঝেছে, লোকটা কিছু সন্দেহ করছে। তাকে স্থানীয় বন্দিনীদের সঙ্গে মেলাচ্ছে না। একাধিকবার চোখাচুখি হল। এটা ভালো লাগল না সুনেত্রার। অথচ বিষ্ণুর সঙ্গে আলোচনা করা যাচ্ছে না, কারণ সে পুরুষবিভাগে আছে। আবার সেই কোর্টের দিন ছাড়া দেখা হবে না। সুনেত্রার মন বলছে দিন নষ্ট না করে জামিন নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া দরকার। জেল আত্মগোপনের জন্য ভালো। কিন্তু সেই কাজটাই যদি না হয়, তাহলে তো আক্ষরিক অর্থেই বন্দি। দু’-তিন দিন অস্বস্তিতে ছিল সুনেত্রা। তারপর আশঙ্কাটা সত্যি হল।
দুপুরে খাওয়ার পর জানলার ধারে বসে আকাশ দেখছিল সুনেত্রা। এইসব সাতপাঁচ ভাবছিল। হঠাৎ মহিলা সেপাই ওয়ার্ডে জানাল কলকাতা থেকে পুলিশের একটা বড় টিম এসেছে অফিস ঘরে। বড় অফিসাররাও আছেন। মনে হয় নির্দিষ্ট কাউকে খুঁজতে এসেছে তারা। এর বেশি কিছু বলতে পারল না সেপাই। জেলে এসব খবর রটে হাওয়ার গতিতে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
কিন্তু এবার হিসেব মেলেনি। এক জেলারের চাউনিতেই সুনেত্রা বুঝেছে, লোকটা কিছু সন্দেহ করছে। তাকে স্থানীয় বন্দিনীদের সঙ্গে মেলাচ্ছে না। একাধিকবার চোখাচুখি হল। এটা ভালো লাগল না সুনেত্রার। অথচ বিষ্ণুর সঙ্গে আলোচনা করা যাচ্ছে না, কারণ সে পুরুষবিভাগে আছে। আবার সেই কোর্টের দিন ছাড়া দেখা হবে না। সুনেত্রার মন বলছে দিন নষ্ট না করে জামিন নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া দরকার। জেল আত্মগোপনের জন্য ভালো। কিন্তু সেই কাজটাই যদি না হয়, তাহলে তো আক্ষরিক অর্থেই বন্দি।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
মুহূর্তে সজাগ, সতর্ক সুনেত্রা। তার মানে ওই জেলারের কিছু সন্দেহ হয়েছিল। সে-ই নিশ্চয়ই খবর পাঠিয়েছিল কলকাতায়। কিন্তু এখন সুনেত্রার কী করার আছে? জেলের মধ্যেই আছে তারা। নিজেদের তৈরি ফাঁদে নিজেরা আটকে। বিষ্ণুও নিশ্চয়ই খবর পেয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওয়ার্ডে এসে গেল ‘অফিস কল’-এর চিরকুট। সুনেত্রা বুঝল পরিস্থিতি হাতের বাইরে। আশঙ্কা সত্যি হচ্ছে। এখান থেকে বাধা দেওয়া বা পালানোর চেষ্টার কোনও সুযোগ নেই। আত্মঘাতী ফাঁদে পড়ে গিয়েছে তারা।
একই ঘটনা ঘটল বিষ্ণুর ক্ষেত্রে। ‘অফিস কল।’ কড়া পাহারায় অফিসে আনা হল তাদের। সামনে রাহুল। কনস্টেবল নীলিমা সুনেত্রাকে দেখেই চিৎকার করে উঠলেন, ‘এই তো, সেই মেয়েটা।’ রাহুলের ভেতরের উত্তেজনাটা বাইরে বুঝতে দিচ্ছে না। বিষ্ণুর চোখে চোখ রেখে বলল, ‘কী নিখিল, তাহলে আবার দেখা হল!’ বিষ্ণুর মুখ থমথমে।
অতনু সমাদ্দার রাহুলকে বলল, ‘তাহলে সন্দেহটা লেগে গেল ঠিকঠাক। মহিলাকে দেখেই মনে হচ্ছিল লোকাল নন। আপনাদের এলাকার খবরও শুনেছিলাম। মনে হল এখানে এসে গা ঢাকা দিয়ে নেই তো? একবার চেক করা দরকার।’
‘তোমাকে যে কী বলে ধন্যবাদ দেব অতনু। এত বড় কাজটা এতটা সহজে হয়ে গেল তোমার জন্য।’ বলল রাহুল। তারপর সবটা জানাল ত্রিপাঠীসাহেবকে। তাঁর গলাও এখন পাল্টে গিয়েছে। বিরাট খুশি। অভিনন্দন জানালেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সব চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ: মাওবাদী নেতানেত্রী বিষ্ণু-সুনেত্রা গ্রেপ্তার। ক্রমশ তার সঙ্গে জুড়ছে এই জেলে এসে লুকিয়ে থাকতে গিয়ে ফেঁসে যাওয়ার গল্প।
ওদের কলকাতা নিয়ে যেতে গেলে কিছু আইনি পথ আছে। কোর্টের কাগজ লাগতে পারে। রাহুল আইনি পরামর্শ নেওয়া শুরু করল। জেলে প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট দিতে হবে। সুনেত্রা, বিষ্ণুকে কড়া পাহারায় ভেতরে পাঠানো হল। রাহুল অতনুকে বলল, ‘নজরদারি বাড়াও। দরকারে ডবল সিপাই দাও। আলাদা আলাদা সেলে রাখো। সিসি ক্যাম নজরদারি চাই।’
জেলগেট থেকে খবর এল, বাইরে মিডিয়ার লোকেরা এসেছে। কলকাতা অফিস ইতিমধ্যেই জেলা সাংবাদিকদের নির্দেশ দিয়ে দিয়েছে। ত্রিপাঠীসাহেবকে জানাল রাহুল। তিনি বললেন, ‘যাও। তুমি নিজে ব্রিফ করে দাও। তবে সংক্ষেপে। বাড়তি প্রশ্নের উত্তর দেবে না।’
সব টিভিতে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে কুসুমডিহার জঙ্গলের হানাদার মাওবাদী নেতানেত্রীদের উত্তরবঙ্গের জেল থেকে ধরা পড়ার নাটকীয় খবর।
আর এসব দেখতে দেখতেই উত্তেজিত বিদ্যুৎ। পুলিশ এখন ওদিকে মেতে। মাওবাদীদেরও কোমর ভেঙে গিয়েছে। কুসুমডিহাতে হামলার এই হল আদর্শ সময়। মাধাই আর ওদের লোকজনকে শেষ করে দিতে হবে আজ, এখনই। আর সময় নষ্ট নয়। বিদ্যুৎ ডেকে পাঠাল এক সাকরেদকে। নির্দেশ আর টাকার বান্ডিল ধরিয়ে দিল। কুৎসিত সব শব্দপ্রয়োগ করে বলল, ‘‘আজ কিংবা কাল, দু’দিনের মধ্যে ওগুলো যেন খতম হয়ে যায়।’’
(চলবে)
…পড়ুন কুসুমডিহার কাব্য-এর অন্যান্য পর্ব…
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২৭: কুসুমডিহার চারপাশে পুলিশি তৎপরতা শিথিল, এই সময়েই আক্রমণ করতে হবে
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২৬: যদি ওই মহিলা সত্যিই সুনেত্রা হয়, তাহলে অবশেষে তাকে দেখা গিয়েছে
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২৫: ছায়ার মৃত্যুর খবর গেল শঙ্করের কাছে
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২৪: মলিন চেহারার এই মহিলাকে ধরতে এত পুলিশ?
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২৩: শঙ্কর বারিকের স্ত্রী ছায়া মাহাতো ধরা পড়েছে পুলিশের হাতে
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২২: গুন্ডাবাহিনীর বিরুদ্ধে মাওবাদীরা, কুসুমডিহায় মনোবল বাড়ছে মানুষের
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২১: কুসুমডিহা এক বুক আশঙ্কা নিয়ে দিন কাটায়
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২০: মানুষকে একজোট করতে চায় রেশমি
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৯: দূত এবং দূতের দূত মারফত খবর গিয়েছে কুসুমডিহায়
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৮: টিলার ওপরের মহিলাদের নিয়ে পুলিশের কৌতূহল প্রবল
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৭: পল্টু জবার পিছনে খরচ বাড়িয়ে ইদানীং এদিক-ওদিক হাত পেতে ফেলছে
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৬: কমরেড ব্রহ্মা কতদিন পালিয়ে বেড়াবে?
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৫: প্রতিমাকে পাওয়া গেল কুসুমডিহায়, মিথ্যে ধর্ষণের মামলায় ফাঁসি হয়েছে তাঁর বরের
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৪: এখন খবরের শীর্ষে কুসুমডিহায় মাওবাদী হামলা আর কমরেড ব্রহ্মা
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৩: কমরেড ব্রহ্মা তাহলে যেখানেই থাকুন, কুসুমডিহার ওপর নজর রেখেছেন
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১২: থমথমে কুসুমডিহাতে টহল দিচ্ছে পুলিশ
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১১: ছদ্মপরিচয়ে কুসুমডিহাতে প্রবেশ পুলিশ ফোর্সের
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১০: শান্ত কুসুমডিহা এখন হিংস্র হয়ে ফুঁসছে
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৯: কুসুমডিহাতে পুলিশ, নেতা, বুদ্ধিজীবী, মহিলা কমিশন, মিডিয়ার ভিড়
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৮: জঙ্গলমহলের তল্লাট থেকে উত্তাপ ছড়াল কলকাতার মিডিয়াগুলির স্টুডিওতেও
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৭: কুসুমডিহাতেই দেখিয়ে দেব আমরা মরে যাইনি
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৬: পরিচয় যত বাড়ছে, সুমিত অনুভব করছে এলাকা গরম হচ্ছে
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৫: পশ্চিমগড়ের মৃতদেহর খবর এখনও কলকাতা সংস্করণে জায়গা পায়নি
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৪: সভা আর প্রচার মানেই বন্দুক ধরা নয়
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৩: ‘বন্দুক হাতে নেওয়া প্রত্যেকটা মেয়েকে সমর্থন করি’
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২: সিস্টেমের দোষেই কুসমডিহাতে ফের অমঙ্গলের পদধ্বনি, সুমিতকে বোঝাল রেশমি
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১: জঙ্গলমহলের কুসুমডিহার নতুন পোস্টমাস্টার সুমিত, জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করে পারবে!