মধ্যবিত্ত চাকুরিজীবী ইংরেজ বা ইঙ্গ-ভারতীয়দের উপস্থিতি শহরে যত বাড়তে থাকে উনিশ শতকের শেষ ভাগ থেকে ততই সাহেব পাড়ায় বাড়ি ভাড়ার চাহিদা উর্ধ্বমুখী হতে থাকে। এই অঞ্চলেই বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দপ্তর ছিল (যেমন, সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার বা সি আই ডি’র অফিস), আর ছিল বেশ কিছু বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের মূল কার্যালয়। কর্মক্ষেত্রের কাছাকাছি বাড়ির চাহিদা তাই স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে গিয়েছিল। আর এঁদের উপস্থিতি এই এলাকায় এক বিশেষ কসমোপলিটান আবহাওয়া গড়ে তুলেছিল।
১২.
কোনও শহরের চরিত্র বুঝতে সেই শহরের রাস্তার দিকে নজর দেওয়া দরকার। রাস্তার রকমফের সামগ্রিকভাবে গোটা শহরের, বা শহরের অঞ্চলভেদে, নানা বৈচিত্র নিয়ে আসে। বড়, মেজো, সেজো নানা রাস্তার পাশাপাশি থাকে গলি– সোজাসাপটা, প্যাঁচানো, অত্যন্ত সরু, বা দুম করে শেষ হয়ে যাওয়া। আধুনিক নগর পরিকল্পনার একটা মূল বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে এই নানা ধরনের রাস্তাকে এক ছাঁদে ফেলে সাজিয়ে নেওয়া। আঁকাবাঁকা পথ নয়, সোজা লম্বা-চওড়া রাস্তা, মোটর গাড়ি চলার মতো। সরু গলি শাসন কাজে বিশেষ বাধা দেয়, নানারকম সুযোগ করে দেয় বিরোধিতার, প্রতিবাদের। রাস্তাঘাট যে কোনও শহরের চরিত্র তৈরি করে দেয়, পাড়া বা মহল্লার রূপরেখা এঁকে দেয়, শহরবাসীর মানসিকতা গড়ে দেয়। এভাবেই কলকাতা আলাদা হয়ে যায় নতুন দিল্লির থেকে, মুম্বই জেগে থাকে সারারাত।
একটা বড় রাস্তা ও তার আশপাশের বাড়ি ঘরদোর, দোকানপাট, অফিস কাচারি, লোকজন, গাড়িঘোড়া, পার্ক বেঞ্চ– এইসব মিলিয়ে জনমানসে একটা ধারণা তৈরি হয়ে যায় সেই এলাকা সম্পর্কে। বাগবাজার স্ট্রিট আর পার্ক স্ট্রিটের পার্থক্য কলকাতার বাসিন্দাকে বোঝানোর দরকার পড়ে না। তেমনই গড়িয়াহাট রোড আর ইএম বাইপাস শহরের দু’রকম ছবি তুলে ধরে। ঔপনিবেশিক শহরে হোয়াইট টাউন/ব্ল্যাক টাউনের রাস্তা আবার সম্পূর্ণ আলাদা কথা বলত। আপাতদৃষ্টিতে দুই অঞ্চল যেন দুটো আলাদা শহরের অংশ; কিন্তু একটু খুঁটিয়ে দেখলে নানা মেলামেশার ছবি বেরিয়ে আসে। কলকাতার ক্ষেত্রে থিয়েটার রোড এরকমই একটা রাস্তা ছিল।
সাহেব কলকাতার খাস তালুকের অন্যতম রাস্তা ছিল থিয়েটার রোড। চওড়া সুন্দর রাস্তা, দু’ধারে মস্ত মস্ত বাগানবাড়ি, গাছপালা, দোকানপাট। দেশ-বিদেশের নানা বাসিন্দার পাশাপাশি ভারতীদের উপস্থিতিও চোখে পড়ার মতো ছিল, বিশেষ করে দেশীয় রাজা আর জমিদারের। বিশ শতকের গোড়ার দশকগুলিতে এই রাস্তায় ছিল বিদেশি, ভারতীয়, আংলো-ইন্ডিয়ান– নানা জনের সমাহার। ১৪ আর ১৫ নম্বর বাড়িগুলি ছিল বিহারের এক জমিদারি, হাথওয়ার মহারানির। পিছনের রাস্তায়, ৩ নম্বর ক্যামাক স্ট্রিটে, খয়রার রাজার সম্পত্তি ছিল। তথাকথিত শ্বেতাঙ্গ শহরে বনেদি ভারতীয়দের এই উপস্থিতি কলকাতার জনসংস্কৃতির এক বিশিষ্ট চরিত্র তৈরি করতে সাহায্য করেছিল। বাঙালি চাকুরিজীবী বড়লোকরাও বিশ শতকের গোড়া থেকে থিয়েটার রোডে থাকতে শুরু করেন। ৩৪ নম্বর বাড়িতে ব্যারিস্টার কে. এন. মজুমদার তাঁর আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে থাকতেন, যাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বিখ্যাত হোমিওপ্যাথ ড. প্রতাপচন্দ্র মজুমদার। ১৯১৫ সালে ৪৬ নম্বর বাড়িতে বাস করতেন বিখ্যাত প্রফেসর ও অ্যাডভোকেট, ড. রাসবিহারী ঘোষ– যাঁর নামে তৈরি হবে দক্ষিণ কলকাতার অন্যতম নতুন রাস্তা, রাসবিহারী অ্যাভিনিউ। ১৯১৮ সালে এই বাড়িটি নাটোরের জমিদার, কুমার বীরেন্দ্রনাথ রায় বাহাদুর কিনে নেন। কিছুটা এগিয়ে, রাস্তার মাঝামাঝি, উত্তর ভারতের কিছু বনেদি মুসলমান পরিবারের বসবাস ছিল। ১৯৩১ সাল নাগাদ ৩০ নম্বর বাড়িতে থাকতেন আইনসভার সদস্য স্যর আবদেল করিম গাজনভি।
ইউরোপীয় আদবকায়দায় রপ্ত ভারতীয় সমাজের উচ্চবর্গের আনাগোনা থিয়েটার রোডের সামাজিক বিন্যাসে নিঃসন্দেহে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। দেশীয় রাজা বা জমিদার ছাড়াও ঔপনিবেশিক সরকারের বড় চাকুরে বা ধনী ব্যবসায়ীরা এই অঞ্চলে থাকতে শুরু করেন বিশ শতকের গোড়ার দিকে। শাসক শাসিতের দূরত্ব সত্ত্বেও সামাজিক মেলামেশাও ছিল ইউরোপীয় ও ভারতীয়দের মধ্যে। একই বিল্ডিংয়ের বিভিন্ন ফ্ল্যাটে ইংরেজ পরিবারের পাশাপাশি ভারতীয় পরিবার বাস করছে– এরকম নিদর্শনও পাওয়া যায়। ৭ নম্বর বাড়িতে যেমন ডব্ল্যু জে ট্রেইস, আর. সি. সেন, আর মিসেস লতিফ– এই তিনজন একইসঙ্গে থাকতেন। আবার ১৮ নম্বরে এক ইংরেজ ভদ্রলোক, সি. এস. গ্রসারের সঙ্গে থাকতেন রায় বাহাদুর পি. সি. লাল চৌধুরী।
তবে শুধু উচ্চবর্গের লোকজন থাকতেন এই এলাকায় সেরকম ভাবলে ভুল হবে। ১৯১২ সালে দেখা যাচ্ছে ২ নম্বর এলিসিয়াম রো ঠিকানায় বাস করতেন এক বাঙালি মহিলা, মিস মিটার নামে। নিজের পরিচয় হিসেবে লিখে রেখেছিলেন ‘হাউস অ্যান্ড ল্যান্ড এজেন্ট’। থিয়েটার রোডের ইউরোপীয় বাসিন্দাদের মধ্যেও এরকম বেশ কিছু মধ্যবিত্ত পরিবারের কথা পাওয়া যায়। চৌরঙ্গী থেকে থিয়েটার রোডের ঢোকার মুখে ডানদিকের প্রথম বাড়িটি ছিল মিসেস ক্যাম্ববেল নামের এক ইংরেজ মহিলার। ১ নং বাড়িটির নাম ছিল ‘বেডফোর্ড হাউস’। বোর্ডিং লজ হিসেবে বিভিন্ন লোককে ভাড়া দিতেন তিনি। ১৯১২ সালে বাড়িটি ছিল একতলা। পরের ছয় বছরের মধ্যে বাড়িটিতে আরও বেশ কয়েকটি তল যোগ হয়। ১৯১৮ সালে সবচেয়ে উঁচুতলার ফ্ল্যাটে এক ইংরেজ ভাড়া থাকতেন আর গ্রাউন্ড ফ্লোরে ছিলেন চিলির কন্স্যুলেট জেনারেল, ওটা সেইজো। ১৯২৬-এ আবার দেখা যাচ্ছে নতুন এক ভাড়াটে, সরকারের কর্মচারী, স্যর হিউ স্টিফেনসন, এই বাড়িতে থাকছেন। আজ এই ১ নম্বর বাড়িটিতে একগুচ্ছ দোকানের সারি চোখে পড়বে।
৯ আর ১০ নম্বর বাড়িগুলিতেও মূলত ইউরোপীয় আর অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের জন্য এই ধরনের বোর্ডিং হাউস ছিল। ১৯১৮ সালে মিসেস ম্যাকডোনেল মালকিন হিসেবে চালাতেন এই বোর্ডিং। ১৯২৬ নাগাদ এখানে চালু হয় ‘গার্লস ফ্রেণ্ডলি সোসাইটি, হোস্টেল অ্যান্ড ক্লাব’। আবার কয়েক বছর পর এর পরিচিতি হয় মিসেস মলিনার বোর্ডিং হাউস হিসেবে। এর আশপাশের ক্যামাক স্ট্রিট বা উড স্ট্রিটের মতো রাস্তাতেও এই ধরনের একাধিক ভাড়া বাড়ি বা বোর্ডিং হাউসের নাম পাওয়া যায় বিশ শতকের প্রথম কয়েক দশক জুড়ে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই বাড়িগুলির মালকিন হিসেবে নাম পাওয়া যেত কোনও ইউরোপীয় বা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মহিলার। মধ্যবিত্ত চাকুরিজীবী ইংরেজ বা ইঙ্গ-ভারতীয়দের উপস্থিতি শহরে যত বাড়তে থাকে উনিশ শতকের শেষ ভাগ থেকে ততই সাহেব পাড়ায় বাড়ি ভাড়ার চাহিদা উর্ধ্বমুখী হতে থাকে। এই অঞ্চলেই বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দপ্তর ছিল (যেমন, সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার বা সি আই ডি’র অফিস), আর ছিল বেশ কিছু বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের মূল কার্যালয়। কর্মক্ষেত্রের কাছাকাছি বাড়ির চাহিদা তাই স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে গিয়েছিল। আর এঁদের উপস্থিতি এই এলাকায় এক বিশেষ কসমোপলিটান আবহাওয়া গড়ে তুলেছিল।
থিয়েটার রোডের বোর্ডিং হাউসগুলি চাকুরিজীবী ছাড়াও আরেক দলের জন্য জরুরি হয়ে উঠেছিল। পার্ক স্ট্রিটে ছিল ছেলেদের জন্য সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ। অন্যদিকে, পাশেই মিডলটন রো’তে, বাংলার এককালীন গভর্নর হেনরি ভ্যান্সিটার্টের (১৭৬০-৬৪) বাগানবাড়িটি হাতবদল হয়ে তৈরি হয় মহিলাদের স্কুল লোরেটো হাউস। ১৯২৬-এ তাই যখন মিসেস ম্যাকডোনেলের বোর্ডিং হাউস বদলে গিয়ে মহিলাদের হোস্টেল হিসেবে চালু হয়, তখন সেটা কোনও আকস্মিক ঘটনা ছিল না। ছাত্র-ছাত্রী, স্কুল-কলেজের শিক্ষক-শিক্ষিকা বা কর্মচারী– অনেকের কাছেই থিয়েটার রোড, ক্যামাক স্ট্রিট, বা উড স্ট্রিটে অল্প দামে বাড়ি বা ঘর ভাড়া পাওয়া নিতান্ত জরুরি হয়ে পড়েছিল।
একই সময় নাগাদ আরও খানিক উত্তরে, বাগবাজার, হ্যারিসন রোড, আমহার্স্ট স্ট্রিট, বা শিয়ালদহ অঞ্চলে ‘মেস’ বাড়ির আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। কলকাতার বাইরে থেকে শহরে পড়তে বা চাকরি করতে আসা বাঙালি ছাত্র ও কেরানিকুলের আস্তানা ছিল এই মেস। বাংলা সাহিত্য, সিনেমা, জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে জমকালো উপস্থিতি এই মেসবাড়ি আর তার বাসিন্দাদের। সেই নিয়ে পরে কখনও আলোচনা করা যাবে। কিন্তু সমসাময়িক সাহেব পাড়ার ভাড়া বাড়িগুলি নিয়ে আমরা বেশি কিছু জানি না। বেশিরভাগ বাড়িই এখন বহুতল বিল্ডিং, যেখানে রয়েছে নানা অফিস, দোকান, ব্যাঙ্ক, আর কিছু আবাসিকদের ফ্ল্যাট। শ’খানেক বছর আগের বোর্ডিং হাউসগুলি নিয়ে আজকের কলকাতা বিশেষ মাথা ঘামায় না। এই বাসাগুলি আমাদের তথাকথিত সাহেবপাড়ার একমাত্রিক ছবি থেকে সরে এসে এক অন্য ইতিহাসের ইঙ্গিত দেয়, যেখানে নানা জাতি, ধর্ম, শ্রেণি, ভাষার সহাবস্থান ছিল, যা ঔপনিবেশিক কলকাতায় এক বিশিষ্ট নাগরিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল।
তথ্যসূত্র: সুমন্ত ব্যানার্জী, মেময়ার্স অফ রোডস: ক্যালকাটা ফ্রম কলোনিয়াল আর্বানাইজেশন টু গ্লোবাল মডার্নাইজেশন (২০১৬)
…কলিকথা–র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১১: সারা বিশ্বে শ্রমিক পাঠানোর ডিপো ছিল এই কলকাতায়
পর্ব ১০: কলকাতার যানবাহনের ভোলবদল ও অবুঝ পথচারী
পর্ব ৯: বৃষ্টি নিয়ে জুয়া খেলা আইন করে বন্ধ করতে হয়েছিল উনিশ শতকের কলকাতায়
পর্ব ৮: ধর্মতলা নয়, ময়দানই ছিল নিউ মার্কেট গড়ে তোলার প্রথম পছন্দ
পর্ব ৭: সেকালের কলকাতায় বাঙালি বড়মানুষের ঠাঁটবাটের নিদর্শন ছিল নিজের নামে বাজার প্রতিষ্ঠা করা
পর্ব ৬: কলকাতার বহিরঙ্গ একুশ শতকের, কিন্তু উনিশ-বিশ শতকের অসহিষ্ণুতা আমরা কি এড়াতে পেরেছি?
পর্ব ৫: কলকাতা শহর পরিকল্পনাহীনভাবে বেড়ে উঠেছে, একথার কোনও বিশেষ ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই
পর্ব ৪: ঔপনিবেশিক নগর পরিকল্পনার বিরুদ্ধ মত প্রকাশ পেয়েছিল যখন প্লেগ ছড়াচ্ছিল কলকাতায়
পর্ব ৩: ঔপনিবেশিক কলকাতায় হোয়াইট টাউন-ব্ল্যাক টাউনের মধ্যে কোনও অলঙ্ঘনীয় সীমানা
পর্ব ২: ‘জল’ যেভাবে ‘জমি’ হল এ কলকাতায়
পর্ব ১: চেনা কলকাতাকে না পাল্টেই বদল সম্ভব, পথ দেখাতে পারে একটি বাতিল রিপোর্ট