কল্পবিজ্ঞান কী? কেউ কেউ বলেন, কল্পবিজ্ঞানের উদ্দেশ্য– ‘preventing and inventing the future’, ভবিষ্যৎ-কে একইসঙ্গে উদ্ভাবন করা ও তার প্রতিকারের সুলুকসন্ধান দেওয়া। কীভাবে আমরা যুদ্ধ করব আমাদের ভবিষ্যতের সঙ্গে? সে পথ দর্শাতে পারে কল্পবিজ্ঞান। দেখা যাক, আমাদের কাছে নারীর দৃষ্টি বা গেজ, বা আতসকাচ কতটা পেরেছে সে প্রশ্নের উত্তর দিতে।
৮.
‘I think hard times are coming when we will be wanting the voices of writers who can see alternatives to how we live now and can see through our fear-stricken society and its obsessive technologies. We will need writers who can remember freedom. Poets, visionaries– the realists of a larger reality.’
(Ursula Leguin)
একদিকে ক্যাম্পবেলীয় পুরুষবিশ্বের ‘সাইফাই’। যার মূল কথা প্রকৃতিবাদ, বস্তুবাদ, বাস্তববাদ (মেটিরিয়ালিজম, রিয়ালিজম, ন্যাচারালিজম)। যা ভাবে, প্রযুক্তিই পারে দুনিয়ার সব সমস্যার সমাধান করতে। উল্টোদিকে, উরসুলা লেগুইনের মতো লেখকরা বিকল্প বিশ্বের কথা বলেন, আদর্শবাদের কথা বলেন। বলেন মানব চেতনার, নৈতিকতার কথা। ওমেলাস ছেড়ে চলে যাওয়া এক প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ, সেটাই তাঁর মতে একমাত্র নৈতিক দায়িত্ব, যদি তুমি মনুষ্যত্বে বিশ্বাস করো। ‘fear stricken society and its obsessive technology’-র বিপরীতে দাঁড়িয়ে উরসুলা লেগুইন বলবেন, লেখকরা কেন প্রয়োজনীয়। প্রযুক্তি যখন পরিবেশকে ধ্বংস করছে, তখন এই কথা বলার সাহস খুব জরুরি।
প্রান্তিক হলেও লেখক জরুরি। কারণ লেখক প্রতিরোধের আর স্বাধীনতার কথাগুলি বলে যান। ভুলতে দেন না।
কল্পবিজ্ঞান কী? কেউ কেউ বলেন, কল্পবিজ্ঞানের উদ্দেশ্য– ‘preventing and inventing the future’, ভবিষ্যৎ-কে একইসঙ্গে উদ্ভাবন করা ও তার প্রতিকারের সুলুকসন্ধান দেওয়া। কীভাবে আমরা যুদ্ধ করব আমাদের ভবিষ্যতের সঙ্গে? সে পথ দর্শাতে পারে কল্পবিজ্ঞান। দেখা যাক, আমাদের কাছে নারীর দৃষ্টি বা গেজ, বা আতসকাচ কতটা পেরেছে সে প্রশ্নের উত্তর দিতে। what if? বা যদি এমন হত?– এই ভাবনা যে কোনও কল্পনাশীল মানুষের একখানি দৃষ্টিভঙ্গিও বটে। লেখকমাত্রই ‘যদি এমন হত’-র উত্তর দিচ্ছেন তাঁর আখ্যানে, কিন্তু কল্পবিজ্ঞান বা ফ্যান্টাসি লেখক খুব বেশি করেই দিচ্ছেন সেই উত্তরটি।
অতি কাব্যময় ভাষায় লেখেন উরসুলা। তাঁর বিখ্যাত রচনা ‘দ্য লেফট হ্যান্ড অফ ডার্কনেস’-এর শুরু এইরকম জাদুকরী কল্পনার নমুনায়:
‘আমার রিপোর্ট আমি গল্প বলার মতো করেই বলব। কারণ আমাকে ছোটবেলায় শেখানো হয়েছিল, যে সত্য আসলে এক রকমের কল্পনার বস্তু। সবচেয়ে যাচিয়ে নেওয়া তথ্যও তখনই নিজের পায়ে দাঁড়ায়, যখন তা সুন্দর করে বলা হয়। গল্পের মতো করে বলা হয়। একই সমুদ্রোত্থিত মণি, কোনও মেয়ের পরিধানে যেন জ্বলজ্বল করে, আর কারও গায়ে এতই বেমানান বিবর্ণ হয়ে যায়, যেন ধুলো। সত্যও তেমনই। কে বলছে তার ওপর নির্ভরশীল। তথ্য আসলে ভরাট, শক্ত, গোলাকার আর বাস্তব নয়, যেমন নয় মুক্তোদানা। দুইই স্পর্শকাতর।
এ গল্প একা আমার নয়, গল্পটা আমি একা বলব না। জানিও না এ আসলে কার গল্প, পাঠক তুমিই বুঝে নিও এ গল্প কার। অন্য কারও কণ্ঠে বলা হলে, গল্পটার তথ্যও পাল্টে যাবে। তুমি তোমার পছন্দসই তথ্য বেছে নিও তখন। কারণ কোনওটাই মিথ্যা নয়। আর সবটা মিলিয়েই একটা গল্প।’
এই চূড়ান্ত ফ্লুইড, তরল অবস্থানটিই লেগুইনের। আর এটা লেখার ৫০ বছর পরে আজও তাই এই বই নিয়ে আলোচনা হয়ে চলেছে। জীবন বদলে দেওয়া এ-বই। যা এরপর ঢুকে যাবে ‘ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং’ বা বিশ্ব নির্মাণে।
‘It starts on the 44th diurnal of the Year 1491, which on the planet Winter in the nation Karhide was Odhar- hahad Tuwa or the twenty-second day of the third month of spring in the year one.’
হাইনিশ মহাবিশ্বের এই কাহিনি একটি কাল্পনিক গ্রহের মানুষের কথা বলে, যাদের সুনির্দিষ্ট লিঙ্গ নেই। এই কাহিনিতে লিঙ্গ এবং যৌনতার থিম অন্বেষণ করলেন প্রথম লেগুইন। এবং প্রথম নারীবাদী বিষয়ের অবতারণা সে অর্থে কল্পবিজ্ঞানের সাম্প্রতিক ক্ষেত্রে।
‘Our entire pattern of socio-sexual interaction is nonexistent here. They cannot play the game. They do not see one another as men or women. This is almost impossible for our imagination to accept. What is the first question we ask about a newborn baby?’
(Ursula Le Guin, The Left Hand of darkness)
‘আমাদের সমাজ যেভাবে মানুষে মানুষে সম্পর্কে লিঙ্গনির্ধারিত পথে চলে, তা তো এই সমাজে নেই। ওরা ওই খেলা খেলে না। একজন আরেকজনকে নারী বা পুরুষ হিসেবে দেখে না। আমাদের পক্ষে এই ব্যাপারটা কল্পনায় আনাই কঠিন৷ সদ্যোজাত একটি শিশুর ব্যাপারে আমরা প্রথম কোন প্রশ্নটা করি?’
গবেষক ডোনা হোয়াইটের মতে, এটি ‘বিজ্ঞান কল্পকাহিনি সমালোচকদের হতবাক করে দিয়েছিল’। প্রথম এই বইটিই সেরা উপন্যাসের জন্য হুগো এবং নেবুলা পুরস্কার উভয়ই জিতেছে। লেগুইনই সেই মহিলা, যিনি প্রথম এই দুই পুরস্কার পেলেন।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
লেগুইনের প্রথম লেখক জীবনের কাহিনি কিন্তু বারে বারে প্রত্যাখ্যানের কাহিনি। ১৯৫১ থেকে ১৯৬১ পর্যন্ত, অরসিনিয়া নামক কাল্পনিক বিশ্বের গল্প ছাপতে দিয়েও প্রকাশক সম্পাদকের অনীহার মুখোমুখি হয়েছিলেন উরসুলা। ১৯৬২ সাল থেকে ধীরে ধীরে প্রকাশ পায় তাঁর ছোট গল্প। ‘ফ্যান্টাস্টিক সায়েন্স ফিকশন’ পত্রিকা আর ‘অ্যামেজিং স্টোরি’ পত্রিকায় অজস্র গল্প লেখেন সেই সময়ে তিনি। কাল্পনিক হাইনিশ বিশ্ব তাঁর উদ্ভাবিত। ১৯৬৬-তে আসে ‘রোকাননস ওয়ার্ল্ড’, তারপরে সিরিজ হিসেবে প্রকাশ পায় ‘প্ল্যানেট অফ এক্সাইলস’ ( ১৯৬৬) ও ‘সিটি অফ ইলিউশন্স’ ( ১৯৬৭)৷ এই ট্রিলজির পরেই লেখা হয়েছিল লেগুইনের সুবিখ্যাত ফ্যান্টাসি ট্রিলজি– ‘আর্থসি’ সিরিজ।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
লেগুইনের প্রথম লেখক জীবনের কাহিনি কিন্তু বারে বারে প্রত্যাখ্যানের কাহিনি। ১৯৫১ থেকে ১৯৬১ পর্যন্ত, অরসিনিয়া নামক কাল্পনিক বিশ্বের গল্প ছাপতে দিয়েও প্রকাশক সম্পাদকের অনীহার মুখোমুখি হয়েছিলেন উরসুলা। ১৯৬২ সাল থেকে ধীরে ধীরে প্রকাশ পায় তাঁর ছোট গল্প। ‘ফ্যান্টাস্টিক সায়েন্স ফিকশন’ পত্রিকা আর ‘অ্যামেজিং স্টোরি’ পত্রিকায় অজস্র গল্প লেখেন সেই সময়ে তিনি। কাল্পনিক হাইনিশ-বিশ্ব তাঁর উদ্ভাবিত। ১৯৬৬-তে আসে ‘রোকাননস ওয়ার্ল্ড’, তার পরে সিরিজ হিসেবে প্রকাশ পায় ‘প্ল্যানেট অফ এক্সাইলস’ ( ১৯৬৬) ও ‘সিটি অফ ইলিউশন্স’ ( ১৯৬৭)৷ এই ট্রিলজির পরেই লেখা হয়েছিল লেগুইনের সুবিখ্যাত ফ্যান্টাসি ট্রিলজি– ‘আর্থসি’ সিরিজ। আগের কিস্তিতেই বলেছি তার কথা। ২০টি নভেল আর শতাধিক ছোটগল্পের লেখক লেগুইন। ৮বার হুগো পুরস্কার আর ৬বার নেবুলা পুরস্কার পাওয়া, কোটি কপি বিক্রি হওয়া লেগুইনের সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে, ‘এ ভিসনারি হু সেট হারসেলফ এগেন্সট অল ব্রুটালিটি ডিসক্রিমিনেশন অ্যান্ড এক্সপ্লয়েটেশন।’ (হ্যারল্ড ব্লুম) ব্লুমের মতে, তাঁর লেখায় একটি বাক্যও এদিক-ওদিক করা যায় না।
একটি শ্লেষ দিয়ে শেষ করি এই পর্ব। ১৯৬৮ সালে ‘প্লেবয়’ পত্রিকা তাঁর একটি গল্প ছাপে। পত্রিকা তরফে তাঁকে জানানো হয়েছিল, উরসুলা নামটি না রেখে U. K. Le Guin রাখা হচ্ছে। স্পষ্টত এক নারী লেখককে সম্পাদক পাঠাতে চেয়েছিলেন পুরুষ ছদ্মবেশের আড়ালে। লেগুইন পরে বলেছিলেন, এত হাস্যকর এবং কুৎসিত ভাবনা দেখে তিনি তাজ্জব বনে গিয়েছিলেন৷
পূর্বেকার সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে ছাপাছাপির জগতে। স্বাভাবিকভাবেই সে সময়ের পুরুষ প্রাধান্যের সাহিত্য জগৎ আর তার ভেতরের মাইক্রো-বিশ্ব কল্পবিজ্ঞান জগৎ কতটা লিঙ্গ-বিষয়ে একপেশে, তা বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না এই গল্পে। এর ১৫ বছর পরে কিন্তু ‘এলিয়েন’ নামক বিশ্ববন্দিত ছায়াছবি রচিত হবে, যার মূল প্রোটাগনিস্ট, এলিয়েনদের সঙ্গে যুদ্ধে জয়ী মানব হিসেবে একাকী মহাকাশচারী রিপলি আসবেন।
একটি মেয়ে প্রোটাগনিস্ট, মেয়ে অ্যাকশন হিরো, ‘আমি মানবী একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে’ গাইবেন রিডলি স্কটের ভুবন বিখ্যাত ১৯৭৯ সালের ‘এলিয়েন’ ছবিটিতে। যার সিকুয়েল, ‘এলিয়েন্স’ ১৯৮৬ সালে আবার ফেরাবে রিপলিকে। রিপলি সেই মেয়ে, যার ভেতরে দেখা যাবে মানবিকতা, মাতৃত্ব আর সাহসের অদ্ভুত সমন্বয়। কোন সায়েন্স ফিকশন চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্র একটি মেয়ে, এ কথা বিশ্ব কোনও দিন এর আগে ভাবতেই পারেনি।
…পড়ুন সায়েন্স ফিকশনারী-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৭। উরসুলা লেগুইন কল্পকাহিনির আইডিয়া পান স্ট্রিট সাইনগুলো উল্টো করে পড়তে পড়তে
পর্ব ৬। কেবলমাত্র নারীরচিত সমাজ কেমন হবে– সে বিষয়ে পুরুষের অনুমান সামান্য
পর্ব ৫। একমাত্র মানুষের মাংসই সহ্য হত ভিনগ্রহী শিশুটির!
পর্ব ৪। পাল্প ম্যাগাজিনের প্রথম লেখিকা
পর্ব ৩। রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ কি কল্পবিজ্ঞান সংজ্ঞার সবগুলো শর্তই পূরণ করতে পেরেছিল?
পর্ব ২। সুলতানার স্বপ্নেই বিশ্বের প্রথম নারীবাদী ইউটোপিয়ার অবকাশ
পর্ব ১। চ্যালেঞ্জের বশেই লেখা হয়েছিল পৃথিবী প্রথম কল্পবিজ্ঞান কাহিনি, লিখেছিলেন একজন নারীই
কিন্তু কেন আমরা এত হিংস্র হয়ে উঠলাম? কেন তাকে পিটিয়ে মারার আগে খেতে দিলাম? কী জানি, একেক সময় মনে হয়, পথের ধারে যে মাংসর দোকানের সামনে দিয়ে আমরা যাতায়াত করি আর লাইনে দাঁড়িয়ে থাকি, সেখানেও কাটার আগে পাঁঠাকে কাঁঠাল পাতা খেতে দেওয়া হয়।