কুমির, মাছ, বাঘ ইত্যাদি মিলিয়ে-মিশিয়ে এক বকচ্ছপ থিম। জলচর আর স্থলচর প্রাণী মিশিয়ে এক উভচরী বাহনের প্রতীক হল মকর। এর মুখ কুমিরের মতো, ল্যাজ মাছের মতো, চারটি পা বাঘের মতো আর সারা গায়ে মাছের আঁশ। এই বিচিত্র বাহনটিকে ভারতের তাবড় শিল্পী-কারিগর তাঁদের সৃষ্টিতে স্থান দিয়েছেন। ছবিতে, টেরাকোটার ফলকে, পাথরে, ছাপচিত্রে মকরের পোট্রের্ট আর পূর্ণাঙ্গ সবরকমের উপস্থিতি পরিচিত।
২.
মকর বড়ই অদ্ভুত প্রাণী। এমনধারা সত্যিই নেই পৃথিবীতে। কুমির, মাছ, বাঘ ইত্যাদি মিলিয়ে-মিশিয়ে এক বকচ্ছপ থিম। জলচর আর স্থলচর প্রাণী মিশিয়ে এক উভচরী বাহনের প্রতীক হল মকর।
এর মুখ কুমিরের মতো, ল্যাজ মাছের মতো, চারটি পা বাঘের মতো আর সারা গায়ে মাছের আঁশ। এই বিচিত্র বাহনটিকে ভারতের তাবড় শিল্পী-কারিগর তাঁদের সৃষ্টিতে স্থান দিয়েছেন। ছবিতে, টেরাকোটার ফলকে, পাথরে, ছাপচিত্রে মকরের পোট্রের্ট আর পূর্ণাঙ্গ সবরকমের উপস্থিতি পরিচিত।
পৌরাণিক ব্যাখ্যান বড় বিচিত্র। শ্রুতি, স্মৃতি এবং লেখার দীর্ঘ যাত্রায় রূপ বদলে যায় মূল কাহিনির। দেবীরূপী গঙ্গাপূজার ও তাই মনে হয় নানা সময়কাল শাস্ত্রে রয়েছে। তবে মূলত জৈষ্ঠ্যমাসের শুক্লপক্ষের দশমীতে গঙ্গাপুজো হয় মহা সমারোহে। মনে করা হয়, ওইদিন স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে নেমে এসেছিলেন তিনি। এটাও একটি রোমহষর্ক ঘটনা! স্বর্গে ওঁর নাম মন্দাকিনী। তা তিনি হুড়মুড় করে প্রবলবেগে যখন ডাইভ দিলেন তখন তো পৃথিবী যায় যায়! অগত্যা মহাদেব। জটায় ধারণ করলেন ওই ভীমবেগ। মকরবাহনের তখন পাত্তা নেই কিন্তু। ১৯ শতকের এক অসামান্য কাঠখোদাই চিত্র আছে।
ভালো করে লক্ষ করলে দেখা যায় যে, যখন নদী উদ্দাম, তখন তার ধারেপাশে মকর নেই। অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের পরে যখন তিনি শান্ত প্রবাহিণী, তখনই বিবি হয়ে বসেছেন মকর বাহনের পিঠে। তার আগে বিষ্ণুর পদতল থেকে উদ্ভুত হলেন তিনি (শ্রী রাধিকার একটু গোঁসা ছিল কৃষ্ণের সঙ্গে গঙ্গার মেলামেশা নিয়ে)। তারপর ব্রহ্মার সংলগ্ন হয়ে একেবারে মহাদেবের জটায় ডাইভ। মনে করা হয়, ব্রহ্মা কমণ্ডলুতে তাঁকে ধারণ করে বয়ে বেড়ান। এখানে ওই কমণ্ডলু বা ব্রহ্মাকে গঙ্গার ক্ষণকালের বাহন বলাই যায়। তারপর ‘ডেসটিনেশন গোমুখ’। খোদাই চিত্রকর সেটা দেখাতে ভোলেননি। পর্বতমালার পিছনে একটা গরুর মুখ পাঠক খেয়াল করুন। তারপর জহ্নুমুনির হাঁটু ফুঁড়ে সমতলে আসা। সেইখানে তিনি যুক্ত হলেন বাহন মকরের সঙ্গে। সামনে এসকর্ট ভগীরথ।
মকর যতটা না বাহন তার থেকে বেশি নিষ্ক্রমণের প্রতীক। পাহাড়ি ঝরনার বা খনিজগুন সমৃদ্ধ গরমজলের নিষ্ক্রমণ দ্বার হিসাবে স্থপতি ও মূর্তিকাররা মকরমুখের অবতারণা করেছেন। মন্দিরের ব্যাবহৃত জল নিষ্ক্রমণ পথেও মকর মুখের ভাস্কর্য খুবই পরিচিত।
পাশাপাশি জ্যোতিষবিদ্যায় মকর এক রাশি হিসাবেই প্রতিষ্ঠিত।
ভারতের মূল নদী গঙ্গা। শাস্ত্রে উল্লেখ আছে তাঁর পবিত্রতার কথা। নানা কাহিনি এবং উপকাহিনির মাধ্যমে গঙ্গা পবিত্র নদী হিসাবেই আমাদের কাছে বেশি পরিচিত যতটা না দেবী হিসাবে। তাই তাঁর বাহনের গতি প্রকৃতিও ভিন্ন। গঙ্গা যখন নদীরূপ পরিহার করে দেবীরূপে অবতীর্ণ হন তখনই তিনি মকরবাহিনী।
আর যখন তিনি শুধুই পবিত্র নদী, মকর তখন নিষ্ক্রমণ পথ। নিষ্ক্রমণে বৃহতের সঙ্গে মিলনের হেতু থাকে। যেমনটা গঙ্গা সাগরে মেশে। এই মিলন-উদ্দেশ্যেই হয়তো গয়নার জোড়া মুখে মকরের উপস্থিতি।
স্বর্ণকারর কাছে খুব একটা জুতসই উত্তর পাইনি, কিন্তু শিল্পভাবে এই দুই মকরমুখের মিলন হয়তো এক সুদীর্ঘ যাত্রাপথের পূর্ণ বৃত্ত রচনা করে।