রবীন্দ্রনাথ একসময় নিয়মিত লিখতেন ‘বালক’ পত্রে। ‘বালক’, ‘সখা’, ‘মুকুল’ এই তিন পত্রিকার তৈরি করা রাস্তা দিয়েই ‘সন্দেশ’-এর হয়ে ওঠা ও তার নিজস্বতা অর্জন। ব্রাহ্ম ভদ্রলোকরা বালক-বালিকাদের মন ও মগজ গড়ে তোলার জন্য তৎপর। বিদ্যালয়ের বাইরে তাদের পঠন-পাঠন ও বিনোদনের জগৎকে নিয়ন্ত্রণ করত এই পত্রিকাগুলি। সুকুমার জানেন কেবল নিয়ন্ত্রণ নয় প্রয়োজনে নিয়মকে প্রশ্ন করারও সাহস দেওয়া চাই। ব্যাকরণ সবসময় মানতে হবে কেন!
সুকুমার রায় যে অর্থে শিশু-কিশোরদের মনোরঞ্জন করতে পারতেন রবীন্দ্রনাথ কি তা পারতেন? এককথায় এর উত্তর, ‘না।’ দু’জনের ছেলেবেলার স্বভাবের মধ্যেই হয়তো এই উত্তরের কারণ নিহিত ছিল। রবি অন্তর্মুখী, বয়সে অনেকটা ছোট সুকুমার একেবারেই তা নন। অন্তর্মুখী রবি বড়বেলায় আর অন্তর্মুখী থাকেননি, নিজের ছেলেবেলা নিয়ে পরিণত বয়সে নানা কৌতুক করেছেন। ‘জীবনস্মৃতি’-তে একরকমভাবে, ‘ছেলেবেলা’ বইতে আরেক-রকমে। ‘ছেলেবেলা’-য় হাসির জগৎ উজ্জ্বল, ছবির মতো ঝকঝকে। রবীন্দ্রনাথের আবদুল মাঝির কথা শুনে সন্দেহ নেই ছোট পড়ুয়ারা খিলখিলিয়ে হেসে উঠবে। আবদুল মাঝি বলেছিল নেকড়ে বাঘকে দিয়ে সে ঝড়ের নদীতে ডিঙি টানিয়ে নিয়েছিল। মাঝি বলেছিল, ‘নদীতে বান এসেছে, বাহাদুরগঞ্জে ফিরতে হবে তো? ডিঙির সঙ্গে জুড়ে বাঘের বাচ্ছাকে দিয়ে গুণ টানিয়ে নিলেম অন্তত বিশ ক্রোশ রাস্তা। গোঁ গোঁ করতে থাকে, পেটে দিই দাঁড়ের খোঁচা, দশ-পনেরো ঘণ্টার রাস্তা দেড় ঘণ্টায় পৌছিয়ে দিলে। তার পরেকার কথা আর জিগ্গেস কোরো না বাবা, জবাব মিলবে না।’ এসব গল্পে যে তারপর ‘কী’ হল তার উত্তর মেলে না, সে-কথা রসিক পাঠকের জানা। তবে আবদুল মাঝির গল্পে যেন খানিক সুকুমারের সাহিত্যের স্বাদ পাওয়া যায়। বিশেষ করে যেখানে মাঝি বলে দশ-পনেরো ঘণ্টার রাস্তা দেড় ঘণ্টায় চলে যাওয়া গেল সেখানটা যেন ভিন্নার্থে সুকুমারের ‘আবোল তাবোল’-এর ‘খুড়োর কল’-এর মতো। কেবল পার্থক্য একটাই, নেকড়েকে মাঝি গুণ টানিয়ে নিয়েছে– সুকুমারের পদ্যে মাঝির বদলে সামনে ঝুলতে থাকে কলখানি। সেই অপ্রাপণীয় প্রাপ্তির লোভে মানুষটি ছোটে, ক্রমাগতই ছোটে। লোভের কী অসীম ক্ষমতা! পরিণত রবীন্দ্রনাথ যে ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়েছিলেন কিশোর রবীন্দ্রনাথ তার থেকে অন্যরকম– অন্তর্গত রোম্যান্টিক বিষাদের স্পর্শ কিশোরবেলায় জীবনে ও লেখায় একরকম করে কাজ করে গিয়েছিল।
আর বালক সুকুমার! কথায়-বার্তায়, নিত্যনতুন খেলা আবিষ্কারে তার তুলনা নেই। লীলা মজুমদারের লেখা থেকে জানা যাচ্ছে, সুকুমার রাগ বানানোর খেলা আবিষ্কার করেছিলেন। সে খেলার নিয়ম ছিল যার প্রতি যে জন্য রাগ হতে পারে তা মনে মনে তৈরি করা, খানিক অভিনেয় সে খেলা সম্ভবত। এতে রাগ প্রশমিত হত। সুকুমার তাঁর লেখাতেও এই প্রশমনের নানা উপায় তৈরি করতেন। তাঁর লেখার আপাত অসম্ভব, আসলে কোথাও তাঁর মনের রাগেরই প্রকাশ যেন– হচ্ছে কিন্তু একনজরে বোঝা যাচ্ছে না। হা-হা মজার হাসি দিয়ে খানিক ঢেকে দেওয়া হচ্ছে রাগের তাণ্ডব। সুকুমারের অকাল প্রয়াণের আগে তাঁর প্রতিভার প্রকাশ ‘সন্দেশ’-এর পাতায়– দীর্ঘ আট-নয় বছর ধরে। উপেন্দ্রকিশোরের সম্পাদনায় যখন ‘সন্দেশ’ প্রকাশিত হল সুকুমার তখন বিলেতে– রবীন্দ্রনাথও সেখানে। উপেন্দ্রকিশোরকে লেখা সুকুমারের চিঠি থেকে জানা যাচ্ছে , তিনি রবিবাবুকে ‘সন্দেশ’ পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
উপেন্দ্রকিশোর মারা গেলে সুকুমার ‘সন্দেশ’ পত্রের দায়িত্ব নিলেন যেন শত হাতে। রেখায়-লেখায় কতরকমভাবে যে তাঁর আত্মপ্রকাশ! ‘সন্দেশ’ পত্রে রবীন্দ্রনাথ থাকবেন না তা হয়! কীভাবে থাকবেন? সুকুমারের মতো খেয়াল-খোলা ভাষা আর আঁকার জগৎ তো রবীন্দ্রনাথের নয়। তবে রবীন্দ্রনাথের প্রতি সুকুমার, প্রশান্তচন্দ্রদের মতো তরুণ ব্রাহ্ম যুবাদের টান গভীর।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
রবীন্দ্রনাথ একসময় নিয়মিত লিখতেন ‘বালক’ পত্রে। ‘বালক’, ‘সখা’, ‘মুকুল’ এই তিন পত্রিকার তৈরি করা রাস্তা দিয়েই ‘সন্দেশ’-এর হয়ে ওঠা ও তার নিজস্বতা অর্জন। ব্রাহ্ম ভদ্রলোকরা বালক-বালিকাদের মন ও মগজ গড়ে তোলার জন্য তৎপর। বিদ্যালয়ের বাইরে তাদের পঠন-পাঠন ও বিনোদনের জগৎকে নিয়ন্ত্রণ করত এই পত্রিকাগুলি। সুকুমার জানেন কেবল নিয়ন্ত্রণ নয়, প্রয়োজনে নিয়মকে প্রশ্ন করারও সাহস দেওয়া চাই। ব্যাকরণ সবসময় মানতে হবে কেন!
উপেন্দ্রকিশোর মারা গেলে সুকুমার ‘সন্দেশ’ পত্রের দায়িত্ব নিলেন যেন শত হাতে। রেখায়-লেখায় কতরকমভাবে যে তাঁর আত্মপ্রকাশ! ‘সন্দেশ’ পত্রে রবীন্দ্রনাথ থাকবেন না তা হয়! কীভাবে থাকবেন? সুকুমারের মতো খেয়াল-খোলা ভাষা আর আঁকার জগৎ তো রবীন্দ্রনাথের নয়। তবে রবীন্দ্রনাথের প্রতি সুকুমার, প্রশান্তচন্দ্রদের মতো তরুণ ব্রাহ্ম যুবাদের টান গভীর। সমাজে তাঁরা রবীন্দ্রনাথকে প্রবলভাবে ফিরিয়ে আনতে চান। তাঁদের সেই চাওয়া অবশ্য সফল হয়নি। সুকুমার তো জানেন রবীন্দ্রনাথের গানে তিনি আশ্রয় পান। তাঁর মারণব্যাধির সময় রবীন্দ্রনাথের গাওয়া গান তাঁকে শান্ত করে। ব্যাধি যে তাঁকে বহন করতে হচ্ছে, এ ব্যাধির থেকে মুক্তি যে নেই সুকুমার তা-ও জানেন। তাই বলে ‘সন্দেশ’-এর কাজ থেমে থাকে না। সুকুমারের ‘সন্দেশ’-এর প্রথম ও শেষ পাতায় আত্মপ্রকাশ করেন রবীন্দ্রনাথ নানা সময়। প্রথম পাতা আর শেষ পাতা তো একরকম নয়। প্রথম পাতায় রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখায় কবিতা ছাপা হয়। সে কবিতার সুর গম্ভীর– গভীর তার অর্থ। ‘দিন রজনী আছেন তিনি আমাদের এই ঘরে,/ সকাল বেলায় তাঁরই হাসি আলোক ঢেলে পড়ে’– এ তো বিশ্বাসের স্তব। রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখা অলংকরণহীন ভাবে প্রকাশিত। ‘সন্দেশ’-এর শেষ পাতায় যখন রবীন্দ্রনাথের পদ্য ছাপা হয় তার সুর গম্ভীর নয়। সেখানে পদ্যের সঙ্গে যথাযথ সংগত করার জন্য থাকে মজার ছবি। কবিতার নাম ‘সময় হারা’ (বৈশাখ ১৩৩০)। সে কবিতার ছেলেটি চেয়েছে ঘণ্টা-মিনিট বাজা বন্ধ হয়ে যাক। তাল মিলিয়ে আঁকা হয়েছে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে ভেঙে পড়ছে এমন এক ঘড়ি। একটি বাচ্চা ছেলে মহানন্দে সেই ঘড়ি ভেঙে পড়ার দৃশ্য দেখে নাচছে। নাচবেই তো! সে ছবিতে মুখ গম্ভীর করে বসে আছেন ঘড়িপন্থী এক অভিভাবক। বালকটি বলছে, ‘সময় যদি ফুরোয় তবে ফুরোয় না ত খেলা’ গুরুগম্ভীর পুরুষ অভিভাবকেরা এতে সায় দিতেই পারেন না। এতেও দেননি।
এই যে রবীন্দ্রনাথ নানারকম– কখনও স্তবময় বিশ্বাসী, কখনও সময় হারা চপল– তাঁকে প্রাণ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছিলেন সুকুমার। সেই বোঝাপড়া ‘সন্দেশ’-এর পাতায় রবীন্দ্রনাথের লেখা সাজানোর সময় মনে রাখতেন তিনি। শুধু হাসি নয়, শুধু স্তব নয়– সব মিলিয়ে মিশিয়ে থাকা এই জগৎটিকে ‘আবোল তাবোল’-এর পাতায় একরকম করে ভরে দিয়ে ঘুমের ঘোরে ডুবে গেলেন সুকুমার। সেই ডুবে যাওয়ার আগে বাংলা ভাষার যে রচয়িতাকে প্রাণ ভরে বুঝতে চাইলেন তাঁর নাম রবীন্দ্রনাথ।
…………………ছাতিমতলা অন্যান্য পর্ব……………………..
ছাতিমতলা পর্ব ২৪: বিশ্বভারতীর ছাপাখানাকে বই প্রকাশের কারখানা শুধু নয়, রবীন্দ্রনাথ দেশগঠনের ক্ষেত্রেও কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন
ছাতিমতলা পর্ব ২৩: ধর্মবোধের স্বাধিকার অর্জনের কথা মনে করিয়ে দিয়েও রবীন্দ্রনাথ দেশের মানুষের সাম্প্রদায়িক মনকে মুক্ত করতে পারেননি
ছাতিমতলা পর্ব ২২: রামায়ণে রাম-রাবণের যুদ্ধ রবীন্দ্রনাথের কাছে ছিল গৌণ বিষয়
ছাতিমতলা পর্ব ২১: রবীন্দ্রনাথ পড়ুয়াদের সঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজতেন, চাঁদের আলোয় গান গাইতেন
ছাতিমতলা পর্ব ২০: সুভাষচন্দ্র বসুকে তীব্র তিরস্কার করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ!
ছাতিমতলা পর্ব ১৯: আবেগসর্বস্ব ধর্ম ও রাজনীতির বিরোধিতা করে অপ্রিয় হয়েছিলেন
ছাতিমতলা পর্ব ১৮: রবীন্দ্রনাথ কখনও গীতাকে যুদ্ধের প্রচারগ্রন্থ হিসেবে বিচার করেননি
ছাতিমতলা পর্ব ১৭: ক্রিকেটের রাজনীতি ও সমাজনীতি, দু’টি বিষয়েই তৎপর ছিলেন রবীন্দ্রনাথ
ছাতিমতলা পর্ব ১৬: রবীন্দ্রনাথ কি ক্রিয়েটিভ রাইটিং শেখানোর কিংবা কপি এডিটিং করার চাকরি পেতেন?
ছাতিমতলা পর্ব ১৫: কবি রবীন্দ্রনাথের ছেলে হয়ে কবিতা লেখা যায় না, বুঝেছিলেন রথীন্দ্রনাথ
ছাতিমতলা পর্ব ১৪: ছোট-বড় দুঃখ ও অপমান কীভাবে সামলাতেন রবীন্দ্রনাথ?
ছাতিমতলা পর্ব ১৩: পিতা রবীন্দ্রনাথ তাঁর কন্যা রেণুকার স্বাধীন মনের দাম দেননি
ছাতিমতলা পর্ব ১২: এদেশে ধর্ম যে চমৎকার অস্ত্রাগার, রবীন্দ্রনাথ তা অস্বীকার করেননি
ছাতিমতলা পর্ব ১১: কাদম্বরীকে বঙ্গজ লেখকরা মুখরোচক করে তুলেছেন বলেই মৃণালিনীকে বাঙালি জানতে চায়নি
ছাতিমতলা পর্ব ১০: পাশ্চাত্যের ‘ফ্যাসিবাদ’ এদেশেরই সমাজপ্রচলিত নিষেধনীতির প্রতিরূপ, বুঝেছিলেন রবীন্দ্রনাথ
ছাতিমতলা পর্ব ৯: দেশপ্রেম শেখানোর ভয়ংকর স্কুলের কথা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, এমন স্কুল এখনও কেউ কেউ গড়তে চান
ছাতিমতলা পর্ব ৮: অসমিয়া আর ওড়িয়া ভাষা বাংলা ভাষার আধিপত্য স্বীকার করে নিক, এই অনুচিত দাবি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথও
ছাতিমতলা পর্ব ৭: বাঙালি লেখকের পাল্লায় পড়ে রবীন্দ্রনাথ ভগবান কিংবা ভূত হচ্ছেন, রক্তমাংসের হয়ে উঠছেন না
ছাতিমতলা পর্ব ৬: যে ভূমিকায় দেখা পাওয়া যায় কঠোর রবীন্দ্রনাথের
ছাতিমতলা পর্ব ৫: চানঘরে রবীন্দ্রসংগীত গাইলেও আপত্তি ছিল না রবীন্দ্রনাথের
ছাতিমতলা পর্ব ৪: যে রবীন্দ্র-উপন্যাস ম্যারিটাল রেপের ইঙ্গিতবাহী
ছাতিমতলা পর্ব ৩: ‘রক্তকরবী’র চশমার দূরদৃষ্টি কিংবা সিসিটিভি
ছাতিমতলা পর্ব ২: ‘পলিটিকাল কারেক্টনেস’ বনাম ‘রবীন্দ্র-কৌতুক’
ছাতিমতলা পর্ব ১: ‘ডাকঘর’-এর অমলের মতো শেষশয্যা রবীন্দ্রনাথের কাঙ্ক্ষিত, কিন্তু পাননি