মালদায় ডেকে দেওয়ার বিষয়টি জটিল। ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢোকার মুখে রানিং অবস্থায় আচার, আমসত্ত্ব, আমকাসুন্দি, আমচুড়, হজমি কিনে ট্রেন ছাড়ার আগে সমস্ত বোতল ফাটিয়ে, কামরাময় তেল গড়াগড়ি করিয়ে, উল্টোমুখী তিনসুকিয়ে মেলের এক নিষ্পাপ মহিলার হাত থেকে ‘এইযো বহিনজি, দিজিয়ে তো থোড়াসা’ বলে প্লাস্টিক ছিনিয়ে আনাটাই প্রাথমিক টার্গেট। ভবিষ্যতের গ্রুপ লিডারটাকে কীভাবে চিনবেন? খালি গায়ে গামছা পরা একটা সিরিঙ্গে বাঙাল-টাইপ, একহাতে খালি আমূলের কৌটো, অন্য হাতে টর্চ জ্বালিয়ে চলন্ত ট্রেনের জানালা দিয়ে ফোকাস মেরে ফরাক্কার জল দেখার চেষ্টায় নিবিষ্ট মানেই বুঝবেন ইনিই সেই চোজেন ওয়ান।
২০.
পাড়ায় যাদের মাধ্যমিক, তাদের বাপ-মা সেবার বলত, ‘এবার রেহাই দাও বাপু, রেজাল্ট বেরলে আবার এসো।’ অমনি একদল পরদিনই হাজির– ‘এরপর তো পরীক্ষা, খুদা না খাস্তা কিছু যদি হয়েটয়ে যায়, তাই মাস তিনিকের জন্য চলেই এলাম…।’
এরা সবসময়ই গ্রুপে ঘোরে। অমুকের মাসি, তমুকের পিসে, ঠাকমা এবং ইনভেরিয়েবলি চার-পাঁচজন অবিবাহিত রামপাঁঠা সহযোগে সারা বছর বেড়ানোই একমাত্র কাজ। চাকরিবাকরি নেই, অনন্ত সময়! দু’-এক পিস বিধবা জোগাড় হলেই কেল্লাফতে, তাদের পয়সাতেই হিল্লি-দিল্লি সেকেন্ড ক্লাস আপার বার্থ! তারপর চেকারকে ‘একটু দেখবেন স্যর, সঙ্গে লেডিস আছে’ বলে জানলার ধারে সিট মানেই ‘চায়ের দামটা…এ কী… আ-হা-হা-হা… আপনি দিচ্ছেন বুঝি… না না, সে কী করে, সে কী করে… আ-হা-হা-হা-হা…’
এদের দলের লিডারগুলো চৌকস। শেয়ালদায় পুলিশের পা মাড়িয়ে, ভুল কম্পার্টমেন্টে অন্যের বাঙ্কে বিছানা পেতে, খোট্টা কুলিকে ‘থোরাসা ফুঁ দে দেও তো’ বলে হাওয়াবালিশ ফুলিয়ে ভুবনেশ্বরে পৌঁছেই একগাল হাসি– ‘মালদা এলে ডেকে দেবেন দাদা, আমার আবার ভোরবেলাতেই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা ওব্বেস।’ তারপরই তুলকালাম। ‘আমি এখুনি মামলা করব’ দিয়ে চেকারের সঙ্গে চোটপাট শুরু এবং পরদিন সকালে পুরির মন্দিরে পুজো সেরে, ভোগ গিলে, ঝিনুক কুড়িয়ে, কাকাতুয়ার খাজা গজা প্যাক করিয়ে রেডি। ‘দুপুরে পারসে খাব।’ আর কোনও অ্যাজেন্ডা নেই, কারণ মাঝে একবার উঁকি মেরে স্বর্গদ্বারে মরা পোড়ানো দেখে রেট নিয়ে ডোমদের সঙ্গে মারামারি অবধি চুকিয়ে এসেছে। ততক্ষণে বাকিরাও ধর্মতলা থেকে বাস ধরে এসে পৌঁছেছে, কারণ যেহেতু বহুদিনকার এক্সপিরিয়েন্সড্ লিডার, সকলের টিকিট এঁরই আন্ডারওয়ারের ভিতরে গুপ্ত পকেটে। পরে হাপ প্যাকেট বাদাম ছাড়া কিছুই পাওয়া গেল না দেখে সকলের সে কী রাগ! ‘লিচ্চয় মালের চাট! টাংকির ঘোরে রিটার্ন টিকিটগুলো ফেলে দিয়েছে।’ লিডার তাতেও দমে না। ‘কতকিছু সরিয়ে হাতড়ে বাদাম বের করতে হচ্ছিল সে কথা কেউ বলছে না, অকৃতজ্ঞ, পাষণ্ড, ইতর কোথাকার! এপ্পর থেকে একা বেড়াতে যাবি, পারব না তোদের ট্যুর কন্ডাক্ট করতে।’ পরে অবিশ্যি গুপ্ত পকেটের কেটে যাওয়া চেন পুরির উড়ে দর্জির কাছে সারানোর যৌক্তিকতা নিয়ে তর্কে জড়িয়ে সকলে এই পর্বের ঝগড়া থেকে নিষ্কৃতি পায়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
রাতে খাওয়ার সময় একাধিক জম্পেশ ব্যাপার ঘটলেও পরদিন আলুয়াবাড়ির পৌঁছলে অবস্থা একেবারে আয়ত্তের বাইরে চলে যায়। দূরে নীল পাহাড়ের সারি দেখামাত্র সমস্ত কম্বল, লেপ, সোয়েটার, মাফলার, মাঙ্কিক্যাপ, কাশ্মীরি শাল বের করে জানালার কাঁচ নামিয়ে সিটে পা তুলে জষ্ঠি মাসের পূণ্যপোভাতে কয়েকজনের ডবোল নিমুনিয়া ম্যানেজ কত্তে পারা একমাত্র গড়পারের বাঙালির পক্ষেই সম্ভব।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
মালদায় ডেকে দেওয়ার বিষয়টি জটিল। ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢোকার মুখে রানিং অবস্থায় আচার, আমসত্ত্ব, আমকাসুন্দি, আমচুড়, হজমি কিনে ট্রেন ছাড়ার আগে সমস্ত বোতল ফাটিয়ে, কামরাময় তেল গড়াগড়ি করিয়ে, উল্টোমুখী তিনসুকিয়ে মেলের এক নিষ্পাপ মহিলার হাত থেকে ‘এইযো বহিনজি, দিজিয়ে তো থোড়াসা’ বলে প্লাস্টিক ছিনিয়ে আনাটাই প্রাথমিক টার্গেট। ভবিষ্যতের গ্রুপ লিডারটাকে কীভাবে চিনবেন? খালি গায়ে গামছা পরা একটা সিরিঙ্গে বাঙাল-টাইপ, একহাতে খালি আমূলের কৌটো, অন্য হাতে টর্চ জ্বালিয়ে চলন্ত ট্রেনের জানালা দিয়ে ফোকাস মেরে ফরাক্কার জল দেখার চেষ্টায় নিবিষ্ট মানেই বুঝবেন ইনিই সেই চোজেন ওয়ান। আলাপ করে দেখুন– এত পয়সা দিয়ে পাঁচ বেটারির টর্চ কেনা যে বৃথা গেল, সেটা একনাগাড়ে নানাভাবে ইনিয়ে-বিনিয়ে কোঁকিয়ে যাবে। ঠিকানা দিয়ে দেখুন, চিঠিতেও ওই এক কাঁদুনি। ফরাক্কার জল, সুন্দরবনের বাঘ, ছাদে উঠে অমিতাভ বচ্চনের থালা বাজানো– নাঃ, এর কোনওটাই ওঁর দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া… এমনকী ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া, যা কিনা জ্যোতিবাবুর ডেডবডি, যা কিনা অতক্ষণ রাস্তা দিয়ে গেল, যা কিনা সিপিএমের পার্টি কর্মীরাও কানমলা খাওয়ার ভয় নেই বলে প্রাণভরে দেখেছে, তাও এই ভদ্রলোকের নসিবকে কাঁচকলা প্রদর্শন করল! এক দৌড়ে ছাদে উঠতে যাবেন, ঠিক সেই সময়ই সুধা কাপড় মেলে নামছে একরাশ বালতি গামলা ট্যাং টোং করতে করতে। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য অবস্থায় ঝাঁপিয়ে রেলিং থেকে মুখ বাড়িয়েছেন, আর ঠিক সেই মোমেন্টামেই স্বর্গরথটা মোড় ঘুরল, মানে টার্নস ইটস্ ব্যাক। সবটাই নিমাইয়ের হর্সেস মাউথস্ থেকে শুনতে হল আফটার দ্যাট সো স্যাডলি– ‘‘কী বলব দাদা, পোচোন্ডো গ্যাবিটি! মরে গ্যাছে, কিন্তু ফেসকাটিংটা সেই গম্ভীর! এক ফোঁটা হাসি নেই! মনে হচ্ছে এক্ষুনি ধমকে উডে বোলবে– সুভাষ, ঘরে ফেরো। রমলা ওয়েটিং কোত্তেছে।’’
রাতে খাওয়ার সময় একাধিক জম্পেশ ব্যাপার ঘটলেও পরদিন আলুয়াবাড়ির পৌঁছলে অবস্থা একেবারে আয়ত্তের বাইরে চলে যায়। দূরে নীল পাহাড়ের সারি দেখামাত্র সমস্ত কম্বল, লেপ, সোয়েটার, মাফলার, মাঙ্কিক্যাপ, কাশ্মীরি শাল বের করে জানালার কাঁচ নামিয়ে সিটে পা তুলে জষ্ঠি মাসের পূণ্যপোভাতে কয়েকজনের ডবোল নিমুনিয়া ম্যানেজ কত্তে পারা একমাত্র গড়পারের বাঙালির পক্ষেই সম্ভব।
খোট্টারা খানিকটা ডিফারেন্ট। যাদবজির বাড়িতে প্রায়ই দেশওয়ালি ভাই, বহিন, দাদা, দাদি, জেঠ, নানি, মৌসি, চল্লিশ-বিয়াল্লিশটি ভাই-ভাতিজাদের আগমন ঘটত। মহিলারা যেহেতু সবসময় প্রেগনান্ট, তাই ফেরার সময় গোটা দশ-বারোটা হেড বেশি হতই। ব্যাটাদের অ্যাটিটিউডটাই ছিল ‘দসঠো আয়াথা, দসঠো ওয়াপিস জায়গা’– মানে কিছু তিলে খচ্চর বাচ্চা আর অন্ধ খোঁড়া ডেডবডি টাইপকে ফেলে রেখে পালানোর মতলব। যাদবজিও ধুরন্ধর– যতই বলো ‘দো মিনিটকা বাদমে আকে লেকে যায়গা, মাইরি বোলতা গড প্রমিস’, উঁহুঁ, ‘সবকটাকে একসঙ্গে গাড়িতে তুলবি।’ ওরা মোট দুটো উলের টুপি, একটা চাদর আর দেড়খানা সোয়েটার নিয়ে বেরত– আধখানা ইন দ্য প্রসেস অব বিয়িং উভেন। এই অ্যাটিটিউডটা চল্লিশজনের জন্য তিনটে ফুল আর একটা হাফ টিকিট কাটা থেকে ওই সংখ্যক লোকের জন্য আড়াইটে ভেজ মিল অর্ডার দেওয়া অবধি এক গল্প। আমার ধারণা, এই যে আজকাল পথেঘাটে এত বিহারি দেখা যায়, তারা সকলেই বেড়াতে বেড়িয়ে ফিরতে না পারা অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া কেস, ইদানীং মোট বয়ে রিকশা টেনে দেশে দো বিঘা জমিন বাড়াচ্ছে। তবে, এরা কি সত্যি জানে কোথায় কারা ওই পাঠানো টাকায় জমি কিনছে? এত জমি পায় কোথায়? গত একশো বছরে সমস্ত বিহারি রিকশাওলা, গোয়ালা, কুলির জন্য সত্যিই জমি কেনা হয়ে থাকলে তাইওয়ান, সেজওয়ান, মাঞ্চুরিয়ানও ওদের হওয়ার কথা।
বাঙালিরা এদিকে সচেতন। ‘তোর কাছে আধখানা মোলপুয়ার দাম পাই, বাড়ি ফিরেই দিবি। মোগোলসরাইয়ে নেমে যাওয়ার চেষ্টা করলে পেটে পা পুরে দোবো। বুড়িটাকে তোল, জোয়ান ভিকিরি দেখলেই পাশে বসে পরার চেষ্টা করছে। তার বাপের কাছে দুটো কমলালেবুর দাম পেতাম। সকড়িগলিতে নেমে আর লঞ্চ ধরল না। শুনলাম টিকাটুলি টু বাংলাবাজার মুটের কাজ করে। বুড়িটাকে হয় তোল, নয়তো ঠেলে টাঙার তলায় ফেলে দে। তোদের ফ্যামিলিটাই এরোম। কাল আমার পাত থেকে তোর পিসি পট করে আধখাওয়া লেবু ঝেড়ে নিজের ডালের বাটিতে চিপড়ে নিল। আট-দশ ফোঁটা ছিল তখনও। বিকেলে ট্রিপের পয়সা বুঝে নিয়ে বুড়িটার গায়ে প্যাট্টোল মাখিয়ে বের করবি, শ্মশানের ধারে বসিয়ে রেখে ফিরতে হবে। হরিদ্বার ট্রিপের মিটিং তোদের বাড়িতে। মোচার চপ না খাওয়ালে তোর লছমনঝোলা… এদিকে আয়রে ব্যাটা অন্ধগোকুল, ওদিকে তো খাদ…মরে পার পাবি না… কামড়ে আধসের মাংস তুলে নেব…’
…ভয়বাংলা-র অন্যান্য পর্ব…
ভয়বাংলা পর্ব ১৯: দর্শকরা দ্রুত ঐতিহাসিক থেকে পৌরাণিকে সুইচ করতে পারত
ভয়বাংলা পর্ব ১৮: বাঙালি কি আদৌ জানে তালেগোলে সে কী হারাইয়াছে?
ভয়বাংলা পর্ব ১৭: বাঙালি জীবনের ভেজিটেরিয়ান হওয়ার ভয়
ভয়বাংলা পর্ব ১৬: বাঙাল হওয়া সত্ত্বেও যারা রাবীন্দ্রিক বাংলায় কথা কইত, তারা মুসলমানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে না
ভয়বাংলা পর্ব ১৫: গুষ্টিসুখের প্লেজারই অর্জি-নাল সিন
ভয়বাংলা পর্ব ১৪: কৈশোরে জাতের খোঁজ কেউ কখনও নিয়েছে বলে মনে পড়ে না
ভয়বাংলা পর্ব ১৩: নবনাৎসিগুলোর কাছে আর একটু সফিস্টিকেশন এক্সপেক্ট করেছিলাম মশাই
ভয়বাংলা পর্ব ১২: রাজসভায়, থুড়ি, লোকসভায় কেবল পাশা-খেলাটুকু হবে
ভয়বাংলা পর্ব ১১: আমাগো জয়ার বরের ফিগারটা দ্যাখোনের মতো হইসে
ভয়বাংলা পর্ব ১০: ভূতেরাও ঢিল ছোড়ে, মানুষও রেডি রাখে পাথরের স্টক
ভয়বাংলা পর্ব ৯: চ্যাপলিনের ‘দ্য কিড’-এর খুদে স্টোনম্যান জানলার শার্শি ভেঙেছিল খাবার জুটবে বলেই
ভয়বাংলা পর্ব ৮: ভয়ে ভ্যাবাচ্যাকা লোকেদের সংখ্যা আশ্চর্যরকম বৃদ্ধি পেল
ভয়বাংলা পর্ব ৭: প্রত্যেকেরই মনে হতে থাকে সে-ই অদৃশ্য ঘাতকের একমাত্র টার্গেট
ভয়বাংলা পর্ব ৬: হাতের নাগালে একখানা জলজ্যান্ত বন্দুক চালানো লোকই ছিল সহায়
ভয়বাংলা পর্ব ৫: স্টোনম্যানের একটুকরো খুনে স্টোন বাড়িতে থাকলেই সর্বরোগ থেকে মুক্তি!
ভয়বাংলা পর্ব ৪: ঝেঁটিয়ে বিদেয় কর
ভয়বাংলা পর্ব ৩: বাঙালি ভূত-পেতনিরাও ভারি শুচিবায়ুগ্রস্ত!
ভয়বাংলা পর্ব ২: তবু সে দেখিল কোন ডাইনোসর!
ভয়বাংলা পর্ব ১: বাঙালির ভূতের ভয় যেন উত্তম-সুচিত্রার মতোই সাংস্কৃতিক