এক অর্ধোন্মাদ। সেতুর ওপরে। গাইছেন জাতীয় সংগীত, নাচছেনও। দমকল কর্মীরা সেই একই গান গেয়ে, নেচে, তাঁকে ফিরিয়ে এনেছেন। জাতীয় সংগীত এখানে দেশপ্রেমের আর (R) চিহ্ন নয়, বস্তুত এক আনন্দময় গান। সেই অর্ধোন্মাদ কি আজকের ছিন্নবিচ্ছিন্ন মেরুকরণের ভারত? সে নিজের মতো গেয়ে উঠতে চায় এই গান, ফিরিয়ে দিতে চায় ঐক্যের ধারণা?
বিধাতার সঙ্গে সাপলুডো খেলছিল পাগলটা! ফুটপাথে বসে! ২৫ বছর পেরিয়ে এসে, এখন, সে উঠে পড়েছে একটা সেতুর এক্কেরে টঙে। খেলাচ্ছলেই। বিধাতার আরেকটু কাছাকাছি। আমরা দেখছি সে নাচছে। গান গাইছে তারস্বরে। কী গান? জাতীয় সংগীত! আজ্ঞে হ্যাঁ। কেউ কি তাকে বলেছে তা গাইতে? না। তাহলে? আপনমনে, নিজের খুশিতে-খেয়ালে সে গেয়েছে। গানের মতো। অন্য যে কোনও গানের মতো কি এই গান গাওয়া যায় না? কেবল সময় মেনে, নিয়ম মেনে, দিনক্ষণ মেনে, নির্দিষ্ট ভঙ্গিমায় গাইতে হবেই? জনগণমন কি শেষমেষ একটা গান নয়? গানের আনন্দ তা থেকে নিতে নেই?
………………………………………..
পড়ুন রাজ্যেশ্বর সিনহার লেখা: নজরুল না পড়া মানে সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারকে একরকম অস্বীকার করা
………………………………………..
কবীর সুমন কখনও ভেবেছিলেন সে এক্কেবারে জাতীয় সংগীত গাইবে? কিশোর কুমার কিংবা অরিজিৎ সিং নয়? নিদেনপক্ষে শ্যামল মিত্র? তাহলে কি তা আরও শৈল্পিক হত? রিয়ালিটি শো-তে চান্স পেত সে? জীবনের মলিন যত দুঃখ-বেদনার গপ্পসপ্প টিআরপি বাড়াত? কিন্তু সেসবের চেয়েও অনেক বেশি তীব্র এই ঘটনা। জাতীয় সংগীতকে বেছে নেওয়ার এই ক্ষমতা এক আশ্চর্য দ্যোতনার জন্ম দিয়েছে। দিনেদুপুরে। হাওড়া জেলার জি টি রোডের ওপরে। বাঙালবাবু সেতুর মাথায়। নীচে ২৫ হাজার ভোল্টের বিদ্যুতের লাইন। নীচে মানুষ-মানুষীর অনর্গল যাতায়াত। নীচে একটুকরো ভারত। অর্ধোন্মাদ!
জাতীয় সংগীত। ছেলেবেলায় যখন গাইতাম স্কুলে! প্রতিদিন ক্লাস ওয়ান থেকে ক্লাস টুয়েলভ– সকলে, একসঙ্গে, এক সুরে, এক স্বরে! আশরীর অদ্ভুত শিহরন। গলা ধরে যাচ্ছে। চোখের গোড়ায় জল। চিকচিক। যেন এক অবিনশ্বর ঐক্যের নির্মাণ! সেই মুহূর্তে ওই স্কুলচত্বরটাই আমাদের দেশ। টিফিন-টাইমে ওই স্কুলচত্বরের ফুটবলটাই আমাদের ধর্ম। পরেরদিন আবার। আবার। পাঞ্জাব। সিন্ধু। গুজরাট। মারাঠা… টুপ করে দু’-তিনটে কাঠচাঁপা ঝরে পড়েছিল কারও কারও মাথায়! এরপর দৃশ্যান্তর। চলচ্চিত্রের ভাষায় জাম্পকাট করে!
………………………………………..
পড়ুন রাজা দাশগুপ্তর লেখা: কেজো তথ্যচিত্রে বিশ্বাস ছিল না হরিসাধন দাশগুপ্তের
………………………………………..
২০২০। দিল্লি দাঙ্গা। রাস্তায় আধমরা চার-পাঁচটি দেহ। ছেঁড়া জামা। ঠোঁট ফেটে রক্ত। দিল্লি শহরের পুলিশ দেহগুলো খুঁচিয়ে দিচ্ছিল। লাঠি দিয়ে। তারপর গাইতে বলছিল, জাতীয় সংগীত। বুঝে নিতে চাইছিল, দেহগুলো আদৌ ভারতের কিনা! এমন ঐক্যের ধারণা কি আমি স্কুল থেকে পেয়েছিলাম? না। এমন দেশপ্রেমের ধারণাও আমার মস্তিষ্কে জাঁকিয়ে বসেনি। ভাগ্যিস! অথচ এই মুহূর্তে, অর্থাৎ কেন্দ্রের শাসনকালে জাতীয় সংগীত যেন দেশপ্রেমের অন্যতম পরাকাষ্ঠা। ট্রেনে অথবা মেট্রোয় ক্ষণেক্ষণেই বেজে উঠছে। হয়তো রাস্তাঘাটে আচমকা সহনাগরিককে থামিয়ে জিজ্ঞেস করা হবে, ‘আপনি ভারতীয়? জাতীয় সংগীত গেয়ে তা প্রমাণ করুন এক্ষুণি!’ প্রেম কিংবা দেশপ্রেম দুটোই তো আসলে অ্যাবস্ট্রাক্ট, তার প্রমাণ কী করে করা চলে বলুন তো!
ভেবে দেখুন, শব্দটি জনগণমন। জনগণের মন। যে মন অতি স্বতস্ফূর্তভাবেই গেয়ে উঠেছে এতদিন! ভয়শূন্য। আনন্দে। উচ্ছ্বাসে। যৌথতায়। যে মনই আসলে আগলে রেখেছে মানচিত্র। দ্রাবিড়। উৎকল। বঙ্গ… সে মনে আজকাল বড় ভয়। জাতীয় সংগীতের গা থেকে দেশের ঐক্যের ধারণাটা দিনে দিনে মুচ্ছে যাচ্ছে কেন, হে পাঠক? মনে পড়ছে ফুটবল বিশ্বকাপের কথা। ইরান বনাম ইংল্যান্ড। খেলা শুরুর আগে, ইরানের ১১ জন খেলোয়াড় জাতীয় সংগীত গাইলেন না। নীরব রইলেন সম্পূর্ণ সময়। কেন? বছর তেইশের মাহশা আমিনিকে হত্যা করেছিল ইরান-রাষ্ট্র। যেহেতু সে হিজাব পরেনি! বলতে চাইছি, জাতীয় সংগীতই প্রতিরোধের মোক্ষম অস্ত্র হয়ে উঠেছিল সেদিন। যেন সংগীতের ম্যাজিকেই বেঁধে রেখেছিল প্রত্যেককে। ওই ম্যাজিকটা যদি আজ একজন প্রায়োন্মাদ যুবক আমাদের ফিরিয়ে দেয়, তবে কি খুব আপত্তি করবেন আপনি?
যুবকের বয়স ২৪। অসমের বাসিন্দা। হাওড়া জেলায় সে কীভাবে এসে পড়ল অথবা কেনই-বা এল– প্রশ্ন তা নয়। সে যে মানসিক ভারসাম্যহীন, এ-ও আমরা জানি। এই ভারসাম্যহীনতায় সে যে আঁকড়ে ধরল জাতীয় সংগীত, লেখাটি ফোকাস করতে চাইছে ওখানেই। বাদবাকি সব ঝাপসা। ব্লার করে দিলাম।
………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………..
সে জাতীয় সংগীত গাইছিল। তালে-বেতালে নাচছিল বটে। অন্য কোনও ট্রেন্ডিং কিংবা নস্টালজিক গান নয়, বাঁচার মতো বাঁচবার মাটিতে, বাতাসে ও পথে সে ফিরে আসছে জাতীয় সংগীতে ভর দিয়ে। প্রচ্ছন্নভাবে ঐক্যের ধারণাও কি ফিরে আসছে না? তবে কি সে আমাদের চেয়ে একটু বেশি সুস্থ? তাই কি পাগল ছাড়া দুনিয়া চলে না? আমার ফাঁপা আশাবাদী মন তেমনটাই ভাবছে। ফিরে গিয়েছে স্কুলচত্বরে। আমার পাশে দাঁড়িয়ে একটা পাগল। ভারতের নাগরিক। অতীত থেকে তাকিয়ে দেখছে সাম্প্রতিক ভারত। মন্দিরে জল খেতে গেলে দলিত পাচ্ছে ব্রাহ্মণের লাথি। নাগরিকত্ব আইন ভয় দেখাচ্ছে সক্কলকে। শ্রমের সঠিক মূল্য না পেয়ে যখন পাটকলের শ্রমিক ধর্মঘট করছে, তাতে মালিকের কিছু যায় আসছে না। অগণিত নারীর শ্লীলতাহানি করে বিদেশে পালিয়ে গেছেন সরকার ঘনিষ্ঠ প্রজ্জ্বল রেভান্না। লিঙ্গ। ধর্ম। জাত। পাত। অর্থনীতি। বিভাজনের রাজনীতি। সব কেমন জটপাকিয়ে ভারত দ্বিধাবিভক্ত। ক্রোধের আগুনে দাউদাউ। ঐক্যের মস্ত ছাতায় মস্ত মস্ত ছ্যাঁদা। যে ভারত মগজ, দেশের আপন মন ও আত্মার সঙ্গে ভীষণ আলাদা।
সে ফিরে আসছে নিজের কাছে! বিন্ধ্য। হিমাচল। যমুনা। গঙ্গা… আমাদের দেশ-সংক্রান্ত ধারণাটিও ইয়াব্বড়ো কোনও সেতুর মাথায় আধপাগল হয়ে নাচছে। লারেলাপ্পা গাইছে। এইবার, জাতীয় সংগীত গাইতে গাইতে সে নেমে আসুক। আত্মার কাছে। ঐক্যের কাছে। উচ্ছল-জলধি-তরঙ্গের কাছে। আমাদের প্রতিরোধের অস্ত্র হয়ে।
হ্যাঁ, সেই ফিরে আসার গানে, জাতীয় সংগীতে আপনারাও গলা মেলাতে পারেন।