কোম্পানি একগুচ্ছ নতুন প্রশ্ন তৈরি করল এবার, ‘বাজার’-এর চরিত্র নির্ধারণ করতে। নবকৃষ্ণও নানা সাক্ষী হাজির করতে শুরু করে তাঁর পক্ষে সওয়াল করার জন্য। কোম্পানি দুই পক্ষের কাছেই জানতে চাইল যে, সব বিক্রেতারাই কি ওই জমিতে ঘর বানিয়ে থাকে, নাকি শুধু দোকান আছে তাঁদের? কোন কোন বস্তু বিক্রি হয় তার হদিশও জানতে চাইল কোম্পানি; বিশেষত মাছ বিক্রি করা হয় কি না। মাছ দৈনন্দিন বিক্রি হওয়া বস্তু, সেটা চাল-ডালের মতো দোকানে মজুত করে রাখা যায় না। কোম্পানি জানতে চায় যে অন্য বাজারের মতো যদি মদনের জমিতেও মাছের মতো পচনশীল বস্তু উপস্থিত থাকে, তাহলে একে অতি অবশ্যই ‘বাজার’ বলে চিহ্নিত করতে হবে।
৭.
১৭৭৮ সালের শেষের দিকে রাজা নবকৃষ্ণ দেব কোম্পানির কর্তাদের কাছে অভিযোগ জানান যে, মদন দত্ত একটি নতুন বাজার চালু করেছেন সুতানুটি অঞ্চলে। নবকৃষ্ণ সদ্য সেই অঞ্চলের জমির লিজ পেয়েছেন কোম্পানির থেকে এবং নিজের বাজার তৈরি করেছেন। এই অবস্থায় কাছাকাছি নতুন বাজার চালু হওয়ায় তাঁর প্রভূত ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। তাঁর বাজার থেকে বিক্রেতাদের অন্য বাজারে জোর করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তিনি এও উল্লেখ করেন যে শহরের চলতি রীতি-নীতি না মেনেই এই বাজার প্রতিষ্ঠা করেছেন মদন দত্ত। নবকৃষ্ণের আমিন আর কর্মচারীরা যখন যায় এই নতুন বাজারে খোঁজ-খবর নিতে তখন নাকি তাঁদের গালাগালি দিয়ে আর মারধর করে ভাগিয়ে দেওয়া হয় সেখান থেকে!
নবকৃষ্ণের চিঠির পরপরই কোম্পানি আরেকটি চিঠি পায়, সুতানুটি বাজারের দোকানদারদের কাছ থেকে। নবকৃষ্ণের জুলুমে অতিষ্ট হয়ে তাঁরা বাধ্য হয়েছেন সুতানুটি ছেড়ে মদন দত্তের জমিতে আশ্রয় নিতে, এই কথা লেখা হয় সেই চিঠিতে।
এই দুই চিঠি পেয়ে কোম্পানি নড়েচড়ে বসে। মদন দত্তকে জেরা করা হয়। এবং তারপর একে একে নবকৃষ্ণ, এঁদের দু’জনের উকিল, কর্মচারী, বিভিন্ন দোকানদার ও বিক্রেতা। এই যে প্রশ্নোত্তরের খেলা চালু হল, এখান থেকে পরবর্তীকালের গবেষকদের জন্য নানা আকর্ষণীয় উপাদান জমা হতে শুরু করল ঔপনিবেশিক লেখ্যাগারে। এই কাগজপত্রের জঙ্গল থেকে আমরা কলকাতায় কোম্পানি শাসনের গোড়ার যুগের কিছু বৈশিষ্ট্য খুঁড়ে বের করতে পারি, বিশেষত বাজার ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি, পণ্য ও তার শুল্ক, জমি ও জমি ভাড়া, সরকারি নীতি ও তার ফাঁকফোকর নিয়ে। নবকৃষ্ণ আর মদনের চাপানউতোরের মধ্যে কোম্পানির স্বার্থও জড়িয়ে ছিল।
তিনি কোনও বাজার বসাননি, প্রথমেই বলে দেন মদন। কিছু মুদি আর দোকানদারকে তাঁর জমি ভাড়া দিয়েছেন, সেই বাবদ টাকা নিয়েছেন। কোনও দ্রব্যের ওপর শুল্ক ধার্য করেননি, সেই বাবদ কোনও আয় নেই তাঁর। তাই বাজার বলতে যা বোঝায়, যেখানে বাজারের মালিককে জিনিস বেচাকেনার জন্য আলাদা করে কর দিতে হয়, সেরকম কিছুই তিনি করেননি। কোম্পানি ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতে মদনের এই ‘বাজার’ পরিদর্শন করতে লোক পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়, কারণ যদি সত্যিই বাজার বসিয়ে থাকেন মদন, তাহলে শুধু নবকৃষ্ণের ক্ষতি নয়, কোম্পানিরও শহরের বাজার থেকে প্রাপ্ত খাজনার অধিকার খর্ব হচ্ছিল। কোম্পানির আমলে কলকাতা গড়ে ওঠার এই প্রথম যুগে সরকার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার বা নিজের কর্তৃত্ব জাহির করার একটা মোক্ষম উপায় ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য, হাট-বাজার, পথঘাটের ওপর কর চাপানো, শহরে পণ্যের চলাচলের ওপর নজরদারি করা। অন্যদিকে বাঙালি বড়মানুষদের সামাজিক প্রতিপত্তির এক নিদর্শনই ছিল নিজের নামে বাজার প্রতিষ্ঠা করা, যার রেশ আমরা আজকেও কলকাতার বিভিন্ন বাজারের নামে দেখতে পাই। কোম্পানির শহরে কেউ যদি বাজার বসাতে চাইত নিজের জমিতে, তাহলে সরকারের থেকে অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। মাথায় রাখতে হবে, আঠারো শতকে কলকাতায় সম্পত্তি হিসেবে বাজার, বিত্তশালী ভারতীয় এবং কোম্পানি, উভয়ের পক্ষেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও লাভদায়ক ছিল। সেই সূত্র ধরেই সুতানুটি বাজারে কোম্পানি খোঁজখবর করতে শুরু করে।
কোম্পানি লক্ষ্য করে যে আপাতদৃষ্টিতে মদন দত্তের বাজার অন্য যে কোনও বাজারের মতোই, বেচাকেনা চলছে যেখানে পুরোদমে। যদিও তাঁরা এই বিষয়ে নিশ্চিত ছিল না যে মদন আদৌ কোনও কর নিচ্ছে কি না বিক্রেতাদের থেকে। কিন্তু এর পরই মজা শুরু হয়। কোম্পানির কর্মচারীরা লক্ষ্য করে যে দু’-একদিন তদন্তের পরই মদনের ‘বাজারের’ ধরন-ধারন বদলে যেতে শুরু করে। ওই ফাঁকা জমিতে কয়েকটি বাড়ি তৈরি করা হয়, যেই বাড়ির দালান থেকে লোকে জিনিসপত্র বেচাকেনা চালাতে থাকে। শহরের অন্য বাজারের মতো খোলা আকাশের নিচে কোনও মাঠ বা রাস্তাজুড়ে মদনের ‘বাজার’ বসছিল না। লক্ষ্য করে দেখা যায় যে, প্রায় সব বিক্রেতার মাথার ওপরে কিছু না কিছু ঢাকা আছে। মদন দত্তের মতে বাজারের ব্যাপারী নয়, ‘মুদি’ বা ‘দোকানি’রা ছিল এই এলাকায়। কোম্পানির কর্মচারীরা অবশ্য সেই মত মানতে প্রস্তুত ছিল না। তাঁরা একদিন গিয়ে এক মাছ বিক্রেতাকে ওই এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বলাতে সব দোকানদাররা একজোট হয়ে তাঁদের ঘিরে ধরে, এবং দাবি করে যে খোদ সুপ্রিম কোর্টের (সদ্য গঠিত, ১৭৭৪ সালে) আদেশ ছাড়া সেই অঞ্চল ত্যাগ করবে না কেউ। এর পরপরই এই দোকানিরা কোম্পানির কর্মচারীর বিরুদ্ধে পিটিশন জমা করে। একাধারে নবকৃষ্ণ ও কোম্পানিকে অভিযুক্ত করে তাঁরা দাবি করে যে মদন দত্তের সহযোগিতা ছাড়া তাঁদের বেচাকেনা সম্ভবই হত না।
কোম্পানি বুঝতে পারছিল যে, মদনই মদত দিচ্ছে এই লোকগুলোকে, এবং সে নিজে একটা ব্যক্তিগত বাজার চালু করে বসে আছে। বিক্রেতাদের নিজের বাজারে আকর্ষিত করার জন্য তাঁদের পণ্যের ওপর কোনও কর চাপায়নি মদন। এর ফলে সুতানুটি অঞ্চলে সরকারি বাজারেরও বেশ ক্ষতি হচ্ছিল। কেউ কেন আরও বেশি পয়সা দিয়ে নবকৃষ্ণ বা সরকারের বাজারে বসতে চাইবে যদি একই এলাকায় অন্য আরেক জায়াগা পাওয়া যায়, যেখানে শুধু জমির ভাড়া দিলেই চলবে? কোম্পানি বুঝতে পারছিল যে, শহরে সরকারি আর ব্যক্তিগত বাজারের এই দ্বন্দ্বে শুধু মালিকরাই যুযুধান পক্ষ নয়, সাধারণ বিক্রেতারাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি গোষ্ঠী। তাঁদের মালিকের নিজের কব্জায় রাখা খুব জরুরি ছিল।
মদনের জমিতে যে বেচাকেনা চলছে, কোম্পানির অনুমতি ছাড়াই, সেই এলাকাকে ‘বাজার’ বলে চিহ্নিত করতে এবার কোম্পানি কোমর বেঁধে নামল। মদনকে আবার জেরা করার জন্য ডেকে পাঠানো হল। নিজে না এসে উকিলকে পাঠায় মদন। উকিল সেই একই বুলি আউড়ে যায়— জমি ভাড়া দেওয়া হয়েছে কিছু লোককে, তাঁরা সেখানে ঘরদোর বানিয়ে থাকে, নিজেরা কিছু বেচাকেনা করে হয়তো, কিন্তু মালিক হিসেবে মদন দত্ত জমি ভাড়া ছাড়া আর অন্য কোনও রকমের ট্যাক্স বা কর আদায় করেন না।
কোম্পানি একগুচ্ছ নতুন প্রশ্ন তৈরি করল এবার, ‘বাজার’-এর চরিত্র নির্ধারণ করতে। নবকৃষ্ণও নানা সাক্ষী হাজির করতে শুরু করে তাঁর পক্ষে সওয়াল করার জন্য। কোম্পানি দুই পক্ষের কাছেই জানতে চাইল যে, সব বিক্রেতারাই কি ওই জমিতে ঘর বানিয়ে থাকে, নাকি শুধু দোকান আছে তাঁদের? কোন কোন বস্তু বিক্রি হয় তার হদিশও জানতে চাইল কোম্পানি; বিশেষত মাছ বিক্রি করা হয় কি না। মাছ দৈনন্দিন বিক্রি হওয়া বস্তু, সেটা চাল-ডালের মতো দোকানে মজুত করে রাখা যায় না। কোম্পানি জানতে চায় যে অন্য বাজারের মতো যদি মদনের জমিতেও মাছের মতো পচনশীল বস্তু উপস্থিত থাকে, তাহলে একে অতি অবশ্যই ‘বাজার’ বলে চিহ্নিত করতে হবে। কিন্তু যেসব বিক্রেতাকে প্রশ্ন করা হয়, তাঁরা সবাই বলে যে মাছ বিক্রিও পাকা দোকানঘর থেকে হয়; খুব বড়জোর বাড়ির দোরগোড়ায় হয় কিছু সময়, কিন্তু কখনওই খোলা আকাশের নিচে নয়। এর পরের প্রশ্ন থেকে বোঝা যায় কীরকম আকুল হয়ে কোম্পানি এই মামলার নিষ্পত্তি করতে চাইছিল– ‘মাছ বিক্রেতারা কি এমনভাবে বসে যে বৃষ্টির সময়ে তাঁদের মাথায় জল পড়ে, নাকি তাঁরা কোনও চালার নিচে বসে?’, অথবা, ‘আপনি কি মনে করেন যে সবাইকে আশ্রয় দিতে পারে এত চালা ওখানে আছে?’
গোটা অঞ্চলের বাড়ি, দোকান, দালান, চালা মিলিয়ে যে অবয়ব, তাই নিয়ে কোম্পানি এবার ছানবিন করতে শুরু করল। দোকানের মাপজোক কী, কতগুলো চালাঘর আছে, সব বিক্রেতার মাথার ওপর ছাউনি আছে কি না— এই সব কিছুই খুঁটিয়ে দেখতে লোক পাঠানো হল। একইসঙ্গে, মাছ বা সবজি বিক্রি করা হলে কীভাবে, কোন পদ্ধতিতে সেগুলি বিক্রি করা হচ্ছে, তা জানার চেষ্টা করা হল। এইসব দেখাশোনা যেই শুরু হল, ওমনি দেখা গেল যে কিছু চালাঘর পাকা হয়ে গেল, যে দোকানের আগে কোনও দরজা ছিল না তা বাড়ির ভিতরে চলে গেল, খোলা আকাশের নিচে বেচাকেনার কিছু কিছু জায়গার ওপর চালা চলে এল। এক অদ্ভুত লুকোচুরির মধ্য দিয়ে এই ‘বাজারের’ চেহারা প্রতিনিয়ত বদলাতে থাকে!
কোম্পানির কর্তাব্যক্তিদের কোনও সন্দেহ ছিল না যে মদনের জমিতে যা চলছে, তা এক ‘বাজার’ ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু ‘বাজার’ বলতে কী বোঝায়? কীভাবেই একটা অঞ্চলকে ‘বাজার’ বলে চিহ্নিত করা যায়? এইসব প্রশ্ন কোম্পানির সরকারের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বকে নানা সমস্যার মুখে ফেলে দেয়। সরকারের আর্থিক ক্ষতিও একটা বড় কারণ ছিল এইরকম ব্যক্তিগত বাজার নিয়ে বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা করার। এই বিশেষ ক্ষেত্রে কোম্পানির কোনও উপায় ছিল না মদনকে ছাড় দেওয়া ছাড়া! কিন্তু এই ‘বাজারের লড়াইয়ের’ মধ্য দিয়ে আমরা কলকাতার আদি যুগে জমির দখল আর ব্যক্তিগত সম্পত্তির সঙ্গে সামাজিক আধিপত্যের যে ঐতিহাসিক সম্পর্ক ছিল, তার এক আভাস পাই।
…কলিকথার অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৬: কলকাতার বহিরঙ্গ একুশ শতকের, কিন্তু উনিশ-বিশ শতকের অসহিষ্ণুতা আমরা কি এড়াতে পেরেছি?
পর্ব ৫: কলকাতা শহর পরিকল্পনাহীনভাবে বেড়ে উঠেছে, একথার কোনও বিশেষ ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই
পর্ব ৪: ঔপনিবেশিক নগর পরিকল্পনার বিরুদ্ধ মত প্রকাশ পেয়েছিল যখন প্লেগ ছড়াচ্ছিল কলকাতায়
পর্ব ৩: ঔপনিবেশিক কলকাতায় হোয়াইট টাউন-ব্ল্যাক টাউনের মধ্যে কোনও অলঙ্ঘনীয় সীমানা
পর্ব ২: ‘জল’ যেভাবে ‘জমি’ হল এ কলকাতায়
পর্ব ১: চেনা কলকাতাকে না পাল্টেই বদল সম্ভব, পথ দেখাতে পারে একটি বাতিল রিপোর্ট