তারপর একদিন গ্রামে চলে গেছে সে। এ-গ্রাম থেকে ও-গ্রাম, কোথায় কখন তার কোনো খবর জানিনি আমরা। বিশেষ থেকে নির্বিশেষ হয়ে গেছে একদিন৷ অনেক চেনা-অচেনা ছেলের মতো। মাঝে মাঝে উড়ো খবর শুনতে পাই; শুনতে পাই সংগঠনে সে খুব জোরালো আর জনপ্রিয়, আর পুলিশও তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে চারদিকে। শুনতে পাই, নানা ছদ্মসাজে পুলিশের চোখ এড়িয়ে কাজ করে চলেছে। কিন্তু ধরাও পড়ে একদিন। আর তারপর, আবার একদিন, ষোলোজন সহবন্দীর সঙ্গে মিলিয়ে তাকে পিটিয়ে মারে পুলিশ— সে-খবরও কানে এসে পৌঁছয়।
শুদ্ধব্রত দেব
৯.
‘তিমির মানে কি সঘন আঁধার?
তিমির কি খুব কালো?
তিমির আসলে এ দ্রোহকালের
অগ্নিশুদ্ধ আলো।’
(কবি: অভিজিৎ সেনগুপ্ত)
তিমিরের মৃত্যুর ৫০ বছর পর একজন লিখলেন। তিমিরের মৃত্যুর ৫০ বছর পরও তিমির জীবিত থাকলেন। এইভাবে।
আর তিমিরের মাস্টারমশাই শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন, ‘অনেক দূর থেকে, পঁচিশ বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে এসে, আজ যখন তিমিরের কথা ভাবি, সে আর নিছক কোনো ব্যক্তি হয়ে থাকে না, হয়ে ওঠে যেন প্রতীক…।’
১৯৭১-এর বছর আগের ফেব্রুয়ারির ২৪-এ বহরমপুর জেলে যে তিমিরবরণ সিংহ তাঁর অন্য সহযোদ্ধাদের সঙ্গে শহিদ হয়েছিলেন, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্যের ছাত্র ও সাহিত্যকর্মী পরিচয় ছাপিয়ে তাঁর শেষ ও শ্রেষ্ঠ পরিচয় দাঁড়িয়েছিল– কমিউনিস্ট বিপ্লবীর। মৃত্যুমূহূর্তেও তিনি সে পরিচয়ই বহন করেছেন। তিমিরকে নিয়ে আমি কিছু লিখব না। শুধু দু’জনের স্মৃতিচারণের দু’টি টুকরো তুলে এনে তাঁকে চেনাতে চাইব। প্রথমটি যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে তাঁর শিক্ষক শঙ্খ ঘোষের। দ্বিতীয়টি এক প্রত্যক্ষদর্শীর।
শঙ্খ ঘোষ বলছেন: ‘‘কলেজের ঘরে বসে আছি, হঠাৎ এসে ঢুকল তিমির। একটি কাগজ হাতে তুলে দিয়ে জানতে চাইল: ‘এ বইগুলির কোনোটা কি আছে আপনার কাছে?’ কাগজটাতে ছিল লম্বা এক নামের ফর্দ, নানারকম বইয়ের নাম, ইংরেজিতে বা বাংলায়, সাহিত্যের সমাজতত্ত্বের রাজনীতির অর্থনীতির বই। নামগুলির নির্বাচন তাৎপর্যহীন নয়, বুঝতে পারি তার অভিপ্রায়। কোনো-কোনোটি যে আছে, জানালাম তাকে। দিতে পারি কি? হ্যাঁ, তাও পারি। ‘ফেরত পেতে কিন্তু দেরি হবে অনেক। এখন তো দেখা হবে না অনেকদিন।’ ‘অনেকদিন আর কোথায়? তোমাদের এমএ ক্লাস শুরু হতে খুব তো বেশি দেরি নেই আর।’ অল্প খানিকক্ষণ নিচু মুখে বসে রইল তিমির, বলল তারপর: ‘কিন্তু এমএ পড়ছি না আমি ৷ পড়ে কোনো লাভ নেই । কোনো মানে নেই এইসব পড়াশোনার। আপনি কি মনে করেন, না-পড়লে কোনো ক্ষতি আছে ?’ ‘যোগ্যতর যদি করতে পারো কিছু, তাহলে নিশ্চয়ই ক্ষতি নেই। কিছু কি করবে ভাবছ ?’ ‘আপনি তো জানেন আমি রাজনীতি করি।’ ‘হ্যাঁ, কিন্তু তার জন্যে তো পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়া অনিবার্য নয়।’ আবার একটু সময় চুপ থাকার পর জানাল তিমির: ‘গ্রামে চলে যাচ্ছি আমি। কোথায় থাকব, কবে ফিরব, কিছুই ঠিক নেই। বইগুলি সঙ্গে থাকলে একটু সুবিধে হবে আমার।’
আদর্শের প্রতি ওদের অবিচল নিষ্ঠা আর নির্ভীকতা বিস্মিত করত আমাকে। মতবাদে আমি ওদের বিরােধী জেনেও খোলাখুলি আলােচনা হত ওদের সঙ্গে। জেলের কর্মচারী হিসেবে আমাকে ওরা কোনদিন ঘৃণার চোখে দেখেনি। এই সব উজ্জ্বল ছেলেদের প্রতি আমার একটা স্নেহের সম্পর্কও গড়ে উঠেছিল। হয়তো সেটা তিমিরের মত ছেলেরা বুঝেও ছিল।
তারপর একদিন গ্রামে চলে গেছে সে। এ-গ্রাম থেকে ও-গ্রাম, কোথায় কখন তার কোনো খবর জানিনি আমরা। বিশেষ থেকে নির্বিশেষ হয়ে গেছে একদিন৷ অনেক চেনা-অচেনা ছেলের মতো। মাঝে মাঝে উড়ো খবর শুনতে পাই; শুনতে পাই সংগঠনে সে খুব জোরালো আর জনপ্রিয়, আর পুলিশও তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে চারদিকে। শুনতে পাই, নানা ছদ্মসাজে পুলিশের চোখ এড়িয়ে কাজ করে চলেছে। কিন্তু ধরাও পড়ে একদিন। আর তারপর, আবার একদিন, ষোলোজন সহবন্দীর সঙ্গে মিলিয়ে তাকে পিটিয়ে মারে পুলিশ– সে-খবরও কানে এসে পৌঁছয়।
পঁচিশ বছর কেটে গেছে জেলগারদে সেই হত্যাকাণ্ডের পর। বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতেও কাঁদে না। তিমির এখন ইতিহাসের অংশ।’’
এরপর রইল সেই জেলহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী বহরমপুর সেন্ট্রাল জেলের কারাধ্যক্ষের স্মৃতিচারণার অংশটুকু।
‘‘…ঘটনাটি ঘটান হয়েছিল মধ্যরাতে। জেলাশাসক অশােক গাড়ি চেপে এসে জেলের গেট খুলে ভিতরে এসে নির্দেশ দিলেন নকশাল বন্দীদের উপর আক্রমণ চালাতে। আগে থেকেই এর পরিকল্পনা ছিল! আমি ঘটনাস্থল থেকে দূরে ছিলাম। এই সব তরুণদের সঙ্গেও আমার সম্পর্ক ছিল ভাল। আদর্শের প্রতি ওদের অবিচল নিষ্ঠা আর নির্ভীকতা বিস্মিত করত আমাকে। মতবাদে আমি ওদের বিরােধী জেনেও খোলাখুলি আলােচনা হত ওদের সঙ্গে। জেলের কর্মচারী হিসেবে আমাকে ওরা কোনদিন ঘৃণার চোখে দেখেনি। এই সব উজ্জ্বল ছেলেদের প্রতি আমার একটা স্নেহের সম্পর্কও গড়ে উঠেছিল। হয়তো সেটা তিমিরের মত ছেলেরা বুঝেও ছিল।
আক্রমণ শুরু হল। কুখ্যাত জেল ওয়ার্ডাররা সংগঠিতভাবে ঝাপিয়ে পড়ল নিরস্ত্র নকশাল বন্দীদের ওপর। তার আগেই পরিকল্পনামাফিক অন্য বন্দীদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল অন্য সেলে। জেলাশাসক অশোকের উপস্থিতিতে তারই পরিচালনায় চলে কয়েকঘণ্টা ব্যাপী নারকীয় আক্রমণ আর হত্যালীলা। আমাদের ওপর হুকুম হয়েছিল অফিস ঘরে থেকে যেতে। তখন রাত বারোটা বেজে গেছে। সশস্ত্র ওয়ার্ডাররা লাঠি ও অন্যান্য অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল নিরস্ত্র গুটিকয়েক নকশালপন্থী তরুণদের ওপর। তিমির ও তার বন্ধুরা সেই হিংস্র খুনীদের সাধ্যমত বাধা দেবার চেষ্টা করেছিল। দূর থেকে শুনতে পাচ্ছিলাম ওদের শ্লোগান– ‘নকশালবাড়ি লাল সেলাম’, ‘কমরেড চারু মজুমদার লাল সেলাম’– সঙ্গে ভেসে আসছিল খুনী ওয়ার্ডাদের পৈশাচিক উল্লাস আর অকথ্য অশ্লীল গালিগালাজ। আমার বুকের মধ্যে সমস্ত রক্ত যেন জমাট বরফের টুকরা। অসহায় ক্লীব হয়ে বসে আছি অফিস ঘরে। দু’ঘণ্টা ধরে হয়েছিল সেই অসম লড়াই। একদিকে সংখ্যায় দশগুণ কুখ্যাত ঘাতক ওয়ার্ডার, অন্যদিকে তিমির আর তার বন্ধুরা (বিপ্লব, মৃদুল, গােরা, আশিস, প্রভাত… এদের কয়েক জনের নাম মনে আছে)। আবার রাত দু’টোর পর নেমে এল স্তব্ধতা। অল্পক্ষণ পরে ডাক এল আমার। ডিএম অশোক ডাকছে মৃতদের আইডেন্টিফাই করতে। কেননা আমিই তাদের চিনতাম ভালভাবে।
সেই দুঃস্বপ্নের রাত চিরকাল আমার মনে পােড়া ঘায়ের চিহ্নের মত থেকে গেছে। যে দৃশ্য দেখলাম তা বর্ণনা করা যায় না। মােট আটটি দেহ। তিমির তখনও জীবিত ছিল– অস্ফুট স্বরে শুনেছিলাম তার শেষ কথাটুকু– ‘নকশালবাড়ি লাল সেলাম’…।’’
তিমিরবিনাশী সেই কবি ভালোবাসতে জানতেন।
এতটাই, যার তল পাওয়া যায় না। কবিরা সচরাচর ভালোবাসতে জানেন। তিমিররা শুধু এর সঙ্গে চেয়েছিলেন এমন একটা পৃথিবী যেখানে রোদ, মেঘ, বৃষ্টি আর ফুলকে ভালোবাসার অবকাশটুকু সক্কলে পাবে।
মানুষের কাছে প্রথমে একটা সহজ ও আকর্ষণীয় প্যাকেজ তুলে ধরা, অভ্যস্ত হলে দাম বাড়ানো এবং তাতে তার আস্থা তৈরি হলে ধীরে ধীরে সেখানে অস্থিরতা তৈরি করা। মানুষ এবার তার সীমাবদ্ধ ক্ষমতা নিয়ে ছটফট করবে, হয়তো আরও মহার্ঘ্য হবে মেডিক্লেম।
সারা দুনিয়ায় গণেশ হালুই পরিচিত বিমূর্ত শিল্পী হিসেবেই। তিনি তাঁর মতো করে দেখেছেন শরতকে। শরতকালে শুধু যে দুর্গাপুজো হয়, তা তো না। এ তো আরেকটা অকালবোধনও হতে পারে।