Robbar

যিনি লাইব্রেরিতে ঢুকতে দেন, বই নিতে দেন– তিনি সর্বশক্তিমান

Published by: Robbar Digital
  • Posted:October 11, 2025 3:05 pm
  • Updated:October 11, 2025 6:25 pm  

সাড়ে সাতটার সময় মুরারিদা এসে বলত– দিদি, বাড়ি যাবে না এবার? অনেক রাত হয়ে গেল। দিদি তখন উঠে গোটা চার-পাঁচ বই ট্যাঁকে করে অমলদার সামনে টেবিলে গিয়ে হাজির হতেন। কোনও দিন জানতে পারিনি যে আমার নিজের কার্ডে আমি বই পাই একটা আর মায়ের কার্ড থাকলে আরও একটা। বাকিগুলো অমলদা নিজের কার্ডে ইস্যু করে দেন! আজ জল আসে চোখে। এই নিঃশব্দ প্রশ্রয়, ভালোবাসা, তৃষ্ণা মেটানোর এতখানি জোগান দিতেন যাঁরা, একদিনও বুঝতেও পারিনি এত উদাসী অন্যমনস্ক ছিলাম। যা পেয়েছি, সব কিছুকেই সহজে পাওয়ার বলে ধরে নিতাম। কৃতজ্ঞতাহীন।

জয়া মিত্র

৩.

পুরুলিয়ার সবচেয়ে সুন্দর রাস্তা যদি হয় সাহেববাঁধের পাশের পথটা, ডিস্ট্রিক্ট লাইব্রেরির রাস্তাটাও খুব সুন্দর ভারি প্রিয় মোরাম বিছোনো, কী শান্ত আর পরিষ্কার একদিকে জেলখানার সবজিবাগান। দুপুরে সেখানে সাদা ফতুয়া আর হাফপ্যান্ট পরা কয়েকজন লোককে কাজ করতে দেখা যায়। উল্টো‌দিকে একসারিতে অরবিন্দ স্কুলের পরে দুটো বড় বাড়ি, তারপর ‘সুনিলয়’ নামে সামনে বাগানওয়ালা পুরনো দোতলা বাড়িটা, তারপরই লাইব্রেরির উঁচু বড় বাড়ি সামনে লোহার গেট, তার ভেতরে বাগান বাগানের মধ্যে ডানদিক দিয়ে পিছনে চলে গেলেই তো পিছনদিক দিয়ে ওই বইবাড়ির ভেতরে চলে যাওয়ার গেট হোস্টেল থেকে বাড়ি এসে ওই একটাই তো মোটামুটি যাওয়ার জায়গা স্কুলের ছুটিতে তবু মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি ছিল, কলেজে ওঠার পর থেকে তো লায়েক হয়ে গেছি ইশকুলের কালে প্রথমদিকে যেতাম মায়ের বই পালটে আনার জন্য তাই-ই কি কম রোমাঞ্চ? কাউন্টারে দাঁড়িয়ে যা খুশি বই বাছছি জানি, মা কোনগুলো পছন্দ করবেন, কিন্তু আমি তো খুঁজছি আমি কোনগুলো পড়তে চাইব সেই ’৬৪-’৬৫ সালে ক্লাস নাইন টেনে গল্পের বই তো পড়ি না, বেশি ওস্তাদ হয়ে উঠেছি পড়ছি কল্লোল যুগ, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের লোকায়ত দর্শন, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের বিশ্বসাহিত্যে ছোটগল্প আর সুযোগ পেলেই তক্কো করে বেড়াচ্ছি বন্ধুদের সঙ্গে খুব মুগ্ধতায় শরদিন্দু পড়ি বটে কিন্তু এমনিতে গল্প-উপন্যাস পড়া সমবয়সিদের যেন কিছুটা বালখিল্য মনে হয় আর পড়ছি রবীন্দ্রনাথ কলেজের ছুটিতে এসে কবে থেকে যেন পারমিশন পেলাম– তুমি ভেতরে গিয়ে দেখো কোন বই পছন্দ

এর থেকে বড় স্বাধীনতা তখন পর্যন্ত আর কিছুই ভাবা যেত না কাজেই এমনকী গ্রীষ্মের ছুটিতেও পুরুলিয়ার রোদ্দুর অগ্রাহ্য করে ঠিক দুটো বাজতে দশে সেই পিছনের দরজায় এক-একদিন দেখতাম তালা খোলেনি তখনও গাছের নিচে সিমেন্টের বেঞ্চিতে বসে থাকতে অধৈর্য লাগেনি কখনও দশ মিনিটের মধ্যেই পরিমল দাদা এসে দরজা খুলত আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সাইকেলটা গোল করে পাক খাইয়ে পান মুখে এসে নামতেন অমলদা চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে বলতেন– উহ্‌! এই মেয়েটার জন্যে একদিন দেরি করে আসারও উপায় নেই আমার

‘মেয়েটা’ তো ততক্ষণে কাউন্টার পার হয়ে ভেতরে বাইরের রোদ্দুর থেকে ঢুকে চোখে অন্ধকার লাগাটা কাটাতে যা দেরি একটা ঘরের ভেতর দিয়ে আরেকটা, আরও ভেতরের ঘর, সবচেয়ে ভেতরে যেখানে ছাদ অবধি উঁচু কাচের পাল্লাওয়ালা আলমারির সবচেয়ে ওপরের তাকে বড় বড় ছবির অ্যালবাম রাখা থাকে কিংবা উঁচু আলমারির মাথায় থাকে মোটা মোটা বাঁধানো ‘প্রবাসী’, ‘পূর্বাশা’, ‘শনিবারের চিঠি’ কাঠের মই দিয়ে নিজেই উঠতাম কখনও, কখনও আবার পিওনদাদারা কেউ পেড়ে দিত সব বই কি পড়তাম? তা নয় অত কি বুঝতে পারব? কিন্তু ওই বড় অ্যালবামগুলো দুটো-তিনটে পাশে মেঝেতে রেখে কাচের জানলার ঝাপসা আলোতে ছবি দেখছি বিদেশি চিত্রগুরুদের মাস্টারমশাই যাঁদের নাম বলেছেন, জীবনীবইয়ের কথা বলেছেন, সেই মাইকেল অ্যাঞ্জেলো, পল গঁগ্যা, ভান গখ, তুলুজ লোত্রেক বুঝতে পারছি? প্রশ্নই ওঠে না দেখছি কেবল ভালো লাগার কী একটা জগৎ তৈরি হচ্ছে এই জগতের প্রবেশদ্বার খুলে দিয়েছিলেন সেই দু’জন মানুষ– জীবনে একমাত্র যাঁকে আমি মাস্টারমশাই বলেছি, যদিও প্রত্যক্ষ ছাত্রী ছিলাম না তাঁর, আর অমলদা, পুরুলিয়া জেলা গ্রন্থাগারের অমলদা কোনও দিন জানার কথা মনেও পড়েনি অমলদার পদাধিকার জানতাম লাইব্রেরিতে যিনি ঢুকতে আর বই নিতে দেন, তিনি সর্বশক্তিমান 

লাইব্রেরির ওইসব ভিতরমহলে যে আমার ঢোকার কথা নয়, সে কথা তো কখনও মাথায়ই আসেনি দশ বছর পরে কেউ যখন বলত, তেমন ভালো স্টক নেই এখানকার লাইব্রেরিতে, আমার মনে হত আমার সংসারকেই অশ্রদ্ধা করা হচ্ছে যেন বই নেই! কত বই চাও, কী বই? সেই দশ বছর পর, জেল থেকে ফিরে আসারও অনেক পরে অন্যদের কাছ থেকে জেনেছিলাম, মুরারিদাকে না কি বলা ছিল আমাকে ওই বইপ্রাসাদের কোথাও যেতে বা হাত দিতে বারণ না করার কথা এখনও মনে পড়ে সাড়ে সাতটার সময় মুরারিদা এসে বলত– ‘দিদি, বাড়ি যাবে না এবার? অনেক রাত হয়ে গেল।’ দিদি তখন উঠে গোটা চার-পাঁচ বই ট্যাঁকে করে অমলদার সামনে টেবিলে গিয়ে হাজির হতেন

কোনও দিন জানতে পারিনি যে আমার নিজের কার্ডে আমি বই পাই একটা আর মায়ের কার্ড থাকলে আরও একটা বাকিগুলো অমলদা নিজের কার্ডে ইস্যু করে দেন! আজ জল আসে চোখে এই নিঃশব্দ প্রশ্রয়, ভালোবাসা, তৃষ্ণা মেটানোর এতখানি জোগান দিতেন যাঁরা, একদিনও বুঝতেও পারিনি এত উদাসী অন্যমনস্ক ছিলাম যা পেয়েছি, সব কিছুকেই সহজে পাওয়ার বলে ধরে নিতাম কৃতজ্ঞতাহীন কত পরে অন্যদের মুখে শুনেছি অমলদা নাকি অন্য কোথাও গল্প করতেন, এই একটা মেয়ে এসেছে শহরে, কী বই পড়তে পারে! বই দিয়েই ওর মাথাটা ভর্তি যাদের বলতেন, ওকে দেখে শেখো তোমাদেরই তো বয়সি… তারা খুশি হত না হওয়ার কথাও নয় পরে তাদেরই দু’-একজন এইসব প্রাইভেট পেপার আউট করেছে কিন্তু ততদিনে আর অমলদা কোথায়? 

সে বইবাড়ির ভেতরমহল আমার এত সহজ অধিকার দিয়েছিল যে, ওর যে একটা বাইরের রিডিং সেকশন বা পাঠকক্ষ আছে, খেয়ালই হয়নি কখনও যতদিন না সদ্য পরিচিত একজন সেখানে দেখা করার কথা বললেন সে জায়গাটা একেবারেই পছন্দ হয়নি কীরকম খোলা একটা হলঘর। এত বড় বড় পেপার বোর্ড লাগানো লোকে কাগজ পড়ছে, শব্দ হচ্ছে, উঠে যাচ্ছে চেয়ার ঠেলে লোকেরা তাকিয়ে থাকে, বই বন্ধ করলে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি মিসেস সেনের মেয়ে, না?’ দূর, এখানে কেউ পড়তে আসে?

ফার্স্ট ইয়ারে একটা বই হাতে এল, নামটা এখন আর মনে নেই, বিশ্বের বিভিন্ন সময়ে নিষিদ্ধ বইগুলো সম্পর্কে লেখা খুবই উৎসাহ হল সেসব বই বিষয়ে লেডি চ্যাটার্লি-র নাম ততদিনে জেনে ফেলেছি আর এও জানি যে সে বই হাতে পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম, কারণ আমার রোজকার পরিচিতদের মধ্যে কারও কাছে ওটা নেই সে নাকি খুবই খারাপ, একেবারেই নাকি পড়ার নয় সুতরাং তার খোঁজ তখন করছি না কিন্তু অয়েল, জাংগল, জার্মিনাল… এগুলো কী? সেই ‘নিষিদ্ধ বই’য়ের মতে বোঝা গিয়েছিল এগুলো খুব প্রেমসংক্রান্ত বই নয় আমার লাইব্রেরির ইংরেজি বইয়ের তাকে একদিন হাতে পড়ল ‘জার্মিনাল’ আরও কয়েকটার সঙ্গে নিয়ে গেলাম এন্ট্রি টেবিলে অমলদা চশমাটা নাকের সামনের দিকে ঠেলে, চশমার ওপর দিয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা কার জন্য?’ ‘পড়ব’ ঠিক একই ভঙ্গিতে, ‘সামনের বছর নিও’ সেই সামনের বছর আর এল কই? ততদিনে তো ’৬৬ সাল ততদিনে তো খাদ্য আন্দোলন

১২-১৩ বছর পিছলে যাওয়ার পর যখন আবার এসে দাঁড়ালাম সেই রাস্তায়, রাস্তাটাও যেন কেমন দুখী হয়ে গেছে পিচ দেওয়া নোংরা মতো দু’পাশের ঘাসে কত ময়লা পড়ে আছে এত রিকশা যাচ্ছে, ট্রাক জেলখানার বাগানের সামনে সারি দিয়ে উঁচু বারান্দাওয়ালা সারি সারি দোকানঘর শেষ মাথায় পরপর কয়েকটা গাড়ি সারাইয়ের চালা কেরোসিনের আর ডিজেলের গন্ধে শ্বাস নেওয়া যায় না তারপরই বাসস্ট্যান্ড লাইব্রেরিটা নতুন গ্রিল, বড় চড়ারঙের সাইনবোর্ড, সরকারি হলুদ রঙের দেওয়ালের আড়ালে কোথায় লুকিয়ে পড়েছে বাইরে থেকে তাকালে পিছন দিকের কাচের লম্বা বন্ধ জানলা দেখা যায়, কিন্তু তার ভেতরে যে সেই ঐশ্বর্যভাণ্ডার এখনও আছে, সে আর বিশ্বাস হয় না ও কি আমাকে দেখতে পায়? চিনতে পারে আর?

___ পড়ুন ধুলোমাটির মুখ কলামের অন্যান্য পর্ব ___

২. পথের কুকুর, আকাশের কাক-চিল, মাটির পিঁপড়েরও অন্নের ভাবনা গৃহস্থের

১. বেনারসে স্কুলে পড়ার সময় বহেনজির তকলি কাটার ক্লাসে বন্ধুদের ভাগেরও সুতো কেটে দিতাম