অন্ন বস্ত্র বাসস্থান-এর পর মনের খোরাকের জন্য আসে নান্দনিকতা। নান্দনিকতা হল সৌন্দর্য এবং রুচির দার্শনিক অধ্যয়ন। সোজা করে বললে, বিষয়টি কিন্তু সাধারণের খাওয়া পরায় কাজে লাগে না সব সময়। তাই যদি মানি তাহলে এটাও মানতে হয় যে নন্দনতত্ত্ব মগজের একটি বিশেষ ব্যাপার। বললে অত্যুক্তি হবে না, যে শিল্পসৃষ্টি একটি মগজের কাজ যেমন, তেমনই গ্রাহক, অর্থাৎ যিনি এটা উপভোগ করবেন, তাঁর কাছেও এটা সমান মগজের কাজ।
৮.
বাংলায় কালীপুজো, প্রবাসে দীপাবলি অথবা দেওয়ালি। মুম্বই বাণিজ্যিক শহর অতএব দেওয়ালিতে আলোর রোশনাই আর বাজির প্রতিযোগিতা। আরও একটা জিনিস চলছে বেশ ক’দিন ধরে, সেটা ঘরবাড়ি পরিষ্কার করা। দেওয়াল রং করা, ফার্নিচার, ঘরের পর্দা পাল্টানো। জোর কদমে ঘরবাড়ি সাফ সাফাইয়ের কাজ মানেই এর ব্যালকনির কাদা জল, সাবান জল অন্যের ব্যালকনিতে। এর ঝাঁটার ছিঁটে ওর দেওয়ালে। সিঁড়ি, বাইরের লবিতে একগাদা কাগজপত্র, বাক্স প্যাটরা, পুরনো জামা কাপড়, ছেড়া চটি সব বের করছে ক’দিন ধরে রোজ। মোদ্দা কথা, আবর্জনা বিদেয় করে ঘরের রূপ বদলে দেওয়া।
এই পর্বে যে বিষয়ে আলোচনা করব বা গল্প করব, তার শিরোনাম হতে পারে, ‘আবর্জনা’। জঞ্জাল, বর্জ্য, ডেব্রিজ, অকেজো মাল, ফালতু জিনিস, ফ্যালনা, যে নামেই ডাকুন না কেন, মানেটা একই। সরাসরি গল্পে যাব, কোনও রাখঢাক, রহস্য নেই।
কাগজ কুড়ানি
কলকাতা থেকে মুম্বইগামী ট্রেনের প্রথম শ্রেণির কামরা। সে কামরাতে সেদিন আমরা দু’জন। কেউ কাউকে চিনি না। সহযাত্রীর পরনে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা। মেদহীন ছিপছিপে চেহারা, চোখা নাক-চোখ। গায়ের রং ময়লা হলেও উজ্জ্বল।
সাদা পাঞ্জাবি-পাজামার সহযাত্রী চুপচাপ বসে আছেন। আমিও চুপ। প্রথম শ্রেণিতে এমনটা প্রায়ই হয়। এখানে কেউ অকারণে কথা বলে না। সেকেন্ড ক্লাসে বরং কেউ না কেউ এগিয়ে এসে আলাপ করে। ঝগড়া করে, তর্ক করে, কিংবা জানলার ধারে বসার অনুরোধ করে। কিন্তু এখানে ফার্স্ট ক্লাসে, প্রথমে দু’জন দু’জনকে একটু মেপে নেয়, তারপর ইচ্ছে হলে আস্তে আস্তে মুখ খোলে।
শুরুতে আমরা দু’জনেই সিটে আধশোয়া হয়ে বিশ্রামের ভঙ্গি নিলাম। অল্পক্ষণের মধ্যেই ফাৎনা নড়ল।
–মুম্বই পর্যন্ত? নাকি মাঝপথে নামবেন?
–হ্যাঁ, মুম্বই পর্যন্তই। আপনি?
–আমিও। আপনি কি ওখানেই থাকেন, নাকি কাজের জন্য যাচ্ছেন?
–থাকি। আপনি?
–আমিও।
–চাকরি না বিজনেস?
আমি একটু থেমে বললাম, চাকরি। আপনি?
ঠোঁটের কোণে একরকম মৃদু হাসি এনে বললেন, আমি কাগজ কুড়োই। মানে, কাগজ কুড়ানি।
আমি চমকাইনি। কারণ এরকম মানুষদের আগে দেখেছি। ওরা কথার শুরুতেই একটু ‘টেস্ট’ নিতে ভালোবাসে। আপনি টিকে গেলে গল্প চলবে, না টিকলে, দরজা বন্ধ।
দীর্ঘ ট্রেনযাত্রায় কারও নতুন লোকের সঙ্গে আলাপ করার ইচ্ছে হয়, আবার কারও ঘুম পায়।
যারা এমন বাঁকা উত্তর দেয়, তাদের আপনি যদি ‘ট্যাঁরা লোক’ ভেবে ঘুমের ভান করেন তাহলে গল্পটা হাতছাড়া হয়ে যায়। আর যদি আলাপ চালিয়ে যেতে চান, তবে হাসি মুখে জিজ্ঞেস করতে হবে, আপনার কাগজের ব্যাপারটা ঠিক ধরতে পারলাম না, একটু খুলে বলবেন?
আসলে সত্যিকারেই পুরনো কাগজ। তবে ধরনটা কীরকম জানেন, এই যে বড় বড় অফিস কাছারি, যাদের এত প্রচুর পরিমাণে কাগজে-কলমে কাজ, সেই সমস্ত কাগজগুলো কিছুদিন পরে পরে ফেলতে হয়। ধরুন ব্যাংকের রেকর্ড। হয়তো তিন বছর রাখতে হয়, পাঁচ বছর রাখতে হয়। পরের সংবাদটা আকাশ থেকে পড়ার মতো, এই যে বিভিন্ন শহরে অফিসের পুরনো কাগজপত্র, তার পরিমাণটা উনি যেটা বললেন, সেটা কুইন্টাল হিসেবে। বছরে কত টন কাগজ কুড়োতে পারেন তার হিসেব দিচ্ছেন আর কি।
আলোচনা আরও একটু এগোলে উনি পুরনো ফার্নিচার, লোহা লক্কড়, গাড়ি-বাড়ি, কী না কুড়োতে পারেন তার হদিশ দিলেন। আমি বললাম, বাহ্ এ তো বেশ নতুন খবর। উনি এই বিষয়ে আর এগোতে চাইলেন না, খোশগল্প করতে চাইলেন টাইম পাস করার জন্য। বললেন, নতুন খবর অর্থাৎ ‘NEWS’? এই ‘নিউজ’ শব্দের ফুল ফর্মটা জানেন তো? আশ্চর্য, ওটা ফুল ফর্মে নেই? তা কেমন? আমি জানতে চাইলাম। উনি বললেন, নর্থ, ইস্ট, ওয়েস্ট, সাউথ। প্রিয় পাঠক বন্ধুরা, এরপরে আমাদের গল্পগুজবের বহমানতা কোন দিকে যাবে আপনি ট্রেনযাত্রী হিসেবে আন্দাজ করুন।
অকেজো লোহা-লক্কড়
কিছুদিনের মধ্যেই মুম্বইয়ে একটা খবর পেলাম, মানে খবরের কাগজে দেখলাম, বান্দ্রার কাছাকাছি এক বিশাল জাহাজ সমুদ্রতটের কাছাকাছি এসে আটকে গেছে এবং সেই আটকে যাওয়াটা এমনই যে, ওই জাহাজটাকে আর কখনওই সরিয়ে গভীর জলে নিয়ে যাওয়া যাবে না। একদিন যাতায়াতের পথে দেখলাম বিশাল একটা জাহাজ সত্যিই সমুদ্রে তীরের বেশ কাছাকাছি জলে দাঁড়িয়ে আছে। সোজাসুজি নয়, একটু যেন কাত হয়ে। অদ্ভুত, যে জাহাজটা ভাসতে ভাসতে এল ঠিকঠাক, কী এমন হল যে সে জলের নীচে মাটিতে আটকে গেল এবং সেটাকে টেনেটুনে কোনওমতে সমুদ্রের গভীরে আর নিয়ে যাওয়া যাবে না?
ক’দিন বাদে আরও অবাক হওয়ার ব্যাপার ঘটল। ওই পথ দিয়ে যেতে গিয়ে দেখলাম, সমুদ্রের ধারে বড় রাস্তা থেকে জলের মধ্যে একটা রাস্তা বানানো হয়েছে। তারপরে একদিন দেখলাম, সেই রাস্তায় লরি যায় জাহাজ পর্যন্ত। বেশ কিছুদিন ধরে এই লরি যাতায়াত দেখতে দেখতে একদিন দেখলাম, জাহাজটা আর নেই। মানে ঘটনাটা কী ঘটেছে জানেন তো! জাহাজের পাতলা মোটা নানারকম লোহার শরীরের অঙ্গগুলো বিভিন্নভাবে কেটে, সেগুলোকে লরি করে নিয়ে গিয়ে বেঁচে দেওয়া হচ্ছে। মানে গোটা জাহাজটাই হয়ে গেল সমুদ্রের আবর্জনা।
ফ্লাশব্যাক
ছোটবেলায় আমাদের ছিল নানা রকমের গ্রামীণ পুজো-পার্বণ। পুজো-পার্বণের কতগুলো রীতিনীতি এমন ছিল, যার মধ্যে থাকত অদ্ভুত আনন্দ, শিক্ষা আর প্রকৃতির সঙ্গে পরিচয়ের, যোগাযোগের নানা ছুতো। সরস্বতী পুজোর সময়ে জোগাড় করতে হত আমের বউল, টোপাকুল, যবের শীষ, দোয়াত, কঞ্চির কলম, বই, দুধ, গঙ্গাজল ইত্যাদি। স্বাধীনতা দেওয়া হল একদিকে, অন্যদিকে বাড়ি ছেড়ে বন্ধুদের সঙ্গে জঙ্গলে উপকরণ জোগাড় করা মানে প্রকৃতির সঙ্গে মেশা। পাতা চেনা, গাছ চেনা, গাছের টেক্সচার জানা, রং চেনা।
অন্যরকম একটা পুজো ছিল, ছেলে মেয়ে আমরা সবাই মিলেই তাতে যোগ দিতাম। পুজোটার নাম ‘ঘেঁটু পুজো’। বসবাসের এলাকার বাইরে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় সেই পুজোর আয়োজন। গ্রামের ভাগাড়ের কাছাকাছি তিন রাস্তার সংযোগস্থানে পুজোর থান।
পুজোর উপকরণগুলো বড় অদ্ভুত। ঘেঁটু ফুল, ছেঁড়া চুল, ঘুঁটের ছাই, সজনের খাড়া, গোবর, শামুকের খোল, মাছের কাঁটা, ছেড়া চটি, তালের আটি, কেলে হাঁড়ি ইত্যাদি। মাটির পুরনো ভূষোকালি মাখা কেলে হাঁড়িটা চাই-ই। এসবগুলো একটা ছেঁড়া ঝুড়ি বা ভাঙা কুলোর মধ্যে করে মাথায় নিয়ে আমরা যেতাম সকাল সকাল সেই পুজোর থানে। সারা পাড়া জানিয়ে মেয়েরা শঙ্খ বাজাতে বাজাতে চলত। গোবরে ঘেঁটু ফুল পুঁতে পুজোর উপকরণগুলো ফেলা হত। কিছু ছেলেরা হাতে লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত ওই কেলেহাঁড়ি ভাঙার জন্য। একটা মজার খেলা।
পুজোটার স্থানভেদে নানা পৌরাণিক গল্প আছে। কিন্তু আমার মনে হয় পরিবেশ পরিস্কার রাখা, বাড়িঘরের আশপাশগুলোর সাফ-সাফাইয়ের একটা আয়োজন আসলে। লক্ষ করুন, কী সুন্দর বাড়ির আবর্জনা পরিষ্কারের একটা রাস্তা বের হল। চমৎকার লাগে এখন ভাবতে। পুজোর ছলে নোংরা, আবর্জনা পরিষ্কার, স্বাস্থ্যরক্ষা এ সমস্তই কেউ যেন একটা অদ্ভুতভাবে হোমওয়ার্ক আকারে দিয়েছিল আমাদের ছোটবেলায়।
আবর্জনা– জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে
দেশে বিদেশে, আধুনিক শহরাঞ্চলে আবর্জনা নিষ্কাশন একটা মস্ত সমস্যা আজকাল। ভাঙা কুলো নয়, ভাঙা গাড়িটা ফেলা মুশকিল এখন। আধুনিক জীবনযাত্রা এবং শিল্পায়নের ফলে আমাদের পরিবেশে বর্জ্য ও আবর্জনার পরিমাণ দ্রুত বাড়ছে। এটি জল, স্থল এবং এমনকী অন্তরীক্ষেও ছড়িয়ে পড়ছে, যা জীবজগৎ, মানুষের স্বাস্থ্য এবং ভবিষ্যতের স্থায়িত্বকে হুমকির মুখে ফেলছে।
সমুদ্র এবং নদীতে প্লাস্টিক, রাসায়নিক এবং অন্যান্য বর্জ্যের দূষণ সবচেয়ে উদ্বেগজনক। প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক জলীয় পরিবেশে প্রবেশ করছে, যা মাছ, সামুদ্রিক প্রাণী এবং মানুষের খাদ্য-মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে। এশিয়ায় প্লাস্টিকের ব্যবহার ২০২৫ সালে সাংঘাতিক। সমুদ্রের প্লাস্টিক বর্জ্যের ৬০% এসেছে মাত্র ৫টি দেশ থেকে। এই দূষণের ফলে প্রতি ব্যক্তি বছরে ২,১১,০০০ মাইক্রোপ্লাস্টিক শরীরে ঢোকাচ্ছে খাদ্যের মাধ্যমে।
স্থলভাগে সলিড ওয়েস্ট, ইলেকট্রনিক বর্জ্য এবং খাদ্য বর্জ্যের স্তূপ গড়ে উঠছে, যা মাটির উর্বরতা নষ্ট করছে এবং মিথেন গ্যাস তৈরি করে জলবায়ু পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করছে। ল্যান্ডফিল সাইটগুলো অতিরিক্ত চাপে আছে। বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর ২ বিলিয়ন মেট্রিক টন অস্থায়ী মিউনিসিপাল বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যা পরিবেশকে বিপজ্জনক জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে।
অন্তরীক্ষে স্যাটেলাইটের অংশ, রকেটের ধ্বংসাবশেষ এবং অন্যান্য মানুষসৃষ্ট বস্তু (স্পেস ডেব্রিজ) দ্রুত বাড়ছে, যা স্যাটেলাইট এবং মহাকাশযানের জন্য বিপজ্জনক। ২০২৫ সালে অন্তরীক্ষে প্রায় ৪০,০০০ অবজেক্ট ট্র্যাক করা হয়েছে, যার মধ্যে মাত্র ১১,০০০টি সক্রিয় স্যাটেলাইট; বাকিগুলো আবর্জনা।
এমনকী পাতালে
খনিজ পদার্থ উত্তোলনের পর খনিতে যে আবর্জনা বা বর্জ্য থেকে যায়, তা খনি আবর্জনা। এগুলো বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। যন্ত্রপাতির ব্যবহার, খনিজের ধরন, ও উত্তোলনের পদ্ধতির ওপর নির্ভর করে। খনিজ পদার্থের স্তর পর্যন্ত পৌঁছতে যে উপরিভাগের মাটি, বালি, পাথর ইত্যাদি সরাতে হয়, সেগুলো সাধারণত মাটির ঢিবি আকারে ফেলে রাখা হয়। এতে জমিক্ষয় ও ধূলিকণা দূষণ ঘটায়।
খনিজ পদার্থের প্রয়োজনীয় ধাতু বা খনিজ আলাদা করার পর যে অবশিষ্ট পদার্থ থাকে, তাতে সায়ানাইড, সালফাইড, পারদ, আর্সেনিক ইত্যাদি বিষাক্ত পদার্থ থাকতে পারে। খনির পাথরে থাকা সালফাইড যখন বাতাস ও জলের সংস্পর্শে আসে, তখন গন্ধক অ্যাসিড তৈরি হয়। এই অ্যাসিড জলাশয়ে গিয়ে অম্ল দূষণ ঘটায়। খনি অঞ্চলে বিস্ফোরণ, ড্রিলিং, ট্রাক চলাচল ইত্যাদি থেকে ধুলো, সালফার ডাইঅক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড ইত্যাদি বায়ুদূষণ ঘটায়।
বৈজ্ঞানিক কাজের আবর্জনা
বিজ্ঞান বিষয়ক পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজে যেমন প্রযুক্তি এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা ইত্যাদি নানা জায়গা থেকে প্রচুর পরিমাণে আবর্জনা তৈরি হয়। তবে আশার কথা, বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার চূড়ান্ত লক্ষ্য হল পুনর্ব্যবহার এবং বর্জ্য থেকে শক্তির মতো জিনিসের সর্বাধিক ব্যবহার করে আবর্জনা হিসাবে শেষ পর্যন্ত বর্জ্যের পরিমাণ হ্রাস করা।
অ্যাটমিক রিয়াক্টরের ওয়েস্ট, মানে অ্যাটমিক চুল্লির বর্জ্য হল পারমাণবিক বিক্রিয়ার ফলে উৎপন্ন তেজস্ক্রিয় পদার্থ, যা ফিশন প্রক্রিয়ায় ক্ষয়প্রাপ্ত বা অকেজো হয়ে যাওয়া জ্বালানি (যেমন ব্যবহৃত ইউরেনিয়াম জ্বালানি) থেকে আসে। এটি উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয় এবং দীর্ঘস্থায়ী, যা বিশেষ উপায়ে এবং গভীর সুরক্ষা ব্যবস্থা-সহ সংরক্ষণ করা হয়। এই বর্জ্যকে নিরাপদে রাখতে এবং পরিবেশকে সুরক্ষিত রাখতে বিজ্ঞানীরা প্রাকৃতিক পারমাণবিক চুল্লির বর্জ্য সংরক্ষণের পদ্ধতি নিয়ে নিয়ত গবেষণা করছেন। এটি ফিশন বিক্রিয়ার উপজাত হিসেবে তৈরি হয় এবং অত্যন্ত তেজস্ক্রিয় হয় এবং মানুষের পক্ষে বিপজ্জনক।
অবাক করা আবর্জনা
মিশরে বেড়াতে গিয়ে পৌঁছে গেলাম অবশ্য দ্রষ্টব্য আলেকজান্দ্রিয়ার সেই বিখ্যাত অত্যাধুনিক লাইব্রেরিতে। অবিশ্বাস্য রকমের বড় সেই লাইব্রেরিতে বইয়ের আয়োজন ছাড়াও এখন আধুনিকভাবে আছে নানা রকমের ডিজিটাল পদ্ধতি এবং স্বল্পপরিসরে অনেক তথ্য সংগ্রহের আধুনিক বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা। সেখানেই শুনেছিলাম সেই ভয়াবহ গল্প। দীর্ঘদিন আগে নাকি এই আধুনিক লাইব্রেরির আগের পুরনো লাইব্রেরিতে আগুন লেগে নষ্ট হয়ে যায় পুরো বইপত্রের সংগ্রহ।
আবার এও শুনেছি, ৩৯১ এবং ৬৪২ খ্রিস্টাব্দের দিকে খ্রিস্টান এবং আরবরা মিশরে টলেমির প্রতিষ্ঠিত সমগ্র আলেকজান্দ্রিয়ান গ্রন্থাগারটি সুন্দরভাবে পুড়িয়ে দেয়। অনুমান করা হয় যে, প্রায় ৭,০০,০০০ খণ্ড অমূল্য গ্রন্থ এবং পাণ্ডুলিপি পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয়েছিল। ভাবতে অবাক লাগে, কোনও কোনও মানুষের কাছে বই হল আবর্জনা।
আবার হিটলারদের কাছে লক্ষ লক্ষ মানুষের শরীর হল আবর্জনা। হাড় হিম করা গল্প শুধু নয়, সত্যিকারের চাক্ষুষ করে এসেছি। হলোকাস্ট মিউজিয়ামের অসংখ্য ছবি, ভিডিও ইত্যাদির মাধ্যমে আবার সংগ্রহে রাখা আছে সেসব তথ্য। বদ্ধ ঘরে বিষাক্ত গ্যাস দিয়ে মারা হল যে লক্ষ লক্ষ মানুষ, তাদের লাশ হয়ে দাঁড়াল বিশাল আবর্জনা।
ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট, অর্থাৎ আবর্জনা নিষ্কাশন ব্যবস্থাও করা হল অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায়। আধুনিক প্রযুক্তির বুলডোজার ইত্যাদি ব্যবহার করে ওই অসংখ্য মানুষের লাশ নিয়ে গিয়ে বড় বড় গর্তে রেখে মাটি চাপা দিয়ে পুঁতে ফেলা হয়েছে। সেইটা আবার খুব গুছিয়ে ভিডিও করা হয়েছে, তথ্যচিত্র করা হয়েছে। সেই ভিডিও দেখার দুর্ভাগ্য হয়েছে আমার। মানুষের শরীর যেখানে আবর্জনা।
আবর্জনার শিল্পকর্ম
পৃথিবীর নানা দেশের শিল্পীরা নানাভাবে আবর্জনা দিয়ে শিল্পকর্ম ভাস্কর্য ইত্যাদি তৈরির চেষ্টা করেছে আমাদের পরিবেশ সচেতনতা মাথায় রেখে। উদাহরণ হিসেবে এখানে একজন শিল্পীর নাম করব আর একটা সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান। এছাড়াও বহু শিল্পী ও শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে সারা পৃথিবীতে।
এইচ. এ. শুল্ট, একজন জার্মান কনসেপচুয়াল আর্টিস্ট, যিনি বিশেষভাবে পরিচিত, আবর্জনাকে কেন্দ্র করে তাঁর সৃষ্ট কাজগুলোর জন্য। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কাজের মধ্যে অন্যতম হলো ‘ট্র্যাশ পিপল’, আবর্জনা দিয়ে তৈরি ভাস্কর্যের এক প্রদর্শনী, যা পৃথিবীর সব মহাদেশে ঘুরে বেড়িয়েছে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি হল ‘সেভ দ্য বিচ হোটেল’ যা সম্পূর্ণভাবে আবর্জনা দিয়ে তৈরি একটি ভবন।
শুল্ট নিজেকে পরিবেশ-সচেতনতার প্রবক্তা বলে মনে করেন, আর ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’ তাঁকে অভিহিত করেছে ‘পরিবেশ-শিল্পের অগ্রদূত’ হিসেবে। দশকের পর দশক ধরে শুল্ট এমন সব কাজ করে চলেছেন, যা জনসচেতনতা জাগিয়ে তোলে এবং যেখানে তা প্রদর্শিত হয়, যেন স্থানটি নিজেই এক বক্তব্যের অংশ হয়ে ওঠে।
আমাদের দেশে গোয়া-র শিল্পীবন্ধু ড. সুবোধ কেরকার-ও বেশ সফলতার সঙ্গে সমুদ্রে ভেসে আসা আবর্জনা, বিশেষ করে শামুক ঝিনুকের খোলা ইত্যাদি দিয়ে চমৎকার ভাস্কর্য এবং বিচ ইনস্টলেশনের কাজ করেছে। দেশে এবং বিদেশে নাম করেছে সুবোধ।
পরিবেশ সচেতন সংস্থা হিসেবে উল্লেখ করছি, দ্য ওয়াশড অ্যাশোর (washed ashore) প্রজেক্টের। এমন এক শিল্প উদ্যোগ, যা সব বয়সের মানুষকে মুগ্ধ করে এবং একই সঙ্গে পরিবেশ সংরক্ষণ ও জীবনের গুরুত্ব শেখায়।
এই প্রকল্পের ভ্রাম্যমাণ প্রদর্শনীতে দেখা যায় নানাবিধ বিশাল সামুদ্রিক প্রাণীর ভাস্কর্য, যা সমুদ্রতট থেকে কুড়িয়ে নেওয়া প্লাস্টিক ও অন্যান্য বর্জ্য দিয়ে তৈরি। এই ভাস্কর্যগুলো সমুদ্র ও জলপথে প্লাস্টিক দূষণের ভয়াবহতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, এবং মানুষকে পরিবেশ রক্ষার প্রতি উদ্বুদ্ধ করে। এঁদের কর্মকাণ্ড দেখতে পারেন washedashore.org, এই সাইটে।
সৃজনশীল কাজের বর্জ্য
সবশেষে চলে আসি আমার নিজস্ব এলাকায়। যেখানে অপরাধে আমারই মাথা নত করার পালা। হ্যাঁ, সৃজনশীল কাজ, যেমন চিত্রকলা এবং ভাস্কর্য ইত্যাদিতে নিম্নমানের কাজ বা অদক্ষতার কারণে বর্জ্য উৎপাদন অনেকাংশে বাড়তে পারে। এটি শুধু শিল্পীদের অভ্যাসের ওপর নির্ভর করে না, বরং উপকরণের অপচয়, পরিকল্পনার অভাব এবং বাজারের চাপের ফলে ঘটে। এই অপচয় মানুষের লোভ, খারাপ পরিকল্পনা এবং অদক্ষতার ফল, যা প্রকৃতিতে স্বাভাবিকভাবে ঘটে না। সমকালীন শিল্পে উৎপাদন প্রক্রিয়া স্পষ্টভাবে অপচয়মূলক, কারণ শিল্পীরা বাজারের চাপে দ্রুত কাজ করেন, কিন্তু সফলতার হার কম থাকলে উপকরণ নষ্ট হয়ে যায়। বিশ্বব্যাপী, শিল্পকর্মের উৎপাদনে বর্জ্যের পরিমাণ বছরে লক্ষাধিক টন, যার মধ্যে অন্তত ২০% নিম্নমানের বা অসম্পূর্ণ কাজ থেকে আসে।
অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান-এর পর মনের খোরাকের জন্য আসে নান্দনিকতা। নান্দনিকতা হল সৌন্দর্য এবং রুচির দার্শনিক অধ্যয়ন। সোজা করে বললে, বিষয়টি কিন্তু সাধারণের খাওয়া পরায় কাজে লাগে না সব সময়। তাই যদি মানি তাহলে এটাও মানতে হয় যে নন্দনতত্ত্ব মগজের একটি বিশেষ ব্যাপার। বললে অত্যুক্তি হবে না, যে শিল্পসৃষ্টি একটি মগজের কাজ যেমন, তেমনই গ্রাহক, অর্থাৎ যিনি এটা উপভোগ করবেন, তাঁর কাছেও এটা সমান মগজের কাজ। তাই শিল্প, কারও কারও কাছে নন্দন। আর যদি তা মগজে মগজে না মেলে, তাহলে সেটা কিন্তু গ্রাহকের কাছে আবর্জনা।
…পড়ুন অল্পবিজ্ঞান-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৭: ছবির অসুখ-বিসুখ, ছবির ডাক্তার
পর্ব ৬: বিসর্জনের মতোই একটু একটু করে ফিকে হয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর রং ও রূপ
পর্ব ৫: জীবন আসলে ক্যালাইডোস্কোপ, সামান্য ঘোরালেই বদলে যায় একঘেয়ে নকশা
পর্ব ৪: কুকুরেরই জাত ভাই, অথচ শিয়াল সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি?
পর্ব ৩: অন্ধকারে অল্প আলোর মায়া, ফুরয় না কোনওদিন!
পর্ব ২: বজ্রবিদ্যুৎ ভর্তি আকাশে ঘুড়ি উড়িয়ে আমাদের চিরকালের নায়ক হয়ে আছেন বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved